Thursday, May 1, 2014

অথ সারমেয় কথা

কৈফিয়ত
বিয়ে পরবর্তী দু মাসে লেখার বিশেষ সুযোগ পাইনি। নানাবিধ সাংসারিক কাজে ব্যস্ত ছিলাম। বাজার-হাট, ঘর পরিষ্কার, রান্নাবান্না, সে প্রায় শ্রমিকের মতই খাটাখাটনি! কারো সন্দেহ থাকলে আজকের দিনটার (১লা মে) গুরুত্ব ভেবে দেখুন (ছুটি পেয়েছি!)। যাই হোক, এই বাজারে একটা পুরনো একটা লেখাকে একটু সাজিয়ে-গুছিয়ে ব্লগে তুলছি। পরের লেখার জন্য খুব বেশী দেরি হবে না বলেই আশা করি। আইপিএল আর ভোটের বাজারে নাটকের অভাব হবে বলে মনে হয় না।

অথ সারমেয় কথা

সীতাপতিবাবু বিকেলবেলা নিজের পোষা কুকুরটাকে নিয়ে হাঁটতে বেরিয়েছিলেন। হঠাৎ দেখলেন উল্টোদিক থেকে তাঁর চিরশত্রু লক্ষ্মীকান্তবাবু আসছেন। সীতাপতি আর লক্ষ্মীকান্তর মধ্যে দীর্ঘদিনের ঝামেলা। এই আগের সপ্তাহেই পাড়ার চায়ের দোকানে মোহনবাগান-ইষ্টবেঙ্গল নিয়ে দুজনের মধ্যে একপ্রস্থ ঝামেলা হয়ে গেছে। হাতাহাতি না হলেও দুজনেই শেষ অবধি একে অপরকে দেখে নেবেন বলে শাসিয়ে আর একটা করে চায়ের গ্লাস ভেঙ্গে বাড়ী ফিরেছিলেন।
আজকে লক্ষ্মীকান্তবাবুকে দেখেই সীতাপতিবাবুর মাথা গরম হয়ে গেল। মুখ গোমড়া করে যেন দেখতেই পাননি এমন ভান করে হাঁটছিলেন এমন সময় লক্ষ্মীকান্তবাবু তাঁর সামনে এসে বললেন, “একটা গাধাকে নিয়ে ঘুরতে বেড়িয়েছ?”
সীতাপতিবাবু খেঁকিয়ে উঠে বললেন, “চোখের মাথা খেয়েছো? গাধা কোথায় দেখছ? এটা কুকুর!”
লক্ষ্মীকান্তবাবু গম্ভীর হয়ে বললেন, “আমি কুকুরটাকেই জিজ্ঞেস করছিলাম!”
হতভম্ব সীতাপতিবাবু কিছু বলে ওঠার আগেই “এই পথ যদি না শেষ হয়...” গুনগুন করতে করতে লক্ষ্মীকান্তবাবু টুক করে সেখান থেকে কেটে পড়লেন।
কুকুর নিয়ে লিখতে গিয়ে এই পুরনো বাজে গল্পটা দিয়ে শুরু করলাম। অবশ্য কুকুর ব্যাপারটাই বেশ পুরনো। সেই মহাভারতের শেষে মহাপ্রস্থানের পথে যুধিষ্ঠিরের সঙ্গী কুকুর রূপী ধর্ম থেকে শুরু করে টিনটিনের বলিয়ে-কইয়ে স্নোয়ি (বাংলা মতে কুট্টুস) বা হাওড়ার গৌরব পান্ডব গোয়েন্দাদের সঙ্গী পঞ্চু, যার কাজই ছিল উপন্যাসের শেষে ভৌ-ভৌ করে গল্পের সমাপ্তি ঘোষণা করা, সাহিত্যে কুকুরের প্রবেশ ঘটেছে অবাধে। সিনেমাতেও একই অবস্থা, সেই আদ্যিকালের বাংলা সিনেমা বাদশা থেকে শুরু করে হাল আমলের ১০১ ডলমেশিয়ান অবধি কুকুর নিয়ে সিনেমার অভাব নেই। তবে সবচেয়ে জাঁদরেল হল তামিল সিনেমার কুকুররা, গাড়ি চালানো থেকে বন্দুক চালানো সবই তাদের বাঁ হাতের বা বলা যায় বাঁ থাবার খেল! অবশ্য খোঁজ নিলে হয়তো জানা যাবে যে, এরা প্রত্যেকেই রজনীকান্তের পোষা কুকুর আর তাই এই সব কিছুই তাদের কাছে দুধ-বিস্কুট।
তবে ছোট্ট পিকিংইজ কুকুর থেকে শুরু করে বিরাট সেন্ট বার্নার্ড অবধি বুদ্ধিমান কুকুরের অভাব নেই। সেই যে ‘ক্যামোফ্লেজ’ গল্পে এক বুদ্ধিমান কুকুরের গল্প শুনিয়েছিলেন নারায়ণ গঙ্গোপাধ্যায় তাঁর অননুকরণীয় ভঙ্গিমায়। টেনিদার গল্পের সেই বিরাট গ্রে-হাউন্ড আরাকানের পাহাড়ে কাশীর ল্যাংড়া আমের গাছ থেকে আম খেতে চেয়েছিল। শেষ পর্যন্ত অবশ্য টেনিদা সেজে সে জাপানীদের হাতে প্রাণ দিয়ে স্বর্গে যায়। আর টেনিদা কুকুর সেজে সেই ফাঁকে পালিয়ে আসে!
বুদ্ধিমান কুকুরের আর একটা গল্প লিখে ফেলি এই ফাঁকে। কদিন আগে দেখলাম আমাদের পাড়ার স্বপনকাকু বাড়ীর বারান্দায় সামনে একটা দাবার বোর্ড আর উল্টোদিকে নিজের পোষা কুকুর গঙ্গারামকে নিয়ে বসে আছেন। আমি রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলাম, দেখে জিজ্ঞেস করলাম, “কী করছেন স্বপনকাকু?”
কাকু দাবার বোর্ড থেকে মুখ তুলে উত্তর দিলেন, “এই তো গঙ্গারামের সঙ্গে একটু দাবা খেলছি!”
আমি ঘাবড়ে গিয়ে বললাম, “গঙ্গারাম দাবা খেলে!! ওর তো তাহলে দারুণ বুদ্ধি!”
স্বপনকাকু মুখ বেঁকিয়ে বললেন, “কোথায় আর! এই তো এখনও অবধি পাঁচ হাত খেলেছি, ব্যাটা তাঁর মধ্যে তিন বারই হেরেছে!”
তবে পোষা কুকুর বুদ্ধিমান হোক বা না হোক তারা সব সময়ই তাদের মালিক বা মালকিনের আদরের ধন। আর কিছু কিছু মালিক তাঁদের আদরের চোটে একটু-আধটু বাড়াবাড়ি করে ফেলেন। আমার নিজের চেনা একটি পরিবারে দেখেছি, তাঁরা তাঁদের পোষা কুকুরকে সব সময় কোলে নিয়ে ঘুরে বেড়াচ্ছেন। জিজ্ঞেস করে জেনেছিলাম যে, কুকুরের যাতে পা ব্যথা না হয় তাঁর জন্যেই এই ব্যবস্থা!
তবে ঐ কুকুরটার জন্য আরো অপমানিত হয়েছিলাম অন্য একবার। একবার শীতকালে দুপুরের দিকে আমি এনাদের বাড়ী গেছিলাম। কিছু একটা নেমন্তন্ন ছিল। তো বসার ঘরের যে সোফায় আমি বসেছিলাম, সেই সোফাতে তাঁদের কুকুরটিও শুয়ে ছিল (না, এটাকে অপমান বলছি না), পাশের খোলা জানলা দিয়ে শীতকালের মিঠে রোদ আসছিল, ভালোই লাগছিল। হঠাৎ কুকুরের মালকিন রে রে করে তেড়ে এলেন, আমায় বললেন, “পর্দাটা ফেলে দিতে পারোনি?”
আমি না বুঝে বললাম, “কেন? আমার তো অসুবিধা হচ্ছে না।”
ভদ্রমহিলা আমাকে পাত্তা না দিয়ে বললেন, “আহা, আমার সোনার গায়ে রোদ লাগছে যে। বেচারার কষ্ট হবে। একটু খেয়াল রাখবে তো!” বলে গজগজ করতে করতে কুকুরটাকে তুলে নিয়ে বেডরুমে নিয়ে গেলেন। মনে হল ঘন্টা খানেক এসির সামনে বসিয়ে বেচারা কুকুরটাকে ঠাণ্ডা করবেন। আমি আর কি করি, দুঃখ দুঃখ মুখ করে বসে নাক চুলকোতে লাগলুম।
আমি কিন্তু আসলে কুকুর বেশ ভালোবাসি, বিশ্বাস করুন। এমনকি কুকুর দেখে ভয় পাওয়ার অভ্যেসও আমার নেই। নিজের পোষা কুকুর না থাকলেও অন্য কারো বাড়ীতে পোষ মানানো কুকুর দেখলেই তার মাথায় হাত বোলাতে ইচ্ছে করে।


(রোমিও এবং র‍্যাম্বো)

তবে কুকুর নিয়ে ভয় পাওয়ার গল্প শুনেছিলাম আমার বন্ধু সৌম্যজিতের কাছে। সৌম্য কুকুরদের খুবই ভয় পায়। তা কলেজে পড়ার সময় একবার ও আর ওর আরো কিছু বন্ধু একসঙ্গে বকখালি গেছিল। তা প্রথম দিন ঘোরাঘুরি, সমুদ্রস্নান এসব হওয়ার পর রাত্তিরে আড্ডা মারতে মারতে ঠিক হয় পরদিন ভোর রাতে উঠে সমুদ্রতীরে গিয়ে সূর্যোদয় দেখা হবে। যেমন ভাবা তেমন কাজ। পরদিন চারটে নাগাদ, রাতের অন্ধকার থাকতে থাকতেই চার বন্ধু বেরিয়ে পরে সমুদ্রতীরে যাওয়ার জন্য। চারদিক নিস্তব্ধ, জন-মনুষ্য নেই কোথাও এমন অবস্থায় ওরা হাঁটতে হাঁটতে যাচ্ছিল, এমন সময় একদল কুকুর, সংখ্যায় নাকি প্রায় গোটা কুড়ি ওদের যাত্রায় সঙ্গী হয়।
এরপরই শুরু হয় আসল মজা। অত ভোরে, অন্ধকারের মধ্যে এতগুলো কুকুর পরিবেষ্টিত হয়ে সূর্যোদয় দেখার পরিকল্পনাটা সৌম্যজিতের আর বিশেষ সুবিধার ঠেকছিল না। সৌম্য ওর বাকি বন্ধুদের বলে সূর্যোদয় দেখার প্ল্যান মুলতুবি রেখে হোটেলে ফিরে যাওয়া যাক। কিন্তু বাকি বন্ধুদের তো কুকুরে অত ভয় নেই, সুতরাং তারা সেই প্রস্তাবে প্রত্যাখান করে। শেষ পর্যন্ত সৌম্য ঠিক করেই ফেলে যে, হয় এস্‌পার নয় ওস্‌পার। বন্ধুদের বলে দেয় যে হয় কুকুরগুলো থাকবে নয় সৌম্য থাকবে এবং উল্টোদিকে ঘুরে হোটেলের দিকে রওয়ানা হয়। কিন্তু কয়েক মুহূর্ত পরেই নিজের ভুল বুঝতে পারে সৌম্য। ওর আর ওর বন্ধুদের পথ আলাদা হতেই কুকুরগুলো সেই শোলে সিনেমার মত “আধা ইধার, আধা উধার” ভাগ হয় গেল।  
এতক্ষণ ছিল চার জনের জন্য কুড়িটা কুকুর এখন দাঁড়ালো একদিকে তিন জনের জন্য দশটা কুকুর, অন্যদিকে ওর সৌম্যর সঙ্গে বাকি দশ জন! বেচারা সৌম্যর পক্ষে এরপর একা গোটাদশেক কুকুর পরিবেষ্টিত হয়ে হোটেল ফেরা সম্ভব ছিল না সুতরাং ব্যাজার মুখে গজগজ করতে করতে সৌম্য বাধ্য হয়ে বাকিদের সঙ্গে সমুদ্রের দিকে রওয়ানা হয়।
যাই হোক, কুকুর নিয়ে আমার পড়া একটা অম্লমধুর গল্পের কথাও এই ফাঁকে বলে ফেলি। সৈয়দ মুজতবা আলীর বিখ্যাত ছোটগল্প ‘পাদটীকা’। যে গল্পে কিশোর মুজতবার স্কুলের সংস্কৃতের পন্ডিতমশাই মুজতবাকে দিয়ে অংক কষে দেখিয়ে দিয়েছিলেন যে সেই বৃদ্ধ পন্ডিতমশায়ের পুরো সংসার চালানোর জন্য সে মাসিক বেতন পান তা ম্যাজিস্ট্রেট সাহেবের কুকুরের পেছনের খরচের এক তৃতীয়াংশ। কোন এক দুর্ঘটনায় ঐ কুকুরটির একটি পা বাদ গেছিল আর তাই ঐ পন্ডিতমশায়ের চোখে তাঁর পুরো পরিবার ম্যাজিস্ট্রেটের কুকুরের একটি পায়ের সমান! গল্পের শেষে নিস্তব্ধ ক্লাসরুমে দাঁড়িয়ে সৈয়দ লিখেছিলেন, “নিস্তব্ধতা হিরণ্ময়- Silence is golden যে মূর্খ বলেছে তাকে যেন মরার পূর্বে একবার একলা-একলি পাই।” গল্পটি পড়ে পাঠক হিসেবে আমাদেরও বোধ হয় সেটাই মনে হয়।


ভেবেছিলাম যে, মুজতবা আলীর গল্পটা দিয়ে লেখাটা শেষ করব তারপর ফেসবুকে একাধিকবার দেখা একটা গল্প মনে পড়ে গেল। সেটাও বলে ফেলি।
একদিন মাঝ রাত্তিরে চারদিক অন্ধকার, নির্জন, শুধু একটা ল্যাম্পপোস্টের আলো টিমটিম করে আসছে। একটা মেয়ে কুকুর ভয়ে ভয়ে আসছিল, হঠাৎ সামনে তাকিয়ে দেখল রাস্তার মোড়ে অনেকগুলো ছেলে কুকুর ঘোরাঘুরি করছে। মেয়ে কুকুরটা অতগুলো ছেলে কুকুর দেখে এগোতে ভয় পাচ্ছিল। তখনই একটা ছেলে কুকুর তার দিকে এগিয়ে এসে বলল, “ভয় পেও না। আমার কুকুর, মানুষ নই। আমরা তোমায় কিছু করব না!”
"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”