Saturday, December 1, 2018

লন্ডনে লণ্ডভণ্ড - ৭

~~সারাহর সঙ্গে কিছুক্ষণ~~

সারাহর সঙ্গে সারাদিন হলে ভালোই হত তাও যেটুকু সময় দেখা হয়েছিল সেটাই বা মন্দ কী! যাকগে, পরের কথা পরে পরে হবে। সকালে ব্রেকফাস্টের পর প্রথম গন্তব্য ছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ফুটবল ক্লাব, আরেক তীর্থক্ষেত্র! শ্রেয়সীর পরনে ইস্ট বেঙ্গলের জার্সি, আমার পরনে ইউনাইটেডের জার্সি, ব্যাগে মোহন বাগানের! হোটেল থেকে বেরিয়ে মিনিট দশেক হেঁটেই পৌঁছে গেলাম ক্লাবের সামনে। পথে চোখে পড়ল ট্র্যাফোর্ড পার্ক আর তার সামনের ভাস্কর্য্য। ক্লাবে পৌঁছে বুকিং স্লিপ দেখিয়ে একটা ট্যুর দলের সঙ্গে ভিড়ে গেলাম। যদিও সামান্য দেরী হয়েছিল। ট্রফি রুম থেকে শুরু করে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন স্ট্যান্ডে গিয়ে বসা হল। সেই প্রথম দেখলাম থিয়েটার অফ ড্রিমসকে। 

দেখলাম বিখ্যাত স্ট্র্যাটফোর্ড এন্ড, উল্টোদিকের স্যার ববি চার্লটন স্ট্যান্ড। তারপর একে একে যাওয়া হল মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে, প্রেস কনফারেন্স রুমে, খেলোয়াড়দের বেরিয়ে আসার টানেলে, এমনকি ডাগ আউটের সামনেও। শুধু সিজন শুরুর ঠিক আগেই গেছিলাম বলে খেলোয়াড়দের ড্রেসিং রুমে কিছু শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছিল, তাই ড্রেসিং রুমে এবার আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম গণশক্তির পাতায়। তার লিঙ্ক দিয়ে রাখলাম আর উদ্ধৃত করলাম শেষ অংশটা, কারণ বিদেশের বিভিন্ন মাঠে গিয়ে এটাই আমার বারবার মনে হয়েছে,
কিন্তু একটা প্রশ্ন মনে থেকেই গেল। আমাদের কলকাতার দুই বড় ক্লাব কবে এইভাবে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলবে নিজেদের? কবে দেশবিদেশের সমর্থকরা এসে এইভাবে ঘুরে দেখতে পারবেন নিজেদের প্রিয় ক্লাব? অনুভব করবেন ক্লাবের ইতিহাস, তার ঐতিহ্য! ঘরে নিয়ে যেতে পারবেন তাঁদের প্রিয় ক্লাবের ছবি দেওয়া টি-শার্ট বা অন্য কোন স্মৃতিচিহ্ন? ক্লাবের রেস্তোরায় বসে খাবেন ক্লাবের স্পেশাল ইলিশ ভাপা বা চিংড়ির মালাইকারি?
কর্মকর্তারা শুনছেন কি?”

ক্লাব থেকে বেরিয়ে তাড়াহুড়ো করেই ছুট লাগালাম ম্যানচেস্টারের ন্যাশানাল ফুটবল মিউজিয়ামের উদ্দেশ্যে। যাত্রার উপায় ট্রামে। ভেতরটা ট্রেনের মত হলেও ঠিক শহরের মধ্যে দিয়ে যায় বলে ট্রামে বসেই শহরের পালস্‌টা বেশ ভালো বোঝা যায়। এক নজরেই বেশ ভালো লেগে গেছে ম্যানচেস্টারকে। বিশেষ করে শহরের যেটাকে সিটি সেন্টার বলে সেটা অনেকটাই কলকাতার মত। প্রচুর লোকজন চোখে পড়ল। মিউজিয়ামটা কাছেই। অসাধারণ মিউজিয়াম। টিকিটের ব্যবস্থা নেই, কেউ চাইলে নিজেদের ইচ্ছে মত ডোনেশান দিতে পারেন। ভেতরে কী নেই। শুরুতেই চোখে পড়ল ফুটবল নিয়ে বিভিন্ন বই এবং কমিক্স। রোভার্সের রয় এবং বিলির বুট দুটোই ছিল সেখানে, সঙ্গে টিনটিন বা টাইগার পত্রিকায় ছাপা ফুটবল কমিক্স বা ১৯০৬ সালের মেয়েদের ফুটবল নিয়ে পোস্টকার্ড।
এরপর খেলার জিনিসে ঢুকে পড়লে তো মাথা ঘুরে যাবে। কী নেই সেখানে! ফুটবলের বিবর্তনের স্যাম্পেল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন ফুটবলে ক্লাবের খেলোয়াড়দের ছবি, ১৮৭২ সালের এফএ কাপের মেডেল, বিভিন্ন বিশ্বকাপের পোস্টার, পেলের জার্সি এবং পাসপোর্ট, বিভিন্ন ট্রফি তার মধ্যে জুলে রিমে কাপের রেপ্লিকাটাও আছে, ওই ১৯৬৬ সালেরটা। এমনকি ইএ স্পোর্টসের ফিফার বিবর্তনও বাদ পড়েনি। এবং তার সঙ্গে বিভিন্ন ইন্টার‍্যাক্টিভ অপশন। টিভি স্ক্রিন, যার সামনের বোর্ডে বিভিন্ন ক্লাব বা বিখ্যাত খেলোয়াড়ের নাম লেখা আছে, নিজের পছন্দের প্লেয়ার বা খেলায়াড়ের নামে হাত দিলেই স্ক্রিনে চালু হয়ে যাবে, সেই ক্লাবের ইতিহাস বা ঐ খেলোয়াড়কে নিয়ে দু-তিন মিনিটের ছোট্ট ক্যাপসুল। বাচ্চাদের জন্য নানারকম গেমস। এমনকি ঐ সুযোগে ভার্চুয়াল গোলকিপারের সামনে পেনাল্টি মারার সুযোগও পেয়েছিলাম।
সব মিলিয়ে অসাধারণ, সবার শেষে স্যুভেনিরের দোকানটাও অসাধারণ, ছবি, বই, চাবির রিং, ম্যাগনেট থেকে শুরু করে ছোট ছোট বিশ্বকাপ বা এফএ কাপের রেপ্লিকা, কী নেই। তবে ঐ, সব জিনিসেরই গলাকাটা দাম বলে সাধ আর সাধ্যের মধ্যে লড়াই চলতেই থাকে।
ফুটবল মিউজিয়াম থেকে বেরিয়েই আবার ছুট লাগালাম ট্রাম ধরতে। আবার ফিরতে হবে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে। তবে এবার ফুটবল মাঠের এক কিলোমিটার পাশের ক্রিকেট মাঠে। সেখানে তখন কিয়া সুপার লিগের সারে স্টারস আর ল্যাঙ্কাশায়ার ঠান্ডারদের মধ্যে টি২০ ম্যাচ চলছে। সেখানে খেলছে সারাহ টেলর, ন্যাট সিভার, মেরিজুয়ান কাপ আর ডেন ভ্যান নিকার্ক সারের হয়ে। আর ঠান্ডারদের দলে আছে ঘরের মেয়ে হরমনপ্রিত, এমি জোনস্‌, নিক বল্টনরা। যাইহোক খেলাটা যদিও একপেশেই হল। সহজেই জিতল সারাহর দল। ওর ব্যাটিং দেখতে না পেলেও দেখার সুযোগ হল চোখ ধাঁধানো কিপিং। এখানে বলে রাখি, সারাহ টেলর আমার সবচেয়ে প্রিয় মহিলা ক্রিকেটার! মানে সবচেয়ে প্রিয়দের মধ্যে একজন-ট্যাকজন নয়। সবচেয়ে প্রিয় মানে সবচেয়ে প্রিয়। ওদিকে দাদা, এদিকে সারাহ!

খেলা শেষ হয়ে গেল বেশ তাড়াতাড়িই। টিকিট কাটার সময় আমাদের বলা হয়েছিল যে পুরো মাঠের টিকিটই দশ পাউন্ড, যেখানে ইচ্ছে। আমি বুদ্ধি লাগিয়ে ক্লাব হাউসের পাশের ব্লকের টিকিট নিয়েছিলাম। কারণ ইডেনে প্লেয়ারদের ডাগ আউটটা ওখানেই হয়ে। মাঠে ঢুকে দেখলাম, এখানে ডাগ আউট ঠিক সোজাসুজি উল্টোদিকে। কী আর করি, ক্যামেরার জুম দিয়ে হরমনদের দেখলাম। খেলা শেষ হওয়ার পর শ্রেয়সীকে বললাম, “চল দেখে আসি কতটা যেতে দেয়!”
ও হরি, গ্যালারীর নিচ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দেখি, সেরকম কিছু সিকিউরিটি নেই, দিব্যি মাঠটাকে ঘিরে গোল হয়ে ঘোরা যায়। আমরা টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে উল্টোদিকে চলে এলাম। বাইরে থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম যে খেলোয়াড়রা দর্শকদের সঙ্গে ছবি তুলছে, সই দিচ্ছে। আমরাও আবার গ্যালারিতে ঢুকে একদম সামনে গিয়ে পাকড়াও করলাম হরমনপ্রিতকে, ইন্ডিয়া থেকে এসেছি ইত্যাদি বলে-টলে ওর সঙ্গে ছবিও তোলা হল। অ্যালেক্স হার্টলিরও অটোগ্রাফ নেওয়া হল। কিন্তু তারপরেই আমরা ছুটলাম অন্যদিকে, যেখানে সারের খেলোয়াড়রা ছবি তুলছে। সারাহ চলে না যায়। লোকজনকে কাটিয়ে একটু সামনে যেতেই দেখতে পেলাম ভদ্রমহিলাকে, একজন বয়স্ক ভারতীয় লোকের সঙ্গে কথা বলছিল। সুযোগ বুঝে, “হাই আই অ্যাম আ বিগ ফ্যান” বলে কথা শুরু করলাম। তারপর টুকটাক কথা হল। এমনকি মেয়েদের আইপিএল চালু হলে কেকেআরে খেলার জন্য অনুরোধও করে ফেললাম। সঙ্গে সেলফি। সব মিলিয়ে দারুণ ফ্যানবয় মোমেন্ট। শ্রেয়সী একটু ঘেঁটেই গেছিল। এক তো ওকে বাদ দিয়ে চলে গেছি, তারপর আবার ওর সঙ্গে ছবিটা পছন্দ হয়েনি।
একে ছবি নিয়ে মুড অফ, তার সঙ্গে ঠাণ্ডা লাগছে, সব মিলিয়ে গোমড়ামুখো শ্রেয়সীর মুড ভালো করতে আমি ওকে নিয়ে ঢুকলাম ক্লাবের ক্রিকেট শপে। সেখান থেকে কেনা হল ইংল্যান্ড উইমেন ওয়ান্ ডে দলের রেপ্লিকা সোয়েটার। সেটা পড়ে একটু ধাতস্থ হল সে। তারপর দোকান থেকে বেরিয়ে এসে আরেক চমক। দেখলাম গ্যালারি আর দোকানের মধ্যের খালি জায়গাটায় অনেক অনেক ফ্যানের সঙ্গে খেলোয়াড়রাও দাঁড়িয়ে আছে, ঘুরে বেরাচ্ছে, ছবি তুলছে। সেখানে গিয়ে শ্রেয়সী আর একপ্রস্থ হরমনের সঙ্গে কথা বলে এল এবং তারপর খুঁজে বের করল সারাহকে! গিয়ে পাতি বলল, আগের ছবিটা পছন্দ হয়নি, আরো ছবি তুলতে চায়, তার সঙ্গে আবদার ওই নতুন সোয়েটারে সই করে দিতে হবে। এর পরের কথোপকথন,
-      You want me to sign on that sweater?
-      Yes.
-      You are crazy.
-      I know!
-      Oops... Ready? Where to sign?
-      Wherever you want. I am not going to wash it.
-      Ya ya… Dare you wash it!
এই পুরো ব্যাপারটারই ছবি তুলে রাখা হয়েছিল, যেটার কোলাজটা হয়তো কোন একদিন প্রিন্ট হয়ে আমাদের বসার ঘরে জায়গা নেবে। আপাতত এখানে দিয়ে রাখলাম। কিন্তু এখানেই শেষ নয়!

এইসব উত্তেজনায় ভুলেই গেছিলাম যে, ছেলেদের খেলাটা শুরু হওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমাদের রাতের বাস একটায়। সুতরাং ওটা দেখতেও ঢুকে পড়লাম। আমাদের পুরনো গ্যালারিতে না ফিয়ে গিয়ে যেখানে সারাহদের সঙ্গে সঙ্গে দেখা সেখানেই ঢুকে দুটো সিট জোগাড় করে বসে পড়লাম। ল্যাঙ্কাশায়ার লাইটনিং বনাম ডারহাম জেটসের খেলা। ডারহামের হয়ে পল কলিংউড ওপেন করেছিল। ভদ্রলোক এতদিন খেলছেন সেটাই খেয়াল ছিল না। যাই হোক, তিন-চার ওভার খেলা হয়েছে। হঠাৎ দেখি দুই ভদ্রমহিলা সিঁড়ি দিয়ে উঠে গ্যালারিতে এসে এদিক ওদিক সিট খুঁজছে। একজন ন্যাট সিভার, অন্যজন... সারাহ টেলর! শ্রেয়সীকে বললাম, “ওই দ্যাখ সারাহ!” যদিও আমাদের পাশে খালি সিট ছিল না। সারাহর সঙ্গে চোখাচুখিতে হওয়ায় ভদ্রমহিলা আবার একটা “তোমরা এখানেও” টাইপ হাসি দিয়ে একবার চোখ মেরে নিচের দিকে সিট খুঁজতে চলে গেলেন। আমার বিশ্বাস, আমাদের পাশে আর দুটো সিট ফাঁকা থাকলে আমাদের পাশে এসেই বসতেন!
এত কিছুর পর আর ম্যাচে মন বসানো গেল না। আর ঠাণ্ডাও লাগছিল খুব। আমরা ফিরে গেলাম হোটেলে। সেখান থেকে ব্যাগ নিয়ে দশটা নাগাদ রওয়ানা দিলাম বাস স্টেশানের দিকে। বাইরে তখন টেম্পারেচার দশ-বারোর কাছে এবং আমরা দুজনেই ওজন কমাতে আমাদের জ্যাকেটগুলো লন্ডনে রেখে এসেছিলাম। আসলে লন্ডনের ঐ গরমের পর এখানে এত ঠাণ্ডা হবে ভাবতে পারিনি! যাইহোক, পরদিন সকালে পৌঁছে যাব নতুন দেশ স্কটল্যান্ডে। সেখানকার অ্যাডভেঞ্চারের গল্প পরের পর্বে!

আগের পর্বের লিঙ্ক -


Thursday, November 1, 2018

লন্ডনে লণ্ডভণ্ড - ৬

~~ তীর্থস্থান ~~

সব ধর্মের মানুষই এক এক সময়ে তীর্থ করতে বিভিন্ন চেনা-অচেনা জায়গায় পৌঁছে যান। আমার আর শ্রেয়সীর ধর্ম হল ক্রিকেট। সুতরাং লর্ডস আর ওভালের মত ক্রিকেটীয় তীর্থক্ষেত্র দেখে নেওয়ার পর সময় হল একটু দূরের এক তীর্থস্থানে যাওয়ার। এবং এটার কথা দেশে থাকতে শ্রেয়সীই মনে করিয়েছিল!
সুতরাং দিন তিনেক লন্ডনে কাটিয়ে পরের দিন আমরা বেরিয়ে পড়লাম আমাদের পরবর্তী গন্তব্য টনটনের উদ্দেশ্যে। ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশান থেকেই ঠিক সময় মত বাস ছেড়ে ঘন্টা চারেকের মধ্যে দিল টনটন। সামারসেট কাউন্টির ভেতরে এই টনটনে আসার কারণ শুধু ক্রিকেট মাঠটা একবার দেখা। কেন টনটনের ক্রিকেট মাঠ আমাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তীর্থস্থান সেটা বোঝার জন্য নিচের লিংকটা রইল। http://www.espncricinfo.com/series/8039/scorecard/65213/india-vs-sri-lanka-21st-match-icc-world-cup-1999 এছাড়াও সামারসেটের হয়ে ঐ মাঠে ভিভ রিচার্ডস এবং ইয়ান বথামের কিছু স্মরনীয় পারফর্মেন্স আছে। গাভাস্কারও একটা মরশুম খেলেছিলেন সামারসেটের হয়ে।
বাসস্ট্যান্ড থেকে মাঠটা কাছেই। সুতরাং গুগল ম্যাপের ভরসায় হাঁটা লাগালাম টন নদীর পাশের পার্কের মধ্যে দিয়ে। কাঁধে রুকস্যাক, পাশে শ্রেয়সী, টনটন আসার প্ল্যানটা যার মস্তিষ্কপ্রসুত। অন্য স্যুটকেসটা পাবলাভেরই নিচের বেসমেন্টে রেখে এসেছিলাম। পার্কের মধ্যে দিয়ে হেঁটে এসে একটা বড় মোড় পেরিয়েই প্রথমে পড়ল মাঠের ধারের বিখ্যাত গির্জাটা। সেটাকে বাঁয়ে রেখে আর ২-৩ মিনিট হাঁটতেই এসে পড়লাম সামারসেট ক্রিকেট ক্লাবের ক্যুপার আসোসিয়েটস কাউন্টি গ্রাউন্ডের মেন গেটের সামনে। চারদিকে বিশেষ লোকজন নেই। কয়েকটা গাড়ী পার্ক করা ছিল। আমি আর শ্রেয়সী একটু পাশ দিয়ে হেঁটে মাঠের নামার জায়গা পেয়ে গেলাম। মাঠের ভেতরে দুজন গ্রাউন্ডসম্যান পিচ দেখভাল করছিলেন। আমাদের মাঠে নামতে দেখেও তাঁরা কিছু বলেননি। আমিই ভদ্রতা করে কাছের জনকে জিজ্ঞেস করলাম যে পিচের কাছে যাওয়া যাবে কিনা, তাতে বলল, "please stay off the pitch" সুতরাং আমরা ঐ মাঠের ওখানেই ছবি তোলা শুরু করলাম। মাঠ এবং মাঠের পাশের গির্জাটারই বেশী ছবি তোলা হল, তার সঙ্গে আমাদের ছবিও। দুজনেই আবার ঐ ৯৯ সালের দুই নায়কের এক-একজনের ছবি দেওয়া টিশার্ট পড়ে এসেছিলাম। টনটনের মাঠে দাঁড়িয়ে তোলা সেই ছবিগুলো পরে একজনকে দেখানোরও সুযোগ পেয়েছিলাম। আশা করি ভবিষ্যতে অন্যজনকেও দেখানোর সুযোগ পাব।
এইভাবে মিনিট দশেক ছবি-টবি তুলে মাঠের বাইরে বেরিয়ে খুঁজতে গেলাম মাঠের লাগোয়া ক্রিকেট মিউজিয়ামটা। কিন্তু সোমবার বলে সেটা বন্ধ। তার বদলে লাগোয়া ছোট্ট দোকানটায় ঘুরে টুকটাক জিনিসপত্তর দেখছি, দোকানের ভদ্রলোক শ্রেয়সীর টিশার্ট থেকে রাহুল দ্রাভিডকে বুঝতে পেরে জানালেন সম্প্রতি নাকি রাহুল ভারতের আন্ডার-১৯ টিম নিয়ে সামারসেট ঘুরে গেছে। তখন নাকি এই দোকান থেকে নিজের ছেলেদের জন্য গ্লাভস ইত্যাদি কিনেও নিয়ে গেছে। 
মাঠ থেকে বেরিয়ে ফেরার পথে পড়ল 'রিং অফ বেলস' রেস্তোরা। সেখানে টুক করে ব্রিটিশ স্টাইলের স্টেক, বার্গার এবং বিয়ার দিয়ে লাঞ্চ করে আমরা আবার হাঁটা লাগালাম বাসস্ট্যান্ডের দিকে। আমাদের পরবর্তী গন্তব্য ম্যানচেস্টার। কিন্তু বাসে টনটন থেকে ম্যানচেস্টার যাওয়াটা সহজ নয়। তাই আমরা যে বাসে টিকিট কেটেছিলাম সেটা যাচ্ছিল প্রথমে টনটন থেকে ব্রিস্টল, তারপর ব্রিস্টল থেকে বার্মিংহাম, সবশেষে বার্মিংহাম থেকে ম্যানচেস্টার।
ব্রিস্টল আর বার্মিংহামে মাত্র ঘন্টা খানেক ব্রেক ছিল বলে কোথাও যাওয়ার সুযোগ ছিল না। ব্রিস্টলে রাজা রামমোহন রায়ের সমাধিটা দেখার খুব ইচ্ছে ছিল কিন্তু সেটা আর হল না। তার বদলে বাস স্ট্যান্ডের বাইরে কিছুটা ঘুরে এসেছিলাম। বার্মিংহামে সেই চেষ্টাও করিনি। যাই হোক, এই ধরণের ঘোরার ক্ষেত্রে মাঝেমধ্যেই গণ্ডগোল হওয়ার চান্স থাকে। আমাদেরও সেটাই হল বার্মিংহাম থেকে ম্যানচেস্টার যাওয়ার রাস্তায়। হাইওয়েতে কিছু একটা মেরামতি চলছে বলে প্রচণ্ড জ্যাম। সেটা বাসে অ্যানাউন্স করে আমাদের জানিয়েও দেওয়া হল এবং বাস চলল শামুকের গতিতে। শেষ অবধি রাত নটার বদলে আমরা ম্যানচেস্টারের বাসস্টেশানে গিয়ে নামলাম প্রায় রাত এগারোটার সময়।
আর ম্যানচস্টারে যেহেতু ক্লাবে যাওয়াটাই উদ্দেশ্য ছিল তাই হোটেলটা বুক করা হয়েছিল বাসস্ট্যান্ড থেকে বেশ খানিকটা দূরে ক্লাবের কাছে।  উবেরও পাওয়া গেল না। এখানে আমাদের বাঁচিয়ে দিল সিটিম্যাপার। প্রথমে দেখে নিলাম কোথা থেকে বাস পাচ্ছি হোটেলের জন্য। পিকাডেলি গার্ডেন্সের বাসের ড্রাইভার জানালো যে কীসব কাজ চলছে বলে বাস পুরোটা যাবে না, শেষে প্রায় আধ ঘন্টা হাঁটতে হবে। সারাদিন ঘুরে তখন শরীর আর চলছে না। কপালজোরে সিটিম্যাপার দেখিয়ে দিল যে মাঝের একটা স্টপে নামলে একটা অন্য রাস্তা দিয়ে পনেরো মিনিট হাঁটলেই পৌঁছে যাবো। সুতরাং সেটাই করা হল। যদিও সেটুকু হাঁটতেও শ্রেয়সী ঝামেলা করছিল। অত রাত্তিরে টেম্পারেচারও কমে গেছিল অনেকটা।
 যাইহোক রাস্তাতেই একটা সুপার মার্কেট থেকে প্যাকড ইন্ডিয়ান স্টাইল চিকেন কারি আর রাইস কিনে নিলাম। ওটা না পেলে রাত্তিরে বিস্কুট খেয়েই কাটাতে হত। হোটেলে ঢুকে চটপট এন্ট্রি করে ঘরে চলে গেলাম। শুয়েও পড়লাম তাড়াতাড়ি। 

Saturday, October 27, 2018

লন্ডনে লণ্ডভণ্ড - ৫


~~ইতিহাসের বুকে~~

তৃতীয়দিন আমাদের প্ল্যান ছিল সারাদিনের স্টোনহেঞ্জ এবং বাথ ট্যুর স্টোনহেঞ্জ সম্বন্ধে মোটামুটি সবাই জানেন প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে ঐ অঞ্চলে জনবসতি ছিল এবং সেটার চিহ্ন হিসেবেই সেখানে বেশ কিছু পাথরের স্তম্ভ আজও দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলোউচ্চতা প্রায় ১৩ ফুট এবং এক একটার ওজন প্রায় ২৫ টন। এখনও অবধি ঐতিহাসিকরা ঠিক ধরে উঠতে পারেননি যে ঐ জনবসতিতে এই পাথরগুলোর ভূমিকা কী ছিল। তবে অনেকেই মনে করেন ওটা ছিল সে সময়কার অধিবাসীদের উপাসনাস্থান।
বাথ শহরটা অতটা পুরনো না হলেও এই শহরে যখন রোমানরা এসে বিভিন্ন স্নানাগার তৈরি করেন সেই সময়টা হল মোটামুটি ৬০-১০০ খ্রীষ্টাব্দ। সারাদিনও ঘোরা যায় তবে মোটামুটি প্রধান জায়গাগুলো দেখার জন্য কয়েক ঘন্টাই যথেষ্ট।
আমরা কলকাতায় বসেই অনলাইন অ্যান্ডারসন ট্যুরসের (https://andersontours.co.uk/index.php) সাইটে গিয়ে আমাদের দুজনের ট্যুর বুক করে ফেলেছিলাম। এক একজনের ৬৯ পাউন্ড। সেই সময়েই আমাদের পছন্দ মত ভিক্টোরিয়া স্টেশানের কাছের পিক আপ পয়েন্ট বেছে নিয়েছিলাম। 

সকাল সাতটায় বাস আসার কথা ছিল। আমরা মিনিট দশেক আগে গিয়ে দাঁড়িয়েছি বাসস্ট্যান্ডে, আর দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বাস এসে হাজির। আমরা টপাটপ নাম বলে আর টিকিটের প্রিন্ট আউট দেখিয়ে উঠে পড়লাম। ঠিক সাতটাতেই বাস ছাড়ল পরের পিকআপ পয়েন্টের জন্য। লন্ডন থেকে পৌঁছতে মোটামুটি ঘন্টা তিনেক লেগেছিল। যদিও মাঝে একটা ব্রেক ছিল। বাসে তেমন কিছু হয়নি, আমাদের গাইড দিদিমণি প্রত্যেককে একটা ব্রোসিয়ার দিয়েছিলেন যাতে স্টোনহেঞ্জের কোথায় কী আছে সেটার একটা আইডিয়া দেওয়া ছিল। দিদিমণি নিজে মাঝে মধ্যে কোথা দিয়ে যাচ্ছি বা কতক্ষণ বাকি সেইসব বলছিলেন কিন্তু গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে যাওয়ার সময় যেরকম আমাদের গাইড অনর্গল বকে গেছিল ইনি অত কথা বলার দিকে যাননি। শেষের দিকে গিয়ে দেখি দুদিকেই পুরো সবুজ মাঠ। তা শেষ অবধি বাস এক জায়গায় গিয়ে থামল। সেখানে স্টোনহেঞ্জের টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না।
দিদিমণির কথা শুনে বুঝলাম, এরপর দিদিমণি আমাদের সবার টিকিট আর অডিও গাইড নিয়ে আসবেন। তারপর সেই টিকিট দেখিয়ে আরো একটা বাসে করে দুই কিলোমিটার মত গেলে তবে দেখা যাবে স্টোনহেঞ্জের পাথরগুলো। হেঁটে যাওয়ারও সুযোগ ছিল কিন্তু ওই চড়া রোদে আর হাঁটতে ইচ্ছে করল না। বরং মিনিট পনেরো লাইন দিয়ে তিন নম্বর বাসে চড়ে চলে এলাম স্টোনহেঞ্জের সামনে। শেষে ২০০-৩০০ মিটার হাঁটা। বাস থেকে নেমে পদব্রজে চললাম স্টোনহেঞ্জের দিকে।
যথারীতি দেশ বিদেশের বিভিন্ন লোক উপস্থিত। পাথরগুলোকে চারদিকে কিছুটা জায়গা ঘিরে রাখা হয়েছে কারণ দর্শকরা স্টোনহেঞ্জে চড়ে ছবি তুলতে শুরু করলে সেটা পাথরগুলোর স্বাস্থ্যের জন্য ঠিক সুবিধার হবে না। ঘিরে রাখা বলতে ঐ ফুট খানেক উঁচু লোহার রডে লোহারি শিকল মত দেওয়া। সেটা টপকানো কোন বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু কেউই সেগুলো টপকে স্টোনহেঞ্জের দিকে ছুটে যাচ্ছে না, বা পুলিশ ধরলে “একটু গেছি তো কী হয়েছে!” জাতীয় এঁড়ে তর্ক করছে না (অক্টোবারে হ্যাপি ভ্যালি চা বাগানে গিয়ে এটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল) দেখে বেশ হতাশ হলাম।
পাথরগুলো দেখে অবশ্য ব্যাপারটার প্রাচীনত্বর দিকটা ভেবে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছিল। আর পাথরগুলোর অবস্থান দেখেও পুজো করার জায়গাই মনে হল। কিন্তু ঐ ধূধূ মাঠের মধ্যে ঐ গোদা পাথরগুলো কী করে নিয়ে এসেছিল সেটা সত্যিই ভাবার বিষয়! গ্রহান্তর ইত্যাদি সম্ভাবনাগুলো উড়িয়ে দেওয়া যায় না!
স্টোনহেঞ্জের পর আমাদের গন্তব্য ছিল রোমান শহর বাথ। সেটাও ঐ ঘন্টা খানেকের রাস্তা সবুজ ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে। বাথের সিটি সেন্টারে ‘দ্য হান্টসম্যান’ রেস্তোরার সামনে আমাদের বাস নামিয়ে দিল। সেখানে আবার ঘন্টা দুয়েক ফ্রি টাইম। বাথের কিছু কিছু বাড়ির স্থাপত্য দেখার মত। রোমান বাথের ভেতরের কাজ, বিভিন্ন মূর্তি আর মিউজিয়ামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক অডিও ভিশুয়াল প্রেসেন্টেশান। পুরনো স্নানের জায়গাকে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রোজেক্টারের সাহায্যে কিছু অভিনেতাকে ব্যবহার করে সেই সময়ের ছবি ফুটিয়ে তুলছে দর্শকদের জন্য। এই ব্যাপারটা সত্যিই ভালো লেগেছে। আরো কয়েক জায়গায় এগুলো দেখেছিলাম, সেগুলো যথাস্থানে বলব।
বাথ শহরের একটা বড় আকর্ষণ হল স্যালি লুনের বান বা মিষ্টি পাঁউরুটি। স্যালি লুনের ইটিং হাউসের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৬৮০ সালে! ব্যাপারটা বুঝছেন? ইংল্যান্ডের রাজা তখন দ্বিতীয় চার্লস!  ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জাহাজ তখন সমুদ্রে ঘুরে ঘুরে জলদস্যু শিকার করে বেরাচ্ছে! জব চার্নকের জাহাজ সুতানুটির ঘাটে ভিড়তে তখনো দশ বছর বাকি!
বাড়িটার গায়ে আবার লেখা সেটা বাথের প্রাচীনতম বাড়ি। এই সেদিনই মানে ১৪৮২ সালে তৈরি। যাইহোক আমাদের শেষ আধ ঘন্টা স্যালি লুনের চমৎকার বান আর কফি খেয়েই কাটল। দোকানটা প্রাচীন হতে পারে, বানগুলো কিন্তু একদম টাটকা ছিল!

Saturday, October 6, 2018

লন্ডনে লণ্ডভণ্ড - ৪


~~ হঠাৎ রাণীর বাড়ি ~~

দিনের শুরুতেই একটু ঝামেলা হয়ে গেল। যাওয়ার কথা ছিল লন্ডনের দক্ষিণ দিকে ঐতিহাসিক কেন্সিংটন ওভাল মাঠে। সেইমত সিটিম্যাপার দেখে বুঝলাম যে, বাসে করে একটা বিশেষ স্টপ অবধি গিয়ে তারপর কিছুটা হাঁটতে হবে। সেইমত বাসেও উঠেছি তারপর ট্র্যাভেল কার্ড টাচ করাতে গিয়ে দেখি আমার কার্ড চললেও শ্রেয়সীর কার্ডে পয়সা নেই। তখন বোঝা গেল যে, আগেরদিন শেষবার মেট্রো থেকে বেরোবার সময় ঠিক করে সোয়াইপ না করায় কার্ডের পুরো টাকাটাই চলে গেছে। ড্রাইভারকে পয়সা দিতে গেলাম, সে গম্ভীর হয়ে না বলে বাস চালিয়ে দিল। আমরা আর কী করি বোকার মত পেছনে গিয়ে বসলাম। তার মধ্যে আমার চোখে পড়ল যে, বিনা পয়সায় যাত্রা করে ধরা পড়লে তার জরিমানা মাত্র ৮০ পাউন্ড! সেইসব দেখে শ্রেয়সীর দোষারোপ শুনতে শুনতে হঠাৎ বুঝতে পারলাম আমরা আমাদের গন্তব্য স্টপ ছাড়িয়ে চলে গেছি। টুক করে পরের স্টপে নেমে মুশকিলে পড়লাম। চারদিকে কোথাও ঐ ট্রাভেল কার্ড টপ-আপ করার কিছু ছিল না। সুতরাং ম্যাপ দেখে হাঁটা শুরু হল। এইভাবে প্রায় আধ ঘন্টা হেঁটে, কখোন ভুল দিকে গিয়ে, টেমসের ওপরে ব্রিজ টপকে যতক্ষণে হবস গেট দিয়ে ঢুকে রিসেপশানে পৌঁছলাম তার পনেরো মিনিট আগেই ট্যুর শুরু হয়ে গেছে।
যাই হোক, রিসেপশানের লোকটি ভালোই ছিলেন। তিনি নিজেই আমাদের নিয়ে গেলেন ট্যুরগ্রুপের কাছে। তাঁদের ততক্ষণে ওভালের লাইব্রেরি দেখা হয়ে গেছে। আমরা গিয়ে তাঁদের দলে ভিড়ে গেলাম। রিসেপশানের ভদ্রলোক বলে রাখলেন যে, পুরো ট্যুর হয়ে যাওয়ার পর আমাদের ইচ্ছে থাকলে উনি আমাদের লাইব্রেরিটা দেখিয়ে দেবেন।
অতঃপর, ওভালের স্টেডিয়ামের বিভিন্ন আনাচেকানাচে ঘোরা হল। ঐতিহাসিক ব্র্যাডম্যান গেট, ১৫০ বছর উপলক্ষে বিশেষ ঘড়ী, মাঠের পাশের সেই গ্যাসহোল্ডার দেখলাম সবই। তার সঙ্গে বিভিন্ন ঐতিহাসিক ঘটনার গল্প, সব মিলিয়ে লর্ডস ট্যুরের চেয়ে ওভাল ট্যুর বেশী ভালো লেগেছিল আমাদের। আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়ে বিবিসি এবং স্কাইয়ের রেকর্ডিং বক্সে। সেখানে যে চেয়ারে বসে ম্যাচের শুরুতে বা ব্রেকের সময় আলোচনা করেন নাসের হুসেন বা ডেভিড গাওয়াররা সে চেয়ারে বসার সুযোগও জুটে গেছিল।  অ্যাওয়ে ড্রেসিংরুমের একটা মজার জিনিস হল দেওয়ালের গায়ে বিভিন্ন দেশের খেলোয়াড়দের সাক্ষর। সেখানে খুঁজে খুঁজে রাহুল, কোহলি, পুজারাদের খুঁজে পাওয়া গেল।

ঐ রিসেপশানের ভদ্রলোকও আমাদের সঙ্গেই ঘুরছিলেন। ট্যুর শেষে তাঁকে মনে করিয়ে দিলাম আমাদের লাইব্রেরি ট্যুরের কথা। ভদ্রলোক মিনিট দশেক টাইম চেয়ে নিলেন। কিছুই না, ওভালের স্যুভেনির স্টোরটা খুলেছেন। যদি কেউ কিছু কেনে। সেখানে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল।
আমি আর শ্রেয়সী দোকানের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আরো দু-একজন কেনাকাটা করছে। এমন সময় একটি লোক এসে হাজির। তিনি আমাদের ট্যুরগ্রুপে ছিলেন না। বাইরে থেকে এসেছিলেন, এসে মোজা খোঁজ করলেন। তাঁকে জানানো হল যে মোজা নেই। যখন চলে যাচ্ছেন তখন আমার কী মনে হল, গিয়ে বললাম, “Excuse me, are you Mohammad Ashraful?”
“Ji…”
“ওহ দাদা, আপনি এখানে!”
“আপনে কি বাংলাদেশ থেকে?”
“না না, আমরা ইন্ডিয়া থেকে। তবে আপনাকে চিনি।”
আরো টুকটাক কথা হল। বলল, লন্ডনে নাকি ছুটি কাটাচ্ছে। আশরাফুলের সঙ্গী ভদ্রলোক ছবি তুলে দিলেন। অটোগ্রাফ নেওয়াও হল। পরে শ্রেয়সীর কাছে শুনলাম যে, ও যখন পেন নিতে গেছিল ঐ রিসেপশানের লোকটি নাকি জিজ্ঞেস করেন, “Who is he?” আশরাফুল শোনার পর তাঁর বক্তব্য, “What a fool I am” পরে উনি নিজে গিয়েও কথা বলেছিলেন।
এইসব করে আমরা গেলাম ওভালের লাইব্রেরিতে। ভেতরে একটা ঘরে প্রায় চার দেওয়াল জোড়া ছাদ সমান আলমারি ভর্তি ক্রিকেটের বই, একটা আলমারিতে শুধুই উইজডেন অ্যালামন্যাক। এরকম লোভ খুব কম হয়েছিল। যাই হোক সেটার লাগোয়া ঘরটি আরো ভালো। বিভিন্ন মেমেন্টোতে ভর্তি, দেওয়ালে দ্রুষ্পাপ্য ছবি, খবরের কাগজের কার্টুন, আলমারিতে বিভিন্ন ম্যাচের স্মৃতিতে রাখা ব্যাট, বল, সরঞ্জাম। একটি বহু পুরনো লোহার ২২ গজ মাপার দড়ি। তার সঙ্গে সঙ্গে ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে ক্রিকেট আর সারের পুরনো খেলোয়াড়দের নিয়ে আলোচনা। এসবে খুশি হয়েই বিশেষ করে কেন ব্যারিংটনের প্রসঙ্গে ওনার টেস্ট ব্যাটিং গড় ৫৮ বলে দেওয়ায় ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে আরো কিছু বিশেষ জায়গা ঘুরিয়ে দেখালেন। বিশেষ করে খেলোয়াড়দের লাঞ্চ করার জায়গা। সেখানে আবার জ্যাক হবসের শততম ফার্স্ট ক্লাস শতরান উপলক্ষে বিশেষ একটি প্লেক রাখা আছে। তার সঙ্গে শ্রেয়সীকে দিলেন নিজের ফোনে সেভ করে রাখা রাহুল দ্রাভিডের একটি বিশেষ ছবি, ওনার নিজের সংগ্রহ থেকে।
ওভালের এই অসাধারণ অভিজ্ঞতার পুরো কৃতিত্বই অবশ্য শ্রেয়সী নিয়ে গেল। বলল, “দেখলে! আমার জন্য দেরি হল বলেই তো এরকম স্পেশাল প্রাইভেট ট্যুর পেয়ে গেলে!”
বিধিসম্মত সতর্কীকরণঃ ভবিষ্যতে আপনারাও এই ধরনের বিশেষ অভিজ্ঞতার জন্য দেরি করতে হলে নিজ দায়িত্বে করবেন।

ওভালের ঘোরাঘুরির পর খিদে পেয়েছিল। ভক্সহল ব্রিজের কাছে একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্টে ঢুকে ব্রিটিশ স্টাইলে চিকেন আলা কিভ আর ফিস অ্যান্ড চিপ্স খাওয়া হল। তারপর সাবওয়েতে ঢুকে কার্ডে টাকা ভরিয়ে আমরা চলে গেলাম সাউথ কেন্সিংটন স্টেশানে। উদ্দেশ্য ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়াম এবং ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে যাওয়া। দুটোই বেশ ভালো লেগেছিল।
দুটোই বেশ বড় মিউজিয়াম, সুতরাং আমরা সময়ের অভাবে পুরোটা দেখে উঠতে পারিনি। ন্যাচারাল হিস্ট্রি মিউজিয়ামের প্রাণীতত্ত্ব আর ডাইনোসর বিভাগটা দেখেছিলাম ভালো করে। প্রচুর ফসিল তো আছেই তার সঙ্গে আছে প্রচুর নোটস এবং অডিও-ভিসুয়াল মাধ্যমে দেওয়া প্রচুর তথ্য। বাচ্চাদের মনের মত জিনিস। সঙ্গে একটা বিশাল বড় টাইর‍্যানোসরাস রেক্সের মুভিং মডেল।

ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে আরো একটু বেশী সময় ছিলাম। দেখেছি বিভিন্ন দেশের বহু ঐতিহাসিক জিনিস। মূর্তি, ছবি, গ্লাস পেন্টিং, ফ্রেস্কো। সব জিনিসের লিস্ট দেওয়া সম্ভব নয়। শুধু বলে রাখি এই মিউজিয়ামের মোট গ্যালারীর সংখ্যা ১৪৫ এবং মোট দ্রষ্টব্যের সংখ্যা প্রায় ২৩ লাখ! তার মধ্যেও ব্রিটিশ এবং রোমান গ্যালারিগুলো মনে আছে। আর মনে আছে মিউজিয়ামের পেছনের বাগানটা। যাই হোক সেসব দেখে এবং ছবি তুলে আবার সাবওয়েতে ঢুকে টিউব নিয়ে আমরা এলাম পিকাডিলি সার্কাস বা ফেলুদার ভাষায় পিকলি সার্কাসে।
সেখানে রাস্তার মধ্যিখানে আন্টেরসের মূর্তি আর ফোয়ারার নিচের ধাপে বসা হল। চারদিকে বিভিন্ন দেশের মানুষ! কেউ আড্ডা মারছে, কেউ নিজের মোবাইলে ব্যস্ত, কেউ ছবি তুলছে ঘুরে ঘুরে, কেউ আবার অনেক ঘোরার পরে শুধুই বসে আছে। হঠাৎ দুটো বাচ্চা ছুটে চলে এল, তাদের হাসি আর চিৎকারে জমে উঠল জায়গাটা। অনেকদিন পর দেখা হল দুই বন্ধুর! তাদের হাসি আর টুকরো টুকরো কথা! আবার কয়েকজন বসেছে তাদের গিটার নিয়ে। গান শুনিয়ে যেটুকু পাওয়া যায়! সব মিলিয়ে আদর্শ ল্যাদের পরিবেশ। সামনে একটি মহিলা স্ট্যাচু সেজে দাঁড়িয়েছিল। সেটা বেশ মজার জিনিস। লন্ডনের অনেক জায়গাতেই এটা দেখলাম। 
দোকানপাটের বিবরণ আর কী দেব। কতরকমের যেসব দোকান! আবার পাশেই ১৮৭৪ সালে তৈরি হওয়া ক্রাইটেরিয়ান থিয়েটার। কিছুক্ষণ সেখানে বসে এবং জনসমুদ্র দেখে, একটা ক্যাফেতে রাতের খাবার খেয়ে ম্যাপ দেখে আমরা গ্রীন পার্কের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট খুঁজে হাঁটা লাগালাম পাবলাভের দিকে। এখানেই একটা মজা হয়েছিল।
সন্ধ্যেবেলা গ্রীন পার্ক, ভালোই লোকজন ছিল। তার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি আর শ্রেয়সী ঠিক করলাম আমাদের বন্ধু কৌশিক আর ওর বউ অপরূপাকে ফোন করে একটূ গল্প করব। সেই মত ভিডিওকল করা হল। দেশে তখন রাত সাড়ে বারোটা মত বাজে। দিব্যি আড্ডা হচ্ছে। আমরা কৌশিকদের এখানকার সুন্দর সুন্দর প্যালেসের মত বাড়ীগুলোর কথা বলছি। মাঝে মাঝে ক্যামেরা ঘুরিয়ে পার্কটা দেখাচ্ছি। এসব করতে করতে পার্কের প্রায় অন্যপ্রান্তে পৌঁছে দেখি সামনেই একটা বেশ বড় দারুণ দেখতে বাড়ী। আমি কৌশিককে বললাম, “দাঁড়া, সামনে আরো একটা বেশ বড় বাড়ী দেখতে পাচ্ছি, কী জানি না, তোদের দেখাই!” এই বলে ক্যামেরা ঘুরিয়ে বাড়ীর সামনে এসে দেখলাম শুধু বাড়ী নয়, সেটা ঘিরে পাঁচিল, তার সামনে একটা বেশ উঠোনের মত জায়গা, সেটার সামনে আরো একটা বেশ বড় ফোয়ারা আর মূর্তি এবং পুরো জায়গাটায় প্রচুর লোক, প্রধানত ট্যুরিস্ট। তখন ভালো করে দেখে ওদের বললাম, “ওরে এটা যেকোন বাড়ী নয়। এটাই হল বাকিংহাম প্যালেস! মানে যাকে বলে রাণীর বাড়ী!

ভিডিওকলে ওদের ভালো করে বাকিংহাম প্যালেস দেখিয়ে আমরা আরো কিছুক্ষণ ওখানে ঘোরাঘুরি করলাম। এটা যে পাবলাভের খুব কাছেই সেটা জানতাম কিন্তু প্ল্যান ছিল পরে একদিন আসার। শেষ অবধি বোধহয় বার চারেক আসা হয়েছিল বাকিংহাম প্যালেসের সামনে। প্যালেসের চেয়েও সামনের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মূর্তিগুলো বেশী ভালো লেগেছিল। হ্যাঁ লন্ডনেও একটা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আছে! পুরো মনুমেন্টের ওপরে দাঁড়িয়ে আছে একটা সোনালী পরী আর ভিক্টোরিয়ার মূর্তিটা তো পুরো কলকাতায় যেটা আছে সেটারই কপি!

Saturday, September 15, 2018

লন্ডনে লণ্ডভণ্ড - ৩


~~ জলি ওল্ড লন্ডন ~~
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে গেছিল ছটার আগেই। আগের রাত্তিরের গরম কেটে গিয়ে তখন হাল্কা হাওয়া দিচ্ছে। শুয়ে না থেকে বেরিয়ে এলাম। যেকোন শহরেই পায়ে হেঁটে ঘুরতে হয়। আর এই হোটেলের দরজা ২৪ ঘন্টাই খোলা। সুতরাং পাড়াটা এক চক্কর বেরিয়ে এলাম। সেই ব্রিটিশ স্টাইলের পর পর একই রকমের বাড়ি, সামনে রেলিং, কোথাও কোথাও ফুলের টব, একটা বাড়ির সামনে একটা শ্বেত পাথরের হাতিও দেখেছিলাম। আর একটা ভীষণ সুন্দর জিনিস হল ল্যাম্পপোস্ট থেকে ঝুলন্ত টবে ফুলের গুচ্ছ। এদেশেও জায়গায় জায়গায় করলে পারে!

মোটামুটি পাবলাভের ডানদিক-বাঁদিক বুঝে নেওয়া গেল। তারপর হোটেলের ঠিক পাশের টারপেন্টাইন লেন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটু এগিয়ে দেখি সামনেই তাঁকে দেখা যাচ্ছে। তিনি, আমাদের চিরপরিচিত গঙ্গা… থুড়ি টেমস। পরে শ্রেয়সী দেখে বলেছিল, ছোটবেলা থেকেই লন্ডন শুনলে ওর সেই ভূগোল বইয়ের ‘টেমস নদীর তীরে অবস্থিত লন্ডন শহর…’ মনে পরে যায়। যাই হোক, টেমসের ধার দিয়ে প্রথমবার হাঁটাটা মনে থাকবে। এইসব কারণেই তো ঠেঙ্গিয়ে অদ্দুর যাওয়া। সামনেই চেলসী ব্রিজ আর নদীর ঠিক উল্টোদিকে ব্যাটারসী পাওয়ার স্টেশান। পরে সর্বজিতের কাছে শুনেছিলাম, ওটা এখন অ্যাপেল কিনে নিয়ে নিজেদের লন্ডন হেডকোয়ার্টাস বানাচ্ছে।
টেমস ভ্রমণের পর ফিরে পাবলাভের লবিতে বসে ল্যাধ (এবং জল) খাচ্ছি, ইমরান এসে আলাপ করল। ইমরান রাজা, পাকিস্তানী, গত বারো বছর ধরে লন্ডনে আছে। এখানেই পড়াশুনো। যা বুঝলাম, পরিবারে অনেকেই আর্মিতে আছে। সেইসব কন্ট্যাক্টের জোরেই বাইরে থেকে পড়াশুনো করেছে। আরেক ইমরান মানে ইমরান খানের অন্ধ ভক্ত। তখনো ইমরানের শপথগ্রহণ হয়নি কিন্তু আমাদের ইমরান তাতেই ভারী উত্তেজিত। বলল, এ অন্য রকমের লোক, সত্যিকারের লিডার, দেশটার জন্য ভালো কিছু করবে। কিন্তু পশ্চিমের মিডিয়া সেসব না দেখিয়ে উল্টে বদনাম করবে। বেশ করেছে নিজের শপথগ্রহণে ইউরোপ-আমেরিকাকে না ডেকে শুধু ইন্ডিয়াকে ডেকেছে, ও জেনুইনলি ইন্ডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে চায় ইত্যাদি। ইমরান এতোই উত্তেজিত যে জানালো সে আর দুদিন পরে দেশে ফিরে যাচ্ছে। ইমরান খানের নেতৃত্বে গড়া নতুন পাকিস্তানে কাজ করতে চায় সে। শুনে ভারী ভালো লাগল।
ততক্ষণে শ্রেয়সীও নিচে এসে আড্ডায় যোগ দিয়েছে। সাধারণ মানুষের কথা হচ্ছে, ঘোরার গল্প হচ্ছে। পিউ যথারীতি নিজের ফেভারিট টপিক খাবারের দিকে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিয়েছে। সেই লাহোরের ফুড স্ট্রিটের কাবাব। ইমরান জানালো যে, ওর আর্মি কন্ট্যাক্ট দিয়ে আমাদের ভিসা বের করিয়ে দেবে, সুতরাং ওর সঙ্গে যেন যোগাযোগ রাখি। ফেসবুকে অ্যাডও করা হল নিজেদের। খুব ভালো লেগেছিল ইমরানকে, একটা স্বপ্ন দেখা মানুষ!
ভারতে ফেরার পর একদিন ইমরান ফেসবুক মেসেঞ্জারে পিং করেছিল। ভালো খবর দেয়নি। দেশে এসে ভালো লাগেনি ওর। কদিন থেকেই দেখেছে, দেশের মানুষ ফাঁকিবাজ, দূর্নীতিগ্রস্ত। এমনকি ওর আত্মীয়রাই নাকি সবসময় পয়সার লোভে পেছনে পড়ে আছে। আমার সঙ্গে কথা বলছিল, ভারতে চাকরির সুযোগ নিয়ে। শেষ পর্যন্ত কাতার বা সিঙ্গাপুর চলে যাওয়ার কথা বলেছিল। একদিন খবর নিতে হবে ওর।
ইমরানের সঙ্গে আড্ডা মারার পর শ্রেয়সীকে নিয়ে একটু পায়ে হেঁটে ভ্রমণ হল। একদিকে টেমস অন্যদিকে ভিক্টোরিয়া প্লাজা। আমাদের ফোনগুলো তখনো খুব একটা চলছে না। সেগুলো ঠিক করানোর ছিল। ভিক্টোরিয়া প্লাজার একটা বড় সুপারমার্কেট থেকে স্যান্ডউইচ কিনে ব্রেকফাস্ট করলাম। যদিও পাবলাভে ফিরে মনে পড়েছিল, যে আমাদের হোটেলেই ফ্রি ব্রেকফাস্ট আছে!
যাইহোক, দুজনে সেজেগুজে এবং শ্রেয়সীর সৌজন্যে কিঞ্চিৎ দেরী করে বেরিয়ে পড়লাম। গভর্নর্স পার্ক থেকে ডবলডেকার বাসের দোতলার সামনে সিটে বসে সেলফি তুলতে তুলতে চললাম সেন্ট জনস্‌ উড। বাসস্ট্যান্ড থেকে নেমে মিনিট চারকে হাঁটলেই প্রথমে চোখে পড়ে লর্ডস ট্যাভার্ন আর তারপরেই লর্ডসের গ্রেস গেট।
লর্ডস ট্যুরের টিকিট অনলাইন কাটতে হয় (https://www.lords.org/lords/tours-and-museum/), ওখানে কাটার কোন ব্যবস্থা নেই। টিকিট পাওয়া যায় মোটামুটি তিন মাস আগে থেকে। তবে যেসব দিন খেলা থাকে সেসব দিনে ট্যুর বন্ধ থাকে বলাই বাহল্য।
আমরা কুড়ি-পঁচিশ জনের দলের লর্ডস ট্যুর শুরু হল লর্ডসের মিউজিয়ামে। এক তলায় রয়েছে বিভিন্ন খেলোয়াড়দের ছবি, খবরের কাগজের কাটিং, সরঞ্জাম, জার্সি, মেমেন্টো। তাদের মধ্যেই সাজিয়ে রাখা আছে ১৯৮৩ সালের প্রুডেনশিয়াল কাপের ট্রফি। কপিলদেবের হাতে এই ট্রফির ছবি দেখেছি বহুবার। এবার সামনাসামনি দেখলাম। তারপর দোতলায় উঠতে পেলাম তাকে। লাল টেরাকোটার  সেই ছোট্ট ট্রফি। ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট সিরিজের পুরস্কার। অ্যাসেজ! গাইড অ্যাসেজের জন্মের গল্প কেউ জানে কিনা খোঁজ নিচ্ছিলেন, ট্যুরটাকে ইন্টার‍্যাক্টিভ করার জন্য। দিন-তারিখ অবধি বলে দেব সেটা বোধহয় আশা করেননি। যাই হোক, সেখানে শচীন, সৌরভ, লক্ষণদের জার্সিও দেখলাম। যদিও দাদার জার্সিটা কলকাতা নাইট রাইডার্সের।
মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে আমাদের গন্তব্য ছিল ড্রেসিংরুম। একে একে হোম এবং অ্যাওয়ে টিমের ড্রেসিংরুম দর্শন হল। ড্রেসিংরুমের প্রধান আকর্ষণ সেই বিখ্যাত অনার্স বোর্ড। বিশেষ করে অ্যাওয়ে টিমের শতরানের বোর্ডটা। যেখানে সৌরভ, রাহুল ছাড়াও অজিত আগারকারের নাম আছে কিন্তু শচিন তেন্ডুলকার এবং ব্রায়ান লারা  নামক দুই ব্যাটসম্যান অনুপস্থিত। অবশ্যই যাওয়া হল ড্রেসিংরুমের লাগোয়া বারান্দায়। যেখানে ২০০২ সালের ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনাল জিতে নিজের জামা খুলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন সৌরভ। যদিও আমাদের গাইড খুব পরিষ্কারভাবেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, ব্যাপারটা ওনাদের একদমই পছন্দ হয়নি! লর্ডস বলে কথা! রাহুলকে নিয়ে অবশ্য ভদ্রলোক খুশীই ছিলেন। রাহুলের শেষ ট্যুরের সময় কিভাবে একজন স্টুয়ার্ডের কথায় ড্রেসিংরুমের একটি বিশেষ জায়গায় বসে রাহুল সেঞ্চুরি পেয়েছিল তার গল্প করলেন। সেই বিশেষ জায়গায় বসে শ্রেয়সীরও ছবি তোলা হল!

 পরের গন্তব্য লর্ডসের লংরুম, যেখানে লর্ডসের মেম্বারদের মধ্যে দিয়ে ব্যাট করতে নামতে হয়। অসাধারণ কিছু হাতে আঁকা ছবি ছিল ঐ ঘরে কিন্তু ছবি তোলার সুযোগ পাইনি। তার পাশেই কমিটিরুম। গত ২৩০ বছরের বহু ইতিহাসের সাক্ষী। শুনলাম হেরিটেজ লিস্টের একদম ওপরের দিকে থাকার কারণে এইসব ঘরের বাইরে এবং ভিতরে খুব বেশী পরিবর্তন করা যায় না। তাই ঘরের ভেতরে এখনো সেই কাঠের টেবিল-চেয়ার। শুধু একটা টিভি স্ক্রিন যোগ হয়েছে আজকাল। রীতিমত গায়ে কাঁটা দিয়েছে আমার।
এরপরে মউন্ড স্ট্যান্ডে মাঠের ধারে বসে ছবি ইত্যাদির পর আমরা গেলাম সেই বিখ্যাত জে পি মর্গান মিডিয়াসেন্টারে। পঁচাশি ধাপ সিঁড়ী দিয়ে সেই বিখ্যাত মিডিয়াসেন্টার। যদিও মিডিয়াসেন্টারের আসল ঘটনা পরে একদিন ঘটেছিল। সেটা পরেই বলব।
মোটামুটি এটাই ছিল আমাদের লর্ডস ট্যুর। সবশেষে লর্ডস শপে গিয়ে একটু কেনাকাটাও হল। মনে রাখার মত স্মৃতি। ভবিষ্যতে লন্ডন গেলে আবার একবার ট্যুরে যাওয়ার ইচ্ছে আছে।
লর্ডস থেকে বেরিয়ে একটা বাস নিয়ে আমরা চলে এলাম বেকার স্ট্রিট। ২২১,বির ঠিকানায় শার্লক হোমসের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু যথারীতি শার্লকবাবুর বাড়ীর সামনে লম্বা লাইন। সুতরাং সেসব কাটিয়ে আমরা পাশের স্যুভেনির শপে ঢুকলাম। ভারতের বাইরে অধিকাংশ জায়গাতেই এই স্যুভেনির শপগুলোর প্রাধান্য। আর ইংল্যান্ডের দোকানগুলো তো প্রায় মিউজিয়াম! কী নেই সেখানে, শার্লক হোমসের ভিসিটিং কার্ড অবধি দেখেছিলাম। তাছাড়া কলম, চাবির রিং, ম্যাগনেট, টুপি, ছবি, বই, ঘড়ি, টিশার্ট, এসব তো প্রায় সব জায়গাতেই! সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা গেলাম বেকার স্ট্রিটের মোড়ের মাথার প্যালেস্টাইন রেস্টুরেন্ট ‘শাকশুকা’য়। সেখানে মাংসের পরোটা জাতীয় কিছু খাওয়া হয়েছিল। নাম ভুলে গেছি।
বাইরে তখন প্রায় তেত্রিশ ডিগ্রী, তাঁর মধ্যে শ্রেয়সী নতুন জুতোয় হেভি চাপ খাচ্ছিল। সুতরাং ওখান থেকে একটা বাস নিয়ে হোস্টেলে ফেরা হল। সেখানে আবার কিছুক্ষণ ল্যাধ খেয়ে জুতো চেঞ্জ করে বেরোন হল কিংস ক্রস স্টেশানের উদ্দেশ্য। কারণ সেখানেই আছে প্ল্যাটফর্ম ৯৩/৪ , যেখান থেকে প্রতি বছর পয়লা সেপ্টেম্বর হগওয়ার্টস এক্সপ্রেস রওনা দেয় হগওয়ার্টস স্কুল অফ উইচক্র্যাফট অ্যান্ড উইজার্ডরির উদ্দেশ্য।
কিংস ক্রস মস্ত বড় স্টেশান। সঙ্গে প্রচুর দোকান, ওপরে খাওয়ায়র জায়গা, সামনে চেয়ার পাতা। সেখানে বসে লোক দেখে সময় কাটানোর চমৎকার ব্যবস্থা আছে। সঙ্গে একটা দেওয়াল, ওপরে ৯৩/৪ লেখা। নিচে একটা ট্রলি এবং তাতে কিছু জিনিস, যেগুলো নিয়ে দেশেবিদেশের হ্যারির ভক্তরা ঐ দেওয়ালে ঢুকে যাওয়ার পোজে ছবি তুলতে পারে। সেখানেও লম্বা লাইন, তাই ঐ পোজ দিতে যাইনি। সেরকম ইচ্ছেও ছিল না, মাগলদের এসব করা উচিত নয়! পাশের হ্যারি পটার থিমড দোকানটাও চমৎকার। রকমারী জিনিস ছিল সেখানেও।

ওসব মিটিয়ে ওপরের খাবারের দোকানগুলোর সামনে বসে ডেকে নিলাম আমাদের বন্ধু সর্বজিতকে। তারপর কিছুক্ষণ বসে আড্ডা, তারপর হাঁটতে হাঁটতে প্রথমে একটা ইতালিয়ান রেস্টোরায় পাস্তা ভক্ষণ। তারপরে একটু বিয়ার কিনে কিংসক্রসের পেছনদিকে খালের ধারে বসে আরো কিছু আড্ডা। এইভাবেই শেষ হল আমাদের লন্ডনের প্রথম দিন। পাবলাভে যখন ঢুকছি তখন নিজের পাব জমজমাট। কিন্তু আমাদের আর এনার্জি নেই। তাই হাতমুখ ধুয়ে সোজা বিছানায়, পরের দিনের প্ল্যান ভাবতে ভাবতে।

Monday, September 10, 2018

লন্ডনে লণ্ডভণ্ড - ২

~~শ্রেয়সীর লন্ডন প্রবেশ~~

প্রথম পোস্টটা পড়ে অনেকেই খরচার কথা বলেছেন। কথা দিলাম, পুরো লেখার শেষে খরচের হিসেবটা ডিটেলে দিয়ে দেব। লেখার মধ্যে টুকটাক উল্লেখ তো থাকবেই। মোটামুটি খরচ হয়েছে মাথাপিছু এক লাখ ষাট-পঁয়ষট্টি মত। কেনাকাটা ছাড়া।
যাই হোক, আবার কলকাতা থেকে মুম্বাইয়ের বিমানে ফিরে যাই। সেখানে তখন খাবার নিয়ে একটা বিতর্কের সৃষ্টি হব হব করছে! সেটা লেখার আগে একটা জিনিস বলা উচিত। আমরা দুজনেই মানে এই আমি আর পিউ কেউই খুব একটা চালাকচতুর নই। তাই ঘুরতে গিয়ে অনেক জিনিসই আমাদের চমকপ্রদ লেগেছে বা না বুঝে ছড়িয়েছি যেগুলো অন্যদের অতটাও অদ্ভুত নাও লাগতে পারে।
যাই হোক, কলকাতা থেকে মুম্বাইয়ের বিমানে ব্রেকফাস্ট এল। ভেজ না ননভেজ সেটারও যথাযথ উত্তর  দেওয়া হল। তা আমার প্লেট নিয়ে ঐ রাংতা খুলে দেখলাম যে ননভেজ বস্তুটি হল ডিমের ভুজ্জি। তা ভালো! যা পাওয়া যায়। কিন্তু পিউ জিনিসটা দেখেই এয়ারহোস্টেস দিদিমণিকে ডেকে বলল, “এটা তো ভেজ!” কারণ ওর বাটিতে যে জিনিসটা আছে সেটা দেখতে হলুদ হ্লুদ, অনেকটা আমাদের পেঁপের ঝোলের মত! দিদিমণি হেসে বললেন, “না না, ওটাই নন ভেজ!” তখন বস্তুটিকে নেড়ে ঘেঁটে দেখে বোঝা গেল যে ওই বস্তুটিও ডিমের ভুজ্জি, কোন অজ্ঞাত কারণে ওটাকে হলুদ, মশলা দিয়ে রান্না করা হয়েছে। আরো একটু পরে বুঝলাম যে, পুরোটাই ওভাবে রান্না করা হয়েছে, এবং আমার প্লেটে যে অংশটা এসেছে সেখানে মশলা ভালো করে ঢোকেনি বলে ডিম-ডিম ভাবটা রয়ে গেছে আর তাই দেখে বুঝতে পেরে গেছি।
যাই হোক, মুম্বাইয়ে ঠিক সময়ই পৌঁছে গেছিলাম। তারপর এদিক ওদিক অনেকটা হেঁটে, এক তলা দোতলা করে দরকারী কাজকর্ম মিটিয়ে আমরা লাউঞ্জে পৌছলাম। লাগেজ একদম কলকাতাতেই জমা পড়ে গেছিল, তাই সেসব নিয়ে চাপ ছিল না। আমরা এয়ারপোর্টে একটু পাও ভাজি ইত্যাদি খেয়ে টুক করে লন্ডনের প্লেনে উঠে পড়লাম। এমনিতে সব ঠিকই ছিল। যদিও শুরুতেই প্লেনে উঠিয়ে
প্রিমিয়াম ইকনমি বা বিজনেস ক্লাসের মধ্যে দিয়ে হাঁটিয়ে সিটে পাঠানোটা একটু দুঃখজনক! যেন দেখাচ্ছে, দ্যাখ শালা, সস্তার টিকিট কেটে কী মিস করলি! (ফ্লাইট টিকিট বুক করেছি মেকমাইট্রিপ থেকে, জেটের ফ্লাইট, ৯২,০০০ মত, তাতে আমার ক্রেডিট কার্ডের একটা অফারের সৌজন্যে ৭,৫০০ টাকা ক্যাশব্যাক পেয়েছিলাম)
অন্য যেকোন লম্বা প্লেনজার্নির এটাও বেশ বোরিং ছিল। ঐ টুকটাক খাওয়া দাওয়া, সিনেমা দেখা আর অনেক ঘুমিয়ে যখন লন্ডন পৌঁছলাম তখন ওখানে বিকেল, বাইরে ঝকঝকে রোদ।
এয়ারপোর্টে নেমে ইমিগ্রেশানে অনেক সময় লেগেছে। সে প্রায় চার-পাঁচশো লোকের লাইন। সেও টুকটুক করে পার হয়ে ইমিগ্রেশান কাউন্টারের কাকুর সঙ্গে একটু খেজুর করে পাসপোর্টে স্ট্যাম্প পাওয়া গেল। যথারীতি ছড়িয়ে যে বেল্টে লাগেজ আসছিল সেটায় না গিয়ে পাশের বেল্টে খুঁজছিলাম। এয়ারপোর্টের এক কর্মচারী ভুল ধরিয়ে দেওয়ায় নিজেদের লাল রুকস্যাক আর নীল স্যুটকেসও পাওয়া গেল। এর পরের কাজ ছিল অয়স্টার কার্ড আর সিম নেওয়া।
এয়ারপোর্টেই একাধিক কাউন্টারে অয়স্টার কার্ড পাওয়া যাচ্ছিল। যে দিদিমণি কার্ড বিক্রি করছিলেন তিনি কার্ডের ব্যবহার বুঝিয়ে ‘সিটিম্যাপার’ নামক একটি অ্যাপ নামানোর উপদেশ দিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে গুগল এবং ইউটিউবের কল্যানে ওই অ্যাপের প্রয়োজনীয়তা আমার জানা এবং সেটা কলকাতায় থাকতেই আমার ফোনে নামানো হয়ে গেছে!
সিটিম্যাপার খুবই কাজের জিনিস এবং লন্ডনে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিয়ে ঘুরতে গেলে সিটিম্যাপার না নিয়ে ঘোরা অসম্ভব না হলেও বোকামি তো বটেই। মোটামুটি লন্ডন এবং গ্রেটার লন্ডনের যেকোন দুটো জায়গার মধ্যে যাওয়ার সমস্ত সাম্ভাব্য উপায় এই অ্যাপ দেখিয়ে দেয়। হেঁটে গেলে কতক্ষণ লাগবে (এবং কত ক্যালোরি ঝরবে), উবেরে গেলে কতক্ষণ এবং কত ভাড়া, বাসে, ট্রেনে বা আন্ডারগ্রাউন্ডে (এমনকি ফেরীও) গেলে কত বিভিন্নভাবে যাওয়া যাবে এবং তাতে ভাড়া এবং সময় কত লাগবে তা এই অ্যাপ বলে দেয়। এবং অবশ্যই পরবর্তি বাস বা ট্রেনের সময়ও দেখিয়ে দেয়। পুরো দু সপ্তাহ আমাদের নিজেদের মত ঘোরার পেছনে সিটিম্যাপারের অবদান ভোলার নয়!
সিম নেওয়া হল লাইকার। এদের ১৫ পাউন্ডের প্যাকে এক মাসের জন্য, লোকাল কল, ৫ জিবি ডেটা আর ভারতসহ ৪৩টা দেশে ইন্টারন্যাশানাল কলিং ফ্রি। তবে একটু মনে রাখবেন যে, এই প্যাক ভরাতে হলে সবসময় মোবাইল ডেটা অফ করে ভরতে হয়, তারপর একটা বিশেষ নম্বর ডায়াল করে প্যাক অ্যাক্টিভেট করতে হয়। ডেটা অফ না করা থাকলে পাউন্ড ভরার সঙ্গে সঙ্গেই ডেটার জন্য পয়সা কাটতে শুরু করে এবং ওই বিশেষ প্যাকটা চালু হয় না। এটা না জানায় আমার ১৫ পাউন্ড গচ্চা গেছিল। শ্রেয়সীর সমস্যা ছিল অন্য। ওর প্যাক চালু হওয়ার পরেও ইন্টারনেট চলছিল না। সেটা পরেরদিন বিকেলে একটি দোকানে ৫ পাউন্ডের বিনিময়ে ঠিক করাতে হয়। 
যাই হোক, হিথরো থেকে যখন ট্রেনে উঠলাম তখন আটটা বেজে গেছে। আমাদের গন্তব্য ভিক্টোরিয়া স্টেশান। মাঝে একবার চেঞ্জও করতে হল। লন্ডনের আকাশে তখন বিষণ্ণ বিকেল, সন্ধ্যে নামছে… মানে ওই সাড়ে আটটা বাজে! ভিক্টোরিয়ায় নেমে রাতের জন্য স্যান্ডউইচ কিনে আমরা হাঁটা লাগালাম আমাদের পরবর্তী চারদিনের ঠিকানা পাবলাভ হোস্টেলের উদ্দেশ্য। পথ দেখালো সিটিম্যাপার। মোটামুটি মিনিট পনেরো হেঁটে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছলাম। তার আগে চোখে পড়েছে ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশান। এখান থেকে আমাদের টনটনের বাস ধরার কথা। মাঝে একটা থানাও দেখেছিলাম। শ্রেয়াসী ইন্টারনেট চলছে না বলে ঘ্যানঘ্যান করায় ওকে পুলিশে দেওয়ার ভয়ও দেখিয়েছিলাম।
হোস্টেলে ঢুকে নিজেদের পাসপোর্ট দেখিয়ে নাম-টাম মিলিয়ে ঘরে ঢোকার কম্বিনেশান পাওয়া গেল। পাবলাভে মোট ছটা ডর্ম আছে এবং তাদের প্রত্যেকে কম্বিনেশান লক আলাদা আলাদা। তখনো অবধি লন্ডনে একেবারেই ঠাণ্ডা লাগেনি, বরং হাল্কা গরমভাব। নিজেদের ঘরে ঢুকে চমকে গেলাম!
ঘর পুরো ভ্যাপ্সা গরম এবং তার সঙ্গে গোটা পনেরো লোকের একসঙ্গে থাকার দরুন একটু গুমোটভাব। ব্যাগ-ফ্যাগ গুছিয়ে বসেও গরমের জন্য অস্বস্তিই হচ্ছিল। তাই একবার নিচে যাওয়া হল এয়ার কন্ডিশানের ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে। রিশেপ্সানের ছেলেটি পাতি হাত উলটে জানালো, এসি বা ফ্যানের কোন ব্যবস্থা এই হোস্টেলে নেই!
সুতরাং আবার ঐ ঘরেই প্রত্যাবর্তন। ভাগ্যক্রমে, যে খাটের নীচের এবং মাঝের বাংক পাওয়া গেছিল সেটা জানলার পাশেই, তাই জানলার পর্দা সরিয়ে একটু হাওয়া আসার ব্যবস্থা করা হল। তারপর ফ্রেস হয়ে ওই স্যান্ডউইচ খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ক্লান্তি ছিল, একটু পর থেকে গরমও বিশেষ লাগেনি। ঘুমলাম ভালোই। পরদিন সকালেই বেরনোর কথা। লর্ডস ট্যুরের টিকিট আছে এগারোটার সময়।

Sunday, August 26, 2018

লন্ডনে লণ্ডভণ্ড - ১

~~যাত্রা~~

এই ব্লগ পোস্ট শুরু করব আমার পুরনো একটা ফেসবুক স্ট্যাটাস দিয়ে। মজার ব্যাপার, সেটাও আগস্ট মাসের পোস্ট তবে ২০১৬ সালের। সময়টা ছিল রিও অলিম্পিকের ঠিক পরপরেই। সাক্ষী, দীপা, সিন্ধু নামগুলো তখনো মানুষ ভুলতে শুরু করেনি। আর এই সময়ই একদিন নিচের লেখাটা পোস্ট করেছিলাম,

আমি নিজে বিশেষ কোন খেলা খেলতে পারি না। যদিও ছোটবেলা থেকে অনেক খেলাই খেলেছি। এখনও টুকটাক ফিফা খেলে থাকি, বিশেষ সুবিধা করে উঠতে পারি না। কিন্তু খেলাটাকে ভালোবাসি। এটা নিয়ে আমি যে কোন লোকের সঙ্গে লড়ে যেতে পারি। আর হ্যাঁ, সব খেলাই ভালোবাসি, যদিও ক্রিকেটটা একটু বেশী।আজকাল 'Sporting Event Tourism' বলে যে জিনিসটা আছে সেটা করতে খুব ইচ্ছে করে। শ্রেয়সীর সঙ্গেও প্ল্যান বানাই মাঝেমধ্যে। ইন্ডিয়ার টেস্ট ম্যাচ দেখতে দেখতে মনে হয় নেক্সট ইংল্যান্ড ট্যুরের সময়ে লর্ডস টেস্টটা বা অস্ট্রেলিয়া ্যুরের সময় সিডনি টেস্টটা দেখতে গেলে কেমন হয়, কখনো ভেবে দেখি, ২০১৯ এর ওয়ার্ল্ড কাপে যাওয়া যাবে কিনা, এমনকি ২০১৮ বা ২০২২ এর গুলোতে গেলেও মন্দ হয় না। ওলিম্পিক্স দেখতে দেখতে আবার মনে হচ্ছে ২০২০তে টোকিওটা টার্গেট করা উচিত কিনা। বাড়ির তো কাছেই সুতরাং কদিন গিয়ে দীপা, অতনু, পুসারলা, সাক্ষীদের জন্য গলা ফাটানোই যায়। তারপর কালকে সিজনের ফার্স্ট হোম ম্যাচ দেখে মনে পড়ল 'থিয়েটার অফ ড্রিমসে' তো যেতে হবে। মনে পড়ল, কেন উম্বলডনের সময় যাওয়া যাবে না, কারণ তখন লিগ শুরু হয় না।এত কিছু কবে হবে কে জানে! কিন্তু প্ল্যান বানিয়ে যাই... একদিন না একদিন সেটাকে একজিকিউট করবই। ততদিন মন দিয়ে খেলাগুলো ফলো করি। যতগুলো খেলা সম্ভব। সেগুলোর খবর ফেসবুকে আরো ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করব। লোকে যাতে অলিম্পিকের সময় ছাড়াও প্রদুনোভা কী সেটা মনে রাখে!"

যেমন লিখেছিলাম, তখন থেকেই মাথার মধ্যে ২০১৮ সালের দুটো ইভেন্ট মাথার মধ্যে ঘুরছিল। রাশিয়ার ফুটবল বিশ্বকাপ আর ভারতীয় ক্রিকেট দলের ইংল্যান্ড সফর। শেষ অবধি অবশ্য দ্বিতীয়টাই জিতল। মস্কোর চেয়ে লন্ডনের চার্মটা অনেক বেশী আর ক্রিকেট বনাম ফুটবলেও পছন্দটা সহজ। যদিও অন্তত একটা ফুটবল বিশ্বকাপে যেতে চাই। সম্ভবত ২০২৬ সালের আমেরিকা-কানাডা-মেক্সিকোরটা। দেখা যাক!
এবার ইংল্যান্ডে খেলা দেখা নিয়েও একটা দোনামোনা ছিল। আঠেরোর টেস্ট সিরিজ না উনিশের বিশ্বকাপ। শেষ অবধি আমার এবং আমার সঙ্গিনীর ভোট আঠেরোতেই পড়ল। বিশ্বকাপের সময় হোটেলের ভাড়া ও অন্যান্য খরচা বাড়ার সম্ভাবনা আছে। এছাড়া লর্ডস স্টেডিয়াম আর মিউজিয়াম ট্যুর লিস্টে ছিল। সেগুলোও হয়তো বিশ্বকাপের সময় বন্ধ থাকবে। আর ইংল্যান্ডে টেস্ট ম্যাচ দেখতে হলে প্রথম পছন্দ অবশ্যই লর্ডস, ‘হোম অফ ক্রিকেট’! সুতরাং অপেক্ষা ভারতের ইংল্যান্ড সফরের আর টেস্ট ম্যাচগুলোর তারিখ ঘোষণার। এর মধ্যে ২০১৭ সালের গোড়ার দিকে আমি চলে গেলাম কুয়ালালামপুর। সেখানে একদিন ঘুরে এলাম কিনরারা ওভালে। ভিরাটদের ২০০৮ এর বিশ্বকাপ জেতার মাঠ। পরে শ্রেয়সীও গেছিল।
যাই হোক, ওখানে থাকতে থাকতেই সিরিজের দিনক্ষণ  ঘোষণা হল। মোটামুটি সব দিক দিয়ে খরচ হিসেব করে লর্ডস টেস্ট টার্গেট করা হবে ঠিক হল। ৯-১৩ই আগস্ট টেস্ট ম্যাচ, সুতরাং ২-৩ তারিখ যাত্রার দিন ঠিক হল। টেস্ট ম্যাচের দু-একদিন আগেই লর্ডস ট্যুর বন্ধ হয়ে যেতে পারে, তাই দিন হাতে রাখা।
আমি যথারীতি একটা এক্সেল ফাইল খুলে বিভিন্ন দর্শনীয় স্থানের লিস্ট করতে শুরু করে দিলাম। সঙ্গে একটা রাফ দিনের হিসেব। এদিক ওদিক থেকে লিংক যোগাড় করা ইত্যাদি। কিন্তু তখনো টিকিট ইত্যাদি অনেক দূরের কথা। এর মধ্যে ফিরে এলাম মালায়শিয়া থেকে। ফিরে অক্টোবারে গেলাম দিল্লী। সেখানে একদিন দেখা হল সত্রাজিৎ আর বিম্ববতীর সঙ্গে। ওরা ২০১৬তেই লন্ডন ঘুরে ফিরেছিল। ওদের কাছ থেকে টিপস নেওয়া হল। বিশেষ করে পাবলাভ হোস্টেলের কথা ওরাই বলেছিল। তাই একটা বড় চকোলেট ওদের পাওনা।
তক্কে তক্কে ছিলাম লর্ডস টেস্টের টিকিটের জন্য। তারপর যা হয়, মাঝখানে কদিন দেখিনি। হঠাৎ দেখি প্রথম তিনদিনের টিকিট ইন্টারনেটে হাওয়া। চতুর্থ দিনের মাত্র কয়েকটা টিকিট পড়ে আছে। সে ঝটপট বন্ধু সর্বজিতকে বলে কেটে ফেলা হল। সর্বজিৎ কিছুদিন লন্ডনে আছে। তাই ওকে দিয়েই টিকিট কাটিয়ে ওর ওখানকার ঠিকানায় পাঠিয়ে দেওয়া হল। টিকিট পেলাম মিডিয়া সেন্টারের বাঁদিকের এড্রিচ স্ট্যান্ডে।
এরপর শুরু করলাম একে একে হোস্টেলের খোঁজ এবং বুকিং। তার আগে অবশ্য পুরো ভ্রমণটাই ছকে ফেলেছি। মাঝে কিছু বিতর্ক হয়েছিল স্কটল্যান্ডে না প্যারিস বা ব্রাসেলসে এক দিনের ট্রিপ ইত্যাদি নিয়ে। শেষ অবধি শুধু ইংল্যান্ড আর স্কটল্যান্ডই ঠিক হল। তারপর আমার এবং শ্রেয়সীর রিসার্চের ফলে পুরো ট্যুরটা দাঁড়ালো এরকম,
২-৮-২০১৮ – কলকাতা ত্যাগ
৩-৪ – লন্ডন
৫ – স্টোনহেঞ্জ এবং বাথ
৬ – টনটন
৭ – ম্যাঞ্চেস্টার
৮-৯ – এডিনবার্গ
১০ – ফোর্ট উইলিয়াম
১১-১৪ – লন্ডন
১৫ – লন্ডন ত্যাগ
একে একে বুকিং শুরু হল। অনেকগুলো হোস্টেল এবং হোটেল। সেগুলোর কথায় যথাসময়ে আসা যাবে। তবে সব বুকিংগুলোই হয়েছে বুকিং.কম থেকে। সেই লাঙ্কাওয়ির সময় থেকেই এরা আমার ভরসা। ফ্লাইট বুক হল জেটের। এছাড়া জ্যাকোবাইট ট্রেন, লর্ডস ট্যুর, ওভাল ট্যুর, ম্যাঞ্চেস্টার স্টেডিয়াম ট্যুর, স্টোনহেঞ্জ ট্যুর একে একে সবই হল। এ বছর এপ্রিল-মে মাসের অধিকাংশ শনি-রবি আমার কেটেছে প্ল্যানিং করে। শেষ অবধি সবই হল। মাঝে মনে হয়েছিল সপ্তর্ষি আমাদের সঙ্গী হবে। কিন্তু সে ছোকরা এদিক-ওদিক নানারকম ঘুরে এটা আর ম্যানেজ করে উঠতে পারলো না। সুতরাং শেষ অবধি ১ তারিখ রাত্তিরে নেতাজী সুভাষ চন্দ্র বসু আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের উদ্দেশ্যে রওয়ানা হলাম আমি এবং আমার সঙ্গিনী শ্রীমতি শ্রেয়সী দ্রাভিড। তাঁর বিভিন্ন কীর্তিকলাপের কথা এই লেখায় মাঝে মাঝেই আসবে।
তাহলে আর কী! ঊঠে বসলাম প্লেনে। প্রথম গন্তব্য মুম্বাই!




(চলবে... মানে ইয়ে সেটা না বললেও চলে তবু ছোটবেলায় আনন্দমেলায় এই ব্যাপারটা আর ‘আগে কী ঘটেছে’ বেশ মজার লাগত তাই...)

"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”