~~ হঠাৎ রাণীর বাড়ি ~~
দিনের শুরুতেই
একটু ঝামেলা হয়ে গেল। যাওয়ার কথা ছিল লন্ডনের দক্ষিণ দিকে ঐতিহাসিক কেন্সিংটন ওভাল
মাঠে। সেইমত সিটিম্যাপার দেখে বুঝলাম যে, বাসে করে একটা বিশেষ স্টপ অবধি গিয়ে
তারপর কিছুটা হাঁটতে হবে। সেইমত বাসেও উঠেছি তারপর ট্র্যাভেল কার্ড টাচ করাতে গিয়ে
দেখি আমার কার্ড চললেও শ্রেয়সীর কার্ডে পয়সা নেই। তখন বোঝা গেল যে, আগেরদিন শেষবার
মেট্রো থেকে বেরোবার সময় ঠিক করে সোয়াইপ না করায় কার্ডের পুরো টাকাটাই চলে গেছে। ড্রাইভারকে
পয়সা দিতে গেলাম, সে গম্ভীর হয়ে না বলে বাস চালিয়ে দিল। আমরা আর কী করি বোকার মত
পেছনে গিয়ে বসলাম। তার মধ্যে আমার চোখে পড়ল যে, বিনা পয়সায় যাত্রা করে ধরা পড়লে
তার জরিমানা মাত্র ৮০ পাউন্ড! সেইসব দেখে শ্রেয়সীর দোষারোপ শুনতে শুনতে হঠাৎ বুঝতে
পারলাম আমরা আমাদের গন্তব্য স্টপ ছাড়িয়ে চলে গেছি। টুক করে পরের স্টপে নেমে
মুশকিলে পড়লাম। চারদিকে কোথাও ঐ ট্রাভেল কার্ড টপ-আপ করার কিছু ছিল না। সুতরাং
ম্যাপ দেখে হাঁটা শুরু হল। এইভাবে প্রায় আধ ঘন্টা হেঁটে, কখোন ভুল দিকে গিয়ে,
টেমসের ওপরে ব্রিজ টপকে যতক্ষণে হবস গেট দিয়ে ঢুকে রিসেপশানে পৌঁছলাম তার পনেরো
মিনিট আগেই ট্যুর শুরু হয়ে গেছে।
যাই হোক,
রিসেপশানের লোকটি ভালোই ছিলেন। তিনি নিজেই আমাদের নিয়ে গেলেন ট্যুরগ্রুপের কাছে।
তাঁদের ততক্ষণে ওভালের লাইব্রেরি দেখা হয়ে গেছে। আমরা গিয়ে তাঁদের দলে ভিড়ে গেলাম।
রিসেপশানের ভদ্রলোক বলে রাখলেন যে, পুরো ট্যুর হয়ে যাওয়ার পর আমাদের ইচ্ছে থাকলে
উনি আমাদের লাইব্রেরিটা দেখিয়ে দেবেন।
অতঃপর, ওভালের
স্টেডিয়ামের বিভিন্ন আনাচেকানাচে ঘোরা হল। ঐতিহাসিক ব্র্যাডম্যান গেট, ১৫০ বছর
উপলক্ষে বিশেষ ঘড়ী, মাঠের পাশের সেই গ্যাসহোল্ডার দেখলাম সবই। তার সঙ্গে বিভিন্ন
ঐতিহাসিক ঘটনার গল্প, সব মিলিয়ে লর্ডস ট্যুরের চেয়ে ওভাল ট্যুর বেশী ভালো লেগেছিল
আমাদের। আমাদের নিয়ে যাওয়া হয়ে বিবিসি এবং স্কাইয়ের রেকর্ডিং বক্সে। সেখানে যে
চেয়ারে বসে ম্যাচের শুরুতে বা ব্রেকের সময় আলোচনা করেন নাসের হুসেন বা ডেভিড
গাওয়াররা সে চেয়ারে বসার সুযোগও জুটে গেছিল।
অ্যাওয়ে ড্রেসিংরুমের একটা মজার জিনিস হল দেওয়ালের গায়ে বিভিন্ন দেশের
খেলোয়াড়দের সাক্ষর। সেখানে খুঁজে খুঁজে রাহুল, কোহলি, পুজারাদের খুঁজে পাওয়া গেল।
ঐ রিসেপশানের
ভদ্রলোকও আমাদের সঙ্গেই ঘুরছিলেন। ট্যুর শেষে তাঁকে মনে করিয়ে দিলাম আমাদের
লাইব্রেরি ট্যুরের কথা। ভদ্রলোক মিনিট দশেক টাইম চেয়ে নিলেন। কিছুই না, ওভালের
স্যুভেনির স্টোরটা খুলেছেন। যদি কেউ কিছু কেনে। সেখানে একটা মজার ঘটনা ঘটেছিল।
আমি আর শ্রেয়সী
দোকানের মধ্যে ঘুরে বেড়াচ্ছি। আরো দু-একজন কেনাকাটা করছে। এমন সময় একটি লোক এসে
হাজির। তিনি আমাদের ট্যুরগ্রুপে ছিলেন না। বাইরে থেকে এসেছিলেন, এসে মোজা খোঁজ
করলেন। তাঁকে জানানো হল যে মোজা নেই। যখন চলে যাচ্ছেন তখন আমার কী মনে হল, গিয়ে
বললাম, “Excuse me, are you Mohammad Ashraful?”
“Ji…”
“ওহ দাদা, আপনি এখানে!”
“আপনে কি বাংলাদেশ থেকে?”
“না না, আমরা ইন্ডিয়া থেকে।
তবে আপনাকে চিনি।”
আরো টুকটাক কথা হল। বলল, লন্ডনে
নাকি ছুটি কাটাচ্ছে। আশরাফুলের সঙ্গী ভদ্রলোক ছবি তুলে দিলেন। অটোগ্রাফ নেওয়াও হল।
পরে শ্রেয়সীর কাছে শুনলাম যে, ও যখন পেন নিতে গেছিল ঐ রিসেপশানের লোকটি নাকি জিজ্ঞেস
করেন, “Who is he?” আশরাফুল শোনার পর তাঁর বক্তব্য, “What a fool I am” পরে উনি নিজে
গিয়েও কথা বলেছিলেন।
এইসব করে আমরা গেলাম ওভালের
লাইব্রেরিতে। ভেতরে একটা ঘরে প্রায় চার দেওয়াল জোড়া ছাদ সমান আলমারি ভর্তি ক্রিকেটের
বই, একটা আলমারিতে শুধুই উইজডেন অ্যালামন্যাক। এরকম লোভ খুব কম হয়েছিল। যাই হোক সেটার
লাগোয়া ঘরটি আরো ভালো। বিভিন্ন মেমেন্টোতে ভর্তি, দেওয়ালে দ্রুষ্পাপ্য ছবি, খবরের কাগজের
কার্টুন, আলমারিতে বিভিন্ন ম্যাচের স্মৃতিতে রাখা ব্যাট, বল, সরঞ্জাম। একটি বহু পুরনো
লোহার ২২ গজ মাপার দড়ি। তার সঙ্গে সঙ্গে ঐ ভদ্রলোকের সঙ্গে ক্রিকেট আর সারের পুরনো
খেলোয়াড়দের নিয়ে আলোচনা। এসবে খুশি হয়েই বিশেষ করে কেন ব্যারিংটনের প্রসঙ্গে ওনার টেস্ট
ব্যাটিং গড় ৫৮ বলে দেওয়ায় ভদ্রলোক আমাদের সঙ্গে নিয়ে গিয়ে আরো কিছু বিশেষ জায়গা ঘুরিয়ে
দেখালেন। বিশেষ করে খেলোয়াড়দের লাঞ্চ করার জায়গা। সেখানে আবার জ্যাক হবসের শততম ফার্স্ট
ক্লাস শতরান উপলক্ষে বিশেষ একটি প্লেক রাখা আছে। তার সঙ্গে শ্রেয়সীকে দিলেন নিজের ফোনে
সেভ করে রাখা রাহুল দ্রাভিডের একটি বিশেষ ছবি, ওনার নিজের সংগ্রহ থেকে।
ওভালের এই
অসাধারণ অভিজ্ঞতার পুরো কৃতিত্বই অবশ্য শ্রেয়সী নিয়ে গেল। বলল, “দেখলে! আমার জন্য
দেরি হল বলেই তো এরকম স্পেশাল প্রাইভেট ট্যুর পেয়ে গেলে!”
বিধিসম্মত
সতর্কীকরণঃ ভবিষ্যতে আপনারাও এই ধরনের বিশেষ অভিজ্ঞতার জন্য দেরি করতে হলে নিজ
দায়িত্বে করবেন।
ওভালের ঘোরাঘুরির
পর খিদে পেয়েছিল। ভক্সহল ব্রিজের কাছে একটা ছোট্ট রেস্টুরেন্টে ঢুকে ব্রিটিশ
স্টাইলে চিকেন আলা কিভ আর ফিস অ্যান্ড চিপ্স খাওয়া হল। তারপর সাবওয়েতে ঢুকে কার্ডে
টাকা ভরিয়ে আমরা চলে গেলাম সাউথ কেন্সিংটন স্টেশানে। উদ্দেশ্য ন্যাচারাল হিস্ট্রি
মিউজিয়াম এবং ভিক্টোরিয়া অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে যাওয়া। দুটোই বেশ ভালো
লেগেছিল।
দুটোই বেশ বড়
মিউজিয়াম, সুতরাং আমরা সময়ের অভাবে পুরোটা দেখে উঠতে পারিনি। ন্যাচারাল হিস্ট্রি
মিউজিয়ামের প্রাণীতত্ত্ব আর ডাইনোসর বিভাগটা দেখেছিলাম ভালো করে। প্রচুর ফসিল তো
আছেই তার সঙ্গে আছে প্রচুর নোটস এবং অডিও-ভিসুয়াল মাধ্যমে দেওয়া প্রচুর তথ্য।
বাচ্চাদের মনের মত জিনিস। সঙ্গে একটা বিশাল বড় টাইর্যানোসরাস রেক্সের মুভিং মডেল।
ভিক্টোরিয়া
অ্যান্ড অ্যালবার্ট মিউজিয়ামে আরো একটু বেশী সময় ছিলাম। দেখেছি বিভিন্ন দেশের বহু
ঐতিহাসিক জিনিস। মূর্তি, ছবি, গ্লাস পেন্টিং, ফ্রেস্কো। সব জিনিসের লিস্ট দেওয়া
সম্ভব নয়। শুধু বলে রাখি এই মিউজিয়ামের মোট গ্যালারীর সংখ্যা ১৪৫ এবং মোট
দ্রষ্টব্যের সংখ্যা প্রায় ২৩ লাখ! তার মধ্যেও ব্রিটিশ এবং রোমান গ্যালারিগুলো মনে
আছে। আর মনে আছে মিউজিয়ামের পেছনের বাগানটা। যাই হোক সেসব দেখে
এবং ছবি তুলে আবার সাবওয়েতে ঢুকে টিউব নিয়ে আমরা এলাম পিকাডিলি সার্কাস বা ফেলুদার
ভাষায় পিকলি সার্কাসে।
সেখানে রাস্তার মধ্যিখানে আন্টেরসের
মূর্তি আর ফোয়ারার নিচের ধাপে বসা হল। চারদিকে বিভিন্ন দেশের মানুষ! কেউ আড্ডা মারছে,
কেউ নিজের মোবাইলে ব্যস্ত, কেউ ছবি তুলছে ঘুরে ঘুরে, কেউ আবার অনেক ঘোরার পরে শুধুই
বসে আছে। হঠাৎ দুটো বাচ্চা ছুটে চলে এল, তাদের হাসি আর চিৎকারে জমে উঠল জায়গাটা। অনেকদিন
পর দেখা হল দুই বন্ধুর! তাদের হাসি আর টুকরো টুকরো কথা! আবার কয়েকজন বসেছে তাদের গিটার
নিয়ে। গান শুনিয়ে যেটুকু পাওয়া যায়! সব মিলিয়ে আদর্শ ল্যাদের পরিবেশ। সামনে একটি মহিলা
স্ট্যাচু সেজে দাঁড়িয়েছিল। সেটা বেশ মজার জিনিস। লন্ডনের অনেক জায়গাতেই এটা দেখলাম।
দোকানপাটের বিবরণ আর কী দেব।
কতরকমের যেসব দোকান! আবার পাশেই ১৮৭৪ সালে তৈরি হওয়া ক্রাইটেরিয়ান থিয়েটার। কিছুক্ষণ
সেখানে বসে এবং জনসমুদ্র দেখে, একটা ক্যাফেতে রাতের খাবার খেয়ে ম্যাপ দেখে আমরা গ্রীন পার্কের মধ্যে দিয়ে শর্টকাট
খুঁজে হাঁটা লাগালাম পাবলাভের দিকে। এখানেই একটা মজা হয়েছিল।
সন্ধ্যেবেলা গ্রীন পার্ক, ভালোই
লোকজন ছিল। তার মধ্যে দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে আমি আর শ্রেয়সী ঠিক করলাম আমাদের বন্ধু কৌশিক
আর ওর বউ অপরূপাকে ফোন করে একটূ গল্প করব। সেই মত ভিডিওকল করা হল। দেশে তখন রাত সাড়ে
বারোটা মত বাজে। দিব্যি আড্ডা হচ্ছে। আমরা কৌশিকদের এখানকার সুন্দর সুন্দর প্যালেসের
মত বাড়ীগুলোর কথা বলছি। মাঝে মাঝে ক্যামেরা ঘুরিয়ে পার্কটা দেখাচ্ছি। এসব করতে করতে
পার্কের প্রায় অন্যপ্রান্তে পৌঁছে দেখি সামনেই একটা বেশ বড় দারুণ দেখতে বাড়ী। আমি কৌশিককে
বললাম, “দাঁড়া, সামনে আরো একটা বেশ বড় বাড়ী দেখতে পাচ্ছি, কী জানি না, তোদের দেখাই!”
এই বলে ক্যামেরা ঘুরিয়ে বাড়ীর সামনে এসে দেখলাম শুধু বাড়ী নয়, সেটা ঘিরে পাঁচিল, তার
সামনে একটা বেশ উঠোনের মত জায়গা, সেটার সামনে আরো একটা বেশ বড় ফোয়ারা আর মূর্তি এবং
পুরো জায়গাটায় প্রচুর লোক, প্রধানত ট্যুরিস্ট। তখন ভালো করে দেখে ওদের বললাম, “ওরে
এটা যেকোন বাড়ী নয়। এটাই হল বাকিংহাম প্যালেস! মানে যাকে বলে রাণীর বাড়ী!
ভিডিওকলে ওদের ভালো করে বাকিংহাম
প্যালেস দেখিয়ে আমরা আরো কিছুক্ষণ ওখানে ঘোরাঘুরি করলাম। এটা যে পাবলাভের খুব কাছেই
সেটা জানতাম কিন্তু প্ল্যান ছিল পরে একদিন আসার। শেষ অবধি বোধহয় বার চারেক আসা হয়েছিল
বাকিংহাম প্যালেসের সামনে। প্যালেসের চেয়েও সামনের ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়ালের মূর্তিগুলো
বেশী ভালো লেগেছিল। হ্যাঁ লন্ডনেও একটা ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল আছে! পুরো মনুমেন্টের
ওপরে দাঁড়িয়ে আছে একটা সোনালী পরী আর ভিক্টোরিয়ার মূর্তিটা তো পুরো কলকাতায় যেটা আছে
সেটারই কপি!
No comments:
Post a Comment