Monday, January 30, 2017

বইমেলার বন্ধু

বইমেলায় 'কষে কষা'র লাইনে দাঁড়িয়ে শ্যামলবাবুর সঙ্গে ঈশ্বরের দেখা হল!

পাঠক, ঈশ্বর বলতেই যদি আপনার মনে হয় যে, তাঁর চেহারায় ক্যালন্ডারের ছবির মত জটাজুট, পরণে বাঘছাল বা হাতে শঙ্খ-পদ্ম-গদা-চক্র থাকবে তা হলে আপনি ভুল করছেন। শ্যামলবাবু যাকে দেখলেন তার মোটাসোটা মাখন-মার্কা চেহারা, মাথার সামনের দিকের চুল পাতলা হয়ে এসেছে, সরু গোঁফ। পরণে ঢোলা স্ট্রাইপ শার্ট আর কালো প্যান্ট। একটা বইয়ের দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে জুলজুল করে তাঁকেই দেখছিল লোকটা। চোখাচুখি হতেই রহস্যজনকভাবে ফিক করে হাসলো। তারপর সোজা শ্যামলবাবুর সামনে এসে বলল, "বাড়িতে তো সকাল থেকে চার-চারবার কমোড দিয়ে জল বয়ে যাওয়ার পর বউয়ের কাছ থেকে চেয়ে নরফ্লক্স খেলেন! আর এখানে ছেলে-বউকে আনন্দের লাইনে দাঁড় করিয়ে দিয়ে নিজে পোলাও-মাংস খাওয়ার ধান্দা করছেন?"
শ্যামলবাবু প্রথমেই চমকালেন। এই দুটো খবরের কোনটাই কারো জানার কথা নয় যদি না ওঁর বউ সঙ্গীতা বা ছেলে নন্টে কাউকে বলে থাকে! পরেরটা তো ছেলে-বউও জানে না! ওনার ভ্যাবাচাকা মুখের দিকে তাকিয়ে লোকটা বলল, "ও কিছু নয়। আপনাদের সব খবরই রাখি। দুটো ফিশফ্রাই কিনে আনুন আমি দুটো চেয়ারের ব্যবস্থা করি। আর হ্যাঁ, আমার প্লেটে একটু বেশী করে কাসুন্দি নেবেন তো!"
শ্যামলবাবু মন্ত্রমুগ্ধের মত দুটো ফিশফ্রাই কিনে এদিকওদিকে তাকিয়ে দেখতে পেলেন লোকটা দুটো লাল প্লাস্টিকের চেয়ারে যোগাড় করে তাঁকে হাত নেড়ে ডাকছে। চেয়ারে বসে ওনার হাত থেকে ফিশফ্রাইয়ের প্লেটটা নিয়ে লোকটা বলল, "তারপর?"
"আপনি কে?"
"ওহ্‌ বলা হয়নি।" লোকটা ফিশফ্রাইতে একটা কামড় বসিয়ে চিবোতে চিবোতে নিজের হাতটা এগিয়ে দিল, " আমার নাম ঈশ্বর। ভগবানও বলতে পারেন। দুর্গা-কালী-যিশু-মহম্মদ, ওসব দিকে না হয় নাই গেলেন..."
"আপনি ঈশ্বর! বাজে কথা বললেই হল!"
"বাজে কথা কেন বলব বলুন? দেখছেন তো আপনার হাঁড়ির খবর রাখি। ফোনে কোথায় কী অ্যাপ আছে, পার্সে কত খুচরো আছে, ব্যাঙ্কে কটা এফডি আছে, সব চাইলে বলে দেব। আরে মশাই, আপনাকে আপনার ছোটবেলা থেকে দেখছি। আগে নিজে বাপ-মার হাত ধরে আসতেন, এখন নিজের ছেলের হাত ধরে এসেছেন! তবে কী অধঃপতন! ছ্যা ছ্যা!"
শ্যামলবাবু বেকুবের মত বললেন, "আপনাকে তো আমার বয়সীই মনে হচ্ছে। আমার ছোটবেলাতে তো আপনিও ছোট ছিলেন নিশ্চয়ই!"
"দুর মশাই! বললাম না, আমি হলাম ঈশ্বর। বয়সের যাকে বলে ট্রি-স্টোন নেই! চোখের সামনে মিল্কি ওয়ে টোয়ে তৈরি করলাম! এইসব জলা জমিতে যখন গোদা গোদা ডাইনোসররা ঘুরে বেড়াতো তখন আমার যৌবন। যাকগে, আপনার সঙ্গে আমার কথা আছে।"
শ্যামলবাবুকে বিধ্বস্ত করে দিয়ে লোকটা মনের সুখে ফিশফ্রাই খেতে লাগল। ফিশফ্রাই শেষ করে হাতের কাগজের প্লেটটাকে গোল্লা বানিয়ে নিখুঁত নিশানায় সেটাকে একটা ডাস্টবিনের মধ্যে ফেলে লোকটা বলল, "ভালোই বানিয়েছে। স্বর্গীয় স্বাদ!"
তারপর শ্যামলবাবুর দিকে ঘুরে লোকটা বলল, "ডারউইনের বিবর্তনের থিওরিতে তো বাঁদর থেকে মানুষ হয়েছিল। তা আপনি এরকম উলটো বিবর্তনে মানুষ থেকে বাঁদর হলেন কী করে?"
"মানে?" শ্যামলবাবু এবার একটু রেগেই গেলেন।
"মানে? কিছু বুঝছেন না, তাই না? দাঁড়ান, একে একে বলি।" লোকটা একটা মিচকে হেসে শুরু করল, "সেই ছোটবেলায় আসতেন, তখন বইটই কিনতেন সেটা দেখেছি। গোটা পাঁচেক টিনটিন, তিনটে অ্যাস্টেরিক্স, কাকাবাবু সমগ্রের ফার্স্ট পার্ট এগুলো তো সব বইমেলা থেকেই কেনা। আপনার বাবাও বই ভালোবাসেন। আপনাকে ঘুরে ঘুরে 'লাল-কালো', পরশুরাম সব কিনে দিতেন। তারপর..."
লোকটা একটু থামল, তারপর শ্যামলবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, "আপনি পেকে গেলেন। কলেজের বন্ধুদের সঙ্গে এসে আঁতলামি শুরু করলেন। বইয়ের দোকানে যাওয়া নেই। বই হাতে নিয়ে দেখা তো ছেড়েই দিলাম। শুধু মাঠে বসে শুধু গুলতানি আর গাঁজা-সিগ্রেট খাওয়া! একবার তো বোধহয় কোন একটা স্টলে গিয়ে একগাদা যৌন উত্তেজক বই নিয়ে নিজেদের মধ্যে খ্যাক খ্যাক করে হেসেছিলেন! সব নোট করে রেখেছি মশাই!"
শ্যামলবাবুর মুখটা ক্রমেই বিবর্ণ হয়ে যাচ্ছিল। লোকটার কিন্তু তখনও শেষ হয়নি। আবার শুরু করল, "আর এখনকার কথা আর কী বলব! আপনি তো এখন মস্ত বিজ্ঞ লোক! সারা বছর কাজের চাপে নাকি কলেজ স্ট্রিটের রাস্তা মাড়ানোর সময় পাননা, এদিকে বইমেলায় বাতেলা ঝাড়েন যে, কলেজ স্ট্রিটে বেশী ডিসকাউন্ট পাবেন তাই এখানে কিনবেন না! আর এইসব ছোট-মাঝারি প্রকাশনাগুলো লস্‌ করে বন্ধ হয়ে গেলে আবার বাংলা সংস্কৃতি মৃতপ্রায় বলে নাকি কান্না গাইবেন!"
"বইমেলায় এসে বই কেনেন না, কিন্তু গেলা চাই। যেন সাতদিন খেতে পাননি। গত বছর দেখলাম বইমেলায় বসে বিরিয়ানি খাচ্ছেন! আরে মশাই বিরিয়ানি খাবেন তো আর্সালান যান, রয়্যাল যান, তেমন হলে খিদিরপুরের ইন্ডিয়া রেস্টুরেন্টে গিয়ে কাচ্চি বিরিয়ানি খেয়ে আসুন! বইমেলায় কেন? এদিকে বিরিয়ানির দোকানের পাশে লিটল ম্যাগাজিনের স্টলগুলোয় যাওয়া তো দুরের কথা, তাকিয়ে অবধি দেখলেন না!"
"মানে, এতক্ষণ ঘুরলে খিদে তো একটু পাবেই..." মিনমিন করে বলার চেষ্টা করলেন শ্যামলবাবু।
"ওহ্‌, তাই বুঝি? তা অনেকক্ষণ টিভি মিস করেন বলেই কি গতবছর ওই টিভি চ্যানেলের স্টলে দাঁড়িয়ে ওদের সিরিয়ালের হিরোইনের গয়নাগুলো আসল না সিটি গোল্ড সেই নিয়ে দশ মিনিট তর্ক করছিলেন? আর শুধু তো গয়না নয়, আপনার মনের ভেতরে আর কী কী জিনিস আসল না নকল নিয়ে তর্ক করছিলেন, সেটা বলে দিলে তো আপনার গিন্নি আপনাকে বঁটি নিয়ে তাড়া করবে মশাই!"
"এটা আপনার অন্যায়, ভগবান হয়েছেন বলে এত খুঁতখুঁতানি ভালো নয়।" শ্যামলবাবু শেষ চেষ্টা করলেন।
লোকটাও হেসে বলল, "দেখুন একটা কথাই বলছি। বইমেলায় এসে সব দেখুন। টিভি চ্যানেলের স্টল, কফিমাগ, টিশার্ট, ছবি, মূর্তি সব দেখুন। গান শুনুন, যা ইচ্ছে খান। কিন্তু বইটাও কিনুন। আপনি তো বই ভালোবাসতেন মশাই। আপনার সব নন্টে-ফন্টেগুলো বন্ধুরা নিয়ে ফেরত দেয়নি বলে যেদিন বিকেলবেলা আপনি মন খারাপ করে ছাদে বসেছিলেন আমিও ধারেকাছেই ছিলাম।"
"এটা তো বইমেলা, এখানে বইয়ের জন্য আসুন। আরো তো হাজারটা মেলা হয় শহরে। তার কোথাও একটা বইয়ের দোকান তো চোখে পড়ে না আমার। এই মেলাটা আলাদা। এই মেলাটা সবার, কিন্তু বইকে ভুলে যাবেন না।" লোকটা উঠে পড়ল। হতবাক শ্যামলবাবুর দিকে তাকিয়ে বলল, "নাহ্‌ কাটলাম। আপনার বউ আর ছেলে আপাতত আনন্দের টাকা দেওয়ার লাইনে। আপনি যেতে যেতে ওদের বই কেনা হয় যাবে!"
তারপর শ্যামলবাবুকে কিছু বলার সুযোগ না দিয়েই ভিড়ের মধ্যে মিশে গেলেন ঈশ্বর।

শ্যামলবাবু নিজের হতভম্ব ভাবটা কাটিয়ে হাঁটা লাগালেন আনন্দের স্টলের দিকে। শেষ দশ মিনিটে যে কী হল সেটা কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না তিনি। হঠাৎ কী মনে হল, একটা স্টলে ঢুকে পড়লেন। ছোট স্টল, সব রকম বইই বিক্রি হচ্ছে। সেখান থেকে নন্টের জন্য শীর্ষেন্দুর 'কিশোর উপন্যাস সমগ্র' কিনবেন বলে ঠিক করে ফেললেন তিনি। তখনই শুনতে পেলেন একটা কথোপকথন,
"দাদা, আর টাকা নেই না?"
"কী করে থাকবে? তোকে পই পই করে বললাম, 'কমিক্স সমগ্র'টা এ বছর কিনতে হবে না।"
"খুব লোভ হল তো! দ্যাখ না দাদা, কিছু ম্যানেজ করে। যদি পরে একদিন এসে কেনা যায়।"
"না রে, মা অনেক কষ্ট করে এই টাকাটা দিয়েছে। জানিসই তো সব... আর চাওয়া যাবে না।"
শ্যামলবাবু তাকিয়ে দেখলেন দুই কিশোর। একজনের বয়স পনেরো-ষোল, অন্যজন আরো কম। ছোটজনের হাতে একটা শীর্ষেন্দুর 'কিশোর উপন্যাস সমগ্র', ঠিক যে খন্ডটা শ্যামলবাবুও দেখছেন। কাঁচুমাচু মুখে বইটা নামিয়ে রাখল সে। আস্তে আস্তে এগিয়ে গেল বেরনোর দরজার দিকে।
মুহূর্তের মধ্যে শ্যামলবাবু ঠিক করে ফেললেন, কী করবেন। দু মিনিটের মধ্যে দোকান থেকে বেরিয়ে একটু পা চালিয়েই সামনে ছেলে দুটিকে দেখতে পেলেন। দৌড়ে গিয়ে তাদের ধরে ফেললেন শ্যামলবাবু। বললেন, "আরে তোমাদেরই তো খুঁজছি!"
"কী ব্যাপার?" বড় ছেলেটি ভয় ভয় বলল।
"আরে ওই যে লাস্ট দোকানটায় ঢুকেছিলে, আমি ওদের স্টাফ। আজকে স্পেশাল কনটেস্ট চলছে তো। কিছু কিছু লাকি পাঠকদের আমরা বই গিফট করছি। তোমরা আজকে আমাদের স্টলের পাঁচশতম পাঠক। এই নাও তোমাদের গিফট।" বলে ছোট ছেলেটির হাতে একখানা শীর্ষেন্দুর 'কিশোর উপন্যাস সমগ্র' ধরিয়ে দিয়ে হাঁটা লাগালেন শ্যামলবাবু। ছেলেদুটোর হতভম্বভাব দেখে ভালোই লাগছিল তাঁর। আজকে তিনিও হতভম্ব কম হননি! এবার ওটার অন্য কপিটা নন্টেকে দিতে হবে!

শ্যামলবাবু খেয়াল করলেন না, তাঁদের ঠিক পাশেই ল্যাম্পপোস্টের তলায় বসে ছবি আঁকতে আঁকতে ঈশ্বর মুচকি হাসলেন!
"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”