Saturday, December 24, 2016

Dangal - Quick Thoughts

Dangal is one of those intense sports dramas which keeps you on the edge for most of the time during the film. I think for general public this movie will have more impact regarding the intensity of wrestling than the medals we won because sadly not many follow wrestling despite the multiple medals in last three Olympics. This one is probably the best movie of this year and a must watch.
But don't go to theater thinking this is Aamir Khan's movie. More than Aamir Khan this movie belongs to Zaira Wasim, Sanya Malhotra, Fatima Sana Shaikh and Suhani Bhatnagar. Way to go girls! I will look forward to more such portrayal  from you (As a matter of fact, I am already looking forward to 'Secret Superstar' starring Zaira, the trailer was shown before Dangal in the theater).
P.S. Once this movie becomes a hit which I think it will be, I can foresee a group of Facebook naysayers will come out to bash the movie because it shows how a father forced (at times reaching almost a stage of torture) his daughters to realize his dreams, which is actually a complete opposite storyline of another Aamir Khan movie 'Tare Zamin Par'.
But I guess this is life with all its good, bad and ugly faces and we should just move on. Ohh by the way, watch this movie while you are moving on!
(Source: Internet)

Wednesday, December 21, 2016

দরজা ভাঙ্গার গল্প

এমনিতে দেখতে গেলে ভিভিএস লক্ষণ আর রবীন্দ্র জাদেজার মধ্যে খুব বেশী মিল খুঁজে পাওয়া যাবে না। শুধু খেলার ধরণে নয় মাঠের বাইরেও দুজনের মধ্যে অনেক অমিল। তবে একটা জায়গায় গিয়ে দুজনেই যেন এক হয়ে গেছেন!
১৯৯৯ এর পাকিস্তান সিরিজ আর এশিয়ান টেস্ট চ্যাম্পিয়ানশিপের পর লক্ষণকে ভারতীয় দল থেকে বসিয়ে দেওয়া হয়েছিল। হবে নাই বা কেন! তখনও অব্ধি ১৬টা টেস্টে লক্ষণের মোট রান ৬২৬। গড় ২৮। সর্বোচ্চ ৯৫।
দল থেকে বাদ পড়ার পরে লক্ষণ কিন্তু হতাশ হয়ে বসে ছিল না! ১৯৯৯-২০০০ সালের রঞ্জি ট্রফিতে বিপক্ষদের ওপরে রাগ মিটিয়েছিল (যদিও লক্ষণের রেগে যাওয়াটা খুবই বিরল ঘটনা, প্রজ্ঞান ওঝা জানে) নটা ম্যাচে আটটা শতরান সহ ১৪১৫ রান করে। এ যেন নির্বাচকদের দরজায় নিজের অন্তর্ভুক্ততির জন্য ধাক্কা দেওয়ার বদলে দরজাটাই ভেঙ্গে ফেলা।
ফলস্বরুপ আবার দলে ২০০০ সালের অস্ট্রেলিয়া সফরে। তৃতীয় টেস্টে সিডনিতে অজিদের ঠেঙ্গিয়ে ১৬৭। আর তার বছর খানেক পরে অস্ট্রেলিয়ার ফিরতি ভারত সফরে ইডেনে ২৮১। বাকিটা ইতিহাস।

গত বছর জাদেজাকে দেখে লক্ষণের কথা মনে পড়ছিল। ২০১৫ সালের শুরুতে অস্ট্রেলিয়া গেলেও কোন টেস্টেই চান্স পায়নি। বিশ্বকাপের পরে তো বাদই পড়ে গেল। বাংলাদেশ, শ্রীলংকা পর পর দুটো সিরিজে জায়গা পেল না দলে। অমিত মিশ্র দলে ফিরে এল, কর্ণ শর্মা টেস্ট খেলে ফেলল। জাদেজা তখন শুধুই আইপিএল স্টার (শ্যেন ওয়ার্নের ভাষায় 'রকস্টার') আর স্যার জাদেজা হিসেবে সোসাল মিডিয়ায় বিখ্যাত।
সূত্রঃ ইন্টারনেট
২০১৫-১৬ সালের রঞ্জিতে জাদেজা ফিরে এল। ফিরে আসার নমুনা হচ্ছে, সৌরাষ্ট্রের প্রথম তিনটে ম্যাচে ৩৭টা উইকেট, ত্রিপুরার বিরুদ্ধে ৯১, ঝাড়খন্ডের বিরুদ্ধে ৫৫। তিনটে ম্যাচেই সৌরাষ্ট্রকে জিতিয়ে 'প্লেয়ার অফ দ্যা ম্যাচ'। প্রথম চারটে ম্যাচেই জাদেজা ৩৮টা উইকেট আর ২১৫ রান করে বসে রইল। তখনই মনে হয়েছিল যে, এই ছোকরাও দরজা ভাঙ্গছে। যথারীতি দক্ষিণ আফ্রিকার বিরুদ্ধে জাদেজাকে দলে ফেরাতে বাধ্য হলেন নির্বাচকেরা।
ফিরে এসে প্রথম টেস্টেই আট উইকেট যার মধ্যে দ্বিতীয় ইনিংসে পাঁচ উইকেট নিয়ে ১০৯ রানে প্রোটিয়াসদের মুড়িয়ে দেওয়া। ফলস্বরুপ ম্যান অফ দ্যা ম্যাচ। তারপর সেই ফর্মই চলছে। ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে দলে ফিরে তার পরে ঘরে-বাইরে মিলে ১৩টা টেস্টে ৬৬টা উইকেট নিয়েছে স্যার জাদেজা, সঙ্গে ৪৮৪ রান। নিজের প্রথম বারোটা টেস্টে জাদেজার ব্যাটিং গড় ছিল ২১.৪১ এবং বোলিং গড় ৩০.৩৭। আর শেষ তেরটা ম্যাচে সংখ্যাগুলো যথাক্রমে ৩২.২৬ আর ১৯.৭৭। এই ইংল্যান্ড সিরিজেই জাদেজার উইকেটের সংখ্যা ২৬, রান ২২৪। এই সিরিজে আট নম্বরে নেমেও দুবার পঞ্চাশ করে নিজের ট্রেড মার্ক ব্যাট ঘুরিয়ে দেখিয়েছে সে!
সূত্রঃ ইন্টারনেট
আর চেন্নাই টেস্টের কথা তো ছেড়েই দিলাম। জাদেজা প্রথম খেলোয়াড় যে একই টেস্টে একটা পঞ্চাশ, দশ উইকেট আর চারটে ক্যাচ নিল। শেষ দিনে জাদেজার বোলিং একটা অন্য পর্যায় চলে গেছিল! আর তাই রবিচন্দ্র আশ্বিন উইকেট না পেলেও গোটা ইংল্যান্ড দলকে দুটো সেশনে উড়িয়ে দিতে ভারতের অসুবিধা হয়নি।
এই মুহূর্তে ভারতের হয়ে যারা অন্তত ২০০০ বল করেছেন তাঁদের মধ্যে টেস্টে সর্বকালের সেরা বোলিং অ্যাভারেজ কিন্তু রবীন্দ্র জাদেজারই। ইকনমি রেটের দিক দিয়েও বেশ ওপর দিকেই আছে সে।

সুতরাং লক্ষণের মতই স্যার জাদেজাও যে ভারতীয় ক্রিকেটের জন্য আরো অনেক ইতিহাস রচনা করবে সেই আশা করাই যায়! কারণ নির্বাচকদের দরজা ভাঙ্গার কাজটা সে করে ফেলেছে!

Thursday, September 8, 2016

ট্যাক্সি কাহন

***১***

সকালে অফিস যেতে গিয়ে এমনিতেই বেশ দেরি হয়ে গেছিল
অনেক কষ্টে বেশ কিছুটা ছোটাছুটি করে একজন ট্যাক্সিওয়ালাকে সল্টলেক নিয়ে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে রাজী করিয়ে সস্ত্রীক তাঁর ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম। আমাদের মাথার ওপরে বসেরা আছেন, তাই আমাদের অফিস যাওয়ার তাড়া আছে। কিন্তু উনি মুক্ত পুরুষ, তাই ওনার কোন তাড়া নেই। আমরা বসার পর ভদ্রলোক একটা হাই তুললেন, তারপর আড়মোড়া ভাঙলেন। তারপর যেই আমরা আশাবাদী হচ্ছি যে, উনি এবার ইঞ্জিনটা স্টার্ট করবেন তখনই ফস্‌ করে একটা ধূপকাঠি জ্বালালেন। তারপর ভক্তি ভরে দেড়খানা হাতে (এক হাতে ধূপ, অন্য হাত সেই হাতের কনুইয়ে) উনি ধূপ দেখাতে লাগলেন। প্রথমে ট্যাক্সির মিটারকে প্রায় ৩০ সেকেন্ড! তারপর কালীঘাটের মাকালীর ছবিতে, হনুমানজির মূর্তিতে, তাদের পেছনে রাখা কিছু মাদুলি-তাবিজকে, স্পিডোমিটার আর ফুয়েল ইন্ডিকেটরকে এমনকি স্টিয়ারিংটাকেও ধূপ দেখাবার পর যখন বুঝে গেছি যে এবার আমাকে আর গিন্নিকেও ধূপটা দেখিয়ে ছাড়বেন ভদ্রলোক তখন আমার স্বপ্নে জল ঢেলে ভদ্রলোক ধূপটা মিটারের নিচে গুঁজে দিয়ে গাড়ী স্টার্ট করলেন!
দুগ্‌গা দুগ্‌গা!!

***২***

জন্ম-মৃত্যু-বিবাহের মতই জীবনের আর এক সত্য হল ট্যাক্সি রিফিউজাল! এই কলকাতা শহরে দাঁড়িয়ে কেউ যদি বলেন যে, তিনি জীবনে কখনো কলকাতার ট্যাক্সিওয়ালাদের কাছে ‘যাবো না’ কথাটি শোনেননি তাহলে তাঁকে কালটিভেট করুন কারণ এরকম নির্ভেজাল গুল দেওয়ার ক্ষমতা ভগবান খুব বেশী লোককে দেননি।
কলকাতার ট্যাক্সিওয়ালারা কোথায় যেতে চাইবেন সেটা অনেকটা ওই গেছোদাদা কোথায় থাকবেন সেটার মতই জটিল। মানে ধরুন সল্টলেকের অফিস থেকে বেরিয়ে আপনি যেতে চাইলেন শ্যামবাজার কিন্তু মাঝবয়সী ট্যাক্সিচালক পাটুলি ছাড়া যাবেন না। কিন্তু যেদিন পাটুলি যেতে চাইবেন সেদিন তাঁরা পাটুলিকে গণ্ডগ্রাম বলে বাতিল করে দিয়ে যেতে চাইবেন এয়ারপোর্ট! কলকাতার এই কোটি কোটি মানুষকে ট্যাক্সিওয়ালারা ধর্তব্যের মধ্যেই ধরেন না তাই দিনের মধ্যে যেকোন সময়ে যেকোন জায়গাতে যেতে হলেই বলেন, “না দাদা, ওদিকে প্যাসেঞ্জার পাওয়া যাবে না, যাব না।”
"নেহি যায়েগা... উবার বুলা লো!"
সূত্রঃ ইন্টারনেট
মাঝে মাঝে খুবই গিল্টি ফিলিং হয় জানেন তো। এই যে ভদ্রলোক একটা চকচকে হলুদ রঙের ট্যাক্সি নিয়ে কলকাতার বিভিন্ন ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে বসে চা খেতে আর প্রকৃতির শোভা দেখতে বেরিয়েছেন তাঁকে দৈনন্দিন পনেরো ঘন্টা বিশ্রামের মধ্যে যখন আমাকে নিয়ে পাচন গোলার মত মুখ করে শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যেতে হয় তখন সত্যি বলছি নিজেকে খুবই ছোট মনে হয়।
তবে ট্যাক্সি নিয়ে আসল কথাটা বোধ হয় চন্দ্রিল লিখে গেছেন। ট্যাক্সিচালকের রিফিউজালের হতাশা আর বিরক্তি থেকে আপনি যদি কোনদিন বলে ফেলেন, “চলুন দাদা, আজকে আপনার বাড়ি যাব।” তাহলে ট্যাক্সিচালক দাদা একগাল হেসে বলবেন, “না দাদা, আজকে আমি মামার বাড়ি যাব!”

***৩***

ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সঙ্গে গল্প নিয়ে বেশ কিছু ভালো গল্প আছে স্টকে। তার কয়েকটা বেশ মজার আবার কয়েকটা মন ভালো করে দেওয়া গল্প। বিশেষ করে আজকাল উবের-ওলার আমলে মিশুকে গপ্পোবাজ ড্রাইভারের সংখ্যা বেড়েছে বলেই মনে হয়।
একবার অফিসের বন্ধুরা বাইরে ঘুরতে গেছিলাম। ফেরার সময় হাওড়া স্টেশানে নেমে একটা উবের নিয়ে চারজন একসঙ্গে ফিরছি। ট্রেনে আমাদের এক সহযাত্রী সারা সন্ধ্যে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে আমাদের যথেষ্ট বিরক্তি এবং হাস্যরসের সাপ্লাই দিয়েছিলেন। সেই নিয়ে গল্প করছি, আগের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা হচ্ছে এমন সময়ে আমাদের আলোচনার মধ্যে নিজের নাকটা গলিয়ে উবেরের চালক বললেন, “আমি স্যার ঘুরতে যাওয়ার সময় সঙ্গে নস্যি নিয়ে যাই!”
আমাদের “নস্যি কেন?” প্রশ্নের উত্তরে ভদ্রলোক জানালেন যে, ঘুরতে গেলে, বিশেষ করে ট্রেনে রাত কাটানোর ব্যাপার থাকলে এটাই তাঁর ব্রহ্মাস্ত!
“বুঝলেন না, রাতে যদি ক্যুপে কেউ নাক ডাকে তাহলে তার নাকের কাছে নস্যি নিয়ে গিয়ে হালকা ফুঁ দিলেই সেরাতের মত ঘুমের দফারফা! এবার হেঁচে মরুক ব্যাটা!”

ভদ্রলোক আবার দাবী করলেন ওনার শেষ পুরীভ্রমনের সময় এটা নাকি হাতেকলমে ব্যবহার করে সুফল পেয়েছেন। আমাদের সকলেরই মাঝেমধ্যে নাক দেকে থাকে! তাই, এরকম ভয়ংকর সহযাত্রীর পাল্লায় পড়লে কী হতে পারে সেই ভেবে চারজনেই বেশ ঘাবড়ে গেছিলাম।

Sunday, July 24, 2016

আবার বছর চোদ্দ পরে

ছোটবেলায় প্রায় সবাইকেই ক্লাসের বাংলা স্যারেদের দাবী অনুযায়ী ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ’, এই বিষয়ে রচনা লিখতে হয়েছে। কেউ রচনা বই থেকে গাঁতিয়ে নামিয়েছে, কেউ আবার নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে পারমাণবিক শক্তির উপকারী বা ধ্বংসাত্মক দিক নিয়ে তিন-চারশো শব্দ নামিয়েছে! সে যাই হোক, এইসব লেখার অধিকাংশেরই মূল বক্তব্য হত এটাই যে সহজে বিজ্ঞানকে শুধু আশীর্বাদ বা অভিশাপ বলা যায় না। আজকাল আরোই সেটা বুঝতে পারি।
এই যে ধরুন ফেসবুক আর হোয়াটস্যাপ বলে ধাড়িদের খেলার জন্য দুটো খেলনা বানানো আছে সেগুলোর দোষগুণের তো ঘাটতি নেই। একদিকে সেগুলো লোকজনকে বানিয়ে দিচ্ছে কুঁড়ে, লোকে ফেসবুক করতে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বই থেকে, কমে যাচ্ছে মনঃসংযোগের ক্ষমতা। কিন্তু তাঁর সঙ্গে সঙ্গে এটাও অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, কোন বক্তব্য প্রচারের জন্য বা বিভিন্ন লোকের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করার জন্য ফেসবুক, টুইটার বা হোয়াটস্যাপের তুলনা নেই। বিশেষ করে স্কুলের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে।
আসলে গত সাত দিন ধরে, বালিগঞ্জ রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয় বা ‘বিজিএইচএস’এর আমাদের ব্যাচের বন্ধুরা একটা হোয়াটস্যাপ গ্রুপ বানিয়ে আড্ডা মারছি। এই অসাধারণ অভিজ্ঞতাটা  ঠিক লিখে বোঝানো খুব শক্ত! ধন্যবাদের অনেকটাই যাওয়া উচিত তমালের কাছে, গ্রুপটা খোলার জন্য এবং অবশ্যই কৌশিকের কাছে, যে ভদ্র বালক স্কুলের প্রায় সব বন্ধুদের ফোন নম্বর নিজের ফোনের কন্ট্যাক্ট লিস্টে নিয়ে বসে ছিল!
ব্যাস্‌... আর কী! বিভিন্ন বন্ধুদের অ্যাড করে সারাদিন ধরে আড্ডা চলছে। দিনে হাজার হাজার কমেন্টস! আজকাল কে কী করছে, চারদিকে কী চলছে, কে কে জীবিত বনাম কে কে বিবাহিত, যারা আরো একধাপ এগিয়ে গেছে তাদের খোকা-খুকুদের ছবি... কিচ্ছু বাদ নেই। আর স্কুলের পুরনো গল্প! কত ঘটনা, কত দুষ্টুমি, কত বাওয়াল! সেটাই তো আসল আকর্ষণ!
(ছবিটা গ্রুপে কে শেয়ার করেছিলি মনে নেই)
কোন স্যার ক্লাস নাইনে কার চুল আঁচড়ে দিয়েছিলেন, কে পাঁচিল টপকে বল আনতে গিয়ে আর ফিরতে পারেনি বলে জামা থেকে স্কুলের ব্যাচ খুলে পুরো সেকেন্ড হাফ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছিল, কবে ফিজিক্স ল্যাবে থার্মোমিটার ভেঙে পারদের বল মেঝেতে গড়াগড়ি যাচ্ছিল, কোন গল্পই বাদ নেই।
আর স্কুলের গল্পে স্যারেরা তো আসবেনই। ফ্রেন্ডলি স্যার, চাপের স্যার, স্টাইলিশ স্যার, মারকুটে স্যার, পাংচুয়াল স্যার, ভীতু স্যার, রাগী স্যার এবং হেডস্যার... কেউ বাদ যাচ্ছেন না! কোন স্যারের ডাকনাম কী ছিল, কার ক্লাসে সুদীপ্ত অজ্ঞান হয়ে গেছিল, কে পরীক্ষার আগে ৬৫টা রচনার সাজেশান দিতেন, কোন স্যারের ক্লাস মানেই ডিফেক্টিভ থার্মোমিটারের অঙ্ক করতে হত, কোন স্যার হাজরা মোড়ে টিউশানের আগে লুকিয়ে এগ রোল খেতেন, কার ক্লাস কেটে ক্রিকেট খেলা হত কিচ্ছু বাদ যাচ্ছে না!
এটা একটা পুরো অন্যরকমের আনন্দ! এক-একটা গল্প হচ্ছে আর ছোটবেলাটা যেন ঠিক চোখের সামনে আর একবার ভেসে উঠছে। সুনীলবাবুর ক্লাসে ‘মামু’ দেওয়াল লিখনের লেখক কে ছিল, সেই গল্পের সময় মনে পড়ে যাচ্ছে, সেদিনে ক্লাসের কোথায় দাঁড়িয়েছিলাম (পুরো ক্লাসকে বসতে দেওয়া হয়নি কিনা!)।
আজ স্কুল অনেক বদলে গেছে। অনেক উন্নতি হয়েছে স্কুলের। তিনতলা বিল্ডিং, সত্যজিৎ রায় সভাগৃহ, পেছনের বন্ধ থাকা ঘরগুলো নতুন করে সাজিয়ে তুলে ফাইন আর্টস সেকশান। ঐ ভাঙা বাসগুলো নেই, গোপালদার ক্যান্টিন নেই, আর নেই আমরা। আমরা এখন কেউ কলকাতায়, কেউ হলদিয়ায়, কেউ মুম্বাইতে, কেউ জার্মানীতে, অনেকেই আমেরিকায়। কিন্তু আমাদের সকলের মনের মধ্যে কোথাও একটা ‘বিজিএইচএস’ লুকিয়ে আছে। তাই সেখানে বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে, তাই সে স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে, তাই এতদিন পরেও হঠাৎ বানানো একটা হোয়াটস্যাপ গ্রুপে সবাই কাজের ফাঁকে সেই ছোটবেলার মতই আড্ডা মারে।

সবাই এখন খুব ব্যাস্ত। হয়তো কদিন পরে নতুন উৎসাহটা থিতিয়ে গেলে গ্রুপটা ঝিমিয়ে পরবে, মাঝে মধ্যে পোস্ট হবে। বেশীরভাগ সময়ই পোস্ট হবে অন্যান্য গ্রুপের থেকে ফরোয়ার্ডেড ছবি আর ভিডিও কিন্তু এই কদিনের আড্ডা বুঝিয়ে দিয়েছে যে আমরা বন্ধুরা একে অপরের থেকে খুব দূরে নেই। আর তাই যেকোন সময়ই চলে আসতে পারবো এই গ্রুপে আড্ডা মারতে ঠিক সেই যেমন স্কুলে টিফিনের সময় বা ছুটির পর সবাই মিলে চলে যেতাম বটগাছ তলায়। 

Friday, July 8, 2016

অনিলবাবুর জয়

অফিস থেকে বেশ ভয় ভয়েই বাড়ি ফিরছিলেন অনিলবাবু। একটা চাপা টেনশান আছে সকাল থেকেই। তাই ফোনের ভরসায় না থেকে একটা হাফ ছুটি নিয়ে দুপুর দুপুরই বেরিয়ে পড়েছেনআজকে রোহণ-কুনালদের স্কুলের অ্যানুয়াল পরীক্ষার রেজাল্ট বেরোবার দিন। রোহণ আর কুনাল তাঁর দুই যমজ ছেলে, কলকাতার একটা নামী স্কুলে ক্লাস নাইনে পড়ে। এমনিতে দুই ছেলেকে নিয়ে অনিলবাবুর বিশেষ চিন্তা নেই। দুজনেই বেশ শান্ত, গল্পের বই পড়তে আর টিভিতে ক্রিকেট-ফুটবল দেখতে খুব ভালোবাসে। এই দিকটায় অনিলবাবুর সঙ্গে তাঁর দুই ছেলের দিব্বি জমে! ঘন্টার পর ঘন্টা তিনজনের গল্প চলে শার্লক হোমস বা ডন ব্র্যাডম্যানকে নিয়ে। সমস্যার দিকটা পড়াশুনো সংক্রান্ত। দুজনেই বেশ মাঝারি মানের ছাত্র। ক্লাসে ফেল না করলেও প্রথম দিকে আসার খুব একটা ইচ্ছে বা মেধা কোনটাই তাদের মধ্যে তেমন দেখা যায় না। অনিলবাবুর অবশ্য সেই নিয়ে বিশেষ মাথাব্যাথা নেই। শুধু পরীক্ষার খাতার নম্বর দিয়ে যে কেউ শিক্ষিত হয় না সেটা তিনি বিশ্বাস করেন।
কিন্তু তাঁর স্ত্রী সুলেখা কড়া ধরণের মানুষ। রোজ সন্ধ্যেবেলা অফিস থেকে বাড়ি ফিরে অনেকটা সময়ই তিনি তাঁর দুই ছেলের পেছনে ব্যয় করেন এবং নিজের মনের মত রেজাল্ট না হলেই দুই ছেলের ভবিষ্যৎ যে অন্ধকার তা জোর গলায় জানিয়ে দেন। সেই সময় নিজের স্বামীর প্রতি কিছু চোখা চোখা বাক্যবাণও বাদ পড়ে না।
হবে নাই বা কেন! কোন বাবা যদি নিজেই ছেলেদের কোচিং কাটিয়ে আইপিএল দেখাতে নিয়ে যান বা রবিবার সকালে নন্দনে সোনার কেল্লার স্পেশাল শোয়ের নাম শুনে পড়াশুনো শিকেয়ে তুলে দুই মূর্তিমানকে বগলদাবা করে বেরিয়ে পড়েন তাহলে তাদের খারাপ রেজাল্টের অনেকটা দায় তাঁর ওপরেই বর্তায়, অন্তত সুলেখার পৃথিবীতে তো বটেই।
এছাড়া আছেন কমলেশবাবু। তাঁর কথায় আবার পরে আসা যাবে খন।
যাই হোক, বাড়ি ঢুকেই অনিলবাবু বুঝতে পারলেন পরিবেশ থমথমে। সুলেখা ছুটি নিয়েছিলেন। আপাতত তিনি বসার ঘরে গম্ভীর হয়ে একটা পত্রিকা মুখে দিয়ে বসে আছেন। দুই ছেলের টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না। অনিলবাবু গলা খাঁকড়ি দিয়ে বললেন, “ওরা ফেরেনি?”
“আমায় জিজ্ঞেস করছ কেন? তোমার গুণধর ছেলেরা তাদের ঘরে ঢুকে বসে আছে। তুমিও যাও। তুমি তো ওদের পার্টনার। মাথায় তুলেছ। যাও ছেলেরা কোনরকমে পাস করেছে! সেলিব্রেট কর।”
অনিলবাবু আমতা আমতা করে ছেলেদের ঘরের দিকে এগোলেন। সেখানে গিয়ে দেখলেন দুই মক্কেল নিজের নিজের খাটে শুকনো মুখে বসে আছে। মুখ দেখেই বোঝা যাচ্ছে যে স্কুল থেকে ফিরে ভালোই ঝড়-ঝাপটার মধ্যে দিয়ে গেছে দুজন।
“কী খবর? রেজাল্ট সুবিধার হয়নি?” অনিলবাবুর প্রশ্ন শুনে তাদের ছাপানো রেজাল্ট দুটো এগিয়ে দিল রোহণ আর কুণাল। অনিলবাবু ভালো করে রেজাল্টটা দেখে বুঝলেন যে মোটামুটি সত্তর শতাংশের আশেপাশে নম্বর পেয়েছে দুজনেই। তবে একজনের অঙ্কে মোটে সাতচল্লিশ। অন্যজন ছড়িয়েছে ইতিহাসে, তেতাল্লিশ!
অনিলবাবু তবু মুখটা হাসি হাসি রেখে বললেন, “মোটামুটি ঠিকই আছে বুঝলি। তবে ব্যাপারটা হচ্ছে, নেক্সট ইয়ার আইসিএসই তো। তোরা তো সবই বুঝিস। ওখানে ভালো রেজাল্ট না করলে তো তোদের স্কুল বা অন্য কোন ভালো স্কুলে চান্স পেতে অসুবিধে হবে তাই না?”
দুজনেই ঘাড় নাড়ল। অনিলবাবুরও মনটা একটু খারাপই হয়ে গেল। আর একটু ভালো নম্বর উনিও আশা করেছিলেন। আসলে এরা দুজনেই বুদ্ধিমান, বই পড়তে দারুণ ভালোবাসে। স্কুলে-পাড়ায় দু জায়গাতেই ক্যুইজ চ্যাম্পিয়ান। শুধু পড়ার বই ছাড়া অন্য বইয়ের প্রতিই তাদের আকর্ষণ বেশী, আর ফাঁকি যে মারে না তা নয়। এই কদিন আগেই সন্ধ্যেবেলা রোহণকে হাতে হাতে ধরেছিলেন। কিছুই না, সে ফিজিক্স বইয়ের ভেতরে ‘গোরস্থানে সাবধান’ ঢুকিয়ে সুলেখার চোখে ধুলো দিচ্ছিল। অনিলবাবু অবশ্যই কিছু বলেননি। উলটে রাতে শোওয়ার আগে ছেলেদের সঙ্গে আরেকবার ফেলুদার গল্পগুলো নিয়ে আড্ডা মেরেছিলেন। আর ঠিক শুতে যাওয়ার আগে একবার হাল্কা করে রোহণকে বুঝিয়েছিলেন, পড়াশুনোর গুরুত্বটা।
সেইদিন ছেলেরা শুতে চলে যাওয়ার পর নিজের পার্স থেকে একটা চিরকুট বের করে লেখাটা পড়েছিলেন অনিলবাবু।
এদিন সন্ধ্যে থেকেই দফায় দফায় সুলেখার বক্তব্য শুনতে হল তাঁকে। তিনি কতটা ভ্যাবা গঙ্গারাম! ছেলেরা তাঁকে নাচাচ্ছে। পড়াশুনো না করলে কেউ মানুষ হয় না। তাঁর এইসব খেলা দেখার ঝোঁকে ছেলেদের স্কুল বা কোচিং কামাই হলে তাতে ওদের কত ক্ষতি হয় সেটা তাঁর মাথায় ঢোকে না
লাস্ট পয়েন্টটায় অনিলবাবু মিনমিন করে বলেছিলেন যে, ক্লাসের বাকি বন্ধুরা যে নোটস শেয়ার করবে না তিনি সেটা ভাবতে পারেননি। ওনাদের সময় এসব ভাবাই যেত না। ওনার প্রিয় বন্ধু রঞ্জন যে স্কুল-কলেজের কত নোটস জেরক্স করে দিয়েছে সেটা ভেবে মাঝে মাঝে হাসি পায় অনিলবাবুর।
কিন্তু কথার মাঝখানেই তাঁকে থামিয়ে দিয়েছিলেন সুলেখা। আজকাল নাকি এটাই দস্তুর। ওইসব বন্ধু-ফন্ধু কিছু হয় না। সবাই কম্পিটিটর। কেউ কাউকে এক পা ও জমি ছেড়ে দেয় না। রোহণরা স্কুলে না গিয়ে ফুর্তি করেছে যেখানে ওদের বন্ধুরা কষ্ট করে ক্লাস করছে। ওরা ঠিকই করেছে নোটস না দিয়ে। সুলেখা নিজেও নাকি সেটাই করতেন।
শুনে অবাক হয়ে গেলেন অনিলবাবু। এ আবার কিরকম সংকীর্ণ মানসিকতা। পার্স থেকে চিরকুটটা বের করে পড়তে পড়তে তিনি ঠিক করলেন এই একটা বছর বেশ ভালো করে সময় দেবেন তিনি ছেলেদের পেছনে! ছেলেদের ভালো মানুষ করে তোলাই তাঁর লক্ষ্য। সেটার সঙ্গে পড়াশুনোটাও থাকুক।
কিন্তু তার আগে কাল সকালটা ভালোয়ে ভালোয়ে কাটলে হয়
সকালে বাজারে চারটে বেগুন নিয়ে দরাদরির সময় কমলেশ মেহতা পাকড়াও করলেন অনিলবাবুকে।
“কি দাদা? খবর সব্‌ বড়িয়া?”
কমলেশ মেহতা অনিলবাবুর পাড়াতেই থাকেন। পেশায় চার্টাড অ্যাকাউন্টেন্ট। কমলেশের ছেলে রঘুবীর রোহণদের ক্লাসেই পড়ে। ওদেরই স্কুলে, এবং প্রতি বছরই ক্লাসের প্রথম তিনজনের মধ্যে জায়গা করে নেয়। অনিলবাবুর জন্য সেটাই মুশকিল। কমলেশকে দেখে একটা দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলে মুখে একটু হাসি এনে অনিলবাবু বললেন, “ভালোই চলছে।”
কিন্তু ভবী ভোলবার নয়। পরের প্রশ্ন,
“রঘুর রেজাল্ট শুনেছেন?”
“কই, না তো!”
“সেকেন্ড হয়েছে! ভাবেন! হামি বললাম কি, স্কুলে যদি ফার্স্ট না হতে পারিস আইসিএসইতে আল ইন্ডিয়া ফার্স্ট হবি কী করে? কী বলেন দাদা?”
“মানে ফার্স্ট হওয়ার কি খুব দরকার?”
“বোলেন কী দাদা? এত্ত কম্পিটিশান! ফুল লাইফ ইজ আ রেস। এখন রেজাল্ট সেই স্ট্যান্ডার্ডে না হলে এর পরে বাইরে গেলে তো পিছিয়ে পড়বে না দাদা। রঘু নিডস্‌ টু ইম্প্রুভ।
অনিলবাবু মাথা নাড়লেন। কেটে পড়তে যাচ্ছেন, তখন প্রশ্নটা এল। যেটা নিয়ে ভয় পাচ্ছিলেন তিনি।
“তা আপনার ছেলেদের কী হাল? রঘু বলছিল কি ওদের নাম্বার খুব ইম্প্রেসিভ নয়।”
“না না, ঠিকই আছে। আরো একটু মন দিয়ে পড়লে আরো বেটার হত।”
“না না দাদা। ইউ নিড টু বি স্ট্রিক্ট। ইয়ে সব্‌ ক্রিকেট ম্যাচ-ফুটবল ম্যাচ বন্ধো করে দিন। উন চিজোকে লিয়ে তো পুরা জওয়ানি পড়ি হ্যায়।”
আরো কিসব বলছিল কমলেশ। অনিলবাবু কায়দা করে, অফিস যাওয়ার দেরী হয়ে যাচ্ছে বলে কেটে পড়লেনএসব নতুন কিছু নয়। প্রত্যেকবার রেজাল্টের পর এবং এমনিতেই সারা বছর কমলেশের কাছে পুত্রদের মানুষ করা নিয়ে উপদেশ শুনতে হয় অনিলবাবুর। প্রত্যেকবারই মনে মনে কমলেশের কথাগুলোর সঙ্গে একমত হন না অনিলবাবু। কথাগুলো হয়তো প্র্যাক্টিকাল, তাও।
বাড়ি ফেরার পথে পার্স থেকে চিরকুটটা বের করে আবার একবার পড়লেন তিনি। দেখা যাক!
মাস ছয়েক পরের কথা। আবার একটা রেজাল্টের দিন। ক্লাস টেনের টেস্ট। সুলেখার জোরাজুরিতে অনিলবাবু রোহণ আর কুণালকে নিয়ে স্কুলে এসেছেন। প্রথমে বাড়াবাড়ি মনে হচ্ছিল তারপর ভেবে দেখলেন যে, একদিক দিয়ে ভালোই। ছেলেদের রেজাল্ট সুবিধার না হলে সুলেখার মুখোমুখি হওয়ার আগে একটু সময় পাওয়া যাবে।
এবার পরীক্ষার আগে অনেকটাই সময় দিয়েছিলেন অনিলবাবু। ছেলেদের অনেক করে বুঝিয়ে শেষ কিছুদিন গল্পের বই- খেলা বন্ধ রেখেছিলেন। সুলেখাও বিশেষ সুযোগ পাননি কিছু বলার।
রেজাল্ট কিন্তু সেই তুলনায় তেমন ভালো হল না। মোটামুটি আগের বারের মতই। বরং দু-একটা সাবজেক্টে নম্বর একটু কমেছে। অনিলবাবুদের সময় স্কুলগুলো টেস্টে ভীষণ চেপে নম্বর দিত। উনি নিজে তো বোধ হয় দু একটা সাবজেক্টে কোনরকমে পাস করেছিলেন। আজকাল অবশ্য স্কুলগুলো সেরকমই করে কিনা সেটা ওনার জানা নেই।
ছেলেদের চিয়ার আপ করার জন্য ওদের সঙ্গে নিয়ে কিছুটা হাঁটবেন বলে ঠিক করলেন অনিলবাবু। কমলেশ মেহতাও স্কুলে গেছিল। রঘুবীর বোধহয় সায়ন্সের সব কটা সাবজেক্টেই স্কুলের মধ্যে হায়েস্ট পেয়েছে। সুতরাং কমলেশের লেকচারও শুনতে হয়েছে তাঁকে। ছেলেদের সঙ্গে টুকটাক কথা বলতে বলতে একটা গলির মধ্যে দিয়ে হাঁটছিলেন হঠাৎ একটা প্রচণ্ড অপ্রীতিকর ঘটনা চোখে পড়ল অনিলবাবুর। রাস্তার এক ধারে চার-পাঁচটা ছেলে একটা মেয়েকে ঘিরে ধরেছে। দু একটা মন্তব্য কানে আসতেই ব্যাপারটা বুঝতে পারলেন অনিলবাবু। ইভ টিজিং নিয়ে এই অঞ্চলের বদনাম তিনি শুনেছিলেন কিন্তু কোনদিন ভাবেননি যে দিনের আলোয় এই জিনিস হতে পারে।
কি মনে হল, অনিলবাবু ছেলেদের নিয়ে এগিয়ে গেলেন।
“কী ভাই? কী হয়েছে? অসভ্যতা করছ কেন?”
ওনার গলার আওয়াজ শুনে ছেলেগুলো ঘুরে দাঁড়াল। চোখ গুলো দেখলেই বোঝা যাচ্ছে ভালই নেশা করেছে ছেলেগুলো। ভাঙা ভাঙা গলার আওয়াজে একজন বলল, “আবে বুঢ্‌ঢা! কাহে টেনশান লেতা হ্যায়! ফোট ইহাঁসে!”
অনিলবাবু তাও এগিয়ে গেলেন। মেয়েটা দাঁড়িয়ে কাঁপছিল। তাকে উদ্দেশ্য করে বললেন, “তুমি এদিকে চলে এসো তো। আমার পাশে এসে দাঁড়াও।”
ছেলেগুলো আর থাকতে না পেরে হঠাৎ এসে একটা ধাক্কা মারল অনিলবাবুকে। অনিলবাবু এটা ভাবতে পারেননি। ছিটকে পড়লেন রাস্তায়। দেখতে পেলেন ছেলেগুলো আসতে আসতে এগিয়ে আসছে তাঁর দিকে।
রোহণ আর কুণাল কিন্তু দাঁড়িয়ে ছিল না। যদিও এভাবে রাস্তায় মারপিট কোনদিন করতে হয়নি, তাও পিছু না হটে কুণাল গিয়ে একটা ধাক্কা মারল সবচেয়ে সামনের ছেলেটাকে। তার যদিও কিছু হল না। বরং ছেলেগুলো ঘিরে ধরল কুণালকে। কেউ একটা পকেট থেকে একটা লম্বা ছুরি বের করে চালিয়ে দিল ধস্তাধস্তির মধ্যে। অনিলবাবু দেখতে পেলেন কুণালের ডান হাত থেকে ফিনকি দিয়ে রক্ত পড়ছে।
ভাইয়ের ওই অবস্থা দেখে রোহণ কোত্থেকে একটা গাছের ডাল জোগাড় করে খ্যাপা ষাঁড়ের মত লাফিয়ে পড়ল ছেলেগুলোর ওপর। এই আচমকা আক্রমন ছেলেগুলো আশা করেনি। হঠাৎ রোহণের একটা লাথি খেয়ে ছিটকে পড়ল ওই ছেলেগুলোর লিডার। কুণালও তার রক্তাক্ত হাত নিয়েই দু-এক ঘা দিচ্ছিল। কিন্তু লিডারকে পড়ে যেতে দেখে বাকি ছেলেগুলো বেশ ঘাবড়ে গেল। তারপর রোহণ ডাল নিয়ে তেড়ে যেতেই পালটা মারের ভয়ে লিডার সুদ্ধু দ্রুত পালিয়ে গেল দলটা।
অনিলবাবু উঠে গিয়ে দেখলেন কুণালের হাতের অবস্থা। ক্ষতটা বেশ গভীর। রক্ত বেরোচ্ছে। কোনরকমে বড় রাস্তায় এসে একটা ট্যাক্সি নিয়ে হসপিটালের দিকে চললেন অনিলবাবু। সঙ্গে দুই ছেলে এবং ওই মেয়েটি।
হসপিটালে কুণালের হাতটা ভালো করে ড্রেসিং করে ব্যান্ডেজ বেঁধে দিলেন একজন ডাক্তার। পুরো ঘটনা শুনে দুই ভাইয়ের পিঠ-টিঠ চাপড়ে দিতেও ভুললেন না। অনিলবাবুকে ডেকে বললেন, “ইউ আর আ লাকি ম্যান। ছেলেদের যথার্থ শিক্ষিত করে তুলতে পেরেছেন। আজকালকার দুনিয়ায় এরকম বেশী দেখা যায় না। সবাই তো নিজেদের নিয়েই ব্যস্ত!”
সঙ্গের মেয়েটি, শিপ্রাও অনেক করে ধন্যবাদ দিচ্ছিল অনিলবাবুদের। তাকে একটা ট্যাক্সিতে তুলে বাড়ি পাঠিয়ে দিলেন অনিলবাবু।
এবার ট্যাক্সিতে বাড়ির পথে। দুই ছেলেকে পেছনে বসিয়ে ড্রাইভারের পাশে বসলেন অনিলবাবু। মাঝপথে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখলেন, গল্প করতে করতেই কুণালের হাতের ব্যান্ডেজের ওপর আস্তে আস্তে হাত বোলাচ্ছে রোহণ। দুজনের মুখেই একটা খুশীর হাসি।
সামনে ফিরে নিজের পার্স থেকে চিরকুটটা বের করলেন অনিলবাবু, আরো একবার পড়লেন লেখাটা,

It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on.


ট্যাক্সির সামনের সিটটাকেই লর্ডসের ব্যালকনি ভেবে মনে মনেই নিজের জার্সিটা খুলে উড়িয়ে দিলেন অনিলবাবু।

Monday, June 20, 2016

দুই দশক...


কুড়িটা বছর পার হয়ে গেছে! আজ থেকে কুড়ি বছর আগে পৃথিবীটা অনেক অন্য রকম ছিল। অনেক নরম, শান্ত, ঠাণ্ডা, মজার একটা জায়গা! আমি তখনো বড় হয়ে যাইনি (এখন তো আর উপায় নেই!) তাই আমার পৃথিবীটাও আমার মতই ছোট্ট ছিল। সেই পৃথিবীর একদিকে বাঁটু্ল উটপাখি পুষছে, টিনটিন আর ক্যাপ্টেন হ্যাডক প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপে ঘুরে গুপ্তধন না পেয়ে ফিরে আসছে, ফেলুদা পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানের সবুজ ঘাসের ওপর ভাঙা শ্বেত পাথরের টুকরো সাজিয়ে টমাস গডউইনের নাম খুঁজে বের করছে আর কাকাবাবু সুকুমার রায় আবৃত্তি করে শোনাচ্ছে সন্তুকে।
আমার পৃথিবীর অন্য দিকটা জুড়ে ছিল একদল লোক, যাদের খুব ছোট্টবেলা থেকে টিভিতে দেখতাম। টিভির মধ্যে ব্যাট করছে, বল করছে, ক্যাচ ধরছে! আর দেখতাম বিজ্ঞাপনে। পামোলিভ, বুস্ট, পেপসি। তারপর তাদের নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। গাভাসকার, কপিল দেব, আজহার, সচিন থেকে শুরু করে সি কে নাইডু, ভিনু মানকড়, ওয়ালশ, অ্যামব্রোজ, লারা, জয়সূর্য!
সেই ওয়ান ডে ক্রিকেটের সুবর্ণ যুগে তখন একের পর এক ক্রিকেট সিরিজ, ত্রিদেশীয়, চতুর্দেশীয় টুর্নামেন্ট হয়েই চলত১৯৯৬তে আবার ঘরের মাঠে বিশ্বকাপতার অভিনব বিজ্ঞাপন, টানটান উত্তেজনা, পাকিস্তানকে হারানোর লাগামছাড়া উচ্ছাসের পরই শ্রীলংকার কাছে করুণ পরাজয়। সব মিলিয়ে সে একটা সময় গেছিল বটে! (যদিও এটা আমার স্মৃতিতে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। বিরানব্বইয়ের অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বকাপ দেখার হাতেখড়ি! ফাইনালে ইমরান খানের জন্য #দিল দিল পাকিস্তানও ছিলাম সেই ন বছর বয়সে!)
বিশ্বকাপ শেষ হতে না হতেই ইন্ডিয়া পটাপট দুটো ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলে ফেলল, যদিও একটাও জিতল না। তারপর রওনা দিল ইংল্যান্ডের জন্য, এক গাদা নতুন খেলোয়াড় নিয়ে। রাহুল দ্রাভিড, সুনীল যোশী, ভেঙ্কটেশ প্রসাদ, পরশ মাম্ব্রে, বিক্রম রাঠোড়... এরা কেউ তখনো টেস্ট খেলেনি। ওহ্‌ আর একটা লোক ছিল। ট্যুর শুরুর আগে থেকেই যাকে নিয়ে বাংলা কাগজে বেশ হইচই হচ্ছিল। হাজার হোক, অনেক বছর পর এরকম একটা বড় ট্যুরে একটা বাঙ্গালী ছেলে দলে জায়গা পেয়েছে! ততদিন বাঙ্গালীর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মানেই গোলগাল, চশমা চোখে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক পঙ্কজ রায়। সঙ্গে বুড়ো বয়সে শুঁটে ব্যানার্জীর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে পাঁচ উইকেট নেওয়ার গল্প বা সুব্রত ব্যানার্জীর প্রথম ইনিংসে তিন উইকেট নেওয়ার পর আজহারের দ্বিতীয় ইনিংসে বল না দেওয়ার দীর্ঘশ্বাস! কেউ বলল, ‘কিচ্ছু করতে পারবে না’, আবার কেউ বলল, ‘খেলতে নিলে আগুন লাগিয়ে দেবে!’ কার কথায় ভরসা করা যায় বোঝার বয়স হয়নি তখনও।
লম্বা ট্যুর ছিল। অনেকগুলো কাউন্টির সঙ্গে ম্যাচ, বোধহয় সেই শেষবারইটুকটাক খেলছিল ছোকরা। একটা ওয়ান ডে খেলায় চান্স পেল। সচিন আউট হওয়ার পর ফার্স্ট ডাউন নেমে ৪৬ রান করল। ইন্ডিয়া হারল যথারীতি। সিরিজটাও।
ফার্স্ট টেস্টে টিমে ছিল না। ইন্ডিয়া হেরেছিল। সেকেন্ড টেস্টের আগে টিমে প্রচুর ঝামেলা। মঞ্জরেকারের চোট, সিধুও ঝামেলা করে ইন্ডিয়া ফিরে এসেছিল তত দিনে খবরের কাগজে পড়লাম রাহুল দ্রাভিডের অভিষেক হবে লর্ডস টেস্টে, আরও পরিবর্তন হতে পারে। সে কী কাণ্ড! বাঙ্গালীর ছেলে টেস্ট খেলতে পারে! সে কী প্রাদেশিক উত্তেজনা! বাঙ্গালীকে আর ক্রিকেটে দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না! চারদিকে একটা সাজো সাজো রব।
আগেই বলেছি, কুড়ি বছর! আজ থেকে কুড়ি বছর আগে এই দিনে। সৌরভ গাঙ্গুলীর প্রথম টেস্ট! একটা বৃহস্পতিবার। স্কুলে গেছিলাম, ক্লাস সেভেনস্কুল থেকে ফিরে ছটার খাস খবরে শুনলাম সৌরভ খেলছে! উইকেটও নিয়েছে একটা। নটার খাস খবরে শুনলাম, উইকেট একটা নয় দুটো! তার পরের দিন ব্যাট করতে নেমে ২৬ রানে নট আউট। থার্ড ডে শনিবার। স্কুল হাফ ছুটি, ফিরে এসে রেডিও শুনছিলাম, কেবল টিভি তখন নেই। সৌরভ যখন প্রায় সত্তর তখন এক বন্ধুর বাড়িতে হামলা করলাম। আস্তে আস্তে রান বাড়ছে। সৌরভ নব্বই। সবাই উত্তেজিত! বাঙ্গালী খেলবে জানা ছিল কিন্তু এইসব হয়ে যাবে কেউ ভাবতেও পারেনি!
হঠাৎ টিভিতে ক্রিকেট বন্ধ। ইউরো কাপের খেলা। আজ গুগলে চেক করলাম, ইংল্যান্ড বনাম স্পেনের কোয়ার্টার ফাইনাল ছিল। বড় টুর্নামেন্টে ইংল্যান্ডের একমাত্র টাইব্রেকারে জয়! কিন্তু তখন মনে হয়েছিল স্টার স্পোর্টসের চেয়ে হৃদয়হীন কী আর কেউ আছে!
সৌরভের টেস্টে প্রথমবার একশোয় পৌঁছনোর মুহূর্তটা দেখতে পাইনি। কী আসে যায়! সেটা তো একটা সামান্য স্ট্যাটিস্টিক্স! পরের টেস্টেই তো আর একটা হল!
সৌরভ ভারতীয় ক্রিকেটকে কতটা বদলে দিয়েছেআদৌ তার কোন অবদান আছে কিনা ভারতীয় ক্রিকেটে... সেই নিয়ে লোকে তর্ক করে। করুক! কী আসে যায়!
কিন্তু আমার জীবনটাকে সৌরভ কিভাবে পালটে দিয়েছে সেটা নিয়ে তো আর তর্ক করার জায়গা নেই। তার আগে অবধি ক্রিকেট শুধু একটা খেলা ছিল, সেদিন থেকে ক্রিকেট আমার মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে পড়ল! সৌরভের খেলা, সৌরভের রান-উইকেট-ক্যাচ, অধিনায়কত্ব, সাফল্য, ব্যর্থতা... সবই আস্তে আস্তে হয়ে উঠল আমার জীবনের একটা অংশ।

আসলে আমার জীবনের দুটো ভাগ! ‘Before Lord’s 1996’ আর ‘After Lord’s 1996’

সেই ভাগটা হয়েছিল আজকের দিনেই, ঠিক কুড়িটা বছর আগে!

Wednesday, June 1, 2016

স্মৃতি

ভাবনা-১

সুনির্মলবাবুর আজকাল নিজেকে বড় একা লাগে। একটা গোটা দোতলা বাড়িটায় আর একটাও মানুষ নেই। একাকীত্ব যেন রোজ গিলে খেতে আসে তাঁকে। কিন্তু সব সময় এরকম ছিল না। সুনির্মলবাবুর স্ত্রী কৃষ্ণা এবং একমাত্র ছেলে অঞ্জন যখন ছিল তখনও পুরো বাড়িটা বেশ জমজমাট থাকত। অঞ্জনের বিয়ের পর আরো একজন লোক বাড়ল, সুনয়না, তাঁর পুত্রবধূ। কিন্তু এরা কেউই এখন নেই। কেন নেই সেটা অনেক ভেবেও সুনির্মলবাবু ঠিক করে বুঝে উঠতে পারেন না! ঘন্টার পর ঘন্টা বসার ঘরে কৃষ্ণার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদের বৈবাহিক জীবনের অনেক খুঁটিনাটি ঘটনার কথা তাঁর মনে পড়লেও এই প্রশ্নের উত্তর তাঁর মাথার মধ্যে নেই!
আসলে মানুষের স্মৃতি ব্যাপারটাই খুব জটিল। আর তার ওপর মস্তিষ্কের এক বিরল রোগের কারণে সুনির্মলবাবুর স্মৃতি এক অদ্ভুত চেহারা নিয়েছেনিজের পঁয়ষট্টি বছরের জীবনের অনেক অকিঞ্চিৎকর কথা তাঁর মনে থাকলেও গত এক বছরের অনেক কথাই তাঁর আর মনে পড়ে নাপাঁচ বছর বয়সে পেয়ারা গাছ থেকে কে তাঁকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল, ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় স্কুলের ফাংশানে কোন আবৃত্তি করে সোনার মেডেল পেয়েছিলেন সেগুলো মনে থাকলেও গতকাল তিনি ঠিক কী খেয়েছেন বা কার সঙ্গে কথা বলেছেন, আদৌ কথা বলেছেন কিনা তার কিছুই তাঁর মনে নেই।
 আজকাল স্মৃতির এই সমস্যা তাঁর দুটো অস্বস্তির মধ্যে একটার কারণ। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর কথা কিন্তু তাঁর বেশ ভালোই মনে আছে। একদম ছবির মত দেখতে পান শ্রাবণ মাসের বৃষ্টিভেজা সেই দিনটা। অনেক লোক হয়েছিল সেদিন। অঞ্জন বারান্দায় অনেকক্ষণ গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারপর উনি গিয়ে পাশে দাঁড়াতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। একদম ছবির মত দেখতে পান এটা। কিন্তু এই অঞ্জন আর সুনয়না কোথায় কী করে চলে গেল তাঁর বিন্দুমাত্র স্মৃতি নেই তাঁর।

দৃশ্য – ১

-      তুমি তাহলে আমার কথায় রাজী হবে না?
-      কী করে হই বল?
-      কিন্তু আমি একদম লজিকাল কথা বলছি বাবা। এত পুরনো একটা বাড়ী, এতটা জায়গা! পাইকপাড়ার মত প্রাইম লোকেশান! খুব ভালো দাম পাওয়া...
-      তোমার বাবাও পুরনো হয়ে গেছে অঞ্জন। তুমি কি তাহলে আমাকেও বেচে দিতে চাও?
-      ননসেন্স! এসব কথার কোন মানে হয় না বাবা! মা মারা যাওয়ার পর তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে!
-      হতে পারে। কিন্তু তাহলেও তোমাকে এই বাড়ী বিক্রির পারমিশান আমি দেবো না!
-      এই তোমার শেষ কথা?
-      হ্যাঁ... আনফরচুনেটলি আমার মৃত্যু অবধি তোমায় অপেক্ষা করতেই হবে।
-      সেটা যাতে তাড়াতাড়ি হয় সেটার ব্যবস্থাও করে ফেলা যায়।
কথাটা বলে গটগট করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল অঞ্জন। সঙ্গে সুনয়নাও। ঘরের বাইরে থেকে তার রিনরিনে গলার আওয়াজ ভেসে এল, “এ বাড়ীতে আর থাকা যায় না। তুমি প্লিজ সল্ট লেকের দিকে একটা ফ্ল্যাট দেখ।”

ভাবনা – ২

সারাটা দিন। একের পর এক স্মৃতি ভেসে আসে। সেই কোন আদ্যিকালের অপ্রয়োজনীয় সব স্মৃতি। কিন্তু একই সঙ্গে কত কত ঘটনার স্মৃতি অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারেননা তিনিএ কী শাস্তি!
এ এক বড় অস্বস্তিকর অবস্থা! এর সঙ্গেই গত বেশ কদিন ধরে আরো একটা জিনিস শুরু হয়েছে। আগে, যখন কৃষ্ণার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন ছবির কাঁচে নিজের ছায়া দেখতে পেতেন সুনির্মলবাবু। এখন আর পান না ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেও পান নাএমনকি দোতলার শোয়ার ঘরের সেই সুপ্রাচীন ড্রেসিং টেবিলের আয়নাতেও আর নিজেকে দেখতে পান না সুনির্মলবাবু। কেন নিজেকে আর দেখতে পান না সেটাও মনে পড়ে না তাঁর। অস্বস্তিটা থেকেই যায়।

দৃশ্য – ২

-      ইয়েস মিস্টার মল্লিক!
-      গুড আফটারনুন স্যার। মার্ডার স্পট থেকে বলছি!
-      কোনটা? গতকালের ওই পাইকপাড়ার কেসটা?
-      ইয়েস স্যার। ওটাই। খুব স্ট্রেঞ্জ কেস স্যার!
-      কেন? একটু ব্রিফ করুন।
-      আপনি তো মোটামুটি জানেন। ভিকটিম রিটায়্যার্ড। ওয়াইফ এক্সপায়ার করেছেন গত বছর। তারপর থেকে ছেলে, ছেলের বউয়ের সঙ্গে থাকতেন। রিসেন্টলি ছেলের সঙ্গে সম্ভবত এই বাড়ী নিয়ে কিছু ঝামেলা হয়েছিল।
-      সেটা কী করে জানলেন?
     -      পাড়ার লোক স্যার! বুঝতেই পারছেন। আর বেশ কয়েকদিন নাকি তর্কাতর্কি বেশ উচ্চকন্ঠেই হয়েছিল, পাড়ার লোক শুনেছে।
     -      ওকে
     -      হ্যাঁ। বেশ কিছুদিন হল, ছেলে-বউকে নাকি আর দেখেনি পাড়ার লোক। উনিও খুব একটা কারো সঙ্গে মেশেন না। তাই কেউ জিজ্ঞেসও করেনি। আর এত বড় বাড়ী স্যার। বাইরে থেকে কিছু বোঝা মুশকিল! নেহাত গতকাল সকালে দুর্গন্ধ পেয়ে পাড়ার লোকে আমাদের খবর দিল, তখন এসে দেখলাম, বসার ঘরের ফ্যান থেকে ঝুলছেন ভদ্রলোক!
     -      কি মনে হচ্ছে? ছেলের হাত থাকতে পারে?
     -      না স্যার। সেটা সম্ভব নয়?
     -      কেন?
     -      কী আর বলব স্যার! পুরো বাড়ী সার্চ করতে গিয়ে ওপরের একটা আঁটকাঠ বন্ধ ঘরে পাশাপাশি দুটো ট্রাঙ্কে ওনার ছেলে আর ছেলের বউয়ের রিমেইন্স পাওয়া গেছে স্যার। টুকরো টুকরো করে কাটা! অন্তত মাস খানেক আগে কিলড্‌।
     -      মাই গুডনেস! কী বলছেন? অস্ত্রটা পাওয়া গেছে?
     -      হ্যাঁ স্যার। একটা রক্তের দাগ লাগা চপার পেয়েছি, টেস্টের জন্য ল্যাবে পাঠিয়ে দিয়েছি।
     -      কোথায় পাওয়া গেল?
     -      আজ্ঞে, বসার ঘরে ওনার স্ত্রীর একটা ছবি আছে, তার পেছনে!

Friday, March 4, 2016

বইমেলা ২০১৬ থেকে পছন্দের দুই রম্য গ্রন্থ

ফটকেমি
এবারের বইমেলার যে বইগুলো এখনো অবধি পড়লাম সেগুলোর মধ্যে ফটকেমি সবচেয়ে ভালো লেগেছেনিজেদের ছোটবেলার স্কুলের স্মৃতি তো আমাদের সবার কাছেই খুব মূল্যবান। আর এই বইয়ের বিশেষ গুন হল পড়তে পড়তে মনে হয় এর অনেকগুলো ঘটনা যেন আমাদের স্কুলে আমার সামনেই ঘটেছে। আর ফটিক, তার কথা কী বলব। কখনো সে পাগলা দাশুর মত বুদ্ধিমান, কখনো গাবলুর মত আলাভোলা, কখনো ক্যালভিনের মত দার্শনিক আবার কখনো ডেনিসের মতই বদমাশ। তার কাণ্ডকারখানা পুরো স্কুলের মাস্টারমশাইদের বিরক্তির কারণ, অবশ্য মাস্টারমশাইরাও তো ছোট ছিলেন তাই মাঝে মাঝে ফটিকের কথায় মুখ নিচু করে হাসতেও দেখা যায় তাঁদের।

সব মিলিয়ে ফটিকের ফটকেমির গল্পগুলো আমাদের হৃদয়ের বড় কাছের। আজকাল চারদিকে যা চলছে তাতে সোজা কথা সোজা ভাবে বললে যে কোন সময়েই সমূহ ঝামেলা হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। তাই ফটিক যখন ক্লাসে মাস্টারমশাইদের কঠিন প্রশ্নের সরলতম উত্তর দিয়ে বিপদে পড়ে তখন হাসির সঙ্গে সঙ্গে তার প্রতি সমর্থনে মাথা নাড়তেই হয়।
গল্পে ফটিক ছাড়াও এসেছেন তার মাস্টার মশাইরা, হেডমাস্টারমশাই, ক্লাসের ফার্স্ট বয় প্রদীপ, যার সঙ্গে ফটিকের বেশ খানিকটা রেষারেষিও আছে। এবং আছেন ফটিকের বাবা, প্রায় প্রতি গল্পের শেষের যাঁর ডাক পড়েছে স্কুলে হেডমাস্টারমশাইয়ের ঘরে।
ডায়েরির ফর্মে লেখা গল্পগুলোয় লেখকের সাধু ভাষার ওপর দখল সাধুবাদযোগ্য। শুধু তাই নয়, গল্পগুলোর পরিমিত এবং পরিচ্ছন্ন হাস্যরস আমার মত পাঠকের জন্য বেশ স্বস্তিদায়ক এবং উপভোগ্য। আরিফবাবুর লেখা এই প্রথম পড়লাম। ভবিষ্যতে তাঁর অন্যান্য লেখা পড়ার ইচ্ছে রইল।

লাকি থারটিন
লাকি থারটিন বইয়ের লেখক সুমন সরকার আমার প্রেসিডেন্সী কলেজের জুনিয়ার। সুতরাং অগ্রজ হিসেবে তার লেখার প্রতি একটা পক্ষপাতের সম্ভাবনা থেকেই যায়। কিন্তু তার থেকে বেরিয়ে এসেও নিরপেক্ষভাবেই বলা যায়, “সুমন তুই বেশ লিখিস।”
আমাদের চারদিকের দৈনন্দিন জীবনের ঘটনাপ্রবাহ থেকে কয়েকটা বেছে নিয়েই তার রম্যরচনার সংগ্রহ। কখনো কলকাতার অটো, কখনো পরীক্ষার চোতা, কখনো গুল নিয়ে গুলতানি... আমাদের চেনা-পরিচিত বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের চারদিকের চেনা মুখগুলোকে নিয়ে লেখা ছোট ছোট গল্প, স্মৃতি, মজার ঘটনা। তার সঙ্গে সাম্প্রতিক ঘটনাবলী নিয়ে টিপ্পনী... সব মিলিয়ে বেশ মনে রাখার মত তেরোটা রম্যরচনা নিয়ে লেখা বই লাকি থারটিন।
আমার বিশেষ করে পছন্দ হয়েছে বইয়ের শেষ লেখা, ‘তেলি বড়ার চপ’। আমাদের সকলেরই ছোটবেলার এরকম বেশ কিছু স্মৃতি থাকে। সুমনকে ধন্যবাদ ওর কলমের জোরে আমাদের ছোটবেলার সেইসব চিরন্তন স্মৃতিগুলোকে বাঁচিয়ে রাখার জন্য।
"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”