Saturday, August 1, 2015

ব্যোমকেশ বক্সী – কিছু সংখ্যা

সত্যান্বেষী ব্যোমকেশ বক্সীর সহিত আমার প্রথম পরিচয় হইয়াছিল সন তেরশ’ একত্রিশ চোদ্দশ সালে।

তার আগেই ভদ্রলোকে্র এবং তাঁর স্রষ্টার নাম শুনেছিলাম, সদাশিব আর জেনারেল ন্যাপলার গল্প পড়াও হয়ে গেছিল। কিন্তু টেলিভিশানের পর্দায় ভদ্রলোককে দেখার পর থেকে ব্যোমকেশের বই পড়ার জন্য খেপে  উঠলাম। তখন আমার বছর দশেক বয়স। বই পেয়েও গেলাম হাতের কাছে, ‘শরদিন্দু অম্‌নিবাস – প্রথম খণ্ড’। সেই শুরু, তারপর গত বাইশ বছর ধরে সেইসব গল্প-উপন্যাস উল্টেপাল্টে কতবার যে পড়লাম তার হিসেব রাখা শক্ত।
আর পড়তেই পড়তেই মনে হল ব্যোমকেশকে অংকের হিসেবে সামান্য কাটা-ছেঁড়া করে দেখলে মন্দ হয় না আর সেইসব কিছু সংখ্যা নিয়েই এই লেখা।

মোট গল্প বত্রিশটি। ‘পথের কাঁটা’ দিয়ে শুরু, ‘লোহার বিস্কুট’ দিয়ে শেষ। এই প্রসঙ্গে এটাও উল্লেখযোগ্য যে ব্যোমকেশ সমগ্র বা শরদিন্দু সমগ্রতে 'সত্যান্বেষীে' আগে থাকলেও সময়কালের দিক দিয়ে 'পথের কাঁটা' লেখা হয়ে গেছে এক বছর আগেই। ১৯৩২ সালে 'পথের কাঁটা' এবং 'সীমন্ত-হীরা লেখার পর শরদিন্দু যখন ঠিক করেন যে ব্যোমকেশ চরিত্র নিয়ে নিয়মিত লিখবেন তখন তিনি 'সত্যান্বেষী' গল্পে ব্যোমকেশ এবং অজিত চরিত্র দুটিকে দাঁড় করান এবং তাঁদের আলাপ ঘটান। শেষ গল্পটি, ‘বিশুপাল বধ’, শরদিন্দুর মৃত্যুর কারণে অসম্পূর্ণ থেকে যায়। মাঝে পনেরো বছরের অনুপস্থিতি কিন্তু সেটা বাদ দিলে মোটামুটি নিয়মিত লেখা।


ব্যোমকেশের গল্পগুলোর দৈর্ঘ্যের কম বেশী আছে। ‘রক্তমুখী নীলা’ বা ‘লোহার বিস্কুট’ খুবই ছোট গল্প। আবার ‘চিড়িয়াখানা’ বা ‘আদিম রিপু’ পড়তে বসলে উপন্যাসের কথা মনে হয়। ‘রক্তের দাগ’ বা ‘ব্যোমকেশ ও বরদা’কে বলা যেতে পারে দৈর্ঘ্যের দিকে দিয়ে আদর্শ ব্যোমকেশের গল্প।


সেই ‘পথের কাঁটা’ থেকেই অজিত ব্যোমকেশের গল্প লিখে আসছিলেন কিন্তু ১৯৬৪ সাল নাগাদ অজিতের বইয়ের দোকানের ব্যস্ততা আর ব্যোমকেশের নতুন বাড়ি তৈরির দেখভাল গুরুদায়িত্বের  কারণে শরদিন্দু তাঁকে ‘নিষ্কৃতি’ দিলেন। ১৯৬৮ সালে প্রকাশিত ‘বেণীসংহার’ বইয়ের ভূমিকায় লিখলেন,


          “অজিতকে দিয়ে ব্যোমকেশের গল্প লেখানো আর চলছে না। একে তো তার ভাষা সেকেলে হয়ে গেছে, এখনো চলতি ভাষা আয়ত্ত করতে পারেনি, এই আধুনিক যুগেও ‘করিতেছি’, ‘খাইতেছি’ লেখে। উপরন্তু তার সময়ও নেই। পুস্তক প্রকাশকের কাজে যে-লেখকেরা মাথা গলিয়েছেন তাঁরা জানেন, একবার মা-লক্ষ্মীর প্রসাদ পেলে মা-সরস্বতীর দিকে আর নজর থাকে না। তাছাড়া সম্প্রতি অজিত আর ব্যোমকেশ মিলে দক্ষিণ কলকাতায় জমি কিনেছে, নতুন বাড়ি তৈরি হচ্ছে; শীগ্‌গিরিই তারা পুরনো বাসা ছেড়ে কেয়াতলায় চলে যাবে। অজিত একদিকে বইয়ের দোকান চালাচ্ছে, অন্যদিকে বাড়ি তৈরির তদারক করছে; গল্প লেখার সময় কোথায়?
          দেখেশুনে অজিতকে নিষ্কৃতি দিলাম। এখন থেকে আমিই যা পারি লিখব।


ব্যোমকেশের গল্পের বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে ব্যোমকেশ, অজিত, সত্যবতী, পুঁটিরাম ছাড়াও অনেকেই একাধিক গল্পে উপস্থিত। ‘উপসংহার’ গল্পে ‘সত্যান্বেষী’র অনুকূল গুহ প্রতিশোধের নেশায় ব্যোমকেশ বোস হয়ে ফিরে এসেছেন। পুলিশের ইনফর্মার বিকাশের সাহায্য ব্যোমকেশ নিয়েছে চারবার। আবার বিভিন্ন পুলিশ কর্তাদের মধ্যে অনেকেই একাধিকবার ব্যোমকেশের কেসে জড়িয়ে পড়েছেন বা ব্যোমকেশকে ডেকে পাঠিয়েছেন।


ব্যোমকেশ শার্লক হোমস নয়, তাই শার্লকের মত ব্যোমকেশের অধিকাংশ কেসেই মক্কেল তার দরজায় এসে কড়া নাড়েনি। হ্যাঁ তার মক্কেলদের মধ্যে জমিদার, ব্যবসায়ী, জহুরী, কয়লাখনির মালিক অনেকেই আছেন কিন্তু তা ছাড়াও অনেক গল্পেই ব্যোমকেশ হঠাৎ করে কোন কেসে জড়িয়ে পড়েছে। সে ‘অগ্নিবাণ’ হোক বা ‘চিত্রচোর’। সেইদিক দিয়ে ফেলুদার সঙ্গে বেশ মিল আছে। সেই ‘থ্রি মাস্কেটিয়ার্স’ও যে কত জায়গায় ছুটি কাটাতে গিয়ে অপরাধের সঙ্গে জড়িয়ে পড়েছিল তার হিসেব রাখা শক্ত।

আবার ‘অর্থমনর্থম্‌’ বা ‘দুর্গরহস্য’-র মত গল্পে পুলিশের বিধুবাবু বা পুরন্দর পাণ্ডেরাই ব্যোমকেশকে ডেকে পাঠিয়েছেন। অনেকে সময় কেন্দ্রীয় সরকারও ব্যোমকেশের শরণাপন্ন হয়েছিল, যেমন ‘অমৃতের মৃত্যু’। যদিও অধিকাংশ সরকারী কেসেই গোপনীয়তার কারণে ব্যোমকেশ অজিতকে সঙ্গী করেনি আর তাই অজিতেরও সেগুলো লেখা হয়ে ওঠেনি। নাহলে সর্দার বল্লভভাই প্যাটেলের সঙ্গে ব্যোমকেশের ঠিক কি আলোচনা হয়েছিল সেটাও হয়তো জানা যেত।

এই প্রসঙ্গে টুক করে দেখে নিলাম ব্যোমকেশের গল্পের বিভিন্ন পুলিশ চরিত্রদের। অনেকেই একাধিকবার গল্পে ছিলেন। আর রাখালবাবু তো শেষ পাঁচটি গল্পেই উপস্থিত।


অন্যান্য গোয়েন্দাদের মত ব্যোমকেশও মাঝে মধ্যেই ছদ্মনাম বা ছদ্মবেশের সাহায্য নিয়েছে। যদিও দিগিন্দ্রনারায়ণ ধরে ফেলেছিলেন এবং অজিতের সরলতার সুযোগে অপদস্থ করতেও ছাড়েননি। ব্যোমকেশ নিশ্চয়ই এই ঘটনা ভুলে যায়নি। তাই ‘হেঁয়ালির ছন্দে’ বনমালীবাবুর ওপরে একই পদ্ধতি লাগিয়েছিল।

ফেলুদা-তোপসের মত না হলেও ব্যোমকেশের ঘোরাঘুরি কম হয়নি। প্রায় দুই-তৃতীয়াংশ কেসই কলকাতায় হলেও ‘চিত্রচোর’ বা ‘বহ্নি-পতঙ্গের’ মত স্মরণীয় গুল্পগুলো কলকাতার বাইরেই। আবার ‘চিড়িয়াখানা’ গল্পে কলকাতা আর ২৪ পরগণা (সম্ভবত দক্ষিণ) সমানভাবেই উপস্থিত।

এবার আসা যাক ব্যোমকেশের গল্পের অপরাধীদের কথায়। একজন গোয়েন্দার জনপ্রিয়তা অনেকটাই নির্ভর করে তার বিপক্ষের সুচতুর মস্তিষ্কের ওপর। বুনো ওল না হলে কি আর বাঘা তেঁতুল হওয়া যায়। আর ব্যোমকেশের গল্পে আছে প্রফুল্ল রায়, অনুকূল গুহ, ভুজঙ্গধর-বনলক্ষ্মীর মত অবিস্মরণীয় সব চরিত্র।
ব্যোমকেশের অধিকাংশ কেসেই অপরাধীরা খুন করতে পিছপা হয়নি। তবে অনুকূলবাবুর মত অনেকেই কোকেন গ্যাং চালাতে চালাতেই দরকার মত ভাটিয়া লোকটাকে বা অশ্বিনীবাবুকে পৃথিবী থেকে সরিয়ে দিয়েছিলেন। আবার ‘খুঁজি খুঁজি নারি’ গল্পে অপরাধী কেউ ছিল না। গল্পের রহস্য লুকিয়ে ছিল একটি গুপ্ত উইল খুঁজে বের করার মধ্যে।

শধু পুরুষ নয়, মহিলা অপরাধীদেরও সম্মুখীন হতে হয়েছে ব্যোমকেশকে। ‘অদ্বিতীয়’র প্রমিলা পাল তো স্মরণীয়। যে একই সঙ্গে স্বামী-স্ত্রী শান্তা সেন-তপন সেন সেজে বসবাস করত এবং ধরা পড়ে যাওয়ার পর ছুরি হাতে ঝাঁপিয়ে পড়তে গেছিল ব্যোমকেশের ওপর। আবার ভুজঙ্গধর-বনলক্ষ্মী, রতিকান্ত-শকুন্তলা বা হৈমবতী-বিজয় বিশ্বাসের মত জোড় বেঁধে অপরাধের পথে পা বাড়ানোর নজিরও কম নয়।


ব্যোমকেশের গল্পগুলোর ম্যাচুরিটি বোঝা যায় এই গল্পের অপরাধীদের পরিণতি দেখলে। ধরা হয়তো প্রায় সবাই পড়েছেন। কিন্তু অন্তত ৭টি গল্পে অপরাধীদের কোন শাস্তি হয়নি। এমনকি ‘রক্তের দাগ’ গল্পের ঊষাপতি বা ‘হেঁয়ালির ছন্দ’ গল্পের ভূপেশবাবুর প্রতি ব্যোমকেশের প্রচ্ছন্ন সমর্থনই ছিল। আবার প্রফুল্ল রায়, ভুজঙ্গধর-বনলক্ষ্মী বা সন্তোষ সমাদ্দারদের অপরাধী হিসেবে চিহ্নিত করা গেলেও তাদের ধরার আগেই তারা পালাতে পেরেছে পৃথিবী থেকে। 
সত্যান্বেষী ব্যোমকেশকে নিয়ে সাংখ্যতাত্বিক বিশ্লেষণ এই পর্যন্তই।



28 comments:

  1. Khub shundor laglo. Koyekta proshno:
    1. jeshob golpe ekadhik type er crime ache, jemon chitrochor e churi o khun, segulo te ki primary crime ta ke dhorecho na khun jehetu shobcheye boro crime tai khun ke dhorecho? (cocaine smuggling jehetu alada bhabe mentioned, tai mone hocche primary crime)
    2. sekhetre kon kon golpe khun ekkebare nei vs khun hoyeche, kimba number of khun diye ekta stat pele byapok hoy.
    3. ekaki mohila criminal bolte shanta sen chhara room no. 2 er sashuri-o achen Ar keu achen ki?
    4. choddonam ekadhik ache, kintu choddobesh bolte chiriyakhana-r shei bodragi firingi chhara ar kichu ache ki?
    5. Ochin pakhi bodhoy ekmatro case jekhane byomkesh khun ke condemn kore ebong khuni ke haate peyo kichu korenni.
    6. khuni ke haate naate dhora hoyeche erokom golper shonkhao kom noy... etar ekta stat chai.
    Part II er opekkhay roilam.

    Amritorupa Kanjilal
    (http://riversihaveknown.com/)

    ReplyDelete
  2. Dhonyobaad!!
    Eke eke uttor dilam.

    1. Jesob golpe ekadhik crime achhe segulote sob kotakei dhorechi. Tai 32ta golpo holeo crime 39 ta. Tai 'Satyanweshi' r khun ar caocain smugling dutoi dhorechi.
    2. 6ta golpe kono khun hoeni. Simonto Heera, Makarshar Ros, Upasanhar, ManiMandan, Khnuji Khnuji Nari
    , chholonar chhondo.
    3. Na ar keu nei. Shudhu oi dujon.
    4. Pother Knata e Briddho Firingi, chholonar chhonde Rakhalbabur company r assistant... ar Uposonhare oggyat juboker lash!
    5. serokom ekadhik case ache. Ushapoti, Bhupesh, Bishu Pal-Suresh Rakhkhit.
    6. Last chart ta dekho. Kojon dhotra poreche, kojon paliyeche, kojon mara gechilo ar kojon ke Byomkesh chere diyechilo seta deoya ache.

    ReplyDelete
  3. onobodyo. bhasha nei amar.
    Please eta kothao publish kora hok formally.

    ReplyDelete
  4. Tapo ki korechhis re! ekta ekdom oitihasik kaaj kore felechhis to!

    ReplyDelete
  5. Dhonyobaad dujonkei!!

    Formally publish er kothata mathay rakhbo.

    ReplyDelete
  6. Excellent Tapa :) paper ta publish kor!
    just curious to know how did you collect the data ? some kind of natural language processing for Bengali text and fonts ?

    ReplyDelete
  7. Thanks Satyamda.

    Tobe serokom kono software bangla font er jonyo achhe bole amar jana nei. Sutorang boigulo barbar pore notes niyei ei lekhata toiri korechhi. Prothome ekta excel e golpo dhore dhore details gulo note korechhilam.

    ReplyDelete
  8. Finally post holo eta!!! Darun hoyechhe.....
    ekta proshno....
    1> Technically Makarsha-r rosh-eo to kono oporad nei.....bhodrolok nijei drugs niten....sheta ke ki crime bole dhorechhish?

    ReplyDelete
  9. Trust me, egulo thekei chinta-bhabna r mil gulo dhora pore! Ami prothome Makorsa r ros e kono oporadh nei dhorechilam. Kintu pore mone holo je, oi bhabe bari r lok ke fnaki diye peon ke diye drugs aniye khaoa take crime bole dhorao jae!

    ReplyDelete
  10. visual gulo byapok! osadharon effort boss! Kolkata te tana rickshaw ar kolkatar baaire te steam engine! achcha gopler doirgher measure ta ki...# of pages?

    ReplyDelete
  11. Hna... kintu jehetu setar dimension change hote pare future e tai just average ber kore setar songe compare kore diyechhi!

    ReplyDelete
  12. বিষয়নির্বাচন আর লেখা নিয়ে তো বলার কিছু নেই, এই পোস্টটার পেছনে যে পরিশ্রম আছে সেটাকে অভিবাদন জানাচ্ছি। খুব ভালো, তপোব্রত।

    ReplyDelete
  13. ধন্যবাদ কুন্তলা! পরিশ্রম আর কোথায়... মাঝখান থেকে সবকটা গল্প একদম উল্টেপাল্টে তিন-চার বার পড়া হয়ে গেল।

    ReplyDelete
  14. shadhu shadhu tapo da! shobcheye interesting laglo erom ekta interpretation er kotha bhabte parata..daarun hoyechhe dada :)

    ReplyDelete
  15. Never saw such a fine analysis of Byomkesh Bakshi

    ReplyDelete
  16. Dhonyobaad Bhaitu!

    Thanks Prasenjit!

    ReplyDelete
  17. সত্যান্বেষী ব্যোমকেশের কাহিনি আমরা সবাই গোগ্রাসে পড়ি ঠিকই, কিন্তু তার এমন বিশ্লেষণ এর আগে কেউ করেছেন বলে মনে পড়ছে না| সাধু উদ্যোগ| অভিনন্দন ও ধন্যবাদ|

    ReplyDelete
  18. বেশ মজা লাগল পড়তে!

    ReplyDelete
  19. ধন্যবাদ ঋজু।

    ReplyDelete
  20. @সুশ,
    আমার লিখতেও বেশ মজা লেগেছে!

    ReplyDelete
  21. Very good research and well written

    ReplyDelete
  22. Mugdhyo. Bakruddhyo. Eirokom goendar case diary ke post mortem er vabna je mathay eschay ebong etar ato sukkhyo anusondhan vabnar baire. Khub valo..

    ReplyDelete
  23. Daarun Kaaj
    Apnar ei porishromer jonyo Byomkesh Samagrata abaar porechhi

    ReplyDelete

"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”