Saturday, September 15, 2018

লন্ডনে লণ্ডভণ্ড - ৩


~~ জলি ওল্ড লন্ডন ~~
পরদিন সকালে ঘুম ভেঙে গেছিল ছটার আগেই। আগের রাত্তিরের গরম কেটে গিয়ে তখন হাল্কা হাওয়া দিচ্ছে। শুয়ে না থেকে বেরিয়ে এলাম। যেকোন শহরেই পায়ে হেঁটে ঘুরতে হয়। আর এই হোটেলের দরজা ২৪ ঘন্টাই খোলা। সুতরাং পাড়াটা এক চক্কর বেরিয়ে এলাম। সেই ব্রিটিশ স্টাইলের পর পর একই রকমের বাড়ি, সামনে রেলিং, কোথাও কোথাও ফুলের টব, একটা বাড়ির সামনে একটা শ্বেত পাথরের হাতিও দেখেছিলাম। আর একটা ভীষণ সুন্দর জিনিস হল ল্যাম্পপোস্ট থেকে ঝুলন্ত টবে ফুলের গুচ্ছ। এদেশেও জায়গায় জায়গায় করলে পারে!

মোটামুটি পাবলাভের ডানদিক-বাঁদিক বুঝে নেওয়া গেল। তারপর হোটেলের ঠিক পাশের টারপেন্টাইন লেন দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে একটু এগিয়ে দেখি সামনেই তাঁকে দেখা যাচ্ছে। তিনি, আমাদের চিরপরিচিত গঙ্গা… থুড়ি টেমস। পরে শ্রেয়সী দেখে বলেছিল, ছোটবেলা থেকেই লন্ডন শুনলে ওর সেই ভূগোল বইয়ের ‘টেমস নদীর তীরে অবস্থিত লন্ডন শহর…’ মনে পরে যায়। যাই হোক, টেমসের ধার দিয়ে প্রথমবার হাঁটাটা মনে থাকবে। এইসব কারণেই তো ঠেঙ্গিয়ে অদ্দুর যাওয়া। সামনেই চেলসী ব্রিজ আর নদীর ঠিক উল্টোদিকে ব্যাটারসী পাওয়ার স্টেশান। পরে সর্বজিতের কাছে শুনেছিলাম, ওটা এখন অ্যাপেল কিনে নিয়ে নিজেদের লন্ডন হেডকোয়ার্টাস বানাচ্ছে।
টেমস ভ্রমণের পর ফিরে পাবলাভের লবিতে বসে ল্যাধ (এবং জল) খাচ্ছি, ইমরান এসে আলাপ করল। ইমরান রাজা, পাকিস্তানী, গত বারো বছর ধরে লন্ডনে আছে। এখানেই পড়াশুনো। যা বুঝলাম, পরিবারে অনেকেই আর্মিতে আছে। সেইসব কন্ট্যাক্টের জোরেই বাইরে থেকে পড়াশুনো করেছে। আরেক ইমরান মানে ইমরান খানের অন্ধ ভক্ত। তখনো ইমরানের শপথগ্রহণ হয়নি কিন্তু আমাদের ইমরান তাতেই ভারী উত্তেজিত। বলল, এ অন্য রকমের লোক, সত্যিকারের লিডার, দেশটার জন্য ভালো কিছু করবে। কিন্তু পশ্চিমের মিডিয়া সেসব না দেখিয়ে উল্টে বদনাম করবে। বেশ করেছে নিজের শপথগ্রহণে ইউরোপ-আমেরিকাকে না ডেকে শুধু ইন্ডিয়াকে ডেকেছে, ও জেনুইনলি ইন্ডিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করতে চায় ইত্যাদি। ইমরান এতোই উত্তেজিত যে জানালো সে আর দুদিন পরে দেশে ফিরে যাচ্ছে। ইমরান খানের নেতৃত্বে গড়া নতুন পাকিস্তানে কাজ করতে চায় সে। শুনে ভারী ভালো লাগল।
ততক্ষণে শ্রেয়সীও নিচে এসে আড্ডায় যোগ দিয়েছে। সাধারণ মানুষের কথা হচ্ছে, ঘোরার গল্প হচ্ছে। পিউ যথারীতি নিজের ফেভারিট টপিক খাবারের দিকে প্রসঙ্গ ঘুরিয়ে দিয়েছে। সেই লাহোরের ফুড স্ট্রিটের কাবাব। ইমরান জানালো যে, ওর আর্মি কন্ট্যাক্ট দিয়ে আমাদের ভিসা বের করিয়ে দেবে, সুতরাং ওর সঙ্গে যেন যোগাযোগ রাখি। ফেসবুকে অ্যাডও করা হল নিজেদের। খুব ভালো লেগেছিল ইমরানকে, একটা স্বপ্ন দেখা মানুষ!
ভারতে ফেরার পর একদিন ইমরান ফেসবুক মেসেঞ্জারে পিং করেছিল। ভালো খবর দেয়নি। দেশে এসে ভালো লাগেনি ওর। কদিন থেকেই দেখেছে, দেশের মানুষ ফাঁকিবাজ, দূর্নীতিগ্রস্ত। এমনকি ওর আত্মীয়রাই নাকি সবসময় পয়সার লোভে পেছনে পড়ে আছে। আমার সঙ্গে কথা বলছিল, ভারতে চাকরির সুযোগ নিয়ে। শেষ পর্যন্ত কাতার বা সিঙ্গাপুর চলে যাওয়ার কথা বলেছিল। একদিন খবর নিতে হবে ওর।
ইমরানের সঙ্গে আড্ডা মারার পর শ্রেয়সীকে নিয়ে একটু পায়ে হেঁটে ভ্রমণ হল। একদিকে টেমস অন্যদিকে ভিক্টোরিয়া প্লাজা। আমাদের ফোনগুলো তখনো খুব একটা চলছে না। সেগুলো ঠিক করানোর ছিল। ভিক্টোরিয়া প্লাজার একটা বড় সুপারমার্কেট থেকে স্যান্ডউইচ কিনে ব্রেকফাস্ট করলাম। যদিও পাবলাভে ফিরে মনে পড়েছিল, যে আমাদের হোটেলেই ফ্রি ব্রেকফাস্ট আছে!
যাইহোক, দুজনে সেজেগুজে এবং শ্রেয়সীর সৌজন্যে কিঞ্চিৎ দেরী করে বেরিয়ে পড়লাম। গভর্নর্স পার্ক থেকে ডবলডেকার বাসের দোতলার সামনে সিটে বসে সেলফি তুলতে তুলতে চললাম সেন্ট জনস্‌ উড। বাসস্ট্যান্ড থেকে নেমে মিনিট চারকে হাঁটলেই প্রথমে চোখে পড়ে লর্ডস ট্যাভার্ন আর তারপরেই লর্ডসের গ্রেস গেট।
লর্ডস ট্যুরের টিকিট অনলাইন কাটতে হয় (https://www.lords.org/lords/tours-and-museum/), ওখানে কাটার কোন ব্যবস্থা নেই। টিকিট পাওয়া যায় মোটামুটি তিন মাস আগে থেকে। তবে যেসব দিন খেলা থাকে সেসব দিনে ট্যুর বন্ধ থাকে বলাই বাহল্য।
আমরা কুড়ি-পঁচিশ জনের দলের লর্ডস ট্যুর শুরু হল লর্ডসের মিউজিয়ামে। এক তলায় রয়েছে বিভিন্ন খেলোয়াড়দের ছবি, খবরের কাগজের কাটিং, সরঞ্জাম, জার্সি, মেমেন্টো। তাদের মধ্যেই সাজিয়ে রাখা আছে ১৯৮৩ সালের প্রুডেনশিয়াল কাপের ট্রফি। কপিলদেবের হাতে এই ট্রফির ছবি দেখেছি বহুবার। এবার সামনাসামনি দেখলাম। তারপর দোতলায় উঠতে পেলাম তাকে। লাল টেরাকোটার  সেই ছোট্ট ট্রফি। ইংল্যান্ড এবং অস্ট্রেলিয়ার টেস্ট সিরিজের পুরস্কার। অ্যাসেজ! গাইড অ্যাসেজের জন্মের গল্প কেউ জানে কিনা খোঁজ নিচ্ছিলেন, ট্যুরটাকে ইন্টার‍্যাক্টিভ করার জন্য। দিন-তারিখ অবধি বলে দেব সেটা বোধহয় আশা করেননি। যাই হোক, সেখানে শচীন, সৌরভ, লক্ষণদের জার্সিও দেখলাম। যদিও দাদার জার্সিটা কলকাতা নাইট রাইডার্সের।
মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে আমাদের গন্তব্য ছিল ড্রেসিংরুম। একে একে হোম এবং অ্যাওয়ে টিমের ড্রেসিংরুম দর্শন হল। ড্রেসিংরুমের প্রধান আকর্ষণ সেই বিখ্যাত অনার্স বোর্ড। বিশেষ করে অ্যাওয়ে টিমের শতরানের বোর্ডটা। যেখানে সৌরভ, রাহুল ছাড়াও অজিত আগারকারের নাম আছে কিন্তু শচিন তেন্ডুলকার এবং ব্রায়ান লারা  নামক দুই ব্যাটসম্যান অনুপস্থিত। অবশ্যই যাওয়া হল ড্রেসিংরুমের লাগোয়া বারান্দায়। যেখানে ২০০২ সালের ন্যাটওয়েস্ট ট্রফির ফাইনাল জিতে নিজের জামা খুলে উড়িয়ে দিয়েছিলেন সৌরভ। যদিও আমাদের গাইড খুব পরিষ্কারভাবেই জানিয়ে দিয়েছিলেন যে, ব্যাপারটা ওনাদের একদমই পছন্দ হয়নি! লর্ডস বলে কথা! রাহুলকে নিয়ে অবশ্য ভদ্রলোক খুশীই ছিলেন। রাহুলের শেষ ট্যুরের সময় কিভাবে একজন স্টুয়ার্ডের কথায় ড্রেসিংরুমের একটি বিশেষ জায়গায় বসে রাহুল সেঞ্চুরি পেয়েছিল তার গল্প করলেন। সেই বিশেষ জায়গায় বসে শ্রেয়সীরও ছবি তোলা হল!

 পরের গন্তব্য লর্ডসের লংরুম, যেখানে লর্ডসের মেম্বারদের মধ্যে দিয়ে ব্যাট করতে নামতে হয়। অসাধারণ কিছু হাতে আঁকা ছবি ছিল ঐ ঘরে কিন্তু ছবি তোলার সুযোগ পাইনি। তার পাশেই কমিটিরুম। গত ২৩০ বছরের বহু ইতিহাসের সাক্ষী। শুনলাম হেরিটেজ লিস্টের একদম ওপরের দিকে থাকার কারণে এইসব ঘরের বাইরে এবং ভিতরে খুব বেশী পরিবর্তন করা যায় না। তাই ঘরের ভেতরে এখনো সেই কাঠের টেবিল-চেয়ার। শুধু একটা টিভি স্ক্রিন যোগ হয়েছে আজকাল। রীতিমত গায়ে কাঁটা দিয়েছে আমার।
এরপরে মউন্ড স্ট্যান্ডে মাঠের ধারে বসে ছবি ইত্যাদির পর আমরা গেলাম সেই বিখ্যাত জে পি মর্গান মিডিয়াসেন্টারে। পঁচাশি ধাপ সিঁড়ী দিয়ে সেই বিখ্যাত মিডিয়াসেন্টার। যদিও মিডিয়াসেন্টারের আসল ঘটনা পরে একদিন ঘটেছিল। সেটা পরেই বলব।
মোটামুটি এটাই ছিল আমাদের লর্ডস ট্যুর। সবশেষে লর্ডস শপে গিয়ে একটু কেনাকাটাও হল। মনে রাখার মত স্মৃতি। ভবিষ্যতে লন্ডন গেলে আবার একবার ট্যুরে যাওয়ার ইচ্ছে আছে।
লর্ডস থেকে বেরিয়ে একটা বাস নিয়ে আমরা চলে এলাম বেকার স্ট্রিট। ২২১,বির ঠিকানায় শার্লক হোমসের সঙ্গে দেখা করতে। কিন্তু যথারীতি শার্লকবাবুর বাড়ীর সামনে লম্বা লাইন। সুতরাং সেসব কাটিয়ে আমরা পাশের স্যুভেনির শপে ঢুকলাম। ভারতের বাইরে অধিকাংশ জায়গাতেই এই স্যুভেনির শপগুলোর প্রাধান্য। আর ইংল্যান্ডের দোকানগুলো তো প্রায় মিউজিয়াম! কী নেই সেখানে, শার্লক হোমসের ভিসিটিং কার্ড অবধি দেখেছিলাম। তাছাড়া কলম, চাবির রিং, ম্যাগনেট, টুপি, ছবি, বই, ঘড়ি, টিশার্ট, এসব তো প্রায় সব জায়গাতেই! সেখানে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা গেলাম বেকার স্ট্রিটের মোড়ের মাথার প্যালেস্টাইন রেস্টুরেন্ট ‘শাকশুকা’য়। সেখানে মাংসের পরোটা জাতীয় কিছু খাওয়া হয়েছিল। নাম ভুলে গেছি।
বাইরে তখন প্রায় তেত্রিশ ডিগ্রী, তাঁর মধ্যে শ্রেয়সী নতুন জুতোয় হেভি চাপ খাচ্ছিল। সুতরাং ওখান থেকে একটা বাস নিয়ে হোস্টেলে ফেরা হল। সেখানে আবার কিছুক্ষণ ল্যাধ খেয়ে জুতো চেঞ্জ করে বেরোন হল কিংস ক্রস স্টেশানের উদ্দেশ্য। কারণ সেখানেই আছে প্ল্যাটফর্ম ৯৩/৪ , যেখান থেকে প্রতি বছর পয়লা সেপ্টেম্বর হগওয়ার্টস এক্সপ্রেস রওনা দেয় হগওয়ার্টস স্কুল অফ উইচক্র্যাফট অ্যান্ড উইজার্ডরির উদ্দেশ্য।
কিংস ক্রস মস্ত বড় স্টেশান। সঙ্গে প্রচুর দোকান, ওপরে খাওয়ায়র জায়গা, সামনে চেয়ার পাতা। সেখানে বসে লোক দেখে সময় কাটানোর চমৎকার ব্যবস্থা আছে। সঙ্গে একটা দেওয়াল, ওপরে ৯৩/৪ লেখা। নিচে একটা ট্রলি এবং তাতে কিছু জিনিস, যেগুলো নিয়ে দেশেবিদেশের হ্যারির ভক্তরা ঐ দেওয়ালে ঢুকে যাওয়ার পোজে ছবি তুলতে পারে। সেখানেও লম্বা লাইন, তাই ঐ পোজ দিতে যাইনি। সেরকম ইচ্ছেও ছিল না, মাগলদের এসব করা উচিত নয়! পাশের হ্যারি পটার থিমড দোকানটাও চমৎকার। রকমারী জিনিস ছিল সেখানেও।

ওসব মিটিয়ে ওপরের খাবারের দোকানগুলোর সামনে বসে ডেকে নিলাম আমাদের বন্ধু সর্বজিতকে। তারপর কিছুক্ষণ বসে আড্ডা, তারপর হাঁটতে হাঁটতে প্রথমে একটা ইতালিয়ান রেস্টোরায় পাস্তা ভক্ষণ। তারপরে একটু বিয়ার কিনে কিংসক্রসের পেছনদিকে খালের ধারে বসে আরো কিছু আড্ডা। এইভাবেই শেষ হল আমাদের লন্ডনের প্রথম দিন। পাবলাভে যখন ঢুকছি তখন নিজের পাব জমজমাট। কিন্তু আমাদের আর এনার্জি নেই। তাই হাতমুখ ধুয়ে সোজা বিছানায়, পরের দিনের প্ল্যান ভাবতে ভাবতে।

Monday, September 10, 2018

লন্ডনে লণ্ডভণ্ড - ২

~~শ্রেয়সীর লন্ডন প্রবেশ~~

প্রথম পোস্টটা পড়ে অনেকেই খরচার কথা বলেছেন। কথা দিলাম, পুরো লেখার শেষে খরচের হিসেবটা ডিটেলে দিয়ে দেব। লেখার মধ্যে টুকটাক উল্লেখ তো থাকবেই। মোটামুটি খরচ হয়েছে মাথাপিছু এক লাখ ষাট-পঁয়ষট্টি মত। কেনাকাটা ছাড়া।
যাই হোক, আবার কলকাতা থেকে মুম্বাইয়ের বিমানে ফিরে যাই। সেখানে তখন খাবার নিয়ে একটা বিতর্কের সৃষ্টি হব হব করছে! সেটা লেখার আগে একটা জিনিস বলা উচিত। আমরা দুজনেই মানে এই আমি আর পিউ কেউই খুব একটা চালাকচতুর নই। তাই ঘুরতে গিয়ে অনেক জিনিসই আমাদের চমকপ্রদ লেগেছে বা না বুঝে ছড়িয়েছি যেগুলো অন্যদের অতটাও অদ্ভুত নাও লাগতে পারে।
যাই হোক, কলকাতা থেকে মুম্বাইয়ের বিমানে ব্রেকফাস্ট এল। ভেজ না ননভেজ সেটারও যথাযথ উত্তর  দেওয়া হল। তা আমার প্লেট নিয়ে ঐ রাংতা খুলে দেখলাম যে ননভেজ বস্তুটি হল ডিমের ভুজ্জি। তা ভালো! যা পাওয়া যায়। কিন্তু পিউ জিনিসটা দেখেই এয়ারহোস্টেস দিদিমণিকে ডেকে বলল, “এটা তো ভেজ!” কারণ ওর বাটিতে যে জিনিসটা আছে সেটা দেখতে হলুদ হ্লুদ, অনেকটা আমাদের পেঁপের ঝোলের মত! দিদিমণি হেসে বললেন, “না না, ওটাই নন ভেজ!” তখন বস্তুটিকে নেড়ে ঘেঁটে দেখে বোঝা গেল যে ওই বস্তুটিও ডিমের ভুজ্জি, কোন অজ্ঞাত কারণে ওটাকে হলুদ, মশলা দিয়ে রান্না করা হয়েছে। আরো একটু পরে বুঝলাম যে, পুরোটাই ওভাবে রান্না করা হয়েছে, এবং আমার প্লেটে যে অংশটা এসেছে সেখানে মশলা ভালো করে ঢোকেনি বলে ডিম-ডিম ভাবটা রয়ে গেছে আর তাই দেখে বুঝতে পেরে গেছি।
যাই হোক, মুম্বাইয়ে ঠিক সময়ই পৌঁছে গেছিলাম। তারপর এদিক ওদিক অনেকটা হেঁটে, এক তলা দোতলা করে দরকারী কাজকর্ম মিটিয়ে আমরা লাউঞ্জে পৌছলাম। লাগেজ একদম কলকাতাতেই জমা পড়ে গেছিল, তাই সেসব নিয়ে চাপ ছিল না। আমরা এয়ারপোর্টে একটু পাও ভাজি ইত্যাদি খেয়ে টুক করে লন্ডনের প্লেনে উঠে পড়লাম। এমনিতে সব ঠিকই ছিল। যদিও শুরুতেই প্লেনে উঠিয়ে
প্রিমিয়াম ইকনমি বা বিজনেস ক্লাসের মধ্যে দিয়ে হাঁটিয়ে সিটে পাঠানোটা একটু দুঃখজনক! যেন দেখাচ্ছে, দ্যাখ শালা, সস্তার টিকিট কেটে কী মিস করলি! (ফ্লাইট টিকিট বুক করেছি মেকমাইট্রিপ থেকে, জেটের ফ্লাইট, ৯২,০০০ মত, তাতে আমার ক্রেডিট কার্ডের একটা অফারের সৌজন্যে ৭,৫০০ টাকা ক্যাশব্যাক পেয়েছিলাম)
অন্য যেকোন লম্বা প্লেনজার্নির এটাও বেশ বোরিং ছিল। ঐ টুকটাক খাওয়া দাওয়া, সিনেমা দেখা আর অনেক ঘুমিয়ে যখন লন্ডন পৌঁছলাম তখন ওখানে বিকেল, বাইরে ঝকঝকে রোদ।
এয়ারপোর্টে নেমে ইমিগ্রেশানে অনেক সময় লেগেছে। সে প্রায় চার-পাঁচশো লোকের লাইন। সেও টুকটুক করে পার হয়ে ইমিগ্রেশান কাউন্টারের কাকুর সঙ্গে একটু খেজুর করে পাসপোর্টে স্ট্যাম্প পাওয়া গেল। যথারীতি ছড়িয়ে যে বেল্টে লাগেজ আসছিল সেটায় না গিয়ে পাশের বেল্টে খুঁজছিলাম। এয়ারপোর্টের এক কর্মচারী ভুল ধরিয়ে দেওয়ায় নিজেদের লাল রুকস্যাক আর নীল স্যুটকেসও পাওয়া গেল। এর পরের কাজ ছিল অয়স্টার কার্ড আর সিম নেওয়া।
এয়ারপোর্টেই একাধিক কাউন্টারে অয়স্টার কার্ড পাওয়া যাচ্ছিল। যে দিদিমণি কার্ড বিক্রি করছিলেন তিনি কার্ডের ব্যবহার বুঝিয়ে ‘সিটিম্যাপার’ নামক একটি অ্যাপ নামানোর উপদেশ দিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে গুগল এবং ইউটিউবের কল্যানে ওই অ্যাপের প্রয়োজনীয়তা আমার জানা এবং সেটা কলকাতায় থাকতেই আমার ফোনে নামানো হয়ে গেছে!
সিটিম্যাপার খুবই কাজের জিনিস এবং লন্ডনে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিয়ে ঘুরতে গেলে সিটিম্যাপার না নিয়ে ঘোরা অসম্ভব না হলেও বোকামি তো বটেই। মোটামুটি লন্ডন এবং গ্রেটার লন্ডনের যেকোন দুটো জায়গার মধ্যে যাওয়ার সমস্ত সাম্ভাব্য উপায় এই অ্যাপ দেখিয়ে দেয়। হেঁটে গেলে কতক্ষণ লাগবে (এবং কত ক্যালোরি ঝরবে), উবেরে গেলে কতক্ষণ এবং কত ভাড়া, বাসে, ট্রেনে বা আন্ডারগ্রাউন্ডে (এমনকি ফেরীও) গেলে কত বিভিন্নভাবে যাওয়া যাবে এবং তাতে ভাড়া এবং সময় কত লাগবে তা এই অ্যাপ বলে দেয়। এবং অবশ্যই পরবর্তি বাস বা ট্রেনের সময়ও দেখিয়ে দেয়। পুরো দু সপ্তাহ আমাদের নিজেদের মত ঘোরার পেছনে সিটিম্যাপারের অবদান ভোলার নয়!
সিম নেওয়া হল লাইকার। এদের ১৫ পাউন্ডের প্যাকে এক মাসের জন্য, লোকাল কল, ৫ জিবি ডেটা আর ভারতসহ ৪৩টা দেশে ইন্টারন্যাশানাল কলিং ফ্রি। তবে একটু মনে রাখবেন যে, এই প্যাক ভরাতে হলে সবসময় মোবাইল ডেটা অফ করে ভরতে হয়, তারপর একটা বিশেষ নম্বর ডায়াল করে প্যাক অ্যাক্টিভেট করতে হয়। ডেটা অফ না করা থাকলে পাউন্ড ভরার সঙ্গে সঙ্গেই ডেটার জন্য পয়সা কাটতে শুরু করে এবং ওই বিশেষ প্যাকটা চালু হয় না। এটা না জানায় আমার ১৫ পাউন্ড গচ্চা গেছিল। শ্রেয়সীর সমস্যা ছিল অন্য। ওর প্যাক চালু হওয়ার পরেও ইন্টারনেট চলছিল না। সেটা পরেরদিন বিকেলে একটি দোকানে ৫ পাউন্ডের বিনিময়ে ঠিক করাতে হয়। 
যাই হোক, হিথরো থেকে যখন ট্রেনে উঠলাম তখন আটটা বেজে গেছে। আমাদের গন্তব্য ভিক্টোরিয়া স্টেশান। মাঝে একবার চেঞ্জও করতে হল। লন্ডনের আকাশে তখন বিষণ্ণ বিকেল, সন্ধ্যে নামছে… মানে ওই সাড়ে আটটা বাজে! ভিক্টোরিয়ায় নেমে রাতের জন্য স্যান্ডউইচ কিনে আমরা হাঁটা লাগালাম আমাদের পরবর্তী চারদিনের ঠিকানা পাবলাভ হোস্টেলের উদ্দেশ্য। পথ দেখালো সিটিম্যাপার। মোটামুটি মিনিট পনেরো হেঁটে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছলাম। তার আগে চোখে পড়েছে ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশান। এখান থেকে আমাদের টনটনের বাস ধরার কথা। মাঝে একটা থানাও দেখেছিলাম। শ্রেয়াসী ইন্টারনেট চলছে না বলে ঘ্যানঘ্যান করায় ওকে পুলিশে দেওয়ার ভয়ও দেখিয়েছিলাম।
হোস্টেলে ঢুকে নিজেদের পাসপোর্ট দেখিয়ে নাম-টাম মিলিয়ে ঘরে ঢোকার কম্বিনেশান পাওয়া গেল। পাবলাভে মোট ছটা ডর্ম আছে এবং তাদের প্রত্যেকে কম্বিনেশান লক আলাদা আলাদা। তখনো অবধি লন্ডনে একেবারেই ঠাণ্ডা লাগেনি, বরং হাল্কা গরমভাব। নিজেদের ঘরে ঢুকে চমকে গেলাম!
ঘর পুরো ভ্যাপ্সা গরম এবং তার সঙ্গে গোটা পনেরো লোকের একসঙ্গে থাকার দরুন একটু গুমোটভাব। ব্যাগ-ফ্যাগ গুছিয়ে বসেও গরমের জন্য অস্বস্তিই হচ্ছিল। তাই একবার নিচে যাওয়া হল এয়ার কন্ডিশানের ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে। রিশেপ্সানের ছেলেটি পাতি হাত উলটে জানালো, এসি বা ফ্যানের কোন ব্যবস্থা এই হোস্টেলে নেই!
সুতরাং আবার ঐ ঘরেই প্রত্যাবর্তন। ভাগ্যক্রমে, যে খাটের নীচের এবং মাঝের বাংক পাওয়া গেছিল সেটা জানলার পাশেই, তাই জানলার পর্দা সরিয়ে একটু হাওয়া আসার ব্যবস্থা করা হল। তারপর ফ্রেস হয়ে ওই স্যান্ডউইচ খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ক্লান্তি ছিল, একটু পর থেকে গরমও বিশেষ লাগেনি। ঘুমলাম ভালোই। পরদিন সকালেই বেরনোর কথা। লর্ডস ট্যুরের টিকিট আছে এগারোটার সময়।

"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”