Sunday, September 29, 2013

কিছু কথা বলার জন্য...

ডিসেম্বর মাসটা সবসময়ই স্পেশাল। স্যার জাদেজার জন্মদিন তো বটেই, মা-র জন্মদিন, আমার নিজের জন্মদিন, আমার প্রথম চাকরি পাওয়া, শ্রেয়ার সঙ্গে প্রথম দেখা, সব মিলিয়ে ডিসেম্বর মাস মানেই হৃদয়ের খুব কাছের অনেকগুলো ঘটনা। আর তার সঙ্গেই ২০১১ সালের ডিসেম্বর মাসকে মনে রাখার আরো একটা কারণ হল ‘কথা তো বলার জন্যেই’ তে প্রকাশিত আমার প্রথম লেখা।


২০১১ সালের ১লা ডিসেম্বর ‘কথা তো...’ ওয়েব ম্যাগাজিনে প্রকাশিত হয় আমার লেখা গল্প ‘সেই লোকটা’। আমার জীবনের অন্যতম সেরা আর মনে রাখার মত দিন সেটা।
ছোটবেলা থেকে লিখতে ভালোবাসি। দীর্ঘদিন ধরে স্বপ্ন দেখেছি আমার লেখা ছাপা হচ্ছে শুকতারা, আনন্দমেলা বা দেশ পত্রিকায়। সেই স্কুলে পড়তেই নিজের অপটু, কাঁচা হাতের লেখা গল্প, উপন্যাস, কবিতা বন্ধুদের পড়িয়ে তাদের হাসি-ঠাট্টা, পেছনে লাগার পাত্র হয়েছি অনেকবার। শেষপর্যন্ত নিজে ব্লগ লেখা শুরু করেছি ২০০৮ সালে।
কিন্তু ‘সেই লোকটা’ আমার প্রথম গল্প যেটা আমার নিজের ব্লগের বাইরের অন্য এক সাইটের মাধ্যমে অন্তর্জালের এই বিশাল জগতে জায়গা পেয়েছিলআমার প্রথম লেখা যেটা আমার নিজের বন্ধু-বান্ধবের গণ্ডী পেরিয়ে পৌঁছে গেছিল আমার অচেনা পাঠকদের কাছে।

এখনও মনে আছে, প্রথম লেখা পাঠানোর আগে সুনন্দকে আমি চিনতাম না। ফেসবুকে কোন এক বন্ধুর দেওয়ালে ‘কথা তো বলার জন্যেই’-র নানা রকমের লেখা দেখে আমি ২০১১ সালের নভেম্বর মাসে ‘সেই লোকটা’ সুনন্দকে মেল করি। সেই সময় আমি বাংলাওয়ার্ড ব্যবহার করে লিখতাম। প্রায় কুড়ি দিন পর সুনন্দ জানায় যে, গল্পটা তার পছন্দ হলেও অভ্রয়ে লেখা না পাঠালে তা প্রকাশ করা তার পক্ষে সম্ভব নয়। সুনন্দর কথা মত গল্পটা আবার অভ্রতে টাইপ করে পাঠাই আমি, আর তার পরেই প্রকাশিত হয় ‘সেই লোকটা’ ‘কথা তো...’-র সাইটে।
সেই শুরু, তারপর থেকে সুনন্দ প্রকাশ করেছে আমার অনেকগুলো লেখা। কিছুদিন লেখা না পাঠালেই এসে তাগিদা দিয়ে গেছে নতুন লেখার জন্য। এমনকি আমার ব্লগের পোস্ট পড়ে সেই লেখা ওকে না দিয়ে নিজের ব্লগে বের করে দিয়েছি কেন সেই নিয়ে ছদ্ম কলহ করেছে আমার সঙ্গে।
আমি একের পর এক পাঠিয়ে গেছি ‘মাংস’, ‘বর্ণময় পর্নো’, ‘বৃষ্টিমঙ্গল’ মত নানা ধরণের লেখা। সেগুলো বেড়িয়েছে ‘কথা তো...’-র সাইটে। অচেনা-অজানা জনগণের সঙ্গে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক হয়েছে লেখার গুণাগুণ নিয়ে।
সুনন্দ আর সংহিতার সঙ্গেও কথা হয়েছে লেখা নিয়ে, ওদের মতামত, প্রশ্নোত্তরের মধ্যে দিয়ে লেখার মান উন্নতি করার চেষ্টা চলেছে, এখনও চলছে।

এই সপ্তাহে ‘কথা তো বলার জন্যেই’-র সাইটে প্রকাশিত হয়েছে আমার নতুন লেখা ‘প্যাঁচাকাহিনী’। এই পত্রিকায় প্রকাশিত এটা আমার দশম লেখা!! আমার কাছে এটা একটা অবিশ্বাস্য ব্যাপার! যখন প্রথমবার লেখা পাঠিয়েছিলাম তখন দশটা তো দূরের কথা, আমার আর একটা লেখাও আর কোথাও কোনদিন প্রকাশিত হবে বলে ভাবিনি। কিন্তু পৃথিবীর আরো হাজারটা অত্যাশ্চর্য্য ঘটনাগুলোর মত এই জিনিসটাও ঘটেছে। আমার ব্লগ ছাড়া আরো একটা ঘর তৈরী হয়েছে আমার লেখাগুলোর।
আমি এখনও স্বপ্ন দেখি নানা ধরণের পত্রিকায় প্রকাশিত হচ্ছে আমার লেখা। হয়তো একদিন বইমেলার আসরে আরো ১০০-২০০ বইয়ের সঙ্গে বেরোচ্ছে আমার লেখা গল্পের বই। জানি না সে স্বপ্ন আদৌ কোনদিন বাস্তবায়িত হবে কিনা, কিন্তু আমি জানি ‘কথা তো...’ আমার পাশে আছে সব সময়, আমার কোন রকম দরকারে-অদরকারে ‘কথা তো...’-র পরিবার এগিয়ে আসবে সব সময়, আবার হয়তো ওদের দরকারের সময় বন্ধুর মত হাত বাড়িয়ে দেব আমি।

তবু একবার, হয়তো কিছুটা অকারণেই, আন্তরিক ধন্যবাদ জানাই ‘কথা তো বলার জন্যেই’-কে। ভগবানের কাছে প্রার্থনা করি আরো বেশি, বেশি পাঠকদের কাছে পৌঁছে যাও তোমরা। অবশ্য তাতে আমার লাভের ভাগটাও কম নয়, ‘কথা তো...’ নতুন পাঠকরা কি আর আমার দু-একটা লেখায় ক্লিক করে দেখবেন না!

আর সুনন্দ, নতুন লেখা মাথায় ঘুরছে, আর কদিনের মধ্যেই হয়তো এগারো নম্বরটাও পেয়ে যাবে।

Saturday, September 14, 2013

গল্প বলার গল্প

এই গল্পটা আজ থেকে পঁচিশ বছর আগের। আমার বয়স তখন কত হবে, চারের আশেপাশে। কিছুদিন আগেই শিশুনিকেতন বলে একটা ছোট্ট ইস্কুলে ভর্তি হয়েছি।
তখন থেকেই বই পড়ার নেশা। বাবা দেব সাহিত্য কুটীর থেকে ছবিতে রামায়ণ-মহাভারত কিনে দিয়েছে। সঙ্গে টুনটুনির বই, আবোল তাবোল আর ঠাকুমার ঝুলি। সেইসব বইগুলো যতবার পারি পড়ি আর কল্পনার ডানায় চড়ে উড়ে বেড়াই মজন্তালি সরকার, বোকা জোলা, কাঠ বুড়ো, বকচ্ছপ আর হেড অফিসের বড়বাবুর দুনিয়ায়।
ততদিন অবধি মোটামুটি মা-ই ঘুরে ঘুরে খাইয়ে দেয়। মানে, আমি সারা বাড়ি নেচে বেড়াই আর মা পেছন পেছন খাবারের থালা নিয়ে ঘুরে ভুজুং-ভাজাং দিয়ে, কাক-কোকিল দেখিয়ে খাওয়ায়। অথবা, আমি হয়তো টুনটুনির বই থেকে সেই নাক-কাটা রাজার গপ্পটা পড়ছি আর মা খাইয়ে দিল।
কিন্তু সুখের দিন গেল। মা একদিন বলল, “এবার বড় হয়েছিস। এবার থেকে আমি ভাত মেখে গোল্লা পাকিয়ে দেব। তুই নিজে নিজে খাবি।”
শুনেই মনটা কেমন খিঁচড়ে গেল। নিজে নিজে খেতে হবে, বড় হয়েছি বলে এ কী জুলুম! আমি তো জানি, বড় হলে শুধু বাবার মত রোজ অফিস যাব আর সন্ধ্যেবেলা ফিরে মন দিয়ে টিভিতে খবর দেখব আর ‘তেরো পার্বণ’ বলে কি একটা হয় সেটা দেখব মন দিয়ে।
তার মধ্যে মা আবার জানিয়ে দিল যে, গল্পের বই পড়তে পড়তে খাওয়া যাবে না। মন দিয়ে না খেলে নাকি খাবার হজম হবে না। এ তো বড্ড ঝামেলা! পুরদস্তুর বাওয়াল দিলাম, ঘ্যান ঘ্যান করা, নাকি কান্না ইত্যাদি প্রভৃতি।
যাই হোক শেষ অবধি একটা শান্তি-চুক্তিতে আসা গেল। ঠিক হল, আমি নিজে নিজেই খাবো কিন্তু মা-ও তখন খেতে বসে আমাকে গল্প বলে শোনাবে। তাতেই আমি রাজী।
তা মা গল্পও বলে নানা রকমের। বেশিরভাগই রূপকথা, তাছাড়া এদিক-ওদিক, ঐ বেড়ালের খাবার খেয়ে যাওয়ার গল্প, বারান্দার কাকের গল্প এইসব আর কি।
তা সেইসব গল্পের স্টকও একদিন শেষ হয়ে এল। তারপর মা যে গল্পই বলে আমি ব্যাগড়া দি, “এটা তো আগে বলেছ”, “ওইটা তো পরশু দিন বললে, ছোট রানীটা দুষ্টু...”
হতাশ হয়ে মা শেষ অবধি গল্প ফাঁদল,

-   বুঝলি তো, তিনটে বন্ধু ছিল। গ, ল আর প।
-   গ, ল, প... বাঃ বাঃ... কি রকম বন্ধু? আমার ইস্কুলের মলয় আর কৌশিকের মত?
-   হ্যাঁ রে... সেই রকম খুব বন্ধু।
-   আচ্ছা... তাপ্পর?
-   একদিন গ, ল, প একসঙ্গে যাচ্ছিল...
-   কোথায় যাচ্ছিল?
-   কোথায় যাচ্ছিল... উঁ... ঐ যে... হ্যাঁ, সার্কাস দেখতে।
-   ওমা... সার্কাস? কি মজা? সার্কাসে হাতি ছিল?
-   হাতি তো থাকবেই রে বোকা, তারপর শোন না... আচ্ছা এই গোল্লাটা খেয়ে নে।
-   খাচ্ছি... তুমি বল
-   হ্যাঁ... তো ওরা তিনজন যাচ্ছে যাচ্ছে... এমন সময় সামনে একটা বিরাট বড়ো নদী পড়ল...
-   কি নদী? কত বড়ো?
-   হুগলী নদী... সে বিশাল বড়ো।
-   নদীতে মাছ ছিলো?
-   নদীতে মাছ থাকবে না? অনেক মাছ ছিল... ইলিশ, রুই, কাতলা...
-   তাপ্পর?
-   তখন তারা দেখল কি... গ আর প সাঁতার জানে কিন্তু ল একদম সাঁতার জানে না...
-   আমার মত?
-   হ্যাঁ...
-   তাহলে কি হবে? ল ডুবে যাবে?
-   দুর বোকা... ল-এর বন্ধু গ আর প ছিল তো... আর প-এর গায়ে জানিস তো খুব জোর...
-   খুব জোর? রামায়ণের হনুমানের মত?
-   ঠিক বলেছিস!
-   তাপ্পর কি হল?
-   তখন প বলল, আমি ল-কে আমার কাঁধে করে নিয়ে নদী পার হব!
-   ওমা... তাই?
-   হ্যাঁ তো। তখন নদীতে পাশাপাশি নামল গ, আর প-এর কাঁধে ল... হয়ে গেল গল্প! এবার এই চারটে গোল্লা বাকি আছে, খেয়ে নে...

কত কত নোবেলজয়ী, বুকারজয়ী লেখকের বই তো পড়ে ফেললাম কিন্তু ছোটবেলার এই গল্পের মত সহজ-সরল, মনে থেকে যাওয়া গল্প খুব বেশি পেলাম না!
"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”