Saturday, July 20, 2019

লন্ডনে লণ্ডভন্ড - ৮ (এডিনবার্গ পর্ব)

~~ পটারময় এডিনবার্গ ~~

ম্যানচেস্টার থেকে মাঝরাতের বাস ধরে আমরা যখন এডিনবার্গ ওয়েভারলিতে এসে নামলাম তখন আটটাও বাজেনি। বাস থেকে নেমেই একটু হেঁটেই বুঝলাম যে এখানে আমাদের প্রথম কাজ হবে দুজনের দুটো সোয়েটার কেনা। তাপমাত্রা তখন দশেরও কম আর আমাদের সঙ্গে গরম পোষাক বলতে শ্রেয়সীর ঐ সারাহ টেলরের সই করা সোয়েটার। আমি ঠাণ্ডা চাপতে গোটা দুয়েক শার্ট পরে বসেছিলাম কিন্তু রোদ ওঠা অবধি তাতে খুব একটা কাজ হয়নি।
আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল ওল্ড টাউনের কাউগেট হোস্টেল। সেখানে গিয়ে জানা গেল যে কোন পরিস্থিতিতেই দুটোর আগে আমাদের ঘর পাওয়া যাবে না। অনেক বলেকয়েও কিছু করা গেল না। কী আর করা, ওদের রিসেপসানের পাশের একটা ছোট্ট বাথরুমে মুখটুখ ধুয়ে বেরিয়ে পড়া গেল। প্রথমে ব্রেকফাস্ট তারপর কেল্লার দিকে হন্টন। লন্ডনের আধুনিক রাস্তাঘাটের পর এডিনবার্গের পাথরে বাঁধানো রাস্তা, সিঁড়ি, রাস্তার ধারে শ-খানেক বছরের পুরনো রেস্টুরেন্ট... মন্দ লাগছিল না।

আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল এডিনবার্গ কেল্লা। কেল্লার সবচেয়ে পুরনো অংশ, সেন্ট মার্গারেট চ্যাপেল তৈরি হয়েছিল সেই দ্বাদশ শতাব্দীতে। এছাড়া গ্রেট হল, হাফ মুন ব্যাটারি, রাজকীয় রত্ন, বিখ্যাত মন্স মেগ কামান... দেখার জিনিসের অভাব নেই। শুধু তাই নয়, কেল্লার ওপর থেকে পুরো এডিনবার্গের একটা প্যানারোমিক ভিউ পাওয়া যায় সেটাও চমৎকার। ভেতরে স্কচ টেস্টিং হচ্ছিল এক জায়গায়। সেসবও করা হল।
কেল্লা থেকে বেরিয়ে আমরা হাঁটা লাগালাম রয়্যাল মাইল ধরে। কেল্লা থেকে ওল্ড টাউনের মধ্যে দিয়ে এক মাইল রাস্তা এডিনবার্গের সবচেয়ে জমজমাট অঞ্চল, তার সঙ্গে আবার সেই সময় এডিনবার্গ ফেস্টিভাল চলছিল বলে বিভিন্ন স্ট্রিট আর্টিস্টদের কেরামতি! কেউ বাচ্চাদের ম্যাজিক দেখাচ্ছেন, কেউ আবার তাঁদের সন্ধ্যার শোয়ের টিকিট বিলি করছেন। সেই জনস্রোতের মধ্যে দিয়ে আমরা হেঁটে চললাম। চারদিকের বাড়ীঘর সবই প্রায় প্রাসাদের মত। সেসব দেখার সঙ্গে সঙ্গে নিজেদের জন্য সোয়েটার কেনারও একটা ব্যাপার ছিল। আমার একটা সস্তায় পেয়ে গেলেও শ্রেয়সীর জন্য সোয়েটার বা জ্যাকেট আর পাওয়ায় যায় না। যাই দেখি তার প্রচন্ড দাম। এর মধ্যে আবার এক পশলা বৃষ্টিও হয়ে গেল। এইসবের মধ্যেই কাঁপতে কাঁপতে আমরা পৌঁছে গেলাম ‘মিউজিয়াম অফ চাইল্ডহুডে’। সেখানে ব্রিটিশ ছেলেপুলেদের ছোটবেলার বিভিন্ন নিদর্শন দেখে নিজেদের ছোটবেলাটা মনে করতে করতে দেখি প্রায় চারটে বেজে গেছে। অতঃপর হোটেলের দিকে রওয়ানা হলাম। বাইরে তখন রোদ উঠেছে, ফেরার পথে একটা দোকানে ফাইনালি শ্রেয়সীর একটা সাদা কার্ডিগানও পাওয়া গেল। ফুরফুরে মনে হোস্টেলে ফিরে নিজেদের ঘরের চাবি নিয়ে ঘরে গিয়ে পৌছনো গেল। আমাদের ঘরের বাকি চারজন অবশ্য তখন কেউই ঘরে নেই। তাদের জিনিসপত্র চোখে পড়ল। স্নান-টান করে ভালো করে ফ্রেশ হয়ে আরো ঘন্টা খানেক ল্যাধ খেয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম তীর্থ করতে। আমাদের পরের গন্তব্য ‘দি এলিফ্যান্ট হাউস’, হ্যারি পটারের জন্মস্থান। এই ক্যাফেরই কোন এক টেবিলে বসে আস্তে আস্তে হ্যারি পটারের দুনিয়ে গড়ে তুলেছিলেম জোয়ান রাউলিং আর তাই এডিনবার্গের এই ক্যাফের নাম আমাদের বাকেটলিস্টের বেশ ওপর দিকেই ছিল। সেখানে ঘন্টা খানেক কাটিয়ে ল্যাম্ব পাই উইথ গ্রেভি অ্যান্ড ম্যাস খেয়ে বেরিয়ে ছবি-টবি তুলে আরো কিছুক্ষণ হাঁটাহাঁটি করে সেদিনের মত বিশ্রাম।
দ্বিতীয়দিন সকালে ব্রেকফাস্টের পর আমাদের প্রথম গন্তব্য ছিল ডিন ভিলেজ। এডিনবার্গের থেকে দেড়-দু কিলোমিটারের মধ্যেই এই ছোট্ট গ্রাম যা অনেকের মতে রাউলিং’য়ের লেখার গডরিক’স হলোর অনুপ্রেরণা। গল্পে গডরিক’স হলো পশ্চিম ইংল্যান্ডের এক ছোট্ট গ্রাম যেখানে থাকতেন লিলি এবং জেমস পটার তাঁদের ছোট্ট ছেলে হ্যারিকে নিয়ে। ডিন ভিলেজের ঢালু রাস্তা বেয়ে এদিক ওদিক ঘুরতে ঘুরতে সত্যি মনে হচ্ছিল যেন হ্যারি পটারের দুনিয়েতেই ফিরে গেছি। ইংল্যান্ড বা স্কটল্যান্ডের এই ধরণের ছোট লোকালিটিগুলো এমনিতেই খুব সুন্দর আর ডিন ভিলেজের অন্য চার্মটা অবশ্যই হ্যারি পটার সম্পর্কিত। এমনকি গ্রামের মধ্যের কবরখানায় ঢুকে সামনেই হারবার্ট জেমস লিডল আর মেরি লিলিয়াস রবির কবর দেখাটা একটা অন্য রকমের অভিজ্ঞতা।
ডিন ভিলেজে সকালটা কাটিয়ে সেখান থেকে বাস নিয়ে চলে গেলাম হলিরুড প্যালেস। প্যালেসের বাইরে থেকে ঘুরেই চলে এলাম কারণ বিকেলে ফোর্ট উইলিয়ামের ট্রেন ধরার ব্যাপার ছিল। আর তারপরেই শুরু হল অ্যাডভেঞ্চার!
আমাদের এডিনবার্গ থেকে ট্রেন ছিল গ্লাসগোর। আর গ্লাসগোয় মিনিট দশেকের মধ্যেই অন্য ট্রেন নিয়ে ফোর্ট উইলিয়াম। পৌঁছতে প্রায় রাত দশটা বেজে যাওয়ার কথা এদিকে ফোর্ট উইলিয়ামের ‘চেজ দ্যা ওয়াইল্ড গুজ হোস্টেল’ তাদের ওয়েবসাইটে লিখে রেখেছে সাড়ে নটা অবধি তাদের চেকইন। কাউগেট হোস্টেলের এক্সপেরিয়েন্সের পর অনেক চেষ্টা করে তাঁদের ফোনে ধরে কনফার্ম করা গেল যে রাত দশটা বাজলেও তাদের লোক রিসেপশানে থাকবে।
কিন্তু দশটাতেও কি পৌছব! এডিনবার্গ ওয়েভারলিতে দাঁড়িয়ে আছি আর দেখছি ট্রেনের দেখা নেই। টাইম টেবিল নড়ছে না, ভিড় বাড়ছে কিন্তু ট্রেন নেই। খোঁজখবর নিয়ে জানা গেল যে আমাদের ট্রেন বাতিল, পরের ট্রেন আসবে মিনিট কুড়ি পর। তার মানে গ্লাসগো থেকে ফোর্ট উইলিয়ামের ট্রেন লেট না করলে সেই ট্রেন বেরিয়ে যাবে এবং ফোর্ট উইলিয়ামের জন্য সেটাই শেষ ট্রেন দিনের। কিছু করার নেই। কুড়ি মিনিট পরের ট্রেনেই ভিড়ের মধ্যে ওঠা হল। ট্রেনের ঘোষণা থেকে জানা গেল যে, আগের কোন  ট্রেনে এক যাত্রী অসুস্থ হয়ে পড়ায় তাঁর জন্য বিশেষ অ্যাম্বুলেন্সের ব্যবস্থা করতে গিয়ে আগের ট্রেনটি বাতিল হয়েছিল। এখন আমাদের পরের ট্রেনের চিন্তায় আমাদের শরীর খারাপের যোগার। যাই হোক যথারীতি গ্লাসগো গিয়ে জানা গেল যে গ্লাসগো থেকে ফোর্ট উইলিয়ামের ট্রেন বেরিয়ে গেছে! এবার কী করার! স্কটরেলের দুজন কর্মচারীর সঙ্গে কথা বলা হল। তাঁদের যা ইংরেজি উচ্চারণ তার প্রায় কিছুই আমরা বুঝিনা। অনেক কষ্টে বুঝলাম বাঁদিক দিয়ে বেরিয়ে ওপরে উঠে যেতে হবে। মনে হল সেখানে হয়তো অন্য লাইনের ট্রেন আছে। লাগেজ ঘাড়ে করে সেদিকে গিয়ে দেখি স্টেশান থেকে বেরিয়ে মেন রাস্তায় চলে এসেছি, আর কোন রেল লাইন নেই। আবার ফিরে গেলাম, আবার একদফা স্কটিশ উচ্চারণের চ্যালেঞ্জ সামলে বুঝলাম যে ওই রাস্তাতেই গিয়ে আর একজন স্কটরেলের কর্মচারীকে খুঁজতে হবে। এবার গিয়ে তাঁকে পাওয়া গেল। যেটা জানা গেল তা হচ্ছে স্কটরেলের গন্ডগোলে আমাদের ট্রেন মিস হয়ে যাওয়ায় তারা একটা ট্যাক্সি করে আমাদের এবং আর একজন যাত্রীকে তাদের শেষ গন্তব্যস্থানে পৌঁছে দেবে। আমরা যাবো ফোর্ট উইলিয়াম এবং আমাদের সঙ্গী সোজা যাবেন ম্যালাইগ।

তাহলে আর কী! ট্রেনের বদলে স্কটরেলের বদান্যতায় গাড়ী চড়ে গ্লাসগো থেকে বিভিন্ন স্কটিশ লকের আর সবুজ গাছপালার মধ্যে দিয়ে আমরা চললাম ফোর্ট উইলিয়ামের উদ্দেশ্যে। শুধু তাই নয়, আমাদের ট্যাক্সি যখন ম্যাপ দেখে ‘চেজ দ্যা ওয়াইল্ড গুজ হোস্টেলের’ সামনে আমাদের নামিয়ে দিল তখন বাজে রাত নটা। বাইরে তখন অন্ধকার নামছে আস্তে আস্তে। রিসেপশানের মহিলা আমাদের দেখে বললেন, “কী ব্যাপার? তোমাদের তো দশটার পর আসার কথা ছিল!” যাইহোক তাঁকে গল্প-টল্প বলে প্রথমে এডিনবার্গে কেনা স্যান্ডউইচ ইত্যাদি খেয়ে নেওয়া হল। তারপর ঘরে গিয়ে একদফা স্নান করে ঘুম। কাল সকাল সকাল জ্যাকোবাইট ট্রেন ধরার ব্যাপার আছে!

আগের পর্বের লিঙ্ক -

"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”