Saturday, October 27, 2018

লন্ডনে লণ্ডভণ্ড - ৫


~~ইতিহাসের বুকে~~

তৃতীয়দিন আমাদের প্ল্যান ছিল সারাদিনের স্টোনহেঞ্জ এবং বাথ ট্যুর স্টোনহেঞ্জ সম্বন্ধে মোটামুটি সবাই জানেন প্রায় সাড়ে চার থেকে পাঁচ হাজার বছর আগে ঐ অঞ্চলে জনবসতি ছিল এবং সেটার চিহ্ন হিসেবেই সেখানে বেশ কিছু পাথরের স্তম্ভ আজও দাঁড়িয়ে আছে। সেগুলোউচ্চতা প্রায় ১৩ ফুট এবং এক একটার ওজন প্রায় ২৫ টন। এখনও অবধি ঐতিহাসিকরা ঠিক ধরে উঠতে পারেননি যে ঐ জনবসতিতে এই পাথরগুলোর ভূমিকা কী ছিল। তবে অনেকেই মনে করেন ওটা ছিল সে সময়কার অধিবাসীদের উপাসনাস্থান।
বাথ শহরটা অতটা পুরনো না হলেও এই শহরে যখন রোমানরা এসে বিভিন্ন স্নানাগার তৈরি করেন সেই সময়টা হল মোটামুটি ৬০-১০০ খ্রীষ্টাব্দ। সারাদিনও ঘোরা যায় তবে মোটামুটি প্রধান জায়গাগুলো দেখার জন্য কয়েক ঘন্টাই যথেষ্ট।
আমরা কলকাতায় বসেই অনলাইন অ্যান্ডারসন ট্যুরসের (https://andersontours.co.uk/index.php) সাইটে গিয়ে আমাদের দুজনের ট্যুর বুক করে ফেলেছিলাম। এক একজনের ৬৯ পাউন্ড। সেই সময়েই আমাদের পছন্দ মত ভিক্টোরিয়া স্টেশানের কাছের পিক আপ পয়েন্ট বেছে নিয়েছিলাম। 

সকাল সাতটায় বাস আসার কথা ছিল। আমরা মিনিট দশেক আগে গিয়ে দাঁড়িয়েছি বাসস্ট্যান্ডে, আর দাঁড়াতে না দাঁড়াতেই বাস এসে হাজির। আমরা টপাটপ নাম বলে আর টিকিটের প্রিন্ট আউট দেখিয়ে উঠে পড়লাম। ঠিক সাতটাতেই বাস ছাড়ল পরের পিকআপ পয়েন্টের জন্য। লন্ডন থেকে পৌঁছতে মোটামুটি ঘন্টা তিনেক লেগেছিল। যদিও মাঝে একটা ব্রেক ছিল। বাসে তেমন কিছু হয়নি, আমাদের গাইড দিদিমণি প্রত্যেককে একটা ব্রোসিয়ার দিয়েছিলেন যাতে স্টোনহেঞ্জের কোথায় কী আছে সেটার একটা আইডিয়া দেওয়া ছিল। দিদিমণি নিজে মাঝে মধ্যে কোথা দিয়ে যাচ্ছি বা কতক্ষণ বাকি সেইসব বলছিলেন কিন্তু গ্র্যান্ড ক্যানিয়নে যাওয়ার সময় যেরকম আমাদের গাইড অনর্গল বকে গেছিল ইনি অত কথা বলার দিকে যাননি। শেষের দিকে গিয়ে দেখি দুদিকেই পুরো সবুজ মাঠ। তা শেষ অবধি বাস এক জায়গায় গিয়ে থামল। সেখানে স্টোনহেঞ্জের টিকিটিও দেখা যাচ্ছে না।
দিদিমণির কথা শুনে বুঝলাম, এরপর দিদিমণি আমাদের সবার টিকিট আর অডিও গাইড নিয়ে আসবেন। তারপর সেই টিকিট দেখিয়ে আরো একটা বাসে করে দুই কিলোমিটার মত গেলে তবে দেখা যাবে স্টোনহেঞ্জের পাথরগুলো। হেঁটে যাওয়ারও সুযোগ ছিল কিন্তু ওই চড়া রোদে আর হাঁটতে ইচ্ছে করল না। বরং মিনিট পনেরো লাইন দিয়ে তিন নম্বর বাসে চড়ে চলে এলাম স্টোনহেঞ্জের সামনে। শেষে ২০০-৩০০ মিটার হাঁটা। বাস থেকে নেমে পদব্রজে চললাম স্টোনহেঞ্জের দিকে।
যথারীতি দেশ বিদেশের বিভিন্ন লোক উপস্থিত। পাথরগুলোকে চারদিকে কিছুটা জায়গা ঘিরে রাখা হয়েছে কারণ দর্শকরা স্টোনহেঞ্জে চড়ে ছবি তুলতে শুরু করলে সেটা পাথরগুলোর স্বাস্থ্যের জন্য ঠিক সুবিধার হবে না। ঘিরে রাখা বলতে ঐ ফুট খানেক উঁচু লোহার রডে লোহারি শিকল মত দেওয়া। সেটা টপকানো কোন বড় ব্যাপার নয়। কিন্তু কেউই সেগুলো টপকে স্টোনহেঞ্জের দিকে ছুটে যাচ্ছে না, বা পুলিশ ধরলে “একটু গেছি তো কী হয়েছে!” জাতীয় এঁড়ে তর্ক করছে না (অক্টোবারে হ্যাপি ভ্যালি চা বাগানে গিয়ে এটা দেখার সৌভাগ্য হয়েছিল) দেখে বেশ হতাশ হলাম।
পাথরগুলো দেখে অবশ্য ব্যাপারটার প্রাচীনত্বর দিকটা ভেবে বেশ ইন্টারেস্টিং লাগছিল। আর পাথরগুলোর অবস্থান দেখেও পুজো করার জায়গাই মনে হল। কিন্তু ঐ ধূধূ মাঠের মধ্যে ঐ গোদা পাথরগুলো কী করে নিয়ে এসেছিল সেটা সত্যিই ভাবার বিষয়! গ্রহান্তর ইত্যাদি সম্ভাবনাগুলো উড়িয়ে দেওয়া যায় না!
স্টোনহেঞ্জের পর আমাদের গন্তব্য ছিল রোমান শহর বাথ। সেটাও ঐ ঘন্টা খানেকের রাস্তা সবুজ ক্ষেতের মধ্যে দিয়ে। বাথের সিটি সেন্টারে ‘দ্য হান্টসম্যান’ রেস্তোরার সামনে আমাদের বাস নামিয়ে দিল। সেখানে আবার ঘন্টা দুয়েক ফ্রি টাইম। বাথের কিছু কিছু বাড়ির স্থাপত্য দেখার মত। রোমান বাথের ভেতরের কাজ, বিভিন্ন মূর্তি আর মিউজিয়ামের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে আধুনিক অডিও ভিশুয়াল প্রেসেন্টেশান। পুরনো স্নানের জায়গাকে সাজিয়ে গুছিয়ে প্রোজেক্টারের সাহায্যে কিছু অভিনেতাকে ব্যবহার করে সেই সময়ের ছবি ফুটিয়ে তুলছে দর্শকদের জন্য। এই ব্যাপারটা সত্যিই ভালো লেগেছে। আরো কয়েক জায়গায় এগুলো দেখেছিলাম, সেগুলো যথাস্থানে বলব।
বাথ শহরের একটা বড় আকর্ষণ হল স্যালি লুনের বান বা মিষ্টি পাঁউরুটি। স্যালি লুনের ইটিং হাউসের প্রতিষ্ঠা হয়েছিল ১৬৮০ সালে! ব্যাপারটা বুঝছেন? ইংল্যান্ডের রাজা তখন দ্বিতীয় চার্লস!  ইংল্যান্ডের বিভিন্ন জাহাজ তখন সমুদ্রে ঘুরে ঘুরে জলদস্যু শিকার করে বেরাচ্ছে! জব চার্নকের জাহাজ সুতানুটির ঘাটে ভিড়তে তখনো দশ বছর বাকি!
বাড়িটার গায়ে আবার লেখা সেটা বাথের প্রাচীনতম বাড়ি। এই সেদিনই মানে ১৪৮২ সালে তৈরি। যাইহোক আমাদের শেষ আধ ঘন্টা স্যালি লুনের চমৎকার বান আর কফি খেয়েই কাটল। দোকানটা প্রাচীন হতে পারে, বানগুলো কিন্তু একদম টাটকা ছিল!

No comments:

Post a Comment

"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”