Sunday, July 30, 2017

ইন্দোনেশিয়ার ডায়রি - ৫

ইন্দোনেশিয়ার ডায়রি - ১     ইন্দোনেশিয়ার ডায়রি - ২          ইন্দোনেশিয়ার ডায়রি - ৩    ইন্দোনেশিয়ার ডায়রি - 


কুটার পাব স্ট্রিট খুবই জমজমাট। যদিও ২০০২ সালে ওই পাব স্ট্রিটেই বোমা বিস্ফোরণে ২০২ জন মারা গেছিলেন। এখন সেখানে একটা মেমোরিয়াল বানানো আছে। সেটার চারদিকে বিভিন্ন বড় বড় রেস্টুরেন্ট, পাব এবং একের পর এক রকমারি দোকান। সেগুলোর মধ্যে দিয়ে একটা সরু রাস্তা বিচের দিকে চলে গেছে। পাব স্ট্রিটের হৈ-হট্টগোলের তুলনায় বিচটা বেশ ফাঁকা। ভালোই লেগেছিল। তারপর আমরা টুকটাক কিছু খেয়ে নিলাম। পরের দিনের মন্দির ঘোরার জন্য একটা গাড়ীও ঠিক করে ফেললাম। কথা হল যে, আমাদের ড্রাইভার ইয়োমান পরের দিন নটার সময় চলে আসবে আমাদের হোটেলে। অতঃপর একটি পাবে প্রবেশ এবং লাইভ গান শুনতে শুনতে নানাবিধ পানীয়গ্রহণ। যার মধ্যে স্মারনফ্‌ আইসটি আমার বেশ পছন্দ হয়েছিল। দেশে ফিরে খুঁজতে হবে।
যখন হোটেলে ফিরলাম তখন রাত দুটো বেজে গেছে।
পরদিনের গল্প পুরোই বালির মন্দিরের সৌন্দর্যের কথা। তানহা লট, তামান আয়ুন, গজটেম্পল... কোনটা বাদ দিয়ে কোনটার কথা বলব! অনন্যসাধারণ কিছু জায়গা। তানহা লট যেমন সুমদ্রের মধ্যে। হ্যাঁ, ধারে নয় বরং সমুদ্রের মধ্যে প্রায় ১০০ মিটার দূরে এক পাথরের টিলার ওপর দাঁড়িয়ে আছে তানহা লটের মন্দির। বিকেলবেলা সূর্যাস্তের সময় যখন ভাঁটার জন্য জল নেমে যায় তখন পায়ে হেঁটেই সেই মন্দিরে যাওয়া যায়। কিন্তু আমরা গেছিলাম সকালবেলা। সুতরাং তীরে দাঁড়িয়ে সমুদ্রের উত্তাল জলরাশি আর তানহা লটের ছবি তুলেই আমরা ফিরে এলাম।

এখানেই দেখলাম, বেড়াল প্রজাতির প্রাণী লুয়াক যাদের নাম থেকেই এসেছে পৃথিবীর সবচেয়ে দামী এবং সুস্বাদু (শোনা কথা) লুয়াক কফি। কেন এই নাম? কারণ এই লুয়াক কফি বীজ খেতে ভালোবাসে, তারপর ওই কফি বীজ তাদের পেটের মধ্যে অর্ধ-পাচ্য হয়ে যখন তাদের বিষ্ঠার সঙ্গে বেরিয়ে আসে তখন সেই বীজ দিয়েই বানানো হয় এই অসমান্য লুয়াক কফি। যার এক পাউন্ডের দাম হতে পারে প্রায় ২০০-৩০০ আমেরিকা ডলার! 
তামান আয়ুন ছিল বালির রাজপরিবারের মন্দির। শহরের মধ্যিখানে অসাধারণ স্থাপত্যময় মন্দিরের সারি। শুধু তাই নয়, ওখানে গিয়ে মনে হয়েছিল যেন, ছোটবেলার ইতিহাস বইয়ে পড়া বালির মন্দিরের ছবিগুলো জীবন্ত হয়ে উঠেছে চোখের সামনে।
তামান আয়ুনে কিছুক্ষণ সময় কাটিয়ে আমরা গেলাম জঙ্গলের মধ্যে গজমন্দিরে। গুহার মধ্যে এই মন্দির আর চারদিক জঙ্গলে ঘেরা। যেতে যেতে সন্ধ্যে হয়ে গেছিল বলে বেশীক্ষণ থাকা হয়নি তবে এই মন্দিরও সুন্দর।

সমুদ্রের ধারের উলুয়াতু মন্দির রেখে দেওয়া হল পরের দিনের জন্য।
হোটেলে ফিরে ইয়োমানের কথা মত আমরা গেলাম জিম্বারান বিচে ডিনারের জন্য সেখানে সমুদ্রের ধারে উন্মুক্ত আকাশের নীচে অ্যাকোরিয়াম থেকে নিজেদের পছন্দ মত বেঁচে নেওয়া মাছ, কাঁকড়া, চিংড়ি, ঝিনুক এবং বিয়ার সহযোগে রাতের খাওয়াটা ভালোই হল। যদিও বালির সব জিনিসের সঙ্গে তাল মিলিয়ে পকেট কাটলো ভালোই। ভারতীয় মূদ্রায় প্রায় ১৪,০০০। ভাগ্যিস ক্রেডিট কার্ড ছিল! এর মধ্যে কিছু স্থানীয় গায়করা এসে আমাদের 'কুছ কুছ হোতা হ্যায়'র গান শোনালেন। দেবাও গলা মেলালো তাঁদের সঙ্গে!
হোটেলে ফিরে ঘন্টাখানেকের সাঁতার ক্লাসও হয়েছিল আমার আর ঈশিতার জন্য। শিক্ষক দেবা এবং ড্যুড!
পরের দিন বালির শেষ দিন। প্ল্যান ছিল, সকালে উঠে ব্রেকফাস্ট করে যাওয়া হবে বিকিকিনিতে। তারপর ফিরে সব মালপত্র নিয়ে বারোটা নাগাদ ইয়োমেনের গাড়ী করে উলুয়াতু, সেখান থেকে সোজা এয়ারপোর্ট।
সেইমত দশটা নাগাদ পাব স্ট্রিটে পৌঁছে প্রথমে টাকা তোলা হল। শুধু কঙ্কনার কার্ডেই টাকা তোলা যাচ্ছিল। টাকা তুলে সেটাকে মোটামুটি সমানভাবে ভাগ করে দিলাম আমি। তারপর সবাই ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়লাম কেনাকাটার জন্য। কেউ নিজের জন্য কিনছে, কেউ বাড়ির লোকের জন্যে, কেউ আবার এই গ্রুপের কমন বন্ধুদের জন্য। সব মিলিয়ে বেশ ভজঘট অবস্থা। তার সঙ্গে বালির দোকানদারদের অবাস্তব দাম! একটু পরেই বুঝে গেলাম, যে টি-শার্টের দাম দোকানদার ২০০,০০০ রুপিয়া মানে ভারতীয় টাকায় ১০০০ টাকা চাইছে, সেগুলোর দরদাম করা উচিত, ২০,০০০ বা ৩০,০০০ রুপিয়া থেকে এবং মোটামুটি পাওয়া যাবে ৭০-৮০ হাজারের মধ্যে।
যাই হোক, এর মধ্যে একটি কাকিমার দোকানে বেশ সস্তায় জামাকাপড় পাওয়া যাচ্ছে বলে সবাই মিলে প্রায় তেইশ-চব্বিশটা আইটেম কিনে ফেলল। মহিলা বেশ হাসিখুশি আর মাঝে মাঝেই এসে ফিসফিস করে বলে যাচ্ছিলেন, "এতো সস্তায় হয়না, নেহাত মালিক স্টক ক্লিয়ার করতে বলেছে তাই দিয়ে দিচ্ছি।"
এছাড়া অন্যান্য মেমেন্টো ইত্যাদি যখন কেনা হল, তখন দেখা গেল টাকা-পয়সা সব শেষ। শেষ অবধি বিভিন্ন ক্রেডিট কার্ডে পেমেন্ট মিটিয়ে হোটেল ফেরা হল সাড়ে-বারোটায়।
ইয়োমেন আগেই চলে এসেছিল। সব গুছিয়ে-টুছিয়ে একটার পর বেরোনো হল। তারপর লাঞ্চ করে উলুয়াতুর জন্য যাত্রা শুরু হল দুটোর পর। উলুয়াতু যখন পৌঁছলাম তখন চারটে বেজে গেছে। অসাধারণ বললেও কম বলা হয় এই মন্দিরের সৌন্দর্য। সমুদ্রের ধার দিয়ে সোজা উঠে গেছে একটা খাড়াই পাহাড় আর সেখানেই উলুয়াতু মন্দির। বিভিন্ন মূর্তি, কারুকার্য আর পাহাড়ের ধার দিয়ে উঠে যাওয়া পাঁচিল। সেটা একটা অসাধারণ জায়গা।
সেখানেই হয় ইন্দোনেশিয়ার বিশেষ বৈশিষ্ট্য কেচাক নৃত্য। যদিও প্লেনের যা সময় তাতে পুরোটা দেখা হবে না, তাও ইন্দোনেশিয়ায় এসে এই জিনিস মিস্‌ করার কোন মানে হয় না। তাই সবাই মিলে বসলাম কেচাক নাচের আসরে।
এই নাচের বৈশিষ্ট্যই হল যে, প্রায় কুড়ি-পঁচিশ জন শিল্পী গোল হয়ে বসে মুখ দিয়ে 'কেচাক' ধ্বনি তুলছেন আর তার মধ্যে বাদ্য সহযোগে অভিনীত হচ্ছে সেই রামায়ণের গল্প 'সীতাহরণ"।
একটু আগে থেকেই ঠাণ্ডা হাওয়া দিচ্ছিল। কেচাক নাচ শুরু হওয়ার পর একেবারে ঝমঝম করে নেমে পড়ল বৃষ্টি। সকলকে প্লাস্টিকের কভার দেওয়া হচ্ছিল বটে কিন্তু ওই বৃষ্টি রুখতে তা বড়ই অপ্রতুল। যাই হোক, ঐ বৃষ্টির মধ্যেও ঘড়ির দিকে নজর রেখে বেরোনো হল এবং ওই বিশাল পার্কিং লটের মধ্যে শেষ অবধি গাড়ী খুঁজে আমরা রওয়ানা দিলাম বালি এয়ারপোর্টের দিকে। আমাদের বালি-ট্রিপ এবারের মত শেষ।

বাকি আর বিশেষ কিছু হয়নি। এয়ারপোর্টে জিনিসপত্র আটকে দিয়ে কেবিন লাগেজের সঙ্গে পাঠিয়ে দেওয়াকে তখন আর পাত্তাই দিচ্ছি না। ফ্লাইটেই খাওয়া-দাওয়া হল। যখন কুয়ালালামপুরে নামলাম তখন ঘড়ির কাঁটা পরের দিনে চলে গেছে। আমাদের দুমাসের পরিকল্পনার বালিভ্রমণ এখানেই শেষ। আবার দেখতে হবে, পরের বছরের ঘোরার প্ল্যান কবে বানানো যায়!

Sunday, July 16, 2017

ইন্দোনেশিয়ার ডায়রি - ৪

ইন্দোনেশিয়ার ডায়রি - ১     ইন্দোনেশিয়ার ডায়রি - ২          ইন্দোনেশিয়ার ডায়রি - ৩ 


ছবিঃ কঙ্কনা
বালিতে নেমে যখন এয়ারপোর্টের বাইরে এসে দাঁড়ালাম তখন প্রায় সাড়ে সাতটা। বালিতে আমাদের হোটেল ছিল মায়া ভিলেজ, কুটা বিচের কাছেই। এয়ারপোর্ট থেকে ১০ কিলোমিটারও হবে না, কিন্তু তার জন্য প্রিপেড ট্যাক্সি ভাড়া দেখাচ্ছিল দু লাখ ইন্দোনেশিয়ান টাকা মানে ভারতীয় টাকায় ১০০০ টাকা। তখনই বালির খরচার ব্যাপারটা বুঝলাম। শেষ অবধি এক লাখ সত্তর হাজার টাকায় একটা গাড়ী ধরে বেরোলাম। এয়ারপোর্টের বাইরেটা বেশ সুন্দর কিন্তু লং উইকেন্ডের শুরু বলে একের পর এক প্লেন ভর্তি ট্যুরিস্ট নামছে বলে ভালোই জ্যাম ছিল। যাই হোক জ্যাম কাটিয়ে আধ ঘন্টার মধ্যে হোটেল খুঁজে বের করা গেল। এখানে একটা ড্যুপ্লেক্স ঠিক করা ছিল। হোটেলের একদম ধারে ঘরটা। প্রথমে একটা হল মত বসার জায়গা তারপর নিচে একটা ঘর, লাগোয়া বাথরুম। ওপরে আর একটা ঘর এবং বাথরুম। ভালোই ব্যবস্থা। ফ্রেশ হয়ে বেরিয়ে নৈশাহারে স্থানীয় খাবার, স্টেক ইত্যাদি এবং বিন্টাং নামক স্থানীয় লেমন ফ্লেভারড বিয়ার খেয়ে ফিরতে গিয়ে দেখি বৃষ্টি নেমেছে। সেই বৃষ্টির মধ্যেই হোটেলে ফেরা হল। পরদিন ভোর ভোর বেরোনোর প্ল্যান। কুটার উত্তরে লিবার্টি নামক একটি অ্যামেরিকান জাহাজের ধ্বংসাবশেষে স্কুবা ডাইভিং করার পরিকল্পনা আছে। সকালে সাতটায় গাড়ী এসে নিয়ে যাওয়ার কথা।
স্কুবা ডাইভ বস্তুটা কী তা নিয়ে পাঠকদের (বহুবচন... হুঁ হুঁ বাওয়া!) ধারণা আছে আশা করি। তবু সংক্ষেপে বলতে গেলে, এটা হল ভালো মত ট্রেনিং নিয়ে ধড়াচুড়ো পরে মুখে অক্সিজেন মাস্ক এবং পায়ে পাখনা লাগিয়ে জলের তলায় নামা এবং মাছেরদের রাজ্য থেকে ঘুরে আসা। সঙ্গে অবশ্যই ট্রেনার থাকেন। কুটার এই 'লিবার্টি শিপরেক' একটি পৃথিবী বিখ্যাত ডাইভ সাইট, সারা বিশ্বের ডাইভ-প্রেমিকরা আসেন এখানে। আমরাও গেলাম। প্রথমে শহরের মধ্যে যে সংস্থা আমাদের ডাইভের ব্যবস্থা করছে তাদের অফিসে গিয়ে ফর্ম-ফিলাপ, পোশাকআশাক পরে দেখে নেওয়া, সব ঠিক আছে কিনা। আমাদের ট্রেনার ছিলেন এক স্থানীয় ইন্দোনেশিয় যুবক এবং রবার্ট নামক বিশালদেহী এবং গম্ভীর এক জামাইকান। জামাইকান শুনেই ক্রিস গেলের কথা জিজ্ঞেস করায় খুব একটা পাত্তা পেলাম না বরং গম্ভীরভাবে তিনি যা বললেন, তা হল তাঁর এই ৪৫ বছরের জীবনে তিনি শুধু পৃথিবীর বিভিন্ন জায়গায় ডাইভিং করে গেছেন এবং অন্যান্য খেলাধুলো নিয়ে খুব একটা আগ্রহী নন।
ছবিঃ দেবা
সেখান থেকে দু ঘন্টারও বেশী রাস্তা ঘুমোতে ঘুমোতে এবং মাঝে মাঝে কানের ভেতরে বায়ুর চাপের সামঞ্জস্য রাখার প্র্যাকটিস করতে করতে যাওয়া হল। জলের তলায় নামলে এই বায়ুর চাপের সামঞ্জস্য রাখাটাই একটা বড় চ্যালেঞ্জ।
যাই হোক, আমাদের যাত্রাপথের শেষে ঠিক সমুদ্রের ধারে একটা রিসর্টের মত জায়গায় পৌঁছনো গেল। সুন্দর পার্কের মত, ধার দিয়ে সমুদ্রে সিঁড়ি নেমে গেছে। পার্কের মধ্যে একটা সুইমিংপুল যেখানে আরো অনেকে ডুবসাঁতার প্র্যাকটিস করছেন। আমরাও একটু ধাতস্ত হয়ে নেমে পড়লাম পুলে। অবশ্যই সমস্ত জিনিসপত্র চাপিয়ে। আমাদের একেবারেই বিগিনার্স কোর্স, দেবার এসব আগেই করা, তাই ও চলে গেল একটা ডাইভে। দুই ট্রেনার পড়লেন আমাদের নিয়ে। ঈশিতা, ড্যুড আর কঙ্কনার সঙ্গে সেই ইন্দোনেশিয়ান ছেলেটি আর আমাকে এবং শ্রেয়সীকে নিয়ে পড়ল রবার্ট। পরবর্তী এক ঘন্টা জলের মধ্যে সাঁতার, আকার-ইঙ্গিত, দম নেওয়া ইত্যাদি বিভিন্ন দরকারী জিনিসের অনুশীলন চলল। আমি এবং শ্রেয়সী দুজনেই জলে খুব একটা স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করছিলাম না। রবার্টও যে খুব একটা সাহায্য করছিল তা নয়, মানে হয়তো চেষ্টা করছিল কিন্তু ওর গম্ভীর বকুনির চোটে আমি আর শ্রেয়সী দুজনেই উৎসাহ হারিয়ে ফেললাম এবং শেষ পর্যন্ত ঠিক করলাম যে আমরা সমুদ্রের তলায় যাওয়া থেকে বিরত থাকব। কিছুই না, আমার মনে হয়েছিল যে, যদি জলের তলায় নেমে ছড়াই তখন আমার জন্য বাকিদেরও তাড়াতাড়ি উঠে আসতে হলে সেটা একটা লজ্জাজনক ব্যাপার হবে।
বাকিরা অনেক বোঝালেও আমরা রাজী হলাম না। সুতরাং মধ্যাহ্নভোজনের পর বাকি চারজন ট্রেনারদের সঙ্গে জলে নামল এবং আমি আর শ্রেয়সী সমুদ্রের ধারে বসে ঘন নীল জলের সৌন্দর্য উপভোগ করলাম।
মোটামুটি আধা ঘন্টার মধ্যেই একে একে চার মূর্তিমান/মতী জল থেকে উঠে এল। মোটামুটি কারো জলের তলায় কোন অসুবিধে হয়নি সেটা ভাল ব্যাপার।

ফেরার পথে ওদের জলের তলার গল্প শুনতে শুনতে এবং বিয়ার খেতে খেতে যখন আবার কুটায় ফিরলাম তখন সন্ধ্যা নেমেছে। কিন্তু রাত তখনও বাকি!

Saturday, June 17, 2017

ইন্দোনেশিয়ার ডায়রি - ৩


ফরজি ততক্ষণে একটা ঘুম-টুম দিয়ে চাঙ্গা হয়ে উঠেছে। আমাদের নিয়ে বেরিয়ে পড়ল ঝটপট। বলে দিলাম যে, খিদে পেয়েছে। ব্রেকফাস্ট করা দরকার। পাহাড়ী রাস্তা দিয়ে গাড়ী নিচে নামল। তারপর সমতলে আরো কিছুটা এগিয়ে একটা স্থানীয় ছোট খাওয়ার জায়গায় গিয়ে আমরা থামলাম। সকলেই তখন বেশ ক্লান্ত, বিশেষ করে সারা রাত জেগে থাকার ক্লান্তিটা চোখে মুখে ধরা পড়ছিল। গিয়ে চাউমিন, অমলেট ইত্যাদি অর্ডার করে আমরা বাইরে এসে বসলাম। আরো একটি কাপলও ছিল। তারাও তাদের খাবার অর্ডার দিয়ে আমাদের মতই বাইরে বসল। শ্রেয়সী ততক্ষণে খিদের জ্বালায় অস্থির।
মিনিট পাঁচেক পর ভেতর থেকে একটি মেয়ে দু প্লেট নুডলস্‌ সাজিয়ে গুছিয়ে নিয়ে এল। স্থানীয় খাবার, তার নাম নিয়ে সকলেই কনফিউজড। নাম শুনে ওই কাপলের মেয়েটি একটি প্লেট নিল। অন্য প্লেটটা শ্রেয়সী নিয়ে খাওয়া শুরু করল। দু চামচ খাওয়ার পর বোঝা গেল, ওটাও ঐ অন্য গ্রুপটার জন্যই ছিল। শ্রেয়সী তারপরেও ওটা অফার করেছিল কিন্তু রেস্তোরার লোকজন আরো এক প্লেট বানিয়ে নিয়ে এল চটপট!
পরে দেবাদ্রি ওদের সঙ্গে কোথায় কোথায় ঘুরেছে সেই নিয়ে দিব্যি গল্প জুড়েছিল। খেয়েদেয়ে আমরা আবার যাত্রা শুরু করলাম, এবার গন্তব্য জঙ্গলের মধ্যে মাদেকারিপুরা জলপ্রপাত।

ফরজি প্রায় ঘন্টা খানেক পর আমাদের নিয়ে এসে নামালো জঙ্গলের ঠিক বাইরের পার্কিং লটে। এরপর বোঝা গেল যে, বাকি রাস্তা আর গাড়ী যায় না। তার বদলে স্থানীয় ছেলেরা বাইক নিয়ে ঘুরছে, সেই বাইক ভাড়া করে জঙ্গলের মধ্যে আর দুই কিলোমিটার যেতে হয় আর তারপর বাকিটা হেঁটে। আরো জানা গেল যে, জলপ্রপাতটা বেশ বড় এবং সেখানে গেলে জামা-কাপড় ভেজার সম্ভাবনা আছে। সেসব শুনে এবং যেহেতু চেঞ্জ করার জায়গা ছিল আমরা ঝটপট জলে নামার মত পোশাকে রেডি হয়ে গেলাম। সময়ের ব্যাপারটাও মাথায় রাখতে হচ্ছিল। তখন প্রায় বারোটা বাজে। জলপ্রপাত দেখে মোটামুটি দুটো-আড়াইটের মধ্যে বেরোতেই হবে কারণ ফরজির মতে ওখান থেকে এয়ারপোর্ট যেতে তিন-সাড়ে তিন ঘন্টা লাগবে। এছাড়া খাওয়ার জন্যেও থামতে হতে পারে। এদিকে আমাদের ফ্লাইট সাতটায়।
যাই হোক, তখনকার মত ছটা বাইক ঠিক করে ছয় মূর্তিমান যাত্রা শুরু করলাম। আমাদের চালক যারা তার সব অল্পবয়স্ক ছেলেপুলে কিন্তু পাকা হাত, ওই জঙ্গলের মধ্যেও চমৎকার চালিয়ে এবং ভাঙা ভাঙা ইংরেজিতে গল্প করতে করতে আমাদের পৌঁছে দিল টিকিট কাউন্টারের সামনে। আমার বাইকটা সবচেয়ে পেছনে ছিল। নেমেছি সবে, হঠাৎ দেখি শ্রেয়সীর বাইকটা ঘিরে বেশ হইচই হচ্ছে। গিয়ে দেখি, ভদ্রমহিলা বাইক থেকে নামার সময় কোন অজ্ঞাত (!) কারণে উল্টোদিক দিয়ে নামতে গেছেন এবং বাইকের সাইলেন্সারে লেগে ডান পায়ের গোছের কাছে প্রায় দুই-আড়াই ইঞ্চি মত জায়গা পুড়িয়ে ফেলেছেন!

ব্যাপারটা নিয়ে বেশ সাড়া পড়ে গেল। আমাদের বাইকের ছেলেগুলোই নানাভাবে পিউয়ের যত্ন নিতে লাগল। জলের বদলে একরকম তেল এনে ওর পায়ে দিতে লাগল। আমদের কয়েক জন, যেমন ঈশিতা উত্তেজিত হলেও বাকিরা বিশেষ করে শ্রেয়সী তেমন পাত্তা দেয়নি। সে এরকম কান্ড করেই থাকে! এইসব তালেগোলে আবিষ্কার হল যে, আমরা নাচতে নাচতে এসে গেছি বটে, কিন্তু জলপ্রপাতের কাছে যেতে যে টিকিট লাগে সেই টিকিটের ২১,০০০ করে এক লাখ ছাব্বিশ হাজার রুপিয়া আনা হয়নি। দেবা আবার গেল বাইকে করে টাকা আনতে। আমরা ওখানেই বসলাম। শ্রেয়সী পায়ের পরিচর্যার নামে কঙ্কনার সঙ্গে 'পা পোড়া সেলফি' তুলতে ব্যস্ত হয়ে পড়ল!
ইন্দোনেশিয়ার লোকজন বেশ ফ্রেন্ডলি, ওখানেও একটা ছেলে এসে আমাদের সঙ্গে গল্প করতে শুরু করল। এই প্রসঙ্গে একজন গ্লোবাল ইন্ডিয়ান সুপারস্টারের কথা লিখে ফেলি। এই ইন্দোনেশিয়া ট্রিপ না করলে কোনদিন জানতে পারতাম না শাহরুখ খান আমাদের দেশের বাইরে কতটা জনপ্রিয়। গাড়ীর চালক, দোকানদার বা রেস্টুরেন্টের রাঁধুনি, যেই হোক ভারতীয় শুনলেই তাঁদের একটাই পয়েন্ট অফ রেফারেন্স, 'শারুক খান'... এমনকি দোকানদাররা রীতিমত 'কুছ কুছ হোতা হ্যায়'' আর 'দিল তো পাগল হ্যায়'র গান গেয়ে শুনিয়েছে। এছাড়া দেবার গানের গল্পেও পরে আসব। যাই হোক সেই ছেলেটির সঙ্গে শাহরুখকে নিয়ে আড্ডা মারতে মারতে দেবা টাকা নিয়ে এসে হাজির হল এবং আমরা এগিয়ে পড়লাম মাদেকারিপুরা জলপ্রপাতের উদ্দেশ্যে।
জঙ্গলের মধ্যে হলেও কংক্রিটের বাঁধানো রাস্তা, যদিও কিছুটা এগোনোর পর লোহার ব্রিজ এমনকি বাঁশের ছোট ব্রিজের ওপর দিয়েও যেতে হয়েছে। তবে সে অনেকটা ভেতরে। পা চালিয়ে আমি আর ড্যুড সামনে যাচ্ছিলাম, বাকিরা পেছনে। মাঝে সকালের সেই ভদ্রমহিলা, শ্রেয়সী যাঁদের খাবার খেয়ে নিয়েছিল তাঁদের সঙ্গে দেখা হল। তাঁরাও বললেন যে জলপ্রপাত এখনো ভেতরে কিন্তু দৃশ্য নাকি দুর্দান্ত! সেই শুনে আরো কিছুটা পা চালিয়ে শেষ অবধি পৌঁছলাম। জলপ্রপাতের সামনে গিয়ে বুঝলাম কেন এটা এত বিখ্যাত। কারণ জলপ্রপাত একটা নয়। উঁচু পাহাড় একটা লম্বা দেওয়ালের মত বানিয়েছে আর সেই দেওয়াল থেকে পাঁচ-ছটা ধারায় জল ঠিক আমাদের সামনে নেমে আসছে বিভিন্ন গতিবেগে। সেটা একটা দেখা মত জিনিস!শুধু তাই নয়, জলটা যেখানে এসে পড়ছে পাথর-টাথর টপকে সেখানে যাওয়া যায়। অতঃপর সবাই মিলে নানাভাবে ভিজে মাদেকারিপুরা জলপ্রপাত এনজয় করা হল। ওই জলের মধ্যেও প্রচুর ছবি তুলে ভিজে জবজবে হয়ে আবার আধ ঘন্টা পর রওয়ানা দিলাম ফেরার পথে।

তারপর আবার সেই বাইকে করে গেটে। সেখানে ভিজে জামা-কাপড় চেঞ্জ করে চললাম এয়ারপোর্টের পথে। খুব একটা দেরি হয়নি, সঙ্গে স্ন্যাক্স ছিল, তাই খাওয়াটাও কাটিয়ে দিয়ে চললাম এয়ারপোর্টের উদ্দেশ্যে। খাওয়া-দাওয়া হল এয়ারপোর্টে। পরের গন্তব্য বালি!

Saturday, May 27, 2017

ইন্দোনেশিয়ার ডায়রি - ২

প্লেনযাত্রা ঘটনাবিহীন ছিল। নতুন দেশ ইন্দোনেশিয়ার সুরাবায়ার সময় রাত সাড়ে দশটায় নেমে দেখা হল আমাদের ড্রাইভার এবং গাইড ফরজির সঙ্গে!
প্রথমেই ফরজির সঙ্গে আমাদের প্ল্যানটা একবার ফাইনাল করে নিলাম। প্রথমে আমরা ডিনার করব, তারপর প্রায় ঘন্টা তিনেক ড্রাইভ করে পৌঁছব মাউন্ট ব্রোমোর কাছে। সেখানে একটা স্পটে আমাদের গাড়ি ছেড়ে একটা জিপ নিয়ে যেতে হবে আর এক ঘন্টা। জিপ পৌঁছে দেবে পেনানজাকান হিলের তলায়। সেখান থেকে একজন গাইড নিলে সে আমাদের রাস্তা দেখিয়ে সুবিধামত ভিউপয়েন্টে নিয়ে যাবে, যেখান থেকে ব্রোমো পাহাড়ের উপর সূর্যোদয়ের সময় আলোর খেলা দেখা যাবে! ব্রোমো নামটা কিন্তু এসেছে ব্রহ্মা থেকেই। ব্রোমোর সঙ্গে সেখানে আছে বাতুর এবং সুমেরু পর্বত, যে সুমেরু পর্বতে নাকি ভগবানদের ঘরবাড়ী। সূর্যোদয়ের পর সেই জীপে করেই আরো একটা-দুটো জায়গা দেখার পর আমরা গাড়ীতে ফিরে আসব। তারপর গাড়ী নিয়ে চলে যাবো মাদিকারিপুরা জলপ্রপাত। তবে শেষ অবধি গাড়ী যাবে না, সেখানে জঙ্গলের মধ্যে বাইকে চড়ে যেতে হবে জলপ্রপাতের কাছে। সেসব দেখে ফাইনালি ও আমাদের নামিয়ে দেবে এয়ার পোর্টে।

পরিকল্পনা মত মোটামুটি ঠিকঠাক একটা খাবার জায়গায় নিয়ে যেতে বলে আমরা রওনা দিলাম। রাতে ভালোই ডিনার হল। নাসি গোরেং, ওখানকার স্থানীয় বিফ কারি এবং ভাত ইত্যাদি। এখানে একটা মজার অভিজ্ঞতা হল। লম্বা যাত্রার আগে আমরা সকলেই একবার বাথরুমটা ঘুরে যাবো ভাবছিলাম। ওখানকার বাথরুমটা ছিল পেয়িং টয়লেট। তা সেখানে ঘুরে আসার দক্ষিণা ২০০০ রুপিয়া! ব্যাপারটা কিছুই নয়, বর্তমানে ইন্দোনেশিয়ার রুপিয়ার ক্রয়মূল্য খুবই কম। ভারতীয় এক টাকা ওখানকার ২০০ টাকা। দেশের সবচেয়ে ছোট নোট ১০০০ রুপিয়ার, সেখান থেকে ১ লাখ রুপিয়া অবধি আছে। সঙ্গে ৫০০ আর ১০০০ রুপিয়ার কয়েন!
অতঃপর রাতের অন্ধকারে গাড়ীর ফ্রি ওয়াইফাইতে গান চালিয়ে আমরা বেরিয়ে পড়লাম ব্রোমো পাহাড়ের উদ্দেশ্যে। কিছুক্ষণের মধ্যেই শহরের রাস্তা ছেড়ে গাড়ী ফাঁকা রাস্তা ধরল। দুদিকে গাছপালা, ছোট ছোট বাড়ীঘর। কথামত তিনটে নাগাদ ভিড়ে-ভিড়াক্কার একটা জায়গায় পৌঁছলাম। জানা গেল, এখান থেকেই জিপ নিতে হবে। গাড়ী থেকে বেরিয়ে বুঝলাম ঠাণ্ডা ভালোই। সেটা মাথায় রেখে গরম কাপড় যথেষ্ট আনা হয়েছিল। সেগুলো ভালো করে চড়িয়ে আমরা উঠে বসলাম আমাদের লাল রঙের জীপে।
দেবাদ্রির ক্যামেরা থেকে 
ঘুটঘুটে অন্ধকারে হালকা কুয়াশার মধ্যে দিয়ে গাড়ী চলল। আমি তখন প্রায় ঘুমন্ত। ওই জিপেই চট করে একটা পাওয়ার ন্যাপ মেরে নিলাম। জিপ এসে  থামল এক পাহাড়ের নিচে। ঐ রাত তিনটেও সেখানে কী ব্যস্ততা! একের পর এক জীপ থেকে আমাদের মত অন্য দলবল এসে নামছিল। সঙ্গে টর্চ হাতে গাইডের দল, চা-কফি-সিগারেট বিক্রেতার দল। সেরকম এক গাইড ঠিক করে মিনিট পাঁচসাত অন্ধকারের মধ্যে পেনানজাকান পাহাড়ে উঠে একটা সুবিধামত জায়গায় ঘাসের ওপর মাদুর পেতে বসিয়ে দিয়ে গাইড বাবাজি কেটে পড়ল। যাওয়ার আগে চা-কফিওয়ালা ডেকে আনবে বলেছিল, কিন্তু সেটা শেষ অবধি আসেনি।
চারদিক তখনও অন্ধকার, সামনে পাহাড়ের ঢাল নেমে গেছে। তার সামনে অনেকটা ধোঁয়া ধোঁয়া জায়গা আর আরো সামনে জমাট অন্ধকার। বুঝলাম ঐ ধোঁয়াগুলো কুয়াশা আর জমাট অন্ধকারগুলো পাহাড়। কোনটা ব্রোমো সেটাও দেখিয়ে দিয়ে গেল আমাদের গাইড।
তারপর বসেই আছি। আশেপাশে বিভিন্ন দেশের আরো মানুষ আসছেন। কেউ আমাদের পাশেই বসছেন। কেউ আরো এগিয়ে যাচ্ছেন। দেবা আর ড্যুডও ঘুরে দেখে এল সামনে বেটার ভিউপয়েন্ট আছে কিনা। বসে ঠাণ্ডায় কাঁপতে কাঁপতে গুলতানি চলছে। আস্তে আস্তে অন্ধকার হালকা হচ্ছিল। দূরে ব্রোমো পাহাড় আর তার ওপরে একটা মেঘের স্তর মনে হচ্ছিল। তারপর আস্তে আস্তে বুঝলাম ঐ মেঘ/ধোঁয়ার গঠনটা খুব ধীরে ধীরে চেঞ্জ হচ্ছে। যাইহোক আস্তে আস্তে ভোরের আলো ফুটলেও কুয়াশার জন্য সূর্যের দেখা পাওয়া গেল না। কুয়াশার মধ্যে ব্রোমো পাহাড়ের ধোঁয়া দারুণ লাগছিল কিন্তু সূর্যোদয় দেখার মজাটা পাওয়া গেল না। যাই হোক শ খানেক ছবি এবং দুশ-আড়াইশো সেলফি তোলার পর পাহাড় থেকে নামা হল।
দেবাদ্রির ক্যামেরা থেকে
পরবর্তী গন্তব্য কোথায় জানতাম না। একটু পরে দেখি একটা বিশাল বড় মাঠের ধারে গাড়ী এসে নামিয়ে দিয়েছে। গাড়ী থেকে নেমে দেখি পুরো মাঠটার রঙ কালো এবং সেটা গিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার পর থেকে ব্রোমো পাহাড় উঠে গেছে যার মাথা থেকে একটানা ধোঁয়া বেরিয়ে চলেছে এবং সেটা সেখান থেকে পরিষ্কার দেখা যাচ্ছে। বুঝলাম ঐ আগ্নেয়গিরির লাভা আর ছাইয়ের কারণেই মাঠটা পুরো কালো। নেমে, মেয়ের দল টুক করে ফ্রেশ হয়ে এলো। আমরা এলোমেলো ঘুরছিলাম তারপর বুঝলাম ঐ মাঠের মধ্যে দিয়ে হেঁটে গিয়ে পাহাড়ের গায়ে বানানো সিঁড়ি দিয়ে উঠলে একবারে আগ্নেয়গিরির মুখ অবধি পৌঁছনো যাবে। কিন্তু সেই পাহাড়ের সিঁড়ি অবধি হেঁটেও যাওয়া যায় বা ঘোড়ায় করে যাওয়া যায়। সবাই মিলে শেষ অবধি ঘোড়াই নেওয়া হল। ছটি ঘোড়া এবং ঘোড়ার মালিকদের সঙ্গে আমরা চললাম ঘোড়ায় চলে।
আমার প্রথম অশ্বারোহণ। ভাগ্য ভালো, আমার ঘোড়া পাঞ্জের বেশ শান্তশিষ্ট ছিল। দুলকি চালে নিয়ে গেল তবে বেশ এবড়োখেবড়ো সরু রাস্তার মধ্যে দিয়ে মানুষ ও ঘোড়া একসঙ্গে যাচ্ছে বলে ব্যাপারটা বেশ চাপের। আমার সামনেই দুটো মেয়ে একটু অন্যমনস্ক হয়ে হাঁটছিল। হঠাৎ ঘুরে দেখে পাঞ্জের প্রায় ওদের ঘাড়ের ওপরে, তাড়াতাড়ি সরতে গিয়ে একজন পরেই গেল। তাদের কাটিয়ে আমরা এগোলাম। দলবলের মধ্যে সবার আগে ওই সিঁড়ির কাছে আমিই পৌঁছলাম। ঘোড়া থেকে নামার পর ঘোড়ার মালিকই বলল, "ফোন দাও, ছবি তুলে দিচ্ছি।"
দস্যু সর্দারনী
একে একে বাকিরাও এল, শ্রেয়সীর কাছ থেকে জানা গেল যে, শ্রেয়সীর ঘোড়া খুবই দুষ্টু এবং মাঝে মাঝেই নাকি বেগরবাঁই করেছে তবে সেটা আরোহীর সঙ্গদোষে কিনা জানা গেল না!

আগ্নেয়গিরির মুখ অবধি যাওয়ার সিঁড়িটা বেশ সরু। তাতে করে একজন একজন করে ওঠা আর উল্টোদিক থেকে একজন করে নামা। তার মধ্যে কেউ একজন উঠতে উঠতে ছবি তুলতে দাঁড়িয়ে পড়লেই পেছনে ট্রাফিক জ্যাম। যাই হোক, ওপরে ওঠার পরের দৃশ্যটা অবিস্মরণীয়। ওপরে যে খুব বেশী জায়গা তা নয়। সেই তুলনায় লোক প্রচুরই। কিন্তু আক্ষরিক অর্থেই আগ্নেয়গিরির পেটের মধ্যে কী হচ্ছে দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে একটা অবিশ্রান্ত গুম-গুম আওয়াজ। কিছুটা সময় ওখানে কাটানো হল, ছবি-টবিও তোলা হল। একটা ভাঙাচোরা রেলিং মত আছে, সেটাতেই হেলান দিয়ে বসা হল। সেখানে আবার একটা ছোট গনেশ মূর্তি খুঁজে বের করলাম। বুঝলাম এখানে পুজোও হয়। মিনিট পনেরো পরে আস্তে আস্তে নেমে এলাম সিঁড়ি দিয়ে। ততক্ষণে খুব খিদে এবং জল তেষ্টা পেয়ে গেছে। খাবার ভালো কিছু পাওয়া গেল না। বাকি রাস্তাটাও পায়ে হেঁটেই নামলাম। নিচে এসে সামান্য বিস্কুট জাতীয় খাবার আর জল কিনে খাওয়া হল। তারপর আবার জীপ পৌঁছে দিল আমাদের গাড়ীর কাছে। তখন বাজে প্রায় নটা।
দেবাদ্রির ক্যামেরা থেকে। অগ্নুৎপাতের ফলে তৈরি খাঁজ!

Sunday, May 21, 2017

ইন্দোনেশিয়া ডায়েরি - ১

আমি মালয়শিয়ায় আসার পর থেকেই দলবলের সঙ্গে মালয়শিয়া এবং তার আশেপাশের জায়গাগুলো ঘোরার প্ল্যান বানানো চলছিল। তর্ক-বিতর্কের বহু বিষয় ছিল। যেমন কবে যাওয়া হবে, কোথায় যাওয়া হবে, কী কী দেখা হবে ইত্যাদি। প্রায় মাসখানেক বহু হোয়াটস্যাপ চ্যাট, কনফারেন্স কল এবং ইন্টারনেট সার্চের পর ফাইনালি একটা প্ল্যান দাঁড় করানো গেল।
কিন্তু প্ল্যানের আগে কারা কারা এই ঘোরার প্ল্যানের পার্ট ছিল সেটা লিখে ফেলি।
আমি আর দেবাদ্রি তো ছিলামই মালয়শিয়া থেকে।
কলকাতা থেকে আসছিল আমার অর্ধাঙ্গিনি শ্রেয়াসী, যাকে নিয়ে আমার ব্লগেও আগেও লেখা হয়েছে। সঙ্গে ছিল পাঠভবনের পাঁঠা ওরফে ঈশিতা ওরফে ভাইটু যাকে দার্জিলিং ঘুরতে গিয়ে আমাদের সঙ্গী বিকাশ বলত 'বাইটু'!
দিল্লী থেকে আসছিল দলের সবচেয়ে হাল্কা-ফুল্কা সদস্য দেবনাথ ওরফে ড্যুড!
হায়দ্রাবাদ থেকে আসছিল কঙ্কনা। যার বয়স আঠেরোর বেশী বাড়ে না এবং যে সুস্থভাবে ফিরে যাওয়ায় ওর অফিস আহ্লাদিত হয়ে ওকে এমন একটা পুরষ্কার দিয়েছে যে ঘোরার পুরো খরচাই নাকি উঠে গেছে!
ঘোরার প্ল্যানে কেএল ছাড়াও ছিল সুরাবায়া এবং বালি। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে যাওয়া হবে সুরাবায়া। সুরাবায়া ইস্ট জাভার অন্তর্গত এবং ইন্দোনেশিয়ার ম্যাপে বালির সামান্য ওপরে অবস্থিত। সেখানে যাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মাউন্ট ব্রোমো আগ্নেয়গিরি এবং মাদিকারিপুরা জলপ্রপাত দর্শন। সেখানে থেকে পরের গন্তব্য বালি, সেখানে স্কুবা ডাইভিং করা হবে এবং বালির বিভিন্ন অসাধারণ সুন্দর  ঐতিহাসিক মন্দিরগুলো দেখে কেএল ফেরা হবে।
ফ্লাইট এবং হোটেল বুকিং পুরোটাই অনলাইন করা হয়েছে এয়ার এশিয়া এবং বুকিং ডট কমের সাইট থেকে। এছাড়া শ্রেয়াসী 'ডিসকভার ইন্দোনেশিয়া' বলে একটি গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করে একদিনের ব্রোমো-মাদিকারিপুরা ঘোরার প্ল্যান-গাড়ী ফাইনাল করে ফেলেছিল। আর দেবা ঠিক করে ফেলেছিল স্কুবার গ্রুপ। সেও অনলাইন!
দেবাদ্রির ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে শ্রেয়সীর তোলা ছবি
যাই হোক, এপ্রিল মাসের ২৭ তারিখ কলকাতা-দিল্লী-হায়দ্রাবাদ থেকে দলবল চলে এল কুয়ালালামপুরে। পরের দিন সন্ধ্যেবেলার ফ্লাইট সুরাবায়ার উদ্দেশ্যে আর তারপরেই শুরু অ্যাডভেঞ্চার!
ভুল! অ্যাডভেঞ্চার শুরু হল প্লেনে ওঠার আগেই! ব্যাপারটা হল, আমি আমার অফিসে বলে ২৮ তারিখের একটা হাফ-ডে যোগার করেছিলাম, শুক্রবার ছিল তাই খুব বেশী চাপ হয়নি। কিন্তু দেবার বিকেল পাঁচটার সময় একটা স্ট্যাটাস আপডেট কল ছিল যেটা অনেক চেষ্টা করেও ও কাটাতে পারেনি। এদিকে প্লেনের সময় সাতটা পঁয়ত্রিশ, এবং ইন্টারন্যাশানাল ফ্লাইট তাই তার এক ঘন্টা আগে চেক-ইন বন্ধ হয়ে যাবে! সুতরাং ব্যাপারটা দাড়িয়েছিল যে, ছটা নাগাদ অফিস থেকে বেরিয়ে কোনভাবে ওকে ছটা পঁয়ত্রিশের মধ্যে এয়ারপোর্ট এসে পৌঁছতে হবে! আর ওর অফিস থেকে এয়ারপোর্ট যাওয়ার সবচেয়ে তাড়াতাড়ি উপায় হল কেএল সেন্ট্রাল এসে এয়ারপোর্ট শাটল্‌ ট্রেন নেওয়া যেটা করলেও ৪৫ মিনিট লেগেই যাবে। তার মধ্যে আবার দুপুরে এক প্রস্থ ঝোড়ো বৃষ্টি হয়ে গেল। প্রচণ্ড টেনশান মাথায় নিয়ে আমি, শ্রেয়াসী, ভাইটু আর কঙ্কনা এবং অধিকাংশ ব্যাগ নিয়ে চারটে নাগাদ এয়ারপোর্টের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। ড্যুড গেল দেবার অফিস, ওর মিটিং হয়ে গেলে ওকে নিয়ে একসঙ্গে চলে আসবে।
রাস্তার জ্যাম কাটিয়ে মোটামুটি সাড়ে পাঁচটা নাগাদ এয়ারপোর্টে ঢুকে গেলাম। কিন্তু সেখানে আমাদের জানিয়ে দেওয়া হল যে, শুধু যে কজন এসেছে তাদের পাসপোর্ট দেখে সেই বোর্ডিং পাসগুলো দেওয়া হবে। বাকিরা যখন এসে পৌঁছবে তখন বোর্ডিং পাস পাবে। কী আর করা, আমরা আমাদের বোর্ডিং পাস নিয়ে, ইমিগ্রেশান, সিকিউরিটি চেক করে গেটের সামনে পৌঁছলাম, তখন প্রায় ছটা বাজে। দেবারা তখনো কেএল সেন্ট্রালের পথে। আমরা চারজন গম্ভীর মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এর মধ্যে এক জায়গায় সিকিউরিটি চেকিং হওয়ার পর একটা গোদা ব্যাগ ফেলে এসেছিলাম, সেটা আবার দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এলাম। কিন্তু দেবাদের পৌঁছনোর টেনশানে ওটার চাপ মাথায় রেজিস্টারই হল না। ছটা দশ নাগাদ শুনলাম দেবারা ট্রেনে উঠেছে। যে ট্রেন এয়ারপোর্ট পৌঁছতে ৩৩ মিনিট সময় নেবে। আমাদের গোটা আষ্টেক ব্যাগের দায়িত্ব কঙ্কনাকে দিয়ে তখন আমি, শ্রেয়সী আর ভাইটু এদিকওদিক র‍্যান্ডম অ্যাটেন্ডেন্টকে ধরে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি। সাড়ে ছটা বাজল, দেবারা আপডেট দিচ্ছে যে আর একটু পরেই এয়ারপোর্ট। ছটা তেতাল্লিশ, দেবা আর ড্যুড এয়ারপোর্টে নেমে চেক-ইন লবির দিকে ছুটছে। এর মধ্যে এক দাত-ক্যালানে সিকিউরিটি অ্যাটেন্ডেন্ট আমাদের বুঝিয়েছে, "সি, ইওর ফ্রেন্ডস আর লেট, রাইট? সো ইটস দেয়ার ফল্ট, রাইট?" আর দশবার করে খালি বলে, "আর দে ইন এয়ারপোর্ট?" লাস্টে আমি "একে দিয়ে হবে না, কাটা!" বলে মেয়েগুলোকে অন্যদিকে নিয়ে গেলাম।
ছটা পঞ্চাশ... দেবারা আর ফোন ধরছে না, আমরাও ওদের ছুটোছুটির মধ্যে আর ফোন করছি না।
এর মধ্যে শ্রেয়সী এবং ভাইটু এয়ার এশিয়ার একটি ছেলেকে দাঁড় করিয়ে সমস্যার কথা বলল, সে শুনে 'দেখছি' বলে কেটে পড়ল। আমি তখন মনে মনে ভাবছি যে, ওদের পরের ফ্লাইটে আসতে বলে আমরা এগিয়ে পড়ব কিনা!
পাঁচ মিনিট পর আবার এয়ার এশিয়ার ছেলেটি এসে আমাদের ডেকে নিয়ে গেল। আমরা তিনজন গেলাম একজিট গেটের কাছে। সেখানে একটা কম্পুটারের ব্ল্যাক স্ক্রিনে কয়েকটা নাম দেখিয়ে বলল, "এখানে তোমার বন্ধুদের নাম আছে?"
আমরা দেখে বললাম, না। ছোকরা ম্যাটার অফ ফ্যাক্টলি বলল, "ওহ্‌ তাহলে তোমাদের বন্ধুদের চেক ইন হয়ে গেছে!"
সেই শুনে আমাদের আর দেখে কে! শ্রেয়সী ওই একজিট গেটের সামনে যে জয়োল্লাস ও নাচটা শুরু করল সেটা সাধারণতঃ বিরাট কোহলি টেস্ট সিরিজে স্টিভ স্মিথকে আউট করার পর করে থাকে! লোকজন বেশ ঘাবড়ে গেছিল, আমি 'সরি-টরি' বলে ম্যানেজ করলাম। কঙ্কনাকে গিয়ে সুখবর দিতে দিতে দেখি লম্বা প্যাসেজের শেষপ্রান্ত থেকে বিশ্বজয়ীর হাসি দিতে দিতে দুই মক্কেল আসছে!!

জানা গেল, 'জানে তু ইয়া জানে না' স্টাইলে অনেক দৌড়দৌড়ি করে এবং ঝামেলার পর তারা তাদের বোর্ডিং পাস পেয়েছে। যাই হোক, সব ভালো যার শেষ ভালো! আমাদের ভ্রমনের যদিও সবে শুরু!

... চলবে

Sunday, April 2, 2017

কেএলে কয়েক মাস - ৩

কয়েক হপ্তা পরে ফিরে এলাম ব্লগে। কাজের চাপ চলছে ভালোই আর উইকেন্ডেও ঘুরে বেরাচ্ছি তাই ব্লগ নিয়ে আর বসা হয়নি। এর মধ্যে বাতু কেভস আর কিনারা ওভাল ঘুরে এলাম।

বাতু কেভস হল চূনাপাথর বা লাইমস্টোনের অনেকগুলো গুহা। কুয়ালালামপুর সেন্ট্রাল স্টেশন থেকে ট্রেনে ৪৫ মিনিট লাগল পৌঁছতে। বিকেল সাড়ে চারটে নাগাদ যখন ট্রেন থেকে নামলাম তখন পুরোদমে বৃষ্টি হচ্ছে। মিনিট দশেক দাঁড়ানোর পর বৃষ্টি একটু কমলে স্টেশন থেকে বেরোলাম। স্টেশনের গায়েই বাতু কেভসের গুহা। বড়জোড় ২০০-৩০০ মিটার হবে।
সামনে একটা উঠোন মত জায়গা, সেখানে দোকানপাট বেশ কিছু ছোট মন্দির আর মুরুগনের ১৪০ ফুট লম্বা স্ট্যাচু, বিশ্বের উচ্চতম মুরুগন মূর্তি। মুরুগন দক্ষিণ ভারতীয় দেবতা, যদ্দুর জানি কার্তিকেরই আর এক নাম। মূর্তির পাশ দিয়ে উঠে গেছে ২০০টা সিঁড়ি, তার ওপরে মন্দির। কেউ যদি মন্দিরে যাওয়ার প্ল্যান বানিয়ে আসেন তাহলে ফুল প্যান্ট বা গোড়ালি অবধি ঢাকা পোষাক পড়ে আসাটা জরুরি। না এলেও চাপ নেই, সিঁড়ির নিচে রংবেরঙ্গের কাপড় পাওয়া যায় কোমরে বাঁধার জন্য।
বাতু কেভসের প্রধান তিনটে গুহা হল, মন্দির কেভ, ডার্ক কেভ আর রামায়ণ কেভ।
এগুলোর মধ্যে ডার্ক কেভই সবচেয়ে ইন্টারেস্টিং। গুহার মধ্যে প্রায় হাফ কিলোমিটার পায়ে হেঁটে ট্যুর হয় (দক্ষিণা ৩৫ রিঙ্গিট) গ্রুপে, সঙ্গে গাইডও থাকে। আমাদের সঙ্গে ছিল জাফ। ভালোই গল্প করতে করতে নিয়ে গেল। গুহা ভর্তি বাদুর, এছাড়া একটা বেশ বিষাক্ত সাপ দেখলাম দেওয়ালের ধারে, এছাড়া অনেকগুলো পাওয়ালা বিছের মত একটা প্রানী আর মাকড়সাও দেখলাম। তার সঙ্গে বহু ধরণের ভৌগলিক গঠন দেখলাম নিজের চোখে বিশেষ করে ৪০ কোটি বছরের স্ট্যালাক্টাইটস আর স্ট্যালাগ্মাইটস চোখে পড়ল অনেক জায়গায়, সেগুলো বেশ ইউনিক।
মন্দির কেভ পুরোটাই বাঁধানো, বেশ বড় মন্দির, দানের পাত্র, পুজোর সামগ্রীর দোকান সবই আছে। মন্দিরের চারদিকে পাহাড় উঠে গেছে। ওপরটা খোলা, বেশ সুন্দর।
রামায়ন কেভটা আর কিছুই নয় একটা গুহার ভেতরে রামায়নের বিভিন্ন ঘটনা মূর্তি দিয়ে সাজিয়ে রেখেছে। সেরকম আহামরি কিছু নয় যদিও টিকিট মাত্র ৫ রিঙ্গিট।


মোটামুটি দু ঘন্টায় বাতু কেভসের আশপাশ দেখে ফিরে গেলাম কে এলে। পরের পোস্টে লিখছি কিনারা ওভালের গল্প।

Sunday, March 12, 2017

কেএলে কয়েক মাস - ২

দু সপ্তাহ ধরে এখানে থাকার পর আস্তে আস্তে এখানকার মানুষ, তাঁদের পছন্দ-অপছন্দের দিকটা পরিষ্কার হয়ে আসছে। এমনিতে কুয়ালালামপুরে বিভিন্ন জনজাতির লোক দেখা যায়। দেশের প্রধান তিনটি জনজাতি হল মালয় (৪৬%), চাইনিজ (৪৩%) এবং ভারতীয় (১০%)। এই ভারতীয়দের অধিকাংশই দক্ষিণ ভারত থেকে কয়েকশো বছর আগে এখানে এসে স্থায়ীভাবে থেকে গেছেন। তাই এখানে ভারতীয় সংস্কৃতি বা খাদ্য বলতে মূলত দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতি বা খাদ্যকেই বোঝায়। 
আমার সঙ্গে প্রথম আলাপচারিতায় এখানকার স্থানীয় ভারতীয়রা আমার তামিল না জানায় খুবই আশ্চর্য হয়েছেন। এখানকার লোকেদের বোধহয় ধারণা ছিল যে, তামিল ভারতের প্রধান ভাষা। সেই ভুল ভেঙে দিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত ভাষা হিসেবে হিন্দির উল্লেখ করায় এঁরা বললেন, "ওহ, ইউ আর পাঞ্জাবি!" তখন তাঁদের ভারতের অন্যান্য ভাষা সম্বন্ধে জ্ঞান দিয়ে বাংলাদেশের লোকেরা এবং আমরা এক ভাষায় কথা বলি ইত্যাদি বলে কিছুটা বোঝানো গেল।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, কলকাতা থেকে কে এলে ঘুরতে এলে ভাষা এবং খাওয়া নিয়ে খুব একটা সমস্যা হবে না এবং তার প্রধান কারণ হল শহরের অন্যতম বড় বাংলাদেশী জনজাতি। এই শহরের রাস্তায় আমি হিন্দির চেয়ে বাংলা বেশী শুনেছি এখন অবধি। ছাত্র, চাকুরিরত, দোকানের বা রেস্তোরার কর্মচারী, এই শহরে বাঙ্গালদেশীর অভাব নেই। সত্যি কথা বলতে, দোকানে-টোকানে আমাদের মত চেহারার লোকজন দেখলে, "বাংলা জানেন?" দিয়ে শুরু করাই ভালো। এবং এঁরা দেশের লোকেদের ভালোই বাসেন। দ্বিতীয়বার গেলে চিনতে পারলে কুশল সংবাদ নেন।
দেশের কোন ডিস্ট্রিক্টের লোক জিজ্ঞেস করেন এবং "ডিস্ট্রিক্ট কলকাতা" শুনলেও এদের ব্যবহারের উষ্ণতা হ্রাস পায় না!
আমার সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্টের ঠিক উল্টোদিকের 'মিনি পাশার' (মানে ছোট বাজার) নামক মুদির দোকানটা একদল বাংলাদেশী ছেলেই চালায়। সকালেই তাদের সাহায্য নিয়ে চাল, আলু, ডিম, নুন ইত্যাদি নিয়ে এলাম। দু সপ্তাহ বাইরের খাবার খেয়েছি। এবার নিজের হাতের রান্নার জন্য মন কেমন করছে!
এখানকার লোকেরা খেলা ভালোবাসে, অফিসে রোজ সকালে আলোচনাও হয় এবং সেটা প্রধানত ইউরোপিয়ান ফুটবল নিয়ে। এবং শুধু বাচ্চারা নয় বয়স্ক কাকু এবং মাসিমাদেরও দেখলাম খেলা নিয়ে দিব্যি ইন্টারেস্ট এবং বেশ মন দিয়ে ফলো করেন। যদিও এখানকার সময় ভারত থেকেও আড়াই ঘন্টা এগিয়ে তাই অধিকাংশ খেলাই হয় গভীর রাতে কিন্তু তাও অনেকেই দেখেন এবং আলোচনা করেন।
আর গত দু সপ্তাহে ফুটবলে বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে লেস্টারের কাছে লিভারপুলের হার, তারপর লিভারপুলের আর্সেনালকে হারানো, জ্‌লাটানের সাস্‌পেন্সান, বার্সার ৬-১ কামব্যাক... এর সবগুলো নিয়েই অফিসে আলোচনা হয়েছে। ফুটবল ছাড়াও এখানকার লোকেরা ব্যাডমিন্টন আর হকি ফলো করেন। আমি কিছু পাবে লাইভ হকি ম্যাচ হতেও দেখেছি। ক্রিকেট সম্বন্ধে যা বুঝলাম, ব্যাপারটা অনেকেই জানেন, কোন দেশ খেলে সেগুলো জানেন, ভারতের জনপ্রিয়তাও জানেন তবে ডিটেল সেরকম কেউ জানেন না। কেউ বললেন, "ইন্ডিয়া এখন ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ান তো!" বুঝলাম যে, ২০১৫ সালের ওয়ার্ল্ড কাপের খবর পাননি। কেউ হয়তো ভিরাট কোহলির নাম জানেন কিন্তু সে কী করেছে খবর রাখেন না। ঐ ভারতে লোকে যেভাবে টেনিস বা রাগবি ফলো করে সেরকম আরকি।
যদিও এদেশে ক্রিকেটের ইতিহাস আছে এবং তার কারণ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে ১৯৫৭ সালের স্বাধীনতা অবধি এখানে বসবাসকারী ব্রিটিশ জনসংখ্যা। আমার মনে আছে এখানে কিনারা ওভাল বলে একটা মাঠে একটা সময় খেলা হত। ২০০৬ সালে একটা ত্রিদেশীয় সিরিজও হয়েছিল ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিয়ে। জায়গাটা ম্যাপে দেখে রেখেছি, কোন একটা উইকেন্ডে হয়তো দেখে আসব গিয়ে।
এখানে ইপিএল বা চ্যাম্পিয়ান্স লিগ প্রচার হওয়ার একটা বড় কারণ এখানকার খবরের কাগজগুলো। ইউরোপিয়ান ফুটবল নিয়ে ম্যাচ রিপোর্ট তো বটেই রীতিমত আলোচনাভিত্তিক প্রবন্ধ বেরোয় খেলোয়াড় এবং কোচেদের নিয়ে। ক্রিকেট নিয়ে রিপোর্টিং খুবই অদ্ভুত। এই কদিনে শুধু ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট নিয়ে সামান্য রিপোর্টিং দেখলাম। অনেকটা আমাদের দেশের ডোমেস্টিক ম্যাচ রিপোর্টগুলোর মত। কিন্তু শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ বা নিউজিল্যান্ড-সাউথ আফ্রিকা টেস্ট ম্যাচগুলো নিয়ে একটা লাইনও চোখে পড়েনি।

সারা সপ্তাহে অফিসে ভালোই চাপ ছিল তাই কাল খুঁজে খুঁজে একটা হট এয়ার বেলুন শোয়ে গেছিলাম বিকেলের দিকে। প্রায় ৮-১০ কিলোমিটার দূরে। একটা বেশ বড় খোলা জায়গায় বেশ মেলার মত বসেছিল। প্রায় হাজার পাঁচেক লোক হয়েছিল মনে হল। বেশ নাচ-গান, কনটেস্ট, ছোট ছোট খাবার দোকান ভালোই ছিল। কিন্তু চার খানা গোদা বেলুন দাঁড় করিয়ে সেগুলো ওড়ালো না কেন বুঝলাম না। হয়তো যখন তখন বৃষ্টি হতে পারে ভেবে ওড়ায়নি কিন্তু ব্যাপারটা বেশ অ্যান্টিক্লাইম্যাটিক!


আর সকালে বেরিয়েছিলাম মিউজিয়াম দেখতে। টেলিকন মিউজিয়াম, ন্যাশানাল টেক্সটাইল মিউজিয়াম, কুয়ালালামপুর সিটি গ্যালারি আর থ্রিডি আর্ট মিউজিয়াম দেখে এলাম। সিটি গ্যালারিতে পুরো শহরের মিনিচেয়ার ভিউয়ের সঙ্গে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শোটা বেশ ভালো লেগেছে। তবে ৫০ রিঙ্গিট (৭৫০ টাকা) দিয়ে ঐ থ্রিডি আর্ট গ্যালারি মোটেই সুবিধার নয়।







সঙ্গের ছবিগুলো কালকে তোলা।

Saturday, March 4, 2017

কেএলে কয়েক মাস - ১

সপ্তাহখানেক হল কুয়ালালামপুরে এসে আস্তানা গেড়েছি। অফিসের চক্করেই। আপাতত মাস তিনেক থাকার কথা। এক-দেড় মাস বাড়তেও পারে। পার্ক রয়্যাল কোম্পানির সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্টে একটা সুইটে বেশ গুছিয়ে বসেছি।

বেশ ভালো জায়গা এই কেএল। অনেক রকমের মানুষ। আসলে মালয়শিয়া দেশটাই বিভিন্ন জনজাতির সম্বনয়ে তৈরি। ধরুন তিনটি মানুষের নাম যথাক্রমে চে চুন লিম, মহম্মদ বিন আসলাম, নাগাশেখরন জালাকাট্টি। এরা তিনজনেই কিন্তু মালয়শিয়ার আদি বাসিন্দা হতে পারেন। এর সঙ্গে কর্মসূত্রে এবং ভ্রমণের কারণে একপাল ভারতীয়, পাকিস্তানি, বাংলাদেশী, মধ্য এশিয়ার লোক, আমেরিকান এবং ইউরোপীয়রা এই শহরে ঘুরে বেরাচ্ছেন। একেবারেই কসমোপলিটন এবং সেইজন্যেই রেস্তোরা, কারেন্সি কনভার্টার আর স্যুভেনির স্টোরের প্রাচুর্য্য।
এশিয়ার অন্যতম চকচকে শহর হওয়ায় এখানে সময় কাটানোর ব্যবস্থার অভাব নেই। যদিও সকালে কিছু করার সময় থাকে না। আটটায় ঘর থেকে নেমে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে যাই। রাজা চুলান স্টেশন থেকে মনোরেলে করে যাই হাংটুয়া। সেখানে লাইন চেঞ্জ করে কেএলআরে চেপে যাই মসজেদ জামেক। সেখানে স্টেশন থেকেই বেরিয়েই আমার অফিস। সব মিলিয়ে গোটা পাঁচেক স্টেশন। ঠিকঠাক ট্রেন পেয়ে গেলে বারো-তের মিনিট লাগে। এখানকার এই মনোরেল এবং এলআরটির কভারেজ ভালোই। যেকোন জায়গায় যেতে গেলে শুধু বুঝে নিতে হয় যে কোন স্টেশনে গিয়ে লাইন চেঞ্জ করতে হবে। বাকিটা খুব সহজেই হয় যায়।

সাড়ে আটটা নাগাদ অফিসে ঢুকি। বেরোই সাতটা নাগাদ। তখন আমার ঘোরার সময়। কখনো হেঁটে ফিরি। আসলে আমার অফিস থেকে পার্ক রয়্যাল সোজা রাস্তা। মিনিট কুড়ি লাগে হেঁটে। আর ট্রেন লাইনটা ঘুরে যায়।
কিন্তু দিনের বেলা অত সময় থাকে না হাঁটার। জায়গাটা বেশ গরম, সেটাও একটা কারণ, সকালে না হাঁটার। যদিও গত সপ্তাহে প্রায় রোজই সন্ধ্যের দিকে হালকা বৃষ্টি হয়েছে। তবে আমি যেখানে থাকি তার চারদিকে এত শপিং মল যে বৃষ্টি পড়লেই টুক করে কোথাও একটা ঢুকে পড়া যায়। আর এখানকার মলগুলো বিশাল জায়গা জুড়ে বানানো তাই কিছুক্ষণ টাইম-পাস হয়েই যায়।

আমি যে রাস্তায় থাকি তার নাম জালান নাগাসারি। জালান মানে রাস্তা তাই এখানকার ঠিকানায় জালানের ছড়াছড়ি। আর জালান নাগাসারি থেকে দু মিনিট হাঁটলেই বুকেত বিনতাং। বুকেত বিনতাং হল পাতি কথায় কুয়ালালামপুরের পার্ক স্ট্রিট যদিও অনেক বেশী ঝাঁ-চকচকে। সেখানে গাদা খানেক শপিং মল, গুচ্ছ গুচ্ছ খাবার জায়গা, দোকান-পাট, ফুড স্ট্রিট সব আছে! ফুড স্ট্রিটের নাম হল জালান আলোর। গত শনিবার সন্ধ্যেবেলা গেছিলাম। রাস্তার ওপর সারি সারি চেয়ার-টেবিল পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তাতে ভ্যারাইটির অভাব নেই।

খাবারের প্রসঙ্গে বলে রাখি, আপাতত দোকানে-রেস্টুরেন্টেই খেয়ে বেরাচ্ছি এবং যেটা বুঝেছি যে, এখানকার ভারতীয় খাওয়ার জায়গার তুলনায় পাকিস্তানি (দেশদ্রোহী বলবেন না প্লিজ) এবং অন্যান্য মধ্য এশিয়ার (যেমন লেবানিজ, ইরানিয়ান) দোকানগুলোই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। কারণ এখানকার অধিকাংশ ভারতীয় হোটেলই দক্ষিণ ভারতীয় স্টাইলে রান্না করে এবং কারিপাতাযুক্ত খাবারের প্রতি আমার বিতৃষ্ণার কথা সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশী রেস্তোরাই দেখেছি, যার নাম 'ESO KHAI', এখনও খেতে যাওয়া হয়নি।

গত রবিবার গিয়ে সামনে থেকে বড়বাড়ি এবং জোড়াবাড়ি (বন্ধু দেবাদ্রির ভাষায়) দেখে এসেছি। এগুলো আর কিছুই নয়, যথাক্রমে কুয়ালালামপুর টাওয়ার আর পেট্রোনাস টাওয়ার। পেট্রোনাস টাওয়ারের নীচের সুরিয়া মল এখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত মলগুলোর একটা। গত রবিবার সেখানে ঘুরে নান্দোজে দিব্যি পর্তুগিজ চিকেন খেয়ে এসেছি!এছাড়া প্রায় ১৩০ বছরের পুরনো সেন্ট্রাল মার্কেটও একটা বেশ দেখার মত জায়গা এবং সেটা আবার আমার অফিসের ঠিক পেছনেই।

আপাতত এই অবধিই। আগামী তিনমাসে আরো বেশ কিছু জায়গা ঘোরা হয়ে যাবে আশা করছি। সেগুলোর ছবিও ঠিক সময় মত ব্লগে চলে আসবে!



"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”