Sunday, July 19, 2020

ক্রিকেট ইতিহাসের মহারথীরা - ৩

ওয়েস্ট ইন্ডিজ মানেই ছবির মত সুন্দর কিছু সমুদ্রতীর, জলদস্যু এবং ক্রিকেট। আর আমাদের ছোটবেলা পর্যন্ত ওয়েস্ট ইন্ডিজ মানে শুধুই ক্রিকেট নয় নয়নাভিরাম, রোমান্টিক ক্রিকেট। আর তাই যখন আমার না দেখা স্পেশাল খেলোয়াড়দের তালিকা বানাতে বসি, সেই তালিকা সহজে শেষ হয় না। সেই প্রথম যুগের লিয়ারী কনস্ট্যানটাইন, জর্জ হেডলি থেকে শুরু করে ফ্রাঙ্ক ওরেল, এভার্টন উইকস, ক্লাইড ওয়ালকট, রোহণ কানহাই, আল্ভিন কালিচরণের মত ব্যাটসম্যানদের সঙ্গে হোল্ডিং, রবার্টস, গার্নারের মত ফাস্ট বোলার, কত রথি-মহারথীদের খেলাই লাইভ দেখে উঠতে পারিনি। মার্শালের খেলা দেখেছি শুধু ১৯৯২ সালের বিশ্বকাপ আর তার আগের ত্রিদেশীয় সিরিজে।
‘ফায়ার ইন ব্যাবিলনের’ দেশ হলেও, বইয়ের পাতায় পড়া যে সমস্ত ক্যারিবিয়ানের খেলোয়াড়দের খেলা আমি দেখতে চাই তাঁদের মধ্যে প্রথমেই থাকবেন এক রহস্যময় স্পিন মানিকজোড়। ১৯৫০ সালে যাঁদের মাপা স্পিন বোলিং ওয়েস্ট ইন্ডিজকে এনে দিয়েছিল ইংল্যান্ডের মাটিতে তাঁদের প্রথম সিরিজ জয়। যাঁদের নিয়ে লর্ড বিগিনার লিখেছিলেন,
“With those little pals of mine
Ramadhin and Valentine!”
ছোট্টখাট্ট, গম্ভীর চেহারার রামাধিন আর ভ্যালেন্টাইনকে ইংল্যান্ডের খেলোয়াড় বা ফ্যানেরা কেউই সিরিজের শুরুতে বিশেষ গুরুত্ব দেননি কিন্তু সিরিজ শেষ হলে দেখা গেল, ৪ টেস্টের সিরিজে রামাধিন এবং ভ্যালেন্টাইন মিলে বল করেছেন ৮০০ ওভার। সেই ৮০০ ওভারে তাঁরা নিয়েছেন ৫৯ উইকেট ২১.৬৬ গড়ে এবং তাঁদের বলে প্রতি ওভারে রান উঠেছে গড়ে ১.৫৯। রাতারাতি নায়ক হয়ে যান রামাধিন-ভ্যালেন্টাইন আর সূচনা হয় ক্যালিপ্সো ক্রিকেটের।
এরপর আমরা এক লাফে এগিয়ে আসব দশ বছর। সেই মোহময় ১৯৬০-৬১ সালের অস্ট্রেলিয়া ট্যুর, ক্রিকেটের ইতিহাসের অন্যতম সেরা সিরিজ। ফ্র্যাঙ্ক ওরেলের অসম্ভব জনপ্রিয় দলের প্রধান হীরকখণ্ডটি ছিলেন গ্যারি সোবার্স, ক্রিকেটের ইতিহাসের সর্বকালের সেরা অল-রাউন্ডারদের মধ্যে প্রথম তিনে থাকবেন যিনি, কিন্তু শঙ্করীপ্রসাদের লেখা পড়ার সময় আমার মন কেড়ে নিয়েছিলেন ওয়েস হল। দীর্ঘকায়, আমুদে ওয়েস্ট ইন্ডিয়ান ফাস্টবোলার, যিনি দলের জন্য ১০০ শতাংশ দেওয়ার পাশাপাশি নিজের ব্যাটিং নিয়ে অবলীলায় ইয়ার্কি মারছেন, আবার টাই টেস্টের শেষ ওভারে নিজের বলে অসম্ভব ক্যাচ নেওয়ার চেষ্টা করে ব্যর্থ হচ্ছেন। সব মিলিয়ে এক চরম আকর্ষনীয়ভাবে ওয়েস হলকে নিজের লেখায় তুলে ধরেছিলেন শঙ্করীবাবু। আর ওয়েস হল পেয়েছিলেন এক নতুন ভক্তকে, খেলা ছাড়ার প্রায় ২৫ বছর পরে।
হলের মতই পড়েছিলাম রয় গিল্ক্রিস্টের কথা। সেই সহজ সরল মানুষটি যিনি বল হাতে পেলেই হয়ে উঠতেন আগুনে, প্রায় উন্মাদ এক ফাস্টবোলার। যদিও নিজের আগুনে মেজাজের জন্য খুব বেশীদিন আন্তর্জাতিক ক্রিকেট খেলেননি গিল্ক্রিস্ট কিন্তু এই বিতর্কিত মানুষটির খেলা দেখার ইচ্ছেও আমার অনেকদিনের।
১৯৭০ সালের পর থেকে অধিকাংশ ওয়েস্ট ইন্ডিজ সুপারস্টারদের খেলার ভিডিওই ইউটিউবে এবং অন্যান্য ওয়েবসাইটে পাওয়া যায়। তাই ক্লাইভ লয়েডের ১৯৭৫ সালের ফাইনালের সেঞ্চুরি বা ভিভ রিচার্ডসের অসামান্য সব ইনিংসই চাইলেই দেখা যায় এখন। তবে হ্যাঁ, রিচার্ডসের চ্যুইংগাম চিবোতে চিবোতে ঠ্যাঙ্গানি লাইভ দেখার মজাটা অন্যরকম হত বলেই মনে হয়। বিশেষ করে যদি প্রতিপক্ষ ভারত না হত।

Saturday, June 27, 2020

ক্রিকেট ইতিহাসের মহারথীরা - ২

দ্বিতীয় পর্বের লেখায় থাকুক কিছু অস্ট্রেলিয়ান মহারথীদের কথা। ক্রিকেটের আদিযুগের অনেকটাই ছিল শুধু অ্যাংলো-অস্ট্রেলিয় ক্রিকেটযুদ্ধ। আর সেই যুদ্ধের অস্ট্রেলিয় পঞ্চপাণ্ডব আজকের লেখায়।
বিশ্ব-ক্রিকেটে অস্ট্রেলিয়ার ফাস্টবোলারদের সুনাম আজকের নয়। আমি নিজে টিভিতে প্রথম দেখেছিলাম ক্রেগ ম্যাকডরমট, মার্ভ হিউজ, ব্রুস রিড আর মাইক হুইটনিকে। সেটা ভারতের ১৯৯১ ট্যুর। তার পর থেকে গ্লেন ম্যাকগ্রাথ, পল রাইফেল, জেসন গিলেসপি, ব্রেট লি হয়ে হালের মিচেল স্টার্ক অবধি কম ফাস্ট বোলার দেখিনি। আর তাছাড়া ষাটের দশকের ম্যাকেঞ্জি-কনোলি বা তার পরের লিলি-থমসনদের ব্যাপারটা তো আছেই। কিন্তু আজকের লেখার প্রথম ব্যাক্তিত্ব হলেন ‘দ্যা ডেমন বোলার’। ফ্রেড্রিক স্পফোর্থ, ক্রিকেটের একেবারে প্রথম যুগের সুপারস্টার।
১৮৭৭ সাল থেকে ১৮৮৭ সাল পর্যন্ত ১০ বছরে খেলেছেন ১৮টি টেস্ট। তাতে ১৮.৪১ গড়ে ৯৪টি উইকেট। আর ফার্স্টক্লাস ক্রিকেটে ৮৫০ এর বেশী উইকেট। ১৮৭৭ সালের জেমস লিলিহোয়াইটের দলের বিরুদ্ধে ভিক্টোরিয়া এবং নিউ সাউথ ওয়েলসের মিলিত দলের প্রথম খেলা, যা পরবর্তীতে ক্রিকেটের প্রথম টেস্ট ম্যাচ হিসেবে বিবেচিত হবে তাতে স্পফোর্থের জায়গা ছিল নিশ্চিত। কিন্তু উইকেট কিপার হিসেবে নিজের বন্ধু বিলি মিডউইন্টারের বদলে জ্যাক ব্ল্যাকহ্যাম জায়গা পাওয়ার প্রতিবাদ হিসেবে ছেড়ে দিয়েছিলেন সেই সুযোগ।
বোর্ডের সঙ্গে ঝামেলা মিটে যাওয়ার ফলে দ্বিতীয় খেলাতেই ফিরে আসেন স্পফোর্থ, যদিও অস্ট্রেলিয়া সেই খেলায় জেতেনি কিন্তু এর পরে স্পফোর্থের খেলায় সাফল্যের ভাগই বেশী। প্রথম বোলার হিসেবে টেস্ট ক্রিকেটে ৫০ উইকেট এবং টেস্ট ক্রিকেটের প্রথম হ্যাট-ট্রিকের গৌরব তাঁরই। এছাড়া আছে ১৮৮২ সালের সেই বিখ্যাত টেস্ট ম্যাচ। যাকে বলা হয় ‘Spofforth’s match’। তাঁর ৯০ রানে নেওয়া ১৪ উইকেটের জোরেই দ্বিতীয় ইনিংসে মাত্র ৮৪ রান ডিফেন্ড করতে পেরেছিল অস্ট্রেলিয়া। জন্ম হয়েছিল অ্যাসেজের।
স্পফোর্থকে যদি যুধিষ্ঠির ধরেনি তাহলে ভীম নিশ্চই ট্রাম্পার। বিংশ শতাব্দীর শুরুর দিকে যখন ইংল্যান্ডের মাঠের রাজার সন্মান হাতবদল হয়েছে গ্রেস থেকে রঞ্জীর কাছে, অস্ট্রেলিয়ায় তখন ব্যাটিং শিল্পে রাজত্ব করছেন ভিক্টর ট্রাম্পার। ডন ব্র্যাডম্যানের আগে অস্ট্রেলিয়ার শ্রেষ্ঠ ব্যাটসম্যান। ট্রাম্পারের ব্যাটিংয়ের সৌন্দর্য নিয়ে বহু লেখা আছে, যার মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ সম্ভবত অস্ট্রেলিয় লেগ-স্পিনার আর্থার মেইলির ট্রাম্পারকে প্রথম বল করার অভিজ্ঞতা। যেখানে এক অসামান্য বলে ট্রাম্পারকে আউট করে মেইলির মনে হয়েছিল ‘I felt like a boy who had killed a dove.’
এর সঙ্গেই ট্রাম্পারের কিছু আসামান্য ইনিংস যেমন লর্ডসের ১৩৫, ১৯০২ সালে প্রথম ব্যাটসম্যান হিসবে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে টেস্টের প্রথম সেশনেই শতরান, এগুলো তো আছেই। তাঁর এই দৃষ্টিনন্দন ব্যাটিংয়ের কিছু নমুনা পেলে মন্দ লাগত না।
অস্ট্রেলীয় ক্রিকেটের অর্জুন কে সেই প্রশ্নের একটাই উত্তর? ৯৯.৯৪। আর কিছু না, ডনকে শুধু হেডিংলিতে ব্যাট করতে দেখলেই আমার চলত।
চার নম্বরে আসবেন ‘The Golden boy’ কিথ মিলার। ব্যাটিংশৈলীর দিক দিয়ে যাকে ব্র্যাডম্যানের চেয়েও এগিয়ে রেখেছিলেন লালা অমরনাথ। অল-রাউন্ড পারফর্মেন্স, বড় শট খেলার ক্ষমতা এবং নিজের সুঠাম চেহারার জন্য মিলার সব সময়ই ছিলেন দর্শকদের ফেভারিট। আর এর সঙ্গেই তাঁর বিদ্রোহী মনোভাব এবং স্পষ্টবক্তা হওয়ার কারণেই সুদর্শন এই খেলোয়াড় নিজের একটা আলাদা জায়গা করে নিয়েছিলেন।
কিথ মিলারের অসাধারণ ড্রাইভের বেশ কিছু ভিডিও আছে বাজারে, এবং খেলা ছাড়াও আছে বিভিন্ন সাক্ষাৎকারের ভিডিও। কিন্তু আজকের দিনেও এই বিগ ব্যাশ, আইপিএলের যুগেও মিলারের জনপ্রিয়তায় ভাঁটা পড়ত বলে মনে হয় না।
অস্ট্রেলিয়ার সর্বকালের সেরা অল-রাউন্ডারের লড়াইয়ে রিচি বেনো বা কিথ মিলার এগিয়ে থাকলেও আমার এই তালিকায় বেনোর বদলে আসবে অ্যালান ডেভিডসন। বাঁহাতি লোয়ার অর্ডার ব্যাটসম্যান এবং বাঁহাতি ওপেনিং বোলার ডেভিডসন বেনোর সঙ্গে একই সময় অস্ট্রেলিয়ায়র হয়ে নিয়মিৎ খেলেছেন। ৪৪টি টেস্ট খেলে ১৮৬ উইকেটের সঙ্গে সঙ্গে ১৩২৮ রানও করেছিলেন। কিন্তু ডেভিডসন আমার মনে জায়গা করে নিয়েছেন যেদিন থেকে ১৯৬১ সালের ব্রিসবেন টাই টেস্টের বিস্তৃত বর্ণনা পড়েছিলাম শঙ্করীপ্রসাদের লেখায়। বল হাতে ১১ উইকেট এবং ব্যাট হাতে ১২৪ রান করেছিলেন ডেভিডসন। তার মধ্যে ম্যাচের চতুর্থ ইনিংসে করেছিলেন টেস্টে তাঁর সর্বোচ্চ ৮০ রান। ২৩৩ তাড়া করতে গিয়ে নিজে ব্যাট করতে এসেছিলেন যখন অস্ট্রেলিয়া ৫৭ রানে ৫ উইকেট হারিয়ে ধুঁকছে। প্রথমে কেন ম্যাকে আর তার পর রিচি বেনোর সঙ্গে পার্টনারশিপে দলকে নিয়ে গেছিলেন জয়ের দোরগোড়ায়। ডেভিডসনের ইংল্যান্ডের বিরুদ্ধে ৬/৬৪ এর চমৎকার ভিডিও আছে ইউটিউবে কিন্তু ওয়াসিম আক্রমের আগের বাঁহাতে শ্রেষ্ঠ বোলারকে এইটুকু দেখে মন ভরে না।

Sunday, April 26, 2020

ক্রিকেট ইতিহাসের মহারথীরা - ১

আমার জীবনে ক্রিকেটসাহিত্যের যখন সূচনা হয় তখন আমার বয়স ছয়-সাত। আমার পিসির বাড়ীতে দীপঙ্কর ঘোষের লেখা ‘টেস্ট ক্রিকেট ও বিশ্বকাপে ভারত’ বইটা আমার হাতে আসে এবং কিছুদিনের মধ্যেই সেটিকে আমি নিজের সম্পত্তির মধ্যে ঢুকিয়ে নিই। প্রধানত ভারতীয়দের নিয়ে লেখা এই বইতে ছিল ১৯৩২ থেকে ১৯৮৭ অবধি ভারতের সব টেস্টের সংক্ষিপ্ত স্কোরকার্ড, জনার্দন নাভলে থেকে ভারত অরুণ অবধি ভারতের সব টেস্ট খেলোয়াড়ের পরিচিতি, বেশ কিছু প্রয়োজনীয় স্ট্যাটিস্টিক্স এবং প্রথম চারটে বিশ্বকাপের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ, সব মিলিয়ে বইটা ওই সময়ে আমার প্রিয় বইয়ের তালিকায় উপরের দিকেই ছিল। এর সঙ্গে এখানে ওখানে টুকটাক লেখা যেমন ১৯৮৩ সালের পুজোবার্ষিকীতে রাজু মুখার্জির লেখা মুস্তাক আলি আর মহম্মদ নিসারের প্রোফাইল (‘ঝড়ের নাম নিসার’), এবং সাপ্তাহিক বর্তমান আর খেলার পাতার লেখা সেই সময়ই অনেকের চেয়েই বেশি আপ-টু-ডেট করে দিয়েছিল।
ভারতীয় ক্রিকেট থেকে বিশ্ব ক্রিকেটের যাত্রা সম্পূর্ণ হয় যখন আর দু-এক বছরের মধ্যেই যখন বাবা আমাদের মুঙ্গেরের বাড়ির পুরনো সংগ্রহ থেকে বেশ কিছু বইয়ের মধ্যে শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ‘ক্রিকেট অমনিবাস’ বইয়ের প্রথম এবং দ্বিতীয় খন্ড এনে আমার হাতে তুলে দেয়। আমার জীবনে এই ঘটনাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং নন্টে-ফন্টে, টিনটিন, কাকাবাবুদের সঙ্গে সঙ্গে হ্যারল্ড লারউড, ওয়েস হল, সেলিম দুরানী এবং চান্দু বোরদেরাও আমার জীবনে ঢুকে পড়েন।
সেই সময় হাতে সময় থাকলেও বই ছিল নিতান্তই কম। তাই এইসব বই এবং বইয়ের বিভিন্ন লেখা যে কতবার পড়েছি তার হিসেব নেই। আর তাই আজ যতই আমি ‘Bodyline Autopsy’ পড়ে মুগ্ধ হই, ‘লাল বল লারউড’ সেই বয়সে আমার ওপর যে প্রভাব ফেলেছিল সেটা আজও কমেনি। এবং সেই কারণেই কোন ক্রিকেটিয় টাইম মেশিন যদি আমাকে ইতিহাসে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেয় তাহলে হয়তো ১৯৭১ সালের ইংল্যান্ড বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বদলে ১৯৩২ সালের অ্যাডিলেডে যাওয়াই পছন্দ করব।
যাই হোক নিজেকে নিয়েই ২৫০ শব্দ লিখে ফেললাম। কিন্তু এই লেখার আসল উদ্দেশ্য অন্য। এই লেখা আমার পছন্দের কিছু খেলোয়াড়কে নিয়ে লেখা যাদের খেলার গল্প শুধু বইয়ের পাতায় আর পুরনো সাদা-কালো ছবিতেই আটকে আছে। হয়তো বিবিসির কিছু পুরনো ভিডিও খুঁজলেই পাওয়া যাবে কিন্তু সেগুলো সামান্য কিছু মুহূর্ত। আর তাই আমার লেখাও মোটামুটি ১৯৭০ সালেই এসে শেষ। অবশ্য শঙ্করীবাবুর বইয়ের লেখারগুলোর সময়কালও মোটামুটি ঐ পর্যন্তই। যখন বিষেণ সিং বেদীকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘তরুণ খেলোয়াড়টি’ বলে। আজকের পর্বে থাকবে সেযুগের পাঁচ ইংলিশ ক্রিকেটারের গল্প।
প্রথমে জার্ডিনের কথা লেখা যেত কিন্তু তার বদলে ডাক্তারবাবুকেই বেছে নিলাম। আধুনিক ক্রিকেটের জনক ১৭ স্টোনের ডাক্তার উইলিয়াম গিলবার্ট গ্রেসকে নিয়ে অনেক জায়গাতেই পড়েছি। তাঁর কাঁচা-পাকা দাড়ি-গোঁফ আর লাল-হলুদ টুপির ছবি দেখেছি অনেক জায়গায়। সেযুগের ব্রিটিশ সমাজ এবং সংস্কৃতিতে ক্রিকেটার ডব্লু জি গ্রেস ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। মার্থা গ্রেসের চার ছেলে ইংল্যান্ডের হয়ে ক্রিকেট খেলেছিলেন (পঞ্চমটি অল্প বয়সে মারা যান) এবং তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন ডব্লু জি। ১৮৬১ সাল নাগাদ, গ্রেসের যখন মাত্র ১২ বছর বয়স, মার্থা একটি বিখ্যাত চিঠি লেখেন অল ইংল্যান্ড দলের
সাতষট্টি বছরের জীবনে সিনিয়ার লেভেল ক্রিকেট খেলেছেন প্রায় পঞ্চাশ বছর। তাঁর হাজার হাজার রান এবং প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে একশোর বেশী শতরানের রেকর্ড ছাড়াও তাঁকে নিয়ে তৈরি লিজেন্ডগুলো সেই প্রথম যুগ থেকে ক্রিকেটের সম্পদ। ইউটিউবে তাঁর ব্যাটিং কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখা গেলেও ক্রিকেটভক্তদের মন ভরাতে তা যথেষ্ট নয়।
সেক্রেটারিকে। বিখ্যাত সেই চিঠির প্রধান বক্তব্য ছিল মেজো ছেলে এডওয়ার্ডসকে অল ইংল্যান্ড দলে সুযোগ দেওয়ার আবেদন কিন্তু সেখানেও মার্থা উল্লেখ করেছিলেন যে, তাঁর আরো একটি ছেলে আছে যার মাত্র বারো বছর বয়স, যে ভবিষ্যতে তার দাদাদের থেকে বড় খেলোয়াড় হবে কারণ সে ব্যাক স্ট্রোকে অনেক বেশী সক্ষম এবং সে সর্বদা সোজা ব্যাটে খেলে।
গ্রেসের পরেই আমার কাছে ব্রিটিশ ক্রিকেটের দ্বিতীয় প্রতিনিধি হলেন ডগলাস রবার্ট জার্ডিন। বোম্বাইতে জন্ম, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ব্লু জার্ডিন ইংল্যান্ডের হয়ে বাইশটা টেস্ট খেলেছেন যার মধ্যে পনেরোটায় তিনি অধিনায়ক ছিলেন। আমার কাছে ব্রিটিশ অহংকার, তাঁদের হার-না-মানা, একগুঁয়ে, নিয়মের মধ্যে থেকে জেতার সর্বাগ্রাসী ইচ্ছের প্রতীক হলেন জার্ডিন। বডিলাইনের শরীর লারউড হলেও মাথা সম্পূর্ণভাবেই জার্ডিনেই এবং এই বডিলাইন বোলিং খেলোয়াড়ি মনভাবাপন্ন কিনা সেই নিয়ে যত তর্কই হোক না কেন এর কার্যকারিতা নিয়ে বিশেষ তর্কের জায়গা নেই। মনে রাখতে হবে যে, বডিলাইন সিরিজে ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিং গড় ছিল ‘মাত্র’ ৫৬.৫৭ যা তাঁর ক্যারিয়ার গড়ের প্রায় অর্ধেক।
শঙ্করীপ্রসাদের বই হোক বা বডিলাইন নিয়ে অন্য যেকোন বই বা ভিডিওই হোক, জার্ডিনকে চিরকালই খুব নাটকীয়ভাবে প্রেজেন্ট করা হয়েছে। তাঁর শুকনো ব্রিটিশ হিউমার, ছোট ছোট মন্তব্য, তাঁর হারকিউলান টুপি সেই সময়ে যেমন তাঁকে একটা অন্য জায়গা করে দিয়েছিল সেরকম আমারও চিরকালই জার্ডিনকে খুবই ইন্টারেস্টিং চরিত্র মনে হয়েছে। যদিও তাঁর মাঠের ব্যাটিং চরম রক্ষণাত্মক ঘরানার তাই সেযুগে থাকলে জার্ডিনের মাঠের চেয়ে মাঠের বাইরের আপডেটের দিকেই আমি বেশী নজর রাখতাম। জার্ডিনের ভারতের প্রথম টেস্টে বিপক্ষ দলের অধিনায়ক সেটাও মনে রাখতে হবে।
এর পরের খেলোয়াড়টিকে নিয়ে উৎসাহের পেছনে বই পড়ার পাশাপাশি ২০১৮ সালের একটি দুপুরও দায়ী। স্যার জ্যাক হবসের অসামান্য রেকর্ড, ফার্স্টক্লাস ক্রিকেটে তাঁর ৬১,৭৬০ রান এবং ১৯৯ টি শতরান তাঁকে এক অন্য জায়গা করে দিয়েছে। তাঁকে নিয়ে খুব বেশি গল্প না থাকলেও তাঁর কাউন্টি সারের ইতিহাসে জ্যাক হবস একটা অন্য জায়গা করে নিয়েছেন। আর সেটাই বুঝতে পেরেছিলাম ২০১৮ সালের ওভাল ট্যুরের সময়। আমরা ঢুকেছিলাম হবস গেট দিয়ে এবং পুরো ট্যুরেই এবং শেষ পনেরো-কুড়ি মিনিটের আমাদের পার্সোনাল ট্যুরের সময়ে দেখেছিলাম হবসের জনপ্রিয়তা এবং প্রভাবের কিছু নিদর্শন। তাঁকে নিয়ে লেখা, তাঁর ছবি, তাঁর একশোতম শতরান উপলক্ষে বানানো বিশেষ প্লেক সব মিলিয়ে জ্যাক হবসকেই ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে মেনে নেওয়াই যায়।
হবস যদি হন ক্লাসিকাল ঘরানার ইংল্যান্ডের ক্রিকেট সম্রাট তাহলে রোমান্টিক রাজপুত্রের জায়গাটা কিন্তু থাকবে সুদর্শন ডেনিস কম্পটনের জন্য। অসামান্য ব্যাটসম্যান, বিল্ক্রিমের মডেল, অন্যমনস্কতার জন্য নিয়মিত নিজে বা পার্টনারকে রান আউট করেছেন আবার আর্সেনালের হয়ে ফুটবলও খেলেছেন। সব মিলিয়ে, কম্পটনকে নিয়ে যতই পড়েছি বা ভিডিও দেখেছি ততই ওনাকে আরো আকর্ষনীয় চরিত্র বলে মনে হয়েছে। ওনার নিজের আত্মজীবনী না পড়লেও শঙ্করীপ্রসাদের লেখায় ওনার প্রথম টেস্টের অভিজ্ঞতার দূর্দান্ত বর্ণনা মনে দাগ কেটে গেছিল। বিশেষ করে টেস্টের আগের রাতে বিলি ও’রিলি এবং ফ্লিটউড স্মিথের সঙ্গে আলাপের ঘটনা। এছাড়াও কম্পটন বেশ কিছুদিন ভারতে ছিলেন, রঞ্জি ট্রফি খেলেছেন এবং কলকাতায় অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস বনাম ইস্ট জোনের খেলার মধ্যেই ছিল এক ভক্তের সেই বিখ্যাত উক্তি, “Mr Compton, you very good player, but the match must stop now.”
কম্পটনের ভারতের বিরুদ্ধে কোন শতরান নেই, তবে সুযোগ পেলে কম্পটনের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বিখ্যাত ইনিংসগুলো মাঠে বসে দেখার সুযোগ পেতে চাইব।
আজকের লেখার শেষ চরিত্র অবশ্যই আমার সর্বকালের সবচেয়ে পছন্দের ব্রিটিশ ক্রিকেটার, ক্রিকেটের ট্র্যাজিক হিরো হ্যারল্ড লারউড। নটিংহ্যামশায়ারের কয়লাখনির শ্রমিক থেকে ক্রিকেটের বৃহত্তম বিতর্কের প্রধান মুখ হয়ে ওঠা… লারউডের এই যাত্রায় ওঠাপড়ার অভাব নেই। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বোলার লারউড ছিলেন বডিলাইনে জার্ডিনের প্রধান অস্ত্র এবং তাঁর বলের অভ্রান্ত লাইন এবং গতি অস্ট্রেলিয়ার সমস্ত উপরের সারির ব্যাটসম্যানের জীবনকেই দূর্বিষহ করে তুলেছিল। উডফুল এবং ওল্ডফিল্ডের আঘাতের ঘটনা তো প্রবাদপ্রতিম, কিন্তু মনে রাখতে এর কোনটাই কিন্তু লারউড কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে নয়, এর পুরোটাই নিজের দেশকে মাঠে জেতানোর অদম্য ইচ্ছে আর নিজের অধিনায়কের প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাঁর নির্দেশের প্রতি নিঃশর্ত সমর্পন। আর তাই অ্যাসেজ জেতার পর ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ড যখন নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলার জন্য লারউডকে ১৯৩৪ সালের সিরিজের আগে অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে ক্ষমা চাইতে বলে তখন সেটা পড়তে পড়তে রাগ হয় আর লারউডকে আরো কাছের মানুষ বলে মনে হয়।
এই সময়ে ক্রিকেট থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছিলেন। এরপর নাটকীয়ভাবে জ্যাক ফিঙ্গলটনের কথায় নিজের পুরো পরিবার নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান লারউড। তাও আবার ‘এস এস ওরন্টেস’ জাহাজেই, যে জাহাজ ১৮ বছর আগে তাঁকে নিয়ে গেছিল বডিলাইন সিরিজের জন্য। আবার বলতে হবে শঙ্করীপ্রসাদের ‘লাল বল লারউড’ বইয়ের কথা। জায়গায় জায়গায় অতিনাটকীয়তা বা কল্পনা থাকলেও ক্রিকেটের এক রক্তাক্ত অধ্যায়কে খুব মায়াময় করে তুলে ধরেছিলেন তিনি। আর তাই সঙ্গে রইল, সেই লেখারই শেষের পাতাটি।
[সব ছবিই আমার নিজের সংগ্রহ থেকে]
"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”