Sunday, April 26, 2020

ক্রিকেট ইতিহাসের মহারথীরা - ১

আমার জীবনে ক্রিকেটসাহিত্যের যখন সূচনা হয় তখন আমার বয়স ছয়-সাত। আমার পিসির বাড়ীতে দীপঙ্কর ঘোষের লেখা ‘টেস্ট ক্রিকেট ও বিশ্বকাপে ভারত’ বইটা আমার হাতে আসে এবং কিছুদিনের মধ্যেই সেটিকে আমি নিজের সম্পত্তির মধ্যে ঢুকিয়ে নিই। প্রধানত ভারতীয়দের নিয়ে লেখা এই বইতে ছিল ১৯৩২ থেকে ১৯৮৭ অবধি ভারতের সব টেস্টের সংক্ষিপ্ত স্কোরকার্ড, জনার্দন নাভলে থেকে ভারত অরুণ অবধি ভারতের সব টেস্ট খেলোয়াড়ের পরিচিতি, বেশ কিছু প্রয়োজনীয় স্ট্যাটিস্টিক্স এবং প্রথম চারটে বিশ্বকাপের সংক্ষিপ্ত বিশ্লেষণ, সব মিলিয়ে বইটা ওই সময়ে আমার প্রিয় বইয়ের তালিকায় উপরের দিকেই ছিল। এর সঙ্গে এখানে ওখানে টুকটাক লেখা যেমন ১৯৮৩ সালের পুজোবার্ষিকীতে রাজু মুখার্জির লেখা মুস্তাক আলি আর মহম্মদ নিসারের প্রোফাইল (‘ঝড়ের নাম নিসার’), এবং সাপ্তাহিক বর্তমান আর খেলার পাতার লেখা সেই সময়ই অনেকের চেয়েই বেশি আপ-টু-ডেট করে দিয়েছিল।
ভারতীয় ক্রিকেট থেকে বিশ্ব ক্রিকেটের যাত্রা সম্পূর্ণ হয় যখন আর দু-এক বছরের মধ্যেই যখন বাবা আমাদের মুঙ্গেরের বাড়ির পুরনো সংগ্রহ থেকে বেশ কিছু বইয়ের মধ্যে শঙ্করীপ্রসাদ বসুর ‘ক্রিকেট অমনিবাস’ বইয়ের প্রথম এবং দ্বিতীয় খন্ড এনে আমার হাতে তুলে দেয়। আমার জীবনে এই ঘটনাটি খুবই তাৎপর্যপূর্ণ এবং নন্টে-ফন্টে, টিনটিন, কাকাবাবুদের সঙ্গে সঙ্গে হ্যারল্ড লারউড, ওয়েস হল, সেলিম দুরানী এবং চান্দু বোরদেরাও আমার জীবনে ঢুকে পড়েন।
সেই সময় হাতে সময় থাকলেও বই ছিল নিতান্তই কম। তাই এইসব বই এবং বইয়ের বিভিন্ন লেখা যে কতবার পড়েছি তার হিসেব নেই। আর তাই আজ যতই আমি ‘Bodyline Autopsy’ পড়ে মুগ্ধ হই, ‘লাল বল লারউড’ সেই বয়সে আমার ওপর যে প্রভাব ফেলেছিল সেটা আজও কমেনি। এবং সেই কারণেই কোন ক্রিকেটিয় টাইম মেশিন যদি আমাকে ইতিহাসে ফিরে যাওয়ার সুযোগ দেয় তাহলে হয়তো ১৯৭১ সালের ইংল্যান্ড বা ওয়েস্ট ইন্ডিজের বদলে ১৯৩২ সালের অ্যাডিলেডে যাওয়াই পছন্দ করব।
যাই হোক নিজেকে নিয়েই ২৫০ শব্দ লিখে ফেললাম। কিন্তু এই লেখার আসল উদ্দেশ্য অন্য। এই লেখা আমার পছন্দের কিছু খেলোয়াড়কে নিয়ে লেখা যাদের খেলার গল্প শুধু বইয়ের পাতায় আর পুরনো সাদা-কালো ছবিতেই আটকে আছে। হয়তো বিবিসির কিছু পুরনো ভিডিও খুঁজলেই পাওয়া যাবে কিন্তু সেগুলো সামান্য কিছু মুহূর্ত। আর তাই আমার লেখাও মোটামুটি ১৯৭০ সালেই এসে শেষ। অবশ্য শঙ্করীবাবুর বইয়ের লেখারগুলোর সময়কালও মোটামুটি ঐ পর্যন্তই। যখন বিষেণ সিং বেদীকে উল্লেখ করা হয়েছে ‘তরুণ খেলোয়াড়টি’ বলে। আজকের পর্বে থাকবে সেযুগের পাঁচ ইংলিশ ক্রিকেটারের গল্প।
প্রথমে জার্ডিনের কথা লেখা যেত কিন্তু তার বদলে ডাক্তারবাবুকেই বেছে নিলাম। আধুনিক ক্রিকেটের জনক ১৭ স্টোনের ডাক্তার উইলিয়াম গিলবার্ট গ্রেসকে নিয়ে অনেক জায়গাতেই পড়েছি। তাঁর কাঁচা-পাকা দাড়ি-গোঁফ আর লাল-হলুদ টুপির ছবি দেখেছি অনেক জায়গায়। সেযুগের ব্রিটিশ সমাজ এবং সংস্কৃতিতে ক্রিকেটার ডব্লু জি গ্রেস ছিলেন এক গুরুত্বপূর্ণ চরিত্র। মার্থা গ্রেসের চার ছেলে ইংল্যান্ডের হয়ে ক্রিকেট খেলেছিলেন (পঞ্চমটি অল্প বয়সে মারা যান) এবং তাঁদের মধ্যে সর্বশ্রেষ্ঠ ছিলেন ডব্লু জি। ১৮৬১ সাল নাগাদ, গ্রেসের যখন মাত্র ১২ বছর বয়স, মার্থা একটি বিখ্যাত চিঠি লেখেন অল ইংল্যান্ড দলের
সাতষট্টি বছরের জীবনে সিনিয়ার লেভেল ক্রিকেট খেলেছেন প্রায় পঞ্চাশ বছর। তাঁর হাজার হাজার রান এবং প্রথম খেলোয়াড় হিসেবে একশোর বেশী শতরানের রেকর্ড ছাড়াও তাঁকে নিয়ে তৈরি লিজেন্ডগুলো সেই প্রথম যুগ থেকে ক্রিকেটের সম্পদ। ইউটিউবে তাঁর ব্যাটিং কয়েক সেকেন্ডের জন্য দেখা গেলেও ক্রিকেটভক্তদের মন ভরাতে তা যথেষ্ট নয়।
সেক্রেটারিকে। বিখ্যাত সেই চিঠির প্রধান বক্তব্য ছিল মেজো ছেলে এডওয়ার্ডসকে অল ইংল্যান্ড দলে সুযোগ দেওয়ার আবেদন কিন্তু সেখানেও মার্থা উল্লেখ করেছিলেন যে, তাঁর আরো একটি ছেলে আছে যার মাত্র বারো বছর বয়স, যে ভবিষ্যতে তার দাদাদের থেকে বড় খেলোয়াড় হবে কারণ সে ব্যাক স্ট্রোকে অনেক বেশী সক্ষম এবং সে সর্বদা সোজা ব্যাটে খেলে।
গ্রেসের পরেই আমার কাছে ব্রিটিশ ক্রিকেটের দ্বিতীয় প্রতিনিধি হলেন ডগলাস রবার্ট জার্ডিন। বোম্বাইতে জন্ম, অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির ব্লু জার্ডিন ইংল্যান্ডের হয়ে বাইশটা টেস্ট খেলেছেন যার মধ্যে পনেরোটায় তিনি অধিনায়ক ছিলেন। আমার কাছে ব্রিটিশ অহংকার, তাঁদের হার-না-মানা, একগুঁয়ে, নিয়মের মধ্যে থেকে জেতার সর্বাগ্রাসী ইচ্ছের প্রতীক হলেন জার্ডিন। বডিলাইনের শরীর লারউড হলেও মাথা সম্পূর্ণভাবেই জার্ডিনেই এবং এই বডিলাইন বোলিং খেলোয়াড়ি মনভাবাপন্ন কিনা সেই নিয়ে যত তর্কই হোক না কেন এর কার্যকারিতা নিয়ে বিশেষ তর্কের জায়গা নেই। মনে রাখতে হবে যে, বডিলাইন সিরিজে ব্র্যাডম্যানের ব্যাটিং গড় ছিল ‘মাত্র’ ৫৬.৫৭ যা তাঁর ক্যারিয়ার গড়ের প্রায় অর্ধেক।
শঙ্করীপ্রসাদের বই হোক বা বডিলাইন নিয়ে অন্য যেকোন বই বা ভিডিওই হোক, জার্ডিনকে চিরকালই খুব নাটকীয়ভাবে প্রেজেন্ট করা হয়েছে। তাঁর শুকনো ব্রিটিশ হিউমার, ছোট ছোট মন্তব্য, তাঁর হারকিউলান টুপি সেই সময়ে যেমন তাঁকে একটা অন্য জায়গা করে দিয়েছিল সেরকম আমারও চিরকালই জার্ডিনকে খুবই ইন্টারেস্টিং চরিত্র মনে হয়েছে। যদিও তাঁর মাঠের ব্যাটিং চরম রক্ষণাত্মক ঘরানার তাই সেযুগে থাকলে জার্ডিনের মাঠের চেয়ে মাঠের বাইরের আপডেটের দিকেই আমি বেশী নজর রাখতাম। জার্ডিনের ভারতের প্রথম টেস্টে বিপক্ষ দলের অধিনায়ক সেটাও মনে রাখতে হবে।
এর পরের খেলোয়াড়টিকে নিয়ে উৎসাহের পেছনে বই পড়ার পাশাপাশি ২০১৮ সালের একটি দুপুরও দায়ী। স্যার জ্যাক হবসের অসামান্য রেকর্ড, ফার্স্টক্লাস ক্রিকেটে তাঁর ৬১,৭৬০ রান এবং ১৯৯ টি শতরান তাঁকে এক অন্য জায়গা করে দিয়েছে। তাঁকে নিয়ে খুব বেশি গল্প না থাকলেও তাঁর কাউন্টি সারের ইতিহাসে জ্যাক হবস একটা অন্য জায়গা করে নিয়েছেন। আর সেটাই বুঝতে পেরেছিলাম ২০১৮ সালের ওভাল ট্যুরের সময়। আমরা ঢুকেছিলাম হবস গেট দিয়ে এবং পুরো ট্যুরেই এবং শেষ পনেরো-কুড়ি মিনিটের আমাদের পার্সোনাল ট্যুরের সময়ে দেখেছিলাম হবসের জনপ্রিয়তা এবং প্রভাবের কিছু নিদর্শন। তাঁকে নিয়ে লেখা, তাঁর ছবি, তাঁর একশোতম শতরান উপলক্ষে বানানো বিশেষ প্লেক সব মিলিয়ে জ্যাক হবসকেই ইংল্যান্ডের সর্বকালের সেরা ব্যাটসম্যান হিসেবে মেনে নেওয়াই যায়।
হবস যদি হন ক্লাসিকাল ঘরানার ইংল্যান্ডের ক্রিকেট সম্রাট তাহলে রোমান্টিক রাজপুত্রের জায়গাটা কিন্তু থাকবে সুদর্শন ডেনিস কম্পটনের জন্য। অসামান্য ব্যাটসম্যান, বিল্ক্রিমের মডেল, অন্যমনস্কতার জন্য নিয়মিত নিজে বা পার্টনারকে রান আউট করেছেন আবার আর্সেনালের হয়ে ফুটবলও খেলেছেন। সব মিলিয়ে, কম্পটনকে নিয়ে যতই পড়েছি বা ভিডিও দেখেছি ততই ওনাকে আরো আকর্ষনীয় চরিত্র বলে মনে হয়েছে। ওনার নিজের আত্মজীবনী না পড়লেও শঙ্করীপ্রসাদের লেখায় ওনার প্রথম টেস্টের অভিজ্ঞতার দূর্দান্ত বর্ণনা মনে দাগ কেটে গেছিল। বিশেষ করে টেস্টের আগের রাতে বিলি ও’রিলি এবং ফ্লিটউড স্মিথের সঙ্গে আলাপের ঘটনা। এছাড়াও কম্পটন বেশ কিছুদিন ভারতে ছিলেন, রঞ্জি ট্রফি খেলেছেন এবং কলকাতায় অস্ট্রেলিয়ান সার্ভিসেস বনাম ইস্ট জোনের খেলার মধ্যেই ছিল এক ভক্তের সেই বিখ্যাত উক্তি, “Mr Compton, you very good player, but the match must stop now.”
কম্পটনের ভারতের বিরুদ্ধে কোন শতরান নেই, তবে সুযোগ পেলে কম্পটনের অস্ট্রেলিয়ার বিরুদ্ধে বিখ্যাত ইনিংসগুলো মাঠে বসে দেখার সুযোগ পেতে চাইব।
আজকের লেখার শেষ চরিত্র অবশ্যই আমার সর্বকালের সবচেয়ে পছন্দের ব্রিটিশ ক্রিকেটার, ক্রিকেটের ট্র্যাজিক হিরো হ্যারল্ড লারউড। নটিংহ্যামশায়ারের কয়লাখনির শ্রমিক থেকে ক্রিকেটের বৃহত্তম বিতর্কের প্রধান মুখ হয়ে ওঠা… লারউডের এই যাত্রায় ওঠাপড়ার অভাব নেই। বিশ্বের অন্যতম শ্রেষ্ঠ বোলার লারউড ছিলেন বডিলাইনে জার্ডিনের প্রধান অস্ত্র এবং তাঁর বলের অভ্রান্ত লাইন এবং গতি অস্ট্রেলিয়ার সমস্ত উপরের সারির ব্যাটসম্যানের জীবনকেই দূর্বিষহ করে তুলেছিল। উডফুল এবং ওল্ডফিল্ডের আঘাতের ঘটনা তো প্রবাদপ্রতিম, কিন্তু মনে রাখতে এর কোনটাই কিন্তু লারউড কোন ব্যক্তিগত শত্রুতা থেকে নয়, এর পুরোটাই নিজের দেশকে মাঠে জেতানোর অদম্য ইচ্ছে আর নিজের অধিনায়কের প্রতি শ্রদ্ধা এবং তাঁর নির্দেশের প্রতি নিঃশর্ত সমর্পন। আর তাই অ্যাসেজ জেতার পর ইংল্যান্ডের ক্রিকেট বোর্ড যখন নিজেদের দায় ঝেড়ে ফেলার জন্য লারউডকে ১৯৩৪ সালের সিরিজের আগে অস্ট্রেলিয়ানদের কাছে ক্ষমা চাইতে বলে তখন সেটা পড়তে পড়তে রাগ হয় আর লারউডকে আরো কাছের মানুষ বলে মনে হয়।
এই সময়ে ক্রিকেট থেকে অনেকটাই দূরে সরে গেছিলেন। এরপর নাটকীয়ভাবে জ্যাক ফিঙ্গলটনের কথায় নিজের পুরো পরিবার নিয়ে অস্ট্রেলিয়ায় চলে যান লারউড। তাও আবার ‘এস এস ওরন্টেস’ জাহাজেই, যে জাহাজ ১৮ বছর আগে তাঁকে নিয়ে গেছিল বডিলাইন সিরিজের জন্য। আবার বলতে হবে শঙ্করীপ্রসাদের ‘লাল বল লারউড’ বইয়ের কথা। জায়গায় জায়গায় অতিনাটকীয়তা বা কল্পনা থাকলেও ক্রিকেটের এক রক্তাক্ত অধ্যায়কে খুব মায়াময় করে তুলে ধরেছিলেন তিনি। আর তাই সঙ্গে রইল, সেই লেখারই শেষের পাতাটি।
[সব ছবিই আমার নিজের সংগ্রহ থেকে]

No comments:

Post a Comment

"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”