Sunday, March 12, 2017

কেএলে কয়েক মাস - ২

দু সপ্তাহ ধরে এখানে থাকার পর আস্তে আস্তে এখানকার মানুষ, তাঁদের পছন্দ-অপছন্দের দিকটা পরিষ্কার হয়ে আসছে। এমনিতে কুয়ালালামপুরে বিভিন্ন জনজাতির লোক দেখা যায়। দেশের প্রধান তিনটি জনজাতি হল মালয় (৪৬%), চাইনিজ (৪৩%) এবং ভারতীয় (১০%)। এই ভারতীয়দের অধিকাংশই দক্ষিণ ভারত থেকে কয়েকশো বছর আগে এখানে এসে স্থায়ীভাবে থেকে গেছেন। তাই এখানে ভারতীয় সংস্কৃতি বা খাদ্য বলতে মূলত দক্ষিণ ভারতীয় সংস্কৃতি বা খাদ্যকেই বোঝায়। 
আমার সঙ্গে প্রথম আলাপচারিতায় এখানকার স্থানীয় ভারতীয়রা আমার তামিল না জানায় খুবই আশ্চর্য হয়েছেন। এখানকার লোকেদের বোধহয় ধারণা ছিল যে, তামিল ভারতের প্রধান ভাষা। সেই ভুল ভেঙে দিয়ে সবচেয়ে প্রচলিত ভাষা হিসেবে হিন্দির উল্লেখ করায় এঁরা বললেন, "ওহ, ইউ আর পাঞ্জাবি!" তখন তাঁদের ভারতের অন্যান্য ভাষা সম্বন্ধে জ্ঞান দিয়ে বাংলাদেশের লোকেরা এবং আমরা এক ভাষায় কথা বলি ইত্যাদি বলে কিছুটা বোঝানো গেল।
এই প্রসঙ্গে বলে রাখি, কলকাতা থেকে কে এলে ঘুরতে এলে ভাষা এবং খাওয়া নিয়ে খুব একটা সমস্যা হবে না এবং তার প্রধান কারণ হল শহরের অন্যতম বড় বাংলাদেশী জনজাতি। এই শহরের রাস্তায় আমি হিন্দির চেয়ে বাংলা বেশী শুনেছি এখন অবধি। ছাত্র, চাকুরিরত, দোকানের বা রেস্তোরার কর্মচারী, এই শহরে বাঙ্গালদেশীর অভাব নেই। সত্যি কথা বলতে, দোকানে-টোকানে আমাদের মত চেহারার লোকজন দেখলে, "বাংলা জানেন?" দিয়ে শুরু করাই ভালো। এবং এঁরা দেশের লোকেদের ভালোই বাসেন। দ্বিতীয়বার গেলে চিনতে পারলে কুশল সংবাদ নেন।
দেশের কোন ডিস্ট্রিক্টের লোক জিজ্ঞেস করেন এবং "ডিস্ট্রিক্ট কলকাতা" শুনলেও এদের ব্যবহারের উষ্ণতা হ্রাস পায় না!
আমার সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্টের ঠিক উল্টোদিকের 'মিনি পাশার' (মানে ছোট বাজার) নামক মুদির দোকানটা একদল বাংলাদেশী ছেলেই চালায়। সকালেই তাদের সাহায্য নিয়ে চাল, আলু, ডিম, নুন ইত্যাদি নিয়ে এলাম। দু সপ্তাহ বাইরের খাবার খেয়েছি। এবার নিজের হাতের রান্নার জন্য মন কেমন করছে!
এখানকার লোকেরা খেলা ভালোবাসে, অফিসে রোজ সকালে আলোচনাও হয় এবং সেটা প্রধানত ইউরোপিয়ান ফুটবল নিয়ে। এবং শুধু বাচ্চারা নয় বয়স্ক কাকু এবং মাসিমাদেরও দেখলাম খেলা নিয়ে দিব্যি ইন্টারেস্ট এবং বেশ মন দিয়ে ফলো করেন। যদিও এখানকার সময় ভারত থেকেও আড়াই ঘন্টা এগিয়ে তাই অধিকাংশ খেলাই হয় গভীর রাতে কিন্তু তাও অনেকেই দেখেন এবং আলোচনা করেন।
আর গত দু সপ্তাহে ফুটবলে বেশ কিছু ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটেছে। প্রথমে লেস্টারের কাছে লিভারপুলের হার, তারপর লিভারপুলের আর্সেনালকে হারানো, জ্‌লাটানের সাস্‌পেন্সান, বার্সার ৬-১ কামব্যাক... এর সবগুলো নিয়েই অফিসে আলোচনা হয়েছে। ফুটবল ছাড়াও এখানকার লোকেরা ব্যাডমিন্টন আর হকি ফলো করেন। আমি কিছু পাবে লাইভ হকি ম্যাচ হতেও দেখেছি। ক্রিকেট সম্বন্ধে যা বুঝলাম, ব্যাপারটা অনেকেই জানেন, কোন দেশ খেলে সেগুলো জানেন, ভারতের জনপ্রিয়তাও জানেন তবে ডিটেল সেরকম কেউ জানেন না। কেউ বললেন, "ইন্ডিয়া এখন ওয়ার্ল্ড চ্যাম্পিয়ান তো!" বুঝলাম যে, ২০১৫ সালের ওয়ার্ল্ড কাপের খবর পাননি। কেউ হয়তো ভিরাট কোহলির নাম জানেন কিন্তু সে কী করেছে খবর রাখেন না। ঐ ভারতে লোকে যেভাবে টেনিস বা রাগবি ফলো করে সেরকম আরকি।
যদিও এদেশে ক্রিকেটের ইতিহাস আছে এবং তার কারণ ঊনবিংশ শতাব্দীর শেষ দিক থেকে ১৯৫৭ সালের স্বাধীনতা অবধি এখানে বসবাসকারী ব্রিটিশ জনসংখ্যা। আমার মনে আছে এখানে কিনারা ওভাল বলে একটা মাঠে একটা সময় খেলা হত। ২০০৬ সালে একটা ত্রিদেশীয় সিরিজও হয়েছিল ভারত, অস্ট্রেলিয়া আর ওয়েস্ট ইন্ডিজ নিয়ে। জায়গাটা ম্যাপে দেখে রেখেছি, কোন একটা উইকেন্ডে হয়তো দেখে আসব গিয়ে।
এখানে ইপিএল বা চ্যাম্পিয়ান্স লিগ প্রচার হওয়ার একটা বড় কারণ এখানকার খবরের কাগজগুলো। ইউরোপিয়ান ফুটবল নিয়ে ম্যাচ রিপোর্ট তো বটেই রীতিমত আলোচনাভিত্তিক প্রবন্ধ বেরোয় খেলোয়াড় এবং কোচেদের নিয়ে। ক্রিকেট নিয়ে রিপোর্টিং খুবই অদ্ভুত। এই কদিনে শুধু ভারত-অস্ট্রেলিয়া টেস্ট নিয়ে সামান্য রিপোর্টিং দেখলাম। অনেকটা আমাদের দেশের ডোমেস্টিক ম্যাচ রিপোর্টগুলোর মত। কিন্তু শ্রীলঙ্কা-বাংলাদেশ বা নিউজিল্যান্ড-সাউথ আফ্রিকা টেস্ট ম্যাচগুলো নিয়ে একটা লাইনও চোখে পড়েনি।

সারা সপ্তাহে অফিসে ভালোই চাপ ছিল তাই কাল খুঁজে খুঁজে একটা হট এয়ার বেলুন শোয়ে গেছিলাম বিকেলের দিকে। প্রায় ৮-১০ কিলোমিটার দূরে। একটা বেশ বড় খোলা জায়গায় বেশ মেলার মত বসেছিল। প্রায় হাজার পাঁচেক লোক হয়েছিল মনে হল। বেশ নাচ-গান, কনটেস্ট, ছোট ছোট খাবার দোকান ভালোই ছিল। কিন্তু চার খানা গোদা বেলুন দাঁড় করিয়ে সেগুলো ওড়ালো না কেন বুঝলাম না। হয়তো যখন তখন বৃষ্টি হতে পারে ভেবে ওড়ায়নি কিন্তু ব্যাপারটা বেশ অ্যান্টিক্লাইম্যাটিক!


আর সকালে বেরিয়েছিলাম মিউজিয়াম দেখতে। টেলিকন মিউজিয়াম, ন্যাশানাল টেক্সটাইল মিউজিয়াম, কুয়ালালামপুর সিটি গ্যালারি আর থ্রিডি আর্ট মিউজিয়াম দেখে এলাম। সিটি গ্যালারিতে পুরো শহরের মিনিচেয়ার ভিউয়ের সঙ্গে লাইট অ্যান্ড সাউন্ড শোটা বেশ ভালো লেগেছে। তবে ৫০ রিঙ্গিট (৭৫০ টাকা) দিয়ে ঐ থ্রিডি আর্ট গ্যালারি মোটেই সুবিধার নয়।







সঙ্গের ছবিগুলো কালকে তোলা।

Saturday, March 4, 2017

কেএলে কয়েক মাস - ১

সপ্তাহখানেক হল কুয়ালালামপুরে এসে আস্তানা গেড়েছি। অফিসের চক্করেই। আপাতত মাস তিনেক থাকার কথা। এক-দেড় মাস বাড়তেও পারে। পার্ক রয়্যাল কোম্পানির সার্ভিস অ্যাপার্টমেন্টে একটা সুইটে বেশ গুছিয়ে বসেছি।

বেশ ভালো জায়গা এই কেএল। অনেক রকমের মানুষ। আসলে মালয়শিয়া দেশটাই বিভিন্ন জনজাতির সম্বনয়ে তৈরি। ধরুন তিনটি মানুষের নাম যথাক্রমে চে চুন লিম, মহম্মদ বিন আসলাম, নাগাশেখরন জালাকাট্টি। এরা তিনজনেই কিন্তু মালয়শিয়ার আদি বাসিন্দা হতে পারেন। এর সঙ্গে কর্মসূত্রে এবং ভ্রমণের কারণে একপাল ভারতীয়, পাকিস্তানি, বাংলাদেশী, মধ্য এশিয়ার লোক, আমেরিকান এবং ইউরোপীয়রা এই শহরে ঘুরে বেরাচ্ছেন। একেবারেই কসমোপলিটন এবং সেইজন্যেই রেস্তোরা, কারেন্সি কনভার্টার আর স্যুভেনির স্টোরের প্রাচুর্য্য।
এশিয়ার অন্যতম চকচকে শহর হওয়ায় এখানে সময় কাটানোর ব্যবস্থার অভাব নেই। যদিও সকালে কিছু করার সময় থাকে না। আটটায় ঘর থেকে নেমে ব্রেকফাস্ট করে বেরিয়ে যাই। রাজা চুলান স্টেশন থেকে মনোরেলে করে যাই হাংটুয়া। সেখানে লাইন চেঞ্জ করে কেএলআরে চেপে যাই মসজেদ জামেক। সেখানে স্টেশন থেকেই বেরিয়েই আমার অফিস। সব মিলিয়ে গোটা পাঁচেক স্টেশন। ঠিকঠাক ট্রেন পেয়ে গেলে বারো-তের মিনিট লাগে। এখানকার এই মনোরেল এবং এলআরটির কভারেজ ভালোই। যেকোন জায়গায় যেতে গেলে শুধু বুঝে নিতে হয় যে কোন স্টেশনে গিয়ে লাইন চেঞ্জ করতে হবে। বাকিটা খুব সহজেই হয় যায়।

সাড়ে আটটা নাগাদ অফিসে ঢুকি। বেরোই সাতটা নাগাদ। তখন আমার ঘোরার সময়। কখনো হেঁটে ফিরি। আসলে আমার অফিস থেকে পার্ক রয়্যাল সোজা রাস্তা। মিনিট কুড়ি লাগে হেঁটে। আর ট্রেন লাইনটা ঘুরে যায়।
কিন্তু দিনের বেলা অত সময় থাকে না হাঁটার। জায়গাটা বেশ গরম, সেটাও একটা কারণ, সকালে না হাঁটার। যদিও গত সপ্তাহে প্রায় রোজই সন্ধ্যের দিকে হালকা বৃষ্টি হয়েছে। তবে আমি যেখানে থাকি তার চারদিকে এত শপিং মল যে বৃষ্টি পড়লেই টুক করে কোথাও একটা ঢুকে পড়া যায়। আর এখানকার মলগুলো বিশাল জায়গা জুড়ে বানানো তাই কিছুক্ষণ টাইম-পাস হয়েই যায়।

আমি যে রাস্তায় থাকি তার নাম জালান নাগাসারি। জালান মানে রাস্তা তাই এখানকার ঠিকানায় জালানের ছড়াছড়ি। আর জালান নাগাসারি থেকে দু মিনিট হাঁটলেই বুকেত বিনতাং। বুকেত বিনতাং হল পাতি কথায় কুয়ালালামপুরের পার্ক স্ট্রিট যদিও অনেক বেশী ঝাঁ-চকচকে। সেখানে গাদা খানেক শপিং মল, গুচ্ছ গুচ্ছ খাবার জায়গা, দোকান-পাট, ফুড স্ট্রিট সব আছে! ফুড স্ট্রিটের নাম হল জালান আলোর। গত শনিবার সন্ধ্যেবেলা গেছিলাম। রাস্তার ওপর সারি সারি চেয়ার-টেবিল পেতে খাওয়ার ব্যবস্থা আছে। তাতে ভ্যারাইটির অভাব নেই।

খাবারের প্রসঙ্গে বলে রাখি, আপাতত দোকানে-রেস্টুরেন্টেই খেয়ে বেরাচ্ছি এবং যেটা বুঝেছি যে, এখানকার ভারতীয় খাওয়ার জায়গার তুলনায় পাকিস্তানি (দেশদ্রোহী বলবেন না প্লিজ) এবং অন্যান্য মধ্য এশিয়ার (যেমন লেবানিজ, ইরানিয়ান) দোকানগুলোই আমাকে বাঁচিয়ে রাখবে। কারণ এখানকার অধিকাংশ ভারতীয় হোটেলই দক্ষিণ ভারতীয় স্টাইলে রান্না করে এবং কারিপাতাযুক্ত খাবারের প্রতি আমার বিতৃষ্ণার কথা সর্বজনবিদিত। বাংলাদেশী রেস্তোরাই দেখেছি, যার নাম 'ESO KHAI', এখনও খেতে যাওয়া হয়নি।

গত রবিবার গিয়ে সামনে থেকে বড়বাড়ি এবং জোড়াবাড়ি (বন্ধু দেবাদ্রির ভাষায়) দেখে এসেছি। এগুলো আর কিছুই নয়, যথাক্রমে কুয়ালালামপুর টাওয়ার আর পেট্রোনাস টাওয়ার। পেট্রোনাস টাওয়ারের নীচের সুরিয়া মল এখানকার সবচেয়ে বিখ্যাত মলগুলোর একটা। গত রবিবার সেখানে ঘুরে নান্দোজে দিব্যি পর্তুগিজ চিকেন খেয়ে এসেছি!এছাড়া প্রায় ১৩০ বছরের পুরনো সেন্ট্রাল মার্কেটও একটা বেশ দেখার মত জায়গা এবং সেটা আবার আমার অফিসের ঠিক পেছনেই।

আপাতত এই অবধিই। আগামী তিনমাসে আরো বেশ কিছু জায়গা ঘোরা হয়ে যাবে আশা করছি। সেগুলোর ছবিও ঠিক সময় মত ব্লগে চলে আসবে!



"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”