Saturday, December 1, 2018

লন্ডনে লণ্ডভণ্ড - ৭

~~সারাহর সঙ্গে কিছুক্ষণ~~

সারাহর সঙ্গে সারাদিন হলে ভালোই হত তাও যেটুকু সময় দেখা হয়েছিল সেটাই বা মন্দ কী! যাকগে, পরের কথা পরে পরে হবে। সকালে ব্রেকফাস্টের পর প্রথম গন্তব্য ছিল ম্যানচেস্টার ইউনাইটেড ফুটবল ক্লাব, আরেক তীর্থক্ষেত্র! শ্রেয়সীর পরনে ইস্ট বেঙ্গলের জার্সি, আমার পরনে ইউনাইটেডের জার্সি, ব্যাগে মোহন বাগানের! হোটেল থেকে বেরিয়ে মিনিট দশেক হেঁটেই পৌঁছে গেলাম ক্লাবের সামনে। পথে চোখে পড়ল ট্র্যাফোর্ড পার্ক আর তার সামনের ভাস্কর্য্য। ক্লাবে পৌঁছে বুকিং স্লিপ দেখিয়ে একটা ট্যুর দলের সঙ্গে ভিড়ে গেলাম। যদিও সামান্য দেরী হয়েছিল। ট্রফি রুম থেকে শুরু করে স্যার অ্যালেক্স ফার্গুসন স্ট্যান্ডে গিয়ে বসা হল। সেই প্রথম দেখলাম থিয়েটার অফ ড্রিমসকে। 

দেখলাম বিখ্যাত স্ট্র্যাটফোর্ড এন্ড, উল্টোদিকের স্যার ববি চার্লটন স্ট্যান্ড। তারপর একে একে যাওয়া হল মাঠের বিভিন্ন প্রান্তে, প্রেস কনফারেন্স রুমে, খেলোয়াড়দের বেরিয়ে আসার টানেলে, এমনকি ডাগ আউটের সামনেও। শুধু সিজন শুরুর ঠিক আগেই গেছিলাম বলে খেলোয়াড়দের ড্রেসিং রুমে কিছু শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছিল, তাই ড্রেসিং রুমে এবার আর যাওয়া হয়ে ওঠেনি। এই ভ্রমণের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটা লেখা লিখেছিলাম গণশক্তির পাতায়। তার লিঙ্ক দিয়ে রাখলাম আর উদ্ধৃত করলাম শেষ অংশটা, কারণ বিদেশের বিভিন্ন মাঠে গিয়ে এটাই আমার বারবার মনে হয়েছে,
কিন্তু একটা প্রশ্ন মনে থেকেই গেল। আমাদের কলকাতার দুই বড় ক্লাব কবে এইভাবে সুন্দর করে সাজিয়ে তুলবে নিজেদের? কবে দেশবিদেশের সমর্থকরা এসে এইভাবে ঘুরে দেখতে পারবেন নিজেদের প্রিয় ক্লাব? অনুভব করবেন ক্লাবের ইতিহাস, তার ঐতিহ্য! ঘরে নিয়ে যেতে পারবেন তাঁদের প্রিয় ক্লাবের ছবি দেওয়া টি-শার্ট বা অন্য কোন স্মৃতিচিহ্ন? ক্লাবের রেস্তোরায় বসে খাবেন ক্লাবের স্পেশাল ইলিশ ভাপা বা চিংড়ির মালাইকারি?
কর্মকর্তারা শুনছেন কি?”

ক্লাব থেকে বেরিয়ে তাড়াহুড়ো করেই ছুট লাগালাম ম্যানচেস্টারের ন্যাশানাল ফুটবল মিউজিয়ামের উদ্দেশ্যে। যাত্রার উপায় ট্রামে। ভেতরটা ট্রেনের মত হলেও ঠিক শহরের মধ্যে দিয়ে যায় বলে ট্রামে বসেই শহরের পালস্‌টা বেশ ভালো বোঝা যায়। এক নজরেই বেশ ভালো লেগে গেছে ম্যানচেস্টারকে। বিশেষ করে শহরের যেটাকে সিটি সেন্টার বলে সেটা অনেকটাই কলকাতার মত। প্রচুর লোকজন চোখে পড়ল। মিউজিয়ামটা কাছেই। অসাধারণ মিউজিয়াম। টিকিটের ব্যবস্থা নেই, কেউ চাইলে নিজেদের ইচ্ছে মত ডোনেশান দিতে পারেন। ভেতরে কী নেই। শুরুতেই চোখে পড়ল ফুটবল নিয়ে বিভিন্ন বই এবং কমিক্স। রোভার্সের রয় এবং বিলির বুট দুটোই ছিল সেখানে, সঙ্গে টিনটিন বা টাইগার পত্রিকায় ছাপা ফুটবল কমিক্স বা ১৯০৬ সালের মেয়েদের ফুটবল নিয়ে পোস্টকার্ড।
এরপর খেলার জিনিসে ঢুকে পড়লে তো মাথা ঘুরে যাবে। কী নেই সেখানে! ফুটবলের বিবর্তনের স্যাম্পেল। ঊনবিংশ শতাব্দীর বিভিন্ন ফুটবলে ক্লাবের খেলোয়াড়দের ছবি, ১৮৭২ সালের এফএ কাপের মেডেল, বিভিন্ন বিশ্বকাপের পোস্টার, পেলের জার্সি এবং পাসপোর্ট, বিভিন্ন ট্রফি তার মধ্যে জুলে রিমে কাপের রেপ্লিকাটাও আছে, ওই ১৯৬৬ সালেরটা। এমনকি ইএ স্পোর্টসের ফিফার বিবর্তনও বাদ পড়েনি। এবং তার সঙ্গে বিভিন্ন ইন্টার‍্যাক্টিভ অপশন। টিভি স্ক্রিন, যার সামনের বোর্ডে বিভিন্ন ক্লাব বা বিখ্যাত খেলোয়াড়ের নাম লেখা আছে, নিজের পছন্দের প্লেয়ার বা খেলায়াড়ের নামে হাত দিলেই স্ক্রিনে চালু হয়ে যাবে, সেই ক্লাবের ইতিহাস বা ঐ খেলোয়াড়কে নিয়ে দু-তিন মিনিটের ছোট্ট ক্যাপসুল। বাচ্চাদের জন্য নানারকম গেমস। এমনকি ঐ সুযোগে ভার্চুয়াল গোলকিপারের সামনে পেনাল্টি মারার সুযোগও পেয়েছিলাম।
সব মিলিয়ে অসাধারণ, সবার শেষে স্যুভেনিরের দোকানটাও অসাধারণ, ছবি, বই, চাবির রিং, ম্যাগনেট থেকে শুরু করে ছোট ছোট বিশ্বকাপ বা এফএ কাপের রেপ্লিকা, কী নেই। তবে ঐ, সব জিনিসেরই গলাকাটা দাম বলে সাধ আর সাধ্যের মধ্যে লড়াই চলতেই থাকে।
ফুটবল মিউজিয়াম থেকে বেরিয়েই আবার ছুট লাগালাম ট্রাম ধরতে। আবার ফিরতে হবে ওল্ড ট্র্যাফোর্ডে। তবে এবার ফুটবল মাঠের এক কিলোমিটার পাশের ক্রিকেট মাঠে। সেখানে তখন কিয়া সুপার লিগের সারে স্টারস আর ল্যাঙ্কাশায়ার ঠান্ডারদের মধ্যে টি২০ ম্যাচ চলছে। সেখানে খেলছে সারাহ টেলর, ন্যাট সিভার, মেরিজুয়ান কাপ আর ডেন ভ্যান নিকার্ক সারের হয়ে। আর ঠান্ডারদের দলে আছে ঘরের মেয়ে হরমনপ্রিত, এমি জোনস্‌, নিক বল্টনরা। যাইহোক খেলাটা যদিও একপেশেই হল। সহজেই জিতল সারাহর দল। ওর ব্যাটিং দেখতে না পেলেও দেখার সুযোগ হল চোখ ধাঁধানো কিপিং। এখানে বলে রাখি, সারাহ টেলর আমার সবচেয়ে প্রিয় মহিলা ক্রিকেটার! মানে সবচেয়ে প্রিয়দের মধ্যে একজন-ট্যাকজন নয়। সবচেয়ে প্রিয় মানে সবচেয়ে প্রিয়। ওদিকে দাদা, এদিকে সারাহ!

খেলা শেষ হয়ে গেল বেশ তাড়াতাড়িই। টিকিট কাটার সময় আমাদের বলা হয়েছিল যে পুরো মাঠের টিকিটই দশ পাউন্ড, যেখানে ইচ্ছে। আমি বুদ্ধি লাগিয়ে ক্লাব হাউসের পাশের ব্লকের টিকিট নিয়েছিলাম। কারণ ইডেনে প্লেয়ারদের ডাগ আউটটা ওখানেই হয়ে। মাঠে ঢুকে দেখলাম, এখানে ডাগ আউট ঠিক সোজাসুজি উল্টোদিকে। কী আর করি, ক্যামেরার জুম দিয়ে হরমনদের দেখলাম। খেলা শেষ হওয়ার পর শ্রেয়সীকে বললাম, “চল দেখে আসি কতটা যেতে দেয়!”
ও হরি, গ্যালারীর নিচ দিয়ে হাঁটতে গিয়ে দেখি, সেরকম কিছু সিকিউরিটি নেই, দিব্যি মাঠটাকে ঘিরে গোল হয়ে ঘোরা যায়। আমরা টুকটুক করে হাঁটতে হাঁটতে উল্টোদিকে চলে এলাম। বাইরে থেকেই দেখতে পাচ্ছিলাম যে খেলোয়াড়রা দর্শকদের সঙ্গে ছবি তুলছে, সই দিচ্ছে। আমরাও আবার গ্যালারিতে ঢুকে একদম সামনে গিয়ে পাকড়াও করলাম হরমনপ্রিতকে, ইন্ডিয়া থেকে এসেছি ইত্যাদি বলে-টলে ওর সঙ্গে ছবিও তোলা হল। অ্যালেক্স হার্টলিরও অটোগ্রাফ নেওয়া হল। কিন্তু তারপরেই আমরা ছুটলাম অন্যদিকে, যেখানে সারের খেলোয়াড়রা ছবি তুলছে। সারাহ চলে না যায়। লোকজনকে কাটিয়ে একটু সামনে যেতেই দেখতে পেলাম ভদ্রমহিলাকে, একজন বয়স্ক ভারতীয় লোকের সঙ্গে কথা বলছিল। সুযোগ বুঝে, “হাই আই অ্যাম আ বিগ ফ্যান” বলে কথা শুরু করলাম। তারপর টুকটাক কথা হল। এমনকি মেয়েদের আইপিএল চালু হলে কেকেআরে খেলার জন্য অনুরোধও করে ফেললাম। সঙ্গে সেলফি। সব মিলিয়ে দারুণ ফ্যানবয় মোমেন্ট। শ্রেয়সী একটু ঘেঁটেই গেছিল। এক তো ওকে বাদ দিয়ে চলে গেছি, তারপর আবার ওর সঙ্গে ছবিটা পছন্দ হয়েনি।
একে ছবি নিয়ে মুড অফ, তার সঙ্গে ঠাণ্ডা লাগছে, সব মিলিয়ে গোমড়ামুখো শ্রেয়সীর মুড ভালো করতে আমি ওকে নিয়ে ঢুকলাম ক্লাবের ক্রিকেট শপে। সেখান থেকে কেনা হল ইংল্যান্ড উইমেন ওয়ান্ ডে দলের রেপ্লিকা সোয়েটার। সেটা পড়ে একটু ধাতস্থ হল সে। তারপর দোকান থেকে বেরিয়ে এসে আরেক চমক। দেখলাম গ্যালারি আর দোকানের মধ্যের খালি জায়গাটায় অনেক অনেক ফ্যানের সঙ্গে খেলোয়াড়রাও দাঁড়িয়ে আছে, ঘুরে বেরাচ্ছে, ছবি তুলছে। সেখানে গিয়ে শ্রেয়সী আর একপ্রস্থ হরমনের সঙ্গে কথা বলে এল এবং তারপর খুঁজে বের করল সারাহকে! গিয়ে পাতি বলল, আগের ছবিটা পছন্দ হয়নি, আরো ছবি তুলতে চায়, তার সঙ্গে আবদার ওই নতুন সোয়েটারে সই করে দিতে হবে। এর পরের কথোপকথন,
-      You want me to sign on that sweater?
-      Yes.
-      You are crazy.
-      I know!
-      Oops... Ready? Where to sign?
-      Wherever you want. I am not going to wash it.
-      Ya ya… Dare you wash it!
এই পুরো ব্যাপারটারই ছবি তুলে রাখা হয়েছিল, যেটার কোলাজটা হয়তো কোন একদিন প্রিন্ট হয়ে আমাদের বসার ঘরে জায়গা নেবে। আপাতত এখানে দিয়ে রাখলাম। কিন্তু এখানেই শেষ নয়!

এইসব উত্তেজনায় ভুলেই গেছিলাম যে, ছেলেদের খেলাটা শুরু হওয়ার সময় হয়ে গেছে। আমাদের রাতের বাস একটায়। সুতরাং ওটা দেখতেও ঢুকে পড়লাম। আমাদের পুরনো গ্যালারিতে না ফিয়ে গিয়ে যেখানে সারাহদের সঙ্গে সঙ্গে দেখা সেখানেই ঢুকে দুটো সিট জোগাড় করে বসে পড়লাম। ল্যাঙ্কাশায়ার লাইটনিং বনাম ডারহাম জেটসের খেলা। ডারহামের হয়ে পল কলিংউড ওপেন করেছিল। ভদ্রলোক এতদিন খেলছেন সেটাই খেয়াল ছিল না। যাই হোক, তিন-চার ওভার খেলা হয়েছে। হঠাৎ দেখি দুই ভদ্রমহিলা সিঁড়ি দিয়ে উঠে গ্যালারিতে এসে এদিক ওদিক সিট খুঁজছে। একজন ন্যাট সিভার, অন্যজন... সারাহ টেলর! শ্রেয়সীকে বললাম, “ওই দ্যাখ সারাহ!” যদিও আমাদের পাশে খালি সিট ছিল না। সারাহর সঙ্গে চোখাচুখিতে হওয়ায় ভদ্রমহিলা আবার একটা “তোমরা এখানেও” টাইপ হাসি দিয়ে একবার চোখ মেরে নিচের দিকে সিট খুঁজতে চলে গেলেন। আমার বিশ্বাস, আমাদের পাশে আর দুটো সিট ফাঁকা থাকলে আমাদের পাশে এসেই বসতেন!
এত কিছুর পর আর ম্যাচে মন বসানো গেল না। আর ঠাণ্ডাও লাগছিল খুব। আমরা ফিরে গেলাম হোটেলে। সেখান থেকে ব্যাগ নিয়ে দশটা নাগাদ রওয়ানা দিলাম বাস স্টেশানের দিকে। বাইরে তখন টেম্পারেচার দশ-বারোর কাছে এবং আমরা দুজনেই ওজন কমাতে আমাদের জ্যাকেটগুলো লন্ডনে রেখে এসেছিলাম। আসলে লন্ডনের ঐ গরমের পর এখানে এত ঠাণ্ডা হবে ভাবতে পারিনি! যাইহোক, পরদিন সকালে পৌঁছে যাব নতুন দেশ স্কটল্যান্ডে। সেখানকার অ্যাডভেঞ্চারের গল্প পরের পর্বে!

আগের পর্বের লিঙ্ক -


"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”