এই গল্পটা আজ
থেকে পঁচিশ বছর আগের। আমার বয়স তখন কত হবে, চারের আশেপাশে। কিছুদিন আগেই
শিশুনিকেতন বলে একটা ছোট্ট ইস্কুলে ভর্তি হয়েছি।
তখন থেকেই বই
পড়ার নেশা। বাবা দেব সাহিত্য কুটীর থেকে ছবিতে রামায়ণ-মহাভারত কিনে দিয়েছে। সঙ্গে
টুনটুনির বই, আবোল তাবোল আর ঠাকুমার ঝুলি। সেইসব বইগুলো যতবার
পারি পড়ি আর কল্পনার ডানায় চড়ে উড়ে বেড়াই মজন্তালি সরকার, বোকা জোলা, কাঠ বুড়ো,
বকচ্ছপ আর হেড অফিসের বড়বাবুর দুনিয়ায়।
ততদিন অবধি
মোটামুটি মা-ই ঘুরে ঘুরে খাইয়ে দেয়। মানে, আমি সারা বাড়ি নেচে বেড়াই আর মা পেছন
পেছন খাবারের থালা নিয়ে ঘুরে ভুজুং-ভাজাং দিয়ে, কাক-কোকিল দেখিয়ে খাওয়ায়। অথবা,
আমি হয়তো টুনটুনির বই থেকে সেই নাক-কাটা রাজার গপ্পটা পড়ছি আর মা খাইয়ে দিল।
কিন্তু সুখের দিন
গেল। মা একদিন বলল, “এবার বড় হয়েছিস। এবার থেকে আমি ভাত মেখে গোল্লা পাকিয়ে দেব।
তুই নিজে নিজে খাবি।”
শুনেই মনটা কেমন খিঁচড়ে
গেল। নিজে নিজে খেতে হবে, বড় হয়েছি বলে এ কী জুলুম! আমি তো জানি, বড় হলে শুধু
বাবার মত রোজ অফিস যাব আর সন্ধ্যেবেলা ফিরে মন দিয়ে টিভিতে খবর দেখব আর ‘তেরো পার্বণ’
বলে কি একটা হয় সেটা দেখব মন দিয়ে।
তার মধ্যে মা
আবার জানিয়ে দিল যে, গল্পের বই পড়তে পড়তে খাওয়া যাবে না। মন দিয়ে না খেলে নাকি
খাবার হজম হবে না। এ তো বড্ড ঝামেলা! পুরদস্তুর বাওয়াল দিলাম, ঘ্যান ঘ্যান করা,
নাকি কান্না ইত্যাদি প্রভৃতি।
যাই হোক শেষ অবধি
একটা শান্তি-চুক্তিতে আসা গেল। ঠিক হল, আমি নিজে নিজেই খাবো কিন্তু মা-ও তখন খেতে
বসে আমাকে গল্প বলে শোনাবে। তাতেই আমি রাজী।
তা মা গল্পও বলে
নানা রকমের। বেশিরভাগই রূপকথা, তাছাড়া এদিক-ওদিক, ঐ বেড়ালের খাবার খেয়ে যাওয়ার
গল্প, বারান্দার কাকের গল্প এইসব আর কি।
তা সেইসব গল্পের
স্টকও একদিন শেষ হয়ে এল। তারপর মা যে গল্পই বলে আমি ব্যাগড়া দি, “এটা তো আগে
বলেছ”, “ওইটা তো পরশু দিন বললে, ছোট রানীটা দুষ্টু...”
হতাশ হয়ে মা শেষ
অবধি গল্প ফাঁদল,
- বুঝলি তো, তিনটে বন্ধু ছিল। গ, ল আর প।
- গ, ল, প... বাঃ বাঃ... কি রকম বন্ধু? আমার ইস্কুলের মলয় আর
কৌশিকের মত?
- হ্যাঁ রে... সেই রকম খুব বন্ধু।
- আচ্ছা... তাপ্পর?
- একদিন গ, ল, প একসঙ্গে যাচ্ছিল...
- কোথায় যাচ্ছিল?
- কোথায় যাচ্ছিল... উঁ... ঐ যে... হ্যাঁ, সার্কাস দেখতে।
- ওমা... সার্কাস? কি মজা? সার্কাসে হাতি ছিল?
- হাতি তো থাকবেই রে বোকা, তারপর শোন না... আচ্ছা এই গোল্লাটা
খেয়ে নে।
- খাচ্ছি... তুমি বল
- হ্যাঁ... তো ওরা তিনজন যাচ্ছে যাচ্ছে... এমন সময় সামনে একটা
বিরাট বড়ো নদী পড়ল...
- কি নদী? কত বড়ো?
- হুগলী নদী... সে বিশাল বড়ো।
- নদীতে মাছ ছিলো?
- নদীতে মাছ থাকবে না? অনেক মাছ ছিল... ইলিশ, রুই, কাতলা...
- তাপ্পর?
- তখন তারা দেখল কি... গ আর প সাঁতার জানে কিন্তু ল একদম
সাঁতার জানে না...
- আমার মত?
- হ্যাঁ...
- তাহলে কি হবে? ল ডুবে যাবে?
- দুর বোকা... ল-এর বন্ধু গ আর প ছিল তো... আর প-এর গায়ে
জানিস তো খুব জোর...
- খুব জোর? রামায়ণের হনুমানের মত?
- ঠিক বলেছিস!
- তাপ্পর কি হল?
- তখন প বলল, আমি ল-কে আমার কাঁধে করে নিয়ে নদী পার হব!
- ওমা... তাই?
- হ্যাঁ তো। তখন নদীতে পাশাপাশি নামল গ, আর প-এর কাঁধে ল...
হয়ে গেল গল্প! এবার এই চারটে গোল্লা বাকি আছে, খেয়ে নে...
কত কত নোবেলজয়ী,
বুকারজয়ী লেখকের বই তো পড়ে ফেললাম কিন্তু ছোটবেলার এই গল্পের মত সহজ-সরল, মনে থেকে
যাওয়া গল্প খুব বেশি পেলাম না!
ki nishpaap lekhata re
ReplyDeletemoner shei chhottobelar konta chhuye jaay jeta chapai pore gechhilo bohubocchor agey
thank u for taking me back to my happy old days
আমি রাইয়ের সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। ভীষণ নিষ্পাপ লেখা।
ReplyDelete