কুড়িটা বছর পার হয়ে গেছে! আজ থেকে কুড়ি বছর আগে
পৃথিবীটা অনেক অন্য রকম ছিল। অনেক নরম, শান্ত, ঠাণ্ডা, মজার একটা জায়গা! আমি তখনো
বড় হয়ে যাইনি (এখন তো আর উপায় নেই!) তাই আমার পৃথিবীটাও আমার মতই ছোট্ট ছিল। সেই
পৃথিবীর একদিকে বাঁটু্ল উটপাখি পুষছে, টিনটিন আর ক্যাপ্টেন হ্যাডক প্রশান্ত
মহাসাগরের দ্বীপে ঘুরে গুপ্তধন না পেয়ে ফিরে আসছে, ফেলুদা পার্ক স্ট্রিটের
গোরস্থানের সবুজ ঘাসের ওপর ভাঙা শ্বেত পাথরের টুকরো সাজিয়ে টমাস গডউইনের নাম খুঁজে
বের করছে আর কাকাবাবু সুকুমার রায় আবৃত্তি করে শোনাচ্ছে সন্তুকে।
আমার পৃথিবীর অন্য দিকটা জুড়ে ছিল একদল লোক,
যাদের খুব ছোট্টবেলা থেকে টিভিতে দেখতাম। টিভির মধ্যে ব্যাট করছে, বল করছে, ক্যাচ
ধরছে! আর দেখতাম বিজ্ঞাপনে। পামোলিভ, বুস্ট, পেপসি। তারপর তাদের নিয়ে পড়তে শুরু
করলাম। গাভাসকার, কপিল দেব, আজহার, সচিন থেকে শুরু করে সি কে নাইডু, ভিনু মানকড়,
ওয়ালশ, অ্যামব্রোজ, লারা, জয়সূর্য!
সেই ওয়ান ডে ক্রিকেটের সুবর্ণ যুগে তখন একের পর
এক ক্রিকেট সিরিজ, ত্রিদেশীয়, চতুর্দেশীয় টুর্নামেন্ট হয়েই চলত। ১৯৯৬তে আবার ঘরের মাঠে বিশ্বকাপ। তার অভিনব বিজ্ঞাপন, টানটান উত্তেজনা, পাকিস্তানকে
হারানোর লাগামছাড়া উচ্ছাসের পরই শ্রীলংকার কাছে করুণ পরাজয়। সব মিলিয়ে সে একটা সময়
গেছিল বটে! (যদিও এটা আমার স্মৃতিতে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। বিরানব্বইয়ের অস্ট্রেলিয়ায়
বিশ্বকাপ দেখার হাতেখড়ি! ফাইনালে ইমরান খানের জন্য #দিল দিল পাকিস্তানও ছিলাম সেই
ন বছর বয়সে!)
বিশ্বকাপ শেষ হতে না হতেই ইন্ডিয়া পটাপট দুটো
ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলে ফেলল, যদিও একটাও জিতল না। তারপর রওনা দিল ইংল্যান্ডের জন্য,
এক গাদা নতুন খেলোয়াড় নিয়ে। রাহুল দ্রাভিড, সুনীল যোশী, ভেঙ্কটেশ প্রসাদ, পরশ
মাম্ব্রে, বিক্রম রাঠোড়... এরা কেউ তখনো টেস্ট খেলেনি। ওহ্ আর একটা লোক ছিল।
ট্যুর শুরুর আগে থেকেই যাকে নিয়ে বাংলা কাগজে বেশ হইচই হচ্ছিল। হাজার হোক, অনেক
বছর পর এরকম একটা বড় ট্যুরে একটা বাঙ্গালী ছেলে দলে জায়গা পেয়েছে! ততদিন বাঙ্গালীর
আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মানেই গোলগাল, চশমা চোখে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক পঙ্কজ রায়। সঙ্গে
বুড়ো বয়সে শুঁটে ব্যানার্জীর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে পাঁচ উইকেট নেওয়ার গল্প বা
সুব্রত ব্যানার্জীর প্রথম ইনিংসে তিন উইকেট নেওয়ার পর আজহারের দ্বিতীয় ইনিংসে বল
না দেওয়ার দীর্ঘশ্বাস! কেউ বলল, ‘কিচ্ছু করতে পারবে না’, আবার কেউ বলল, ‘খেলতে
নিলে আগুন লাগিয়ে দেবে!’ কার কথায় ভরসা করা যায় বোঝার বয়স হয়নি তখনও।
লম্বা ট্যুর ছিল। অনেকগুলো কাউন্টির সঙ্গে
ম্যাচ, বোধহয় সেই শেষবারই। টুকটাক খেলছিল ছোকরা। একটা ওয়ান ডে খেলায় চান্স পেল। সচিন আউট হওয়ার পর ফার্স্ট ডাউন নেমে ৪৬ রান করল।
ইন্ডিয়া হারল যথারীতি। সিরিজটাও।
ফার্স্ট টেস্টে টিমে ছিল না। ইন্ডিয়া হেরেছিল।
সেকেন্ড টেস্টের আগে টিমে প্রচুর ঝামেলা। মঞ্জরেকারের চোট, সিধুও ঝামেলা করে
ইন্ডিয়া ফিরে এসেছিল তত দিনে। খবরের কাগজে পড়লাম রাহুল দ্রাভিডের অভিষেক হবে লর্ডস টেস্টে, আরও পরিবর্তন
হতে পারে। সে কী কাণ্ড! বাঙ্গালীর ছেলে টেস্ট খেলতে পারে! সে কী প্রাদেশিক
উত্তেজনা! বাঙ্গালীকে আর ক্রিকেটে দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না! চারদিকে একটা সাজো সাজো
রব।
আগেই বলেছি, কুড়ি বছর! আজ থেকে কুড়ি বছর আগে এই
দিনে। সৌরভ গাঙ্গুলীর প্রথম টেস্ট! একটা বৃহস্পতিবার। স্কুলে গেছিলাম, ক্লাস সেভেন। স্কুল থেকে ফিরে ছটার খাস খবরে শুনলাম সৌরভ খেলছে! উইকেটও নিয়েছে
একটা। নটার খাস খবরে শুনলাম, উইকেট একটা নয় দুটো! তার পরের দিন ব্যাট করতে নেমে ২৬
রানে নট আউট। থার্ড ডে শনিবার। স্কুল হাফ ছুটি, ফিরে এসে রেডিও শুনছিলাম, কেবল
টিভি তখন নেই। সৌরভ যখন প্রায় সত্তর তখন এক বন্ধুর বাড়িতে হামলা করলাম। আস্তে
আস্তে রান বাড়ছে। সৌরভ নব্বই। সবাই উত্তেজিত! বাঙ্গালী খেলবে জানা ছিল কিন্তু এইসব
হয়ে যাবে কেউ ভাবতেও পারেনি!
হঠাৎ টিভিতে ক্রিকেট বন্ধ। ইউরো কাপের খেলা। আজ
গুগলে চেক করলাম, ইংল্যান্ড বনাম স্পেনের কোয়ার্টার ফাইনাল ছিল। বড় টুর্নামেন্টে
ইংল্যান্ডের একমাত্র টাইব্রেকারে জয়! কিন্তু তখন মনে হয়েছিল স্টার স্পোর্টসের চেয়ে
হৃদয়হীন কী আর কেউ আছে!
সৌরভের টেস্টে প্রথমবার একশোয় পৌঁছনোর মুহূর্তটা
দেখতে পাইনি। কী আসে যায়! সেটা তো একটা সামান্য স্ট্যাটিস্টিক্স! পরের টেস্টেই তো
আর একটা হল!
সৌরভ ভারতীয় ক্রিকেটকে কতটা বদলে দিয়েছে। আদৌ তার কোন অবদান আছে কিনা ভারতীয় ক্রিকেটে... সেই নিয়ে লোকে তর্ক করে। করুক! কী আসে যায়!
কিন্তু আমার জীবনটাকে সৌরভ কিভাবে পালটে দিয়েছে
সেটা নিয়ে তো আর তর্ক করার জায়গা নেই। তার আগে অবধি ক্রিকেট শুধু একটা খেলা ছিল,
সেদিন থেকে ক্রিকেট আমার মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে পড়ল! সৌরভের খেলা, সৌরভের
রান-উইকেট-ক্যাচ, অধিনায়কত্ব, সাফল্য, ব্যর্থতা... সবই আস্তে আস্তে হয়ে উঠল আমার
জীবনের একটা অংশ।
আসলে আমার জীবনের দুটো ভাগ! ‘Before Lord’s 1996’ আর ‘After Lord’s
1996’।
সেই ভাগটা হয়েছিল আজকের দিনেই, ঠিক কুড়িটা বছর আগে!
কুড়ি বছর আগে যে সন্দীপ পাটিল টরন্টোয় সৌরভকে বাদ দিয়েছিলেন, আজ সেই সন্দীপ পাটিলকেই সৌরভের কাছে ইন্টারভিউ দিতে হচ্ছে। জীবন এরকমই। লেখাটা যে ভালো হয়েছে আলাদা করে আর বললাম না। এবার রাহুল দ্রাবিড়কে নিয়ে একটা লেখা হোক। -সৌগত
ReplyDeleteSeta Shreyasi likhbe kono ekdin! Aro ekta lekha aschhe kal sokaler agei, setae dujoner kothai achhe!
Deleteক্রিকেট ক্যাকোফোনির লেখাটা পড়লাম, ওটাও খুব ভালো। আজকের আজকালে পড়লাম সন্দীপ পাটিল আসেননি ইন্টারভিউ দিতে। ইসস্
DeleteWell said! Amar jibon tao Oi 5 Jon cricket charar por ektu onyorokom! Interest ta ache kintu attachment ta nai
ReplyDeleteসে কী প্রাদেশিক উত্তেজনা! ekebare sothik bornona
ReplyDelete:)
DeleteAnoboddo lekha hoyeche dada khub sundar anek purono katha mone koriye dilen . tokhon ami class six :)
ReplyDeleteAmi class seven! :)
Deleteশুধু ওই বার নয়। ২০০২ সালেই কিন্তু ভারত শেষ অনেক গুলো কাউন্টি ম্যাচ খেলে। তবে আমার মনে আছে নরফোকের ডিউকের দলের বিরুদ্ধে খেলা ওয়ানডে সিঙ্গল ইনিংস ম্যাচ টার পর ভারত আজ অবধি কোনো ওয়ানডে সিঙ্গল ইনিংস ম্যাচ খেলেনি।
ReplyDeleteমজার ব্যাপার সৌরভ গাঙ্গুলীর প্রথম টেস্ট উইকেট নাসের হুসেন। লর্ডসে। ২০০২ ন্যাটওয়েস্ট মনে পড়ে?
Ekdom. Nusser ar Dada r modhye ei connection ta prothom thekei achhe!
ReplyDelete