Sunday, July 24, 2016

আবার বছর চোদ্দ পরে

ছোটবেলায় প্রায় সবাইকেই ক্লাসের বাংলা স্যারেদের দাবী অনুযায়ী ‘বিজ্ঞান আশীর্বাদ না অভিশাপ’, এই বিষয়ে রচনা লিখতে হয়েছে। কেউ রচনা বই থেকে গাঁতিয়ে নামিয়েছে, কেউ আবার নিজের মনের মাধুরী মিশিয়ে পারমাণবিক শক্তির উপকারী বা ধ্বংসাত্মক দিক নিয়ে তিন-চারশো শব্দ নামিয়েছে! সে যাই হোক, এইসব লেখার অধিকাংশেরই মূল বক্তব্য হত এটাই যে সহজে বিজ্ঞানকে শুধু আশীর্বাদ বা অভিশাপ বলা যায় না। আজকাল আরোই সেটা বুঝতে পারি।
এই যে ধরুন ফেসবুক আর হোয়াটস্যাপ বলে ধাড়িদের খেলার জন্য দুটো খেলনা বানানো আছে সেগুলোর দোষগুণের তো ঘাটতি নেই। একদিকে সেগুলো লোকজনকে বানিয়ে দিচ্ছে কুঁড়ে, লোকে ফেসবুক করতে গিয়ে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে বই থেকে, কমে যাচ্ছে মনঃসংযোগের ক্ষমতা। কিন্তু তাঁর সঙ্গে সঙ্গে এটাও অস্বীকার করার জায়গা নেই যে, কোন বক্তব্য প্রচারের জন্য বা বিভিন্ন লোকের সঙ্গে সহজে যোগাযোগ করার জন্য ফেসবুক, টুইটার বা হোয়াটস্যাপের তুলনা নেই। বিশেষ করে স্কুলের পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে।
আসলে গত সাত দিন ধরে, বালিগঞ্জ রাষ্ট্রীয় উচ্চ বিদ্যালয় বা ‘বিজিএইচএস’এর আমাদের ব্যাচের বন্ধুরা একটা হোয়াটস্যাপ গ্রুপ বানিয়ে আড্ডা মারছি। এই অসাধারণ অভিজ্ঞতাটা  ঠিক লিখে বোঝানো খুব শক্ত! ধন্যবাদের অনেকটাই যাওয়া উচিত তমালের কাছে, গ্রুপটা খোলার জন্য এবং অবশ্যই কৌশিকের কাছে, যে ভদ্র বালক স্কুলের প্রায় সব বন্ধুদের ফোন নম্বর নিজের ফোনের কন্ট্যাক্ট লিস্টে নিয়ে বসে ছিল!
ব্যাস্‌... আর কী! বিভিন্ন বন্ধুদের অ্যাড করে সারাদিন ধরে আড্ডা চলছে। দিনে হাজার হাজার কমেন্টস! আজকাল কে কী করছে, চারদিকে কী চলছে, কে কে জীবিত বনাম কে কে বিবাহিত, যারা আরো একধাপ এগিয়ে গেছে তাদের খোকা-খুকুদের ছবি... কিচ্ছু বাদ নেই। আর স্কুলের পুরনো গল্প! কত ঘটনা, কত দুষ্টুমি, কত বাওয়াল! সেটাই তো আসল আকর্ষণ!
(ছবিটা গ্রুপে কে শেয়ার করেছিলি মনে নেই)
কোন স্যার ক্লাস নাইনে কার চুল আঁচড়ে দিয়েছিলেন, কে পাঁচিল টপকে বল আনতে গিয়ে আর ফিরতে পারেনি বলে জামা থেকে স্কুলের ব্যাচ খুলে পুরো সেকেন্ড হাফ রাস্তায় রাস্তায় ঘুরেছিল, কবে ফিজিক্স ল্যাবে থার্মোমিটার ভেঙে পারদের বল মেঝেতে গড়াগড়ি যাচ্ছিল, কোন গল্পই বাদ নেই।
আর স্কুলের গল্পে স্যারেরা তো আসবেনই। ফ্রেন্ডলি স্যার, চাপের স্যার, স্টাইলিশ স্যার, মারকুটে স্যার, পাংচুয়াল স্যার, ভীতু স্যার, রাগী স্যার এবং হেডস্যার... কেউ বাদ যাচ্ছেন না! কোন স্যারের ডাকনাম কী ছিল, কার ক্লাসে সুদীপ্ত অজ্ঞান হয়ে গেছিল, কে পরীক্ষার আগে ৬৫টা রচনার সাজেশান দিতেন, কোন স্যারের ক্লাস মানেই ডিফেক্টিভ থার্মোমিটারের অঙ্ক করতে হত, কোন স্যার হাজরা মোড়ে টিউশানের আগে লুকিয়ে এগ রোল খেতেন, কার ক্লাস কেটে ক্রিকেট খেলা হত কিচ্ছু বাদ যাচ্ছে না!
এটা একটা পুরো অন্যরকমের আনন্দ! এক-একটা গল্প হচ্ছে আর ছোটবেলাটা যেন ঠিক চোখের সামনে আর একবার ভেসে উঠছে। সুনীলবাবুর ক্লাসে ‘মামু’ দেওয়াল লিখনের লেখক কে ছিল, সেই গল্পের সময় মনে পড়ে যাচ্ছে, সেদিনে ক্লাসের কোথায় দাঁড়িয়েছিলাম (পুরো ক্লাসকে বসতে দেওয়া হয়নি কিনা!)।
আজ স্কুল অনেক বদলে গেছে। অনেক উন্নতি হয়েছে স্কুলের। তিনতলা বিল্ডিং, সত্যজিৎ রায় সভাগৃহ, পেছনের বন্ধ থাকা ঘরগুলো নতুন করে সাজিয়ে তুলে ফাইন আর্টস সেকশান। ঐ ভাঙা বাসগুলো নেই, গোপালদার ক্যান্টিন নেই, আর নেই আমরা। আমরা এখন কেউ কলকাতায়, কেউ হলদিয়ায়, কেউ মুম্বাইতে, কেউ জার্মানীতে, অনেকেই আমেরিকায়। কিন্তু আমাদের সকলের মনের মধ্যে কোথাও একটা ‘বিজিএইচএস’ লুকিয়ে আছে। তাই সেখানে বারবার ফিরে যেতে ইচ্ছে করে, তাই সে স্বপ্নে ফিরে ফিরে আসে, তাই এতদিন পরেও হঠাৎ বানানো একটা হোয়াটস্যাপ গ্রুপে সবাই কাজের ফাঁকে সেই ছোটবেলার মতই আড্ডা মারে।

সবাই এখন খুব ব্যাস্ত। হয়তো কদিন পরে নতুন উৎসাহটা থিতিয়ে গেলে গ্রুপটা ঝিমিয়ে পরবে, মাঝে মধ্যে পোস্ট হবে। বেশীরভাগ সময়ই পোস্ট হবে অন্যান্য গ্রুপের থেকে ফরোয়ার্ডেড ছবি আর ভিডিও কিন্তু এই কদিনের আড্ডা বুঝিয়ে দিয়েছে যে আমরা বন্ধুরা একে অপরের থেকে খুব দূরে নেই। আর তাই যেকোন সময়ই চলে আসতে পারবো এই গ্রুপে আড্ডা মারতে ঠিক সেই যেমন স্কুলে টিফিনের সময় বা ছুটির পর সবাই মিলে চলে যেতাম বটগাছ তলায়। 

7 comments:

"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”