পর্ব - ১ পর্ব - ২ পর্ব - ৩ পর্ব - ৪ পর্ব - ৫ পর্ব - ৬
(আগে যা ঘটেছে)
জলদাপাড়া
সেই লড়ুকে গন্ডার
লোলেগাঁও থেকে গরুমারা
অবধি সেই গা ছমছম করা জঙ্গুলে পথের পর গরুমারা থেকে জলদাপাড়ার রাস্তা নেহাতই
নিরামিষ। মূর্তি নদীর ব্রিজ টপকে, বিভিন্ন চা বাগান দুপাশে রেখে হাইওয়ে ধরে রাস্তা
চলল জলদাপাড়ার দিকে। মোটামুটি ঘন্টা দুয়েকের মধ্যেই আমরা পৌঁছে গেলাম জলদাপাড়া
টুরিস্ট লজ।
অনেকটা বড় জায়গার
মধ্যে বানানো চমৎকার টুরিস্ট লজ। মেন বিল্ডিঙয়ের সামনে কাঠের বারান্দায় উঠে চারদিক
দেখে মন ভালো হয় গেল। শুধু তাই নয়, এরপর যা ঘটল তাতে প্রসন্নতার পরিমাণ এতটাই বেড়ে
গেল যে বলার নয়।
ঘর আগেই বুক করা ছিল
তাই সেটা নিয়ে চিন্তা ছিল না, আসল চিন্তা ছিল হাতির পিঠে চেপে জঙ্গল দর্শন হবে
কিনা সেই নিয়ে। প্রথমে জিজ্ঞেস করতেই রিশেপসানের লোকজন বলে উঠলেন, “না না হবে না,
এখন প্রচুর রাশ!” তারপর একজন হঠাৎ বললেন, “আপনারা কতজন?”
“দুজন” বলতেই তাঁদের
মধ্যে চাঞ্চল্য দেখা দিল। বললেন, “ওহ্ দুজন! হ্যাঁ, তাহলে হয়ে যাবে। দুজনের মতই
জায়গা আছে। তবে অন্য একটা কাপলের সঙ্গে শেয়ার করতে হবে, চলবে তো?”
আলবাত চলবে। জলদাপাড়ায়
এসে হাতিতে সাফারি করার জন্য যে কোন কিছুর সঙ্গেই মানিয়ে নেওয়া যায়। সুতরাং আপত্তি
নেই বলার সঙ্গে সঙ্গেই একটা সরকারী ফর্ম পেয়ে গেলাম আমাদের ডিটেলস্ দেওয়ার জন্য।
রিশেপসানের লোকজন তখন বলাবলি করছেন আমাদের সৌভাগ্যের কথা। একজন জানালেন, “আপনারা
মোর দ্যান লাকি। অনেক পার্টিই তিনদিন ধরে বসে আছেন, আমরা হাতির বুকিং করে দিতে
পারছি না।” আর একজন বললেন, “আপনাদের ২০১৫ দারুণ শুরু হতে যাচ্ছে।”
দ্বিমত হওয়ার জায়গাই
নেই, তাই ওনাদের ধন্যবাদ জানানো ছাড়া আমাদের আর কিছুই করার ছিল না। সেইসঙ্গে সেদিন
রাতের ইয়ার-এন্ড পার্টির কথাও জানলাম। ৭০০ টাকার বিনিময়ে লাইট-এন-সাউন্ড শো, বন
ফায়ার, সাঁওতালি নাচ আর স্পেশাল ডিনার। সেটাতেও নাম লিখিয়ে ফেললাম আমরা।
এই প্রসঙ্গে জলদাপাড়া
টুরিস্ট লজের কর্মচারীদের কথা একটু বলে রাখি। একটা সরকারী হোটেলে যে এত হেল্পফুল
এবং ফ্রেন্ডলি লোকেদের সঙ্গে আলাপ হতে পারে ভাবাই যায় না। মোটামুটি সব হোটেলেই
আমরা ভালো ব্যবহারই পেয়েছি কিন্তু জলদাপাড়া টুরিস্ট লজে এসে যে ব্যবহারের সাক্ষী
রইলাম সেটা সত্যিই মনে রাখার মত। প্রত্যেকেই মিশুকে, হাসিখুশি, দেখা হলেই জমিয়ে
গল্প করেন, নিজেদের মত করে খোঁজ নেন প্রত্যেক টুরিস্টের। ঘোরাঘুরি, খাওয়া-দাওয়া সব
দিকে তাঁদের নজর। টুরিস্ট লজ থেকে আশেপাশের বেশ কিছু জঙ্গলে যেমন জয়ন্তী, বক্সার,
রাজা-ভাত-খাওয়া ডে-ট্রিপের ব্যবস্থা করা হয়, সেগুলোতেও তাঁরা পুরো দস্তুর সহযোগিতা
করেন, টিপস্ দেন। সব মিলিয়ে দারুণ কিছু মনে রাখার মত মানুষ।
তবে পৃথিবীর নিয়মই হল
ভালো আর খারাপের পাশাপাশি সহাবস্থান। সুতরাং খারাপের গল্পটাও সময় মত করা যাবে।
কিন্তু তার আগে আমরা একতলার ১০৭ নম্বর ঘরে গিয়ে চেক-ইন করলাম। পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন
ঘর, বড় বাথরুম, পেছন দিকে ঘরের লাগোয়া বারান্দা। খুবই ভালো ব্যবস্থা।
আমরা ঘরে আমাদের
ব্যাগ-স্যুটকেস সব গুছিয়ে রেখে একটু হাঁটতে বেরোলাম সামনে থেকে। এদিক-ওদিক ঘুরে
যখন হোটেলে ফিরছি দেখলাম যে, হোটেলের কর্মচারীরা আমাদেরই খোঁজাখুঁজি করছেন। আমাদের
দেখে জিজ্ঞাসা করলেন, আর একটি বয়স্ক পরিবার এসেছেন, তাঁদের একতলার ঘরটি ছেড়ে দিয়ে
দোতলায় ঠিক ওপরের ঘরটা নিতে আমাদের আপত্তি আছে কিনা। আপত্তির প্রশ্নই ওঠে না। আমরা
মিনিট পাঁচেকের মধ্যে আমাদের জিনিস-পত্র গুছিয়ে নিয়ে ১০৭-এর বদলে ২০৭ নম্বর ঘরে
চলে গেলাম। লজের ছেলেগুলোও সাহায্য করল জিনিস বয়ে নিয়ে যেতে। তারপর স্নান-টান
করেছি। দুপুরে ভাত-ডাল-আলুভাজা-আলুপোস্ত- ডিমের ডালনা খেয়ে ঘরের সামনের বারান্দায়
দাঁড়িয়ে নিজেদের ছায়াছবি, টুরিস্ট লজের ভিতরেই সামনের পার্কের ছবি এইসব তুলে
টাইম-পাস করেছি। তারপর বিকেলে আবার বেরোতে গিয়ে দেখি আমার জ্যাকেটটা নেই! নেই তো
নেইই। আমার সখের কালো রঙের জ্যাকেট, যদিও সস্তার, ওয়ালমার্টের ডিসকাউন্টে কেনা,
তবু পছন্দের জিনিস। অনেক খুঁজেও যখন পাওয়া গেল না, তখন মনে হল, জ্যাকেটটা হয়তো ১০৭
নম্বর ঘরে ফেলে এসেছি।
নিজেরা গিয়ে নক করতে
কেমন-কেমন লাগছিল তাই টুরিস্ট লজেরই একটি ছেলেকে জ্যাকেটটার কথা বললাম। সে এক
কথাতেই বলল, “চলুন আমি গিয়ে দেখছি।”
১০৭-এর সামনে গিয়ে
দেখলাম, দরজাটা ভেজানো, ভেতরে আলো জ্বলছে। আমাদের সঙ্গের ছেলেটি কলিং বেল বাজাতেই
ভেতর থেকে বয়স্ক মহিলা কন্ঠে আওয়াজ এল, “কী চাই? ডিস্টার্ব করবেন না!”
ছেলেটি বলল, “আপনারা
কি ঘরে কোন জ্যাকেট পেয়েছেন?”
“না না। বললাম তো
ডিস্টার্ব করবেন না। জ্যাকেট-ফ্যাকেট পাইনি। যত্তসব!”
ছেলেটি আমাদের দিকে
করুণ মুখে তাকালো। তো আমরা বললাম, “চলুন, কাটি। কী আর করা যাবে!”
পিউ বলল, “বাব্বাহ্!
মহিলা কী রুড!”
ছেলেটি বলল, “কী আর
করব বলুন, সবাইকে নিয়েই চলতে হয়। সরি আপনাদের জ্যাকেটটা পাওয়া গেল না।”
বললাম, “কী আর করা
যাবে। সাহায্যের জন্য ধন্যবাদ। আমি রিশেপসানে গিয়ে দেখি।”
ছেলেটিও বলল যে,
রিশেপসানে বলে রাখলে পরে কোথাও পাওয়া গেলেও ওনারা দিয়ে যাবেন।
আমি আর পিউ রিশেপসানে
গিয়ে ওনাদের বললাম জ্যাকেটের কথা। তখন ওখানে আমাদের বয়সী একটি মেয়ে দাঁড়িয়ে কিছু
একটা ফর্ম ফিলাপ করছিল। আমাদের কথোপকথন শুনে হঠাৎ বলল, “কালো জ্যাকেট হারিয়েছেন
কি? আমাদের ঘরে একটা কালো জ্যাকেট ছিল!”
সম্ভবত সেটার কথাই
হচ্ছে এটা বলায় মেয়েটি একজন বয়স্ক ভদ্রলোককে ডেকে বলল, “বাবা, ঐ জ্যাকেটটা এনার।
ওনাকে ঘরে নিয়ে গিয়ে দিয়ে দাও না।”
আমি আর পিউ সেই ভদ্রলোকের
সঙ্গে হাঁটতে হাঁটতে ওনার ঘরের দিকে গেলাম। রাস্তায় ভদ্রলোক বললেন, “হ্যাঁ, ওটা
আমি যত্ন করে পাট করে রেখেছি। আমার মনেই হয়েছিল, আগে যাঁরা ছিলেন তাঁদেরই হবে।”
কথা বলতে বলতে আমরা ওনার ঘরের সামনে পৌঁছলাম। ১০৭ নম্বর ঘরই সেটা! ভদ্রলোক আমাদের
বাইরে দাঁড় করিয়ে রেখে ঘরে গিয়ে আমার কালো জ্যাকেটটা নিয়ে এলেন।
মানবচরিত্র কত বিচিত্র
সেটা বিশ্লেষণ করতে করতে আমি আর পিউ ওখান থেকে কেটে পড়লাম। প্রথমে অবশ্য ঐ
কর্মচারী ছেলেটিকে পাকড়াও করে তাকে ঘটনাটা বললাম, হাসাহাসি করলাম।
আগেই বলেছি টুরিস্ট
লজটা অনেকটা জায়গা নিয়ে বানানো। সামনে অফিস, রিশেপসান, ডাইনিং রুম ইত্যাদি। তার
সঙ্গে লাগোয়া উড ব্লক এবং ব্রিক ব্লক। পেছনে আট-নটা আলাদা আলাদা কটেজ। আর ঐ উড
ব্লক আর ব্রিক ব্লকের সামনে অনেকটা খোলা জায়গা বানানো একটা বাগান। সেখানে বিভিন্ন
গাছপালা ছাড়াও নানা রকমের জন্তু-জানোয়ার, পাখী, সাপ ইত্যাদির মাটির মডেল বানানো।
সেই জায়গাটাই রাত্তিরের ইয়ার-এন্ড পার্টির জন্য সাজানো হচ্ছিল। রংবেরঙের আলো,
স্টেজ, চেয়ার-টেবিল লাগানো হচ্ছিল। এক জায়গায় দেখলাম, বড়-বড় গাছের ডাল দিয়ে মস্ত
বড় একটা বন-ফায়ার সাজানো হচ্ছে। বুঝলাম সন্ধ্যেবেলা ভালোই হইচই হবে।
আমাদের খুব একটা উৎসাহ
যদিও ছিল না। বুঝতেই পারছেন বন্ধু-বান্ধব ছাড়া শুধু দুজনে কি আর পার্টি হয়। অনেকে
দেখলাম বিশাল বড় গ্রুপ বানিয়ে ছটা থেকে নিচে বসে গেছে আড্ডা মারতে। আমরা মোটামুটি
সেজেগুজে সাড়ে সাতটার পর নিচে গেলাম। আমাদের চারদিকে অনেককে দেখেই তখন মনে হচ্ছে
যেন তাদের মাথার মধ্যে “রুনুঝুনু নূপুর বাজছে।” হাসিগুলো কিঞ্চিৎ বেহিসেবী, পদযুগল
টলছে। এইরকমই এক মহিলার সঙ্গে পিউয়ের পরে চেয়ার নিয়ে ঝামেলা লাগে। ফেসবুকের সূত্রে
সে গল্প অনেকেই জানে। তবে মূল ব্যাপারটা হল, পার্টির মাঝামাঝি সময় যখন লোকের
সংখ্যা চেয়ারের চেয়ে অনেক বেশী তখন আমি আর পিউ অনেক কষ্টে একটা চেয়ার যোগাড়
করেছিলাম। এরপর আমি আরও একটা চেয়ার খুঁজছি এমন সময় এক মহিলা পিউর কাছে এসে পিউয়ের হাতের
চেয়ার ধরে টান লাগান, এর পরের কথোপকথনঃ
পিউ – কী ব্যাপার?
মহিলা – চেয়ারটা আমি
নিই...
পিউ – মানে?
মহিলা – হ্যাঁ... নিই
না...
পিউ - এটা তো আমি আর
আমার হাজব্যান্ড খুঁজে আনলাম।
মহিলা – তো কী
হয়েছে... আরও একটা খুঁজে আনো!
পিউ – এক্সকিউজ মি...
মহিলা – ওহ্ দেবে না!
দিলে পারতে!
বলে মহিলা নিজেদের
দলবলের কাছে ফিরে গেলাম। পরে শুনলাম নিজেদের মধ্যে খুব ‘সো রুড’, ‘হাউ ডেয়ার শি’
এসব চলছে।
আধা ঘন্টা পর আবার সেই
মহিলার আবির্ভাব। ততক্ষণে লোক একটু কমেছে। অনেক চেয়ারই ফাঁকা। মহিলা নিজে একটা
চেয়ার নিয়েছেন, তারপর আমাদের কাছে এসে বললেন, “তখন দিতেই পারতে... এখন অনেক
চেয়ার...”
আমি “হ্যাঁ... হ্যাঁ”
করে কাটিয়ে দিচ্ছিলাম হঠাৎ সেই মহিলার মেয়ে, ঐ ক্লাস নাইন-টাইনে পড়ে বোধহয়, এসে
ভয়ানক বাওয়াল দিতে শুরু করল। পিউকে উদ্দেশ্য করে, “ ইউ ওয়ার রুড, ডিসরেসপেক্টফুল”
ইত্যাদি বলা শুরু করল। পিউও জবাব দিচ্ছিল। সেই যাকে বলে “উনকা এক এক সওয়াল, হামারা
দো দো জবাব...”
আমি চুপচাপ দেখছিলাম
কদ্দুর গড়ায় ব্যাপারটা। এমন সময়ে ভদ্রমহিলার স্বামী টলতে টলতে এসে হাজির হলেন,
এসেই, “ওকে ওকে... চিল... আমার মেয়ে আপনাদের বোনের মত (প্রথমে বলেছিলেন মেয়ের মত,
তারপর বোধহয় বুঝেছিলেন যে আমরা অতটাও বয়স্ক নই)... ছেড়ে দিন। এনজয় করুন” বলে আমার
আর পিউয়ের হাত ধরে খুব করে “হ্যাপি নিউ ইয়ার উইশ” করে বউ-মেয়েকে নিয়ে সেখান থেকে
কেটে পড়ল।
এসব বাজে ঝামেলা বাদ
দিলে সন্ধ্যেটা ভালোই কাটল। লাইট-সাউন্ডের শো বেশ ভালো ছিল। বিশেষ করে বাচ্চাদের
খুব ভালো লাগবে। সামনের মাঠের ঐ মাটির মডেলগুলোতে আলো ফেলে দেখানো হল, আর তার
সঙ্গে ধারাভাষ্যের কন্ঠস্বরটা ছিল সব্যসাচী চক্রবর্তীর। বেশ যত্ন নিয়ে বানানো শো। যদিও
সাঁওতালী নাচটাও বেশ ক্যাওড়ামি হল। কিছু মাতাল জনতা নাচতে শুরু করে দেওয়ায় ঠিকঠাক
সাঁওতালী নাচটাই হল না।
এসব দেখে আমরাও আর রাত
না বাড়িয়ে মোটামুটি তাড়াতাড়িই খেয়ে নিয়ে ঘরে চলে এলাম। পরদিন সকালে ওঠার ব্যাপারও
ছিল।
পয়লা জানুয়ারী
সকালবেলা লজ থেকে গাড়ী নিয়ে রওয়ানা হলাম পাশের জঙ্গলে হলং বাংলোর উদ্দেশ্যে। সেখান
থেকেই পাওয়া যাবে হাতি। হলং যাওয়ার পথে চোখে পড়ল সদ্য ধরা পড়া একটা বাচ্চা হাতি।
আমাদের সঙ্গে আলাপ করতে প্রায় গাড়ীর মধ্যে শুঁড় ঢুকিয়ে দিয়েছিল সে।
হলং গিয়ে জানা গেল যে
আগের ট্রিপ শেষ করে হাতিদের ফিরতে দেরী হবে। চারদিকে অনেকগুলো বাচ্চা, তাদের
বোঝানো হল যে, হাতিরা আগের রাত্তিরে নিউ ইয়ার পার্টি করেছে তাই তাদের সকালে উঠতে
দেরী হয়ে গেছে!
শেষ অবধি প্রায় মিনিট
পঁয়তাল্লিশ দেরীতে আমাদের যাত্রা শুরু হল। আমাদের হাতির নাম চম্পাকলি আর আমাদের
সঙ্গী তিনজন। মানে একটি দম্পতি এবং তাঁদের বছর তিনেকের পুত্র। সে তো হাতিতে চড়ে
খুবই উত্তেজিত। আরও জানা গেল যে, তার একটা খেলনা হাতি আছে, যাকে সে বাবাই হাতি বলে
ডাকে, তাই সে যে হাতিই দেখছে সেটাই তার বাবাই হাতি!
হাতির পিঠে চেপে অরণ্য
ভ্রমণ সত্যিই এক মনে রাখার মত জিনিস। এমনিতেই জিপের তুলনায় হাতির পিঠে চেপে ঘোরার
সুবিধা অনেক বেশী। কারণ জিপ যেখানে অপেক্ষাকৃত ফাঁকা জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে ঘোরে হাতি
সেখানে বেশ অনেকটাই ঘন জঙ্গলে চলে যেতে পারে। গাছের ডালপালা ভাঙ্গতে ভাঙ্গতে, উঁচু
নীচু রাস্তার মধ্যে দিয়ে, ছোট ছোট ঝোরা পার হয়ে হাতি এগিয়ে চলে। সে এক দারুন
ব্যাপার।
আমরাও এগিয়ে চললাম
গাছপালার মধ্যে দিয়ে। প্রথম কিছুক্ষণ ময়ূর আর অন্যান্য পাখী ছাড়া কিছু চোখে পড়েনি।
এরপর আমরা পৌঁছলাম লম্বা লম্বা ঘাসের বনে। জঙ্গলের মধ্যে অনেকটা ফাঁকা জায়গা জুড়ে
সেই লম্বা ঘাসের বন আর সেখানেই কিছুটা এগোতে দেখতে পেলাম সেই গন্ডারটাকে। এক
জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে ছিল। কাছাকাছি গিয়ে দেখলাম, তার শরীরে জায়গায় জায়গায়
রক্তের দাগ। আমাদের মাহুত জানালো যে, সম্ভবত ঐ গন্ডারটা অন্য কোন গন্ডারের সঙ্গে
মারামারি করেছে একটু আগে। এগুলো তারই আঘাতের চিহ্ন। ততক্ষণে আরও দুটো হাতি তাদের
সওয়ারীদের নিয়ে এসে পৌঁছে গেছিল। অত কাছ থেকে গন্ডার দেখা একটা বিরল অভিজ্ঞতা
সুতরাং ছবি তোলা হল প্রচুর।
এর পর আমরা পর পর দুটো
হরিণ দেখলাম। প্রথমটা চিতল হরিণ, পরেরটা সম্বর। দুটোই আমাদের দেখে ঐ ঘাসের ফাঁকে
নানাভাবে লুকোচুরি খেলে শেষ অবধি বিদায় নিল। যদিও ছবি তোলার অনেক সুযোগই তারা
দিয়েছিল। এইভাবেই আমাদের মিনিট পঁয়তাল্লিশের অরণ্য ভ্রমণ শেষ হল। আমরাও ফিরে গেলাম
আমাদের টুরিস্ট লজে।
এরপর সারাদিন হোটেলেই
ল্যাধ খেলাম। গত দশ দিন ধরে ঘোরার পর আমাদের খুব বেশী এনার্জি অবশিষ্ট ছিল না। আর
বিট্টুকেও যে ঠিক পছন্দ হচ্ছিল না সে তো জানেনই। একটা দিন জলদাপাড়ায় নিজেদের মত
কাটিয়ে পরদিন বেলার দিকে রওয়ানা হলাম নিউ জলপাইগুড়ির জন্য। সেদিন বিকেল-সন্ধ্যেটা
ওখানেই কাটাতে হবে। আমাদের ফেরার ট্রেন পরদিন মানে তিন তারিখ সকাল সাড়ে পাঁচটায়।
আমাদের ঘোরার গল্প
এখানেই প্রায় শেষ। তবে শেষ মজার গল্পটা লিখেনি। জলদাপাড়া টুরিস্ট লজের নিয়ম
অনুযায়ী সকালে প্রাতরাশে এক প্লেট লুচি-তরকারি বা পাঁউরুটি-মাখন-জ্যাম খেলে
অতিরিক্ত পয়সা লাগে না। কিন্তু অন্য কিছু খেলে সেটার দাম আলাদা করে দিতে হয়। ফেরার
দিন আমি আলাদা করে এক প্লেট ফ্রেঞ্চ টোস্ট খেয়েছিলাম। আলাদা করে তার দাম ষাট টাকা
ধরাও হয়েছিল। এরপর আমরা চেক আউট করে সব পয়সা মিটিয়ে বেরিয়ে গেছি। টুরিস্ট লজ থেকে
আমাদের সব খরচের লিস্ট করে বিলও দিয়ে দেওয়া হয়েছে। তখন আর ভালো করে দেখিনি।
নিউ জলপাইগুড়ির হোটেলে
বসে সন্ধ্যেবেলা কী মনে হল, বিলটা নেড়েচেড়ে দেখছিলাম। হঠাৎ খেয়াল করলাম যে, সকালের
ঐ ফ্রেঞ্চ টোস্টের ষাট টাকা বিলে যোগ করা হয়নি। ফোন করলাম জলদাপাড়া টুরিস্ট লজে।
যিনি ফোন ধরেছিলেন তাকে বললাম যে, আমি আজ সকালেই চেক আউট করেছি, এখন বিলে দেখলাম
ষাট টাকা কম ধরা হয়েছে। উনিও শুনে বললেন যে, এটা ওনাদেরও চোখে পড়েছে, বিল করার সময়
কোনভাবে বাদ পড়ে গেছিল।
আমি জিজ্ঞেস করলাম,
“কোনভাবে কি অনলাইন টাকা ট্রান্সফার করে দেওয়া যায়?”
উত্তর পেলাম, “আপনি যে
ফোন করে ঐ টাকাটা দিতে চেয়েছেন ওটাই আমাদের প্রাপ্তি। আবার আসবেন।”
এর পর কি আর কিছু বলা
যায়। ধন্যবাদ জানিয়ে ফোন নামিয়ে রাখতে হল। তার আগেই আমি আর পিউ ঠিক করেছিলাম যে,
ভবিষ্যতে আবার যাব জলদাপাড়ার টুরিস্ট লজে। এই ঘটনার পর সেটা নিশ্চিত করে ফেললাম।
ইচ্ছে আছে ২০১৬-এ আর একবার জলদাপাড়া গিয়ে ওর আশেপাশের সমস্ত অভয়ারণ্যগুলো দেখে
ফেলার।
আমাদের উত্তরবঙ্গ
ভ্রমণের গল্প এখানেই শেষ। প্রায় দু সপ্তাহ লম্বা এই ট্রিপে অনেক নতুন নতুন জায়গায়
গেছি, নতুন মানুষের সঙ্গে মিশেছি, আলাপ করেছি, আড্ডা মেরেছি। প্রকৃতির অনির্বচনীয়
শোভা দেখে মুগ্ধ হয়েছি। আর মুগ্ধ হয়েছি ওখানকার পাহাড়ী মানুষগুলোর সারল্যে আর
হৃদয়ের উষ্ণতায়। মনে রাখব আমাদের দার্জিলিঙয়ের ড্রাইভার বিকাশকে, পাহাড়ী সোলের
বারান্দার জানলার কাঁচে কাঞ্চনজঙ্ঘার প্রতিবিম্বকে, কালিম্পঙের ডেলো পাহাড়ের
ঠান্ডা হাওয়াকে, লোলেগাঁওয়ের সেই কাঠের ফুটব্রিজকে এবং অবশ্যই গরুমারা আর
জলদাপাড়ার জাতীয় উদ্যানকে। এতদিন লোক মুখে শুনেছি, এখন নিজেরাও উপলব্ধি করলাম... জঙ্গলের
নেশা বড় সাংঘাতিক নেশা, একবার গিয়ে থামা কঠিন। তাই আবার হয়তো কখনো বেরিয়ে পড়ব
উত্তরবঙ্গের জঙ্গল-পাহাড়ে উদ্দেশ্যে আর ততদিন ২০১৪র এই শেষ কয়েকটা দিনের স্মৃতিই
থাকবে আমার জীবনের এক মূল্যবান সম্পদ হয়ে।