***১***
সকালে অফিস যেতে
গিয়ে এমনিতেই বেশ দেরি হয়ে গেছিল।
অনেক কষ্টে বেশ
কিছুটা ছোটাছুটি করে একজন ট্যাক্সিওয়ালাকে সল্টলেক নিয়ে যাওয়ার লোভ দেখিয়ে রাজী
করিয়ে সস্ত্রীক তাঁর ট্যাক্সিতে উঠে বসলাম। আমাদের মাথার ওপরে বসেরা আছেন, তাই
আমাদের অফিস যাওয়ার তাড়া আছে। কিন্তু উনি মুক্ত পুরুষ, তাই ওনার কোন তাড়া নেই। আমরা
বসার পর ভদ্রলোক একটা হাই তুললেন, তারপর আড়মোড়া ভাঙলেন। তারপর যেই আমরা আশাবাদী
হচ্ছি যে, উনি এবার ইঞ্জিনটা স্টার্ট করবেন তখনই ফস্ করে একটা ধূপকাঠি জ্বালালেন।
তারপর ভক্তি ভরে দেড়খানা হাতে (এক হাতে ধূপ, অন্য হাত সেই হাতের কনুইয়ে) উনি ধূপ
দেখাতে লাগলেন। প্রথমে ট্যাক্সির মিটারকে প্রায় ৩০ সেকেন্ড! তারপর কালীঘাটের
মাকালীর ছবিতে, হনুমানজির মূর্তিতে, তাদের পেছনে রাখা কিছু মাদুলি-তাবিজকে,
স্পিডোমিটার আর ফুয়েল ইন্ডিকেটরকে এমনকি স্টিয়ারিংটাকেও ধূপ দেখাবার পর যখন বুঝে
গেছি যে এবার আমাকে আর গিন্নিকেও ধূপটা দেখিয়ে ছাড়বেন ভদ্রলোক তখন আমার স্বপ্নে জল
ঢেলে ভদ্রলোক ধূপটা মিটারের নিচে গুঁজে দিয়ে গাড়ী স্টার্ট করলেন!
দুগ্গা দুগ্গা!!
জন্ম-মৃত্যু-বিবাহের
মতই জীবনের আর এক সত্য হল ট্যাক্সি রিফিউজাল! এই কলকাতা শহরে দাঁড়িয়ে কেউ যদি বলেন
যে, তিনি জীবনে কখনো কলকাতার ট্যাক্সিওয়ালাদের কাছে ‘যাবো না’ কথাটি শোনেননি তাহলে
তাঁকে কালটিভেট করুন কারণ এরকম নির্ভেজাল গুল দেওয়ার ক্ষমতা ভগবান খুব বেশী লোককে
দেননি।
কলকাতার
ট্যাক্সিওয়ালারা কোথায় যেতে চাইবেন সেটা অনেকটা ওই গেছোদাদা কোথায় থাকবেন সেটার
মতই জটিল। মানে ধরুন সল্টলেকের অফিস থেকে বেরিয়ে আপনি যেতে চাইলেন শ্যামবাজার
কিন্তু মাঝবয়সী ট্যাক্সিচালক পাটুলি ছাড়া যাবেন না। কিন্তু যেদিন পাটুলি যেতে
চাইবেন সেদিন তাঁরা পাটুলিকে গণ্ডগ্রাম বলে বাতিল করে দিয়ে যেতে চাইবেন এয়ারপোর্ট!
কলকাতার এই কোটি কোটি মানুষকে ট্যাক্সিওয়ালারা ধর্তব্যের মধ্যেই ধরেন না তাই দিনের
মধ্যে যেকোন সময়ে যেকোন জায়গাতে যেতে হলেই বলেন, “না দাদা, ওদিকে প্যাসেঞ্জার
পাওয়া যাবে না, যাব না।”
"নেহি যায়েগা... উবার বুলা লো!" সূত্রঃ ইন্টারনেট |
মাঝে মাঝে খুবই
গিল্টি ফিলিং হয় জানেন তো। এই যে ভদ্রলোক একটা চকচকে হলুদ রঙের ট্যাক্সি নিয়ে
কলকাতার বিভিন্ন ট্যাক্সি স্ট্যান্ডে বসে চা খেতে আর প্রকৃতির শোভা দেখতে
বেরিয়েছেন তাঁকে দৈনন্দিন পনেরো ঘন্টা বিশ্রামের মধ্যে যখন আমাকে নিয়ে পাচন গোলার
মত মুখ করে শহরের এ প্রান্ত থেকে ও প্রান্ত যেতে হয় তখন সত্যি বলছি নিজেকে খুবই
ছোট মনে হয়।
তবে ট্যাক্সি নিয়ে
আসল কথাটা বোধ হয় চন্দ্রিল লিখে গেছেন। ট্যাক্সিচালকের রিফিউজালের হতাশা আর
বিরক্তি থেকে আপনি যদি কোনদিন বলে ফেলেন, “চলুন দাদা, আজকে আপনার বাড়ি যাব।” তাহলে
ট্যাক্সিচালক দাদা একগাল হেসে বলবেন, “না দাদা, আজকে আমি মামার বাড়ি যাব!”
***৩***
ট্যাক্সি ড্রাইভারদের সঙ্গে গল্প নিয়ে বেশ কিছু
ভালো গল্প আছে স্টকে। তার কয়েকটা বেশ মজার আবার কয়েকটা মন ভালো করে দেওয়া গল্প।
বিশেষ করে আজকাল উবের-ওলার আমলে মিশুকে গপ্পোবাজ ড্রাইভারের সংখ্যা বেড়েছে বলেই
মনে হয়।
একবার অফিসের বন্ধুরা বাইরে ঘুরতে গেছিলাম।
ফেরার সময় হাওড়া স্টেশানে নেমে একটা উবের নিয়ে চারজন একসঙ্গে ফিরছি। ট্রেনে আমাদের
এক সহযাত্রী সারা সন্ধ্যে নাক ডাকিয়ে ঘুমিয়ে আমাদের যথেষ্ট বিরক্তি এবং হাস্যরসের
সাপ্লাই দিয়েছিলেন। সেই নিয়ে গল্প করছি, আগের বিভিন্ন অভিজ্ঞতা নিয়ে কথা হচ্ছে এমন
সময়ে আমাদের আলোচনার মধ্যে নিজের নাকটা গলিয়ে উবেরের চালক বললেন, “আমি স্যার ঘুরতে
যাওয়ার সময় সঙ্গে নস্যি নিয়ে যাই!”
আমাদের “নস্যি কেন?” প্রশ্নের উত্তরে ভদ্রলোক
জানালেন যে, ঘুরতে গেলে, বিশেষ করে ট্রেনে রাত কাটানোর ব্যাপার থাকলে এটাই তাঁর
ব্রহ্মাস্ত!
“বুঝলেন না, রাতে যদি ক্যুপে কেউ নাক ডাকে তাহলে
তার নাকের কাছে নস্যি নিয়ে গিয়ে হালকা ফুঁ দিলেই সেরাতের মত ঘুমের দফারফা! এবার
হেঁচে মরুক ব্যাটা!”
ভদ্রলোক আবার দাবী করলেন ওনার শেষ পুরীভ্রমনের
সময় এটা নাকি হাতেকলমে ব্যবহার করে সুফল পেয়েছেন। আমাদের সকলেরই মাঝেমধ্যে নাক
দেকে থাকে! তাই, এরকম ভয়ংকর সহযাত্রীর পাল্লায় পড়লে কী হতে পারে সেই ভেবে চারজনেই
বেশ ঘাবড়ে গেছিলাম।