এই লেখাটা খুব গম্ভীর বা
গভীর তত্ববোধক লেখা নয় (আমার কোন লেখাই বা হয়!)। অত্যন্ত অগোছালো একটি লেখা এবং এই লেখার মূল উদ্দেশ্য হল আমার
ছোটবেলার স্মৃতিচারণ। তবে এই লেখা পড়ে আর কেউ যদি তাঁদের ছোটবেলার পূজাবার্ষিকী
আনন্দমেলা নিয়ে নস্টালজিয়ায় ভোগেন তাহলে মন্দ কি?
প্রথমের ভূমিকার সঙ্গে
আরো একটু না লিখলে হয়তো ব্যাপারটা পরিষ্কার হবে না। গত কয়েক বছরে বহু লোকের সঙ্গে
সাহিত্য নিয়ে আড্ডায় পূজাবার্ষিকী আনন্দমেলার অধঃপতনের বিষয়টা অনেকবার ফিরে এসেছে।
বিশেষ করে আমার নিজের ৩০-৩২টি আনন্দমেলার সংগ্রহ থেকে খুব সহজেই বুঝতে পারি কিভাবে
৮০-এর দশকের দুর্লভ মণি-মুক্তোর মত আনন্দমেলার মান পড়তে পড়তে বর্তমানে তা
শুধুমাত্র কিছু মধ্য মানের গোয়েন্দা গল্প-উপ্পন্যাস সংকলনে পরিণত হয়েছে। আর সেই
আলোচনার ফলশ্রুতিই এই লেখা। বর্তমানের পূজাবার্ষিকী না হয় ভালো নয় কিন্তু ঐ সারা
জীবনের মত মনে রেখে দেওয়ার আনন্দমেলাগুলো নিয়ে কয়েক কথা লিখলে মন্দ কি?
আর সেখান থেকেই আজকের
লেখা যেখানে ফিরে দেখব বাংলা ১৩৯৪ সনের (ইংরেজি ১৯৮৭) শারদীয় আনন্দমেলার কিছু
লেখা।
প্রথমেই স্বীকার করে নিই
যে, ১৯৯২-এর আগের যে পূজাবার্ষিকীগুলো আমার কাছে আছে তা কলেজ স্ট্রিট এবং
গোলপার্কের বিভিন্ন পুরোন বইয়ের দোকান থেকে কেনা, এর ফলে কিছু কিছু বইয়ের অবস্থা
বেশ খারাপ। যেমন, ১৩৯৪-এর যে পূজাবার্ষিকীর কথা বলছি তার শুধুমাত্র ১৩ থেকে ৫১৮
পাতা অবধি দেখতে পাচ্ছি, প্রথম ১২ পাতা (যার অধিকংশই বিজ্ঞাপন এবং সূচিপত্র) এবং
শেষের কিছু পাতা নেই। তাই আমি জানি না, ১৯৮৭ সালে এই বইয়ের দাম কত ছিল বা সম্পাদক
কে ছিলেন।
তবে খুঁজে দেখলাম যে,
১৯৮৬-র পূজাবার্ষিকীর দাম ৩২ টাকা, সম্পাদক নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এবং ১৯৮৮-র
পূজাবার্ষিকীর দাম ৪০ টাকা, সম্পাদক অভীক সরকার। সহজেই বলা যায় যে ১৯৮৭-র
পুজোসংখ্যার দাম ৩৬ টাকা, তবে সম্পাদক কে ছিলেন নিশ্চিত হওয়া গেল না।
একবার দেখে নেওয়া যাক, কি
কি উপন্যাস ছিল ঐ পুজোসংখ্যায়...
সমরেশ বসুর ‘বিদেশী
গাড়িতে বিপদ’
বিমল করের ‘কালবৈশাখীর
রাতে’
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের
‘রাজবাড়ির রহস্য’
শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের
‘ঝিলের ধারে বাড়ি’
সমরেশ মজুমদারের ‘জুতোয় রক্তের
দাগ’
সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজের
‘সবুজ সঙ্কেত’ (যে উপন্যাসের একটি চরিত্রের নাম তপোব্রত!!)
সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের
‘ইতি তোমার মা’
শৈলেন ঘোষের ‘সোনালির
দিন’
এ তো গেল উপন্যাস, সঙ্গে
শঙ্কু কাহিনী ‘শঙ্কুর পরলোকচর্চা’, অসংখ্য গল্প, ৪টি বিদেশী কমিক্স, জ্ঞান-বিজ্ঞান,
খেলা নিয়ে একাধিক লেখা এবং সব শেষে সেই নিয়মিত ‘কী করে নম্বর বাড়াতে হয়’... সব
মিলিয়ে এক জমজমাট পুজোসংখ্যা!
প্রথমেই বলি, রাজবাড়ির
রহস্যের কথা। এটা কাকাবাবুর সুবর্ণযুগের লেখা। যে লেখা পড়ে কাকাবাবু বা পাঠক কারও
চোখেই জল আসে না। রাজবাড়ির রহস্য আমার সবচেয়ে প্রিয় তিনটি কাকাবাবুর উপন্যাসের
মধ্যে একটি। এরকম সহজ, সরল ভাবে লেখা কিন্তু একই সঙ্গে চরম উত্তেজনা, সব সময় একটা
কি হয় কি হয় ভাব, লেখাটাকে একটা অন্য মাত্রা দিয়েছে। গল্পের প্লটটাও অত্যন্ত
আকর্ষণীয় (ভুল-ভুলাইয়া সিনেমাটা ভাল না লাগার একটা কারণ ঐ প্লটের গল্প আগেই পড়েছি,
রাজবাড়ির রহস্যতে) আর সবচেয়ে বড় কথা, হিপনোটিজম, তান্ত্রিক, পুনর্জন্মের মত বেশ
কিছু অলৌকিক বিষয় থাকলেও উপন্যাসটাকে কখোনই গাঁজাখুরি বলে মনে হয় না, বরং শেষে
গল্পের দুষ্টু লোক গুরুদেবের জন্য খারাপই লাগে সবার।
এই গল্পের প্রথমদিকে
সন্তু কিন্তু ছিল না। শুধু কাকাবাবু আর দেবলীনা কেওনঝড়ের রাজবাড়ি গেছিল। জোজো আর
সন্তু কলেজের পরীক্ষা থাকায় গেছিল পরে। তখন অবশ্য রহস্য ঘনীভূত এবং শুধু শেষের
রহস্যোদ্ধার এবং দেবলীনা উদ্ধার পর্বেই কাকাবাবুর সঙ্গী ছিল সন্তু আর জোজো।
আর একটা উপন্যাস মনে দাগ
কেটে গেছিল এই পুজোবার্ষিকীর, ‘ইতি তোমার মা’, একেবারেই সঞ্জীব চট্টোপাধ্যায়ের
ঘরানার লেখা। অত্যন্ত আদর্শবাদী একটি পরিবার এবং তাঁদের কাছের কিছু লোকজন আর তার
সঙ্গে অত্যন্ত খারাপ কিছু লোকের সংঘাত এবং শেষ অবধি শুভবোধের জয় আর অশুভের পরাজয়।
খুবই প্রত্যাশিত, সরলরেখায় ঘটনা এগিয়েছে, কিন্তু যখন প্রথম পড়ি ছোটবেলায় তখন অত
কিছু ভাবতাম না, দারুণ লেগেছিল আর শেষটা পড়ে কষ্ট হয়েছিল খুব। তারপর দীর্ঘদিন সেই
কষ্টের কথা ভেবে উপন্যাসটা আর পড়িনি। সাম্প্রতিককালে পড়েছি, অত ভালো না লাগলেও
খারাপ লাগেনি।
বাকি গোগোল, অর্জুন,
কর্নেল কোন উপন্যাসই খারাপ লাগেনি, মুস্তাফা সিরাজের ‘সবুজ সংকেত’ উপন্যাসটা আর
একবার পড়ে ফেললাম এই লেখা লিখতে লিখতে। সেই বিজ্ঞানী চন্দ্রকান্ত, ডিটেকটিভ হালদার
আর ধুন্ধুমার নামক রোবটের গল্প।
বানী বসুর ‘জেগে ওঠো’
গল্পের কথা মনে আছে? সেই যে গল্পে পৃথিবীর নানা প্রান্তের ছোট ছোট ছেলে মেয়েরা কোন
দুঃখের বা হিংসার ঘটনা দেখলেই ঘুমিয়ে পড়ছিল চিরকালের জন্য। যে গল্পের শেষে ছিল
বিশ্বের সমস্ত রাষ্ট্রনেতাদের প্রতিশ্রুতি,
“আমাদের
বড় প্রিয় খোকাখুকুরা, মন দিয়ে শোনো। কোনও বিশ্বযুদ্ধই আর পৃথিবীতে হবে না। আমাদের
ধনসম্পত্তি আমরা সব ভাগ-বাঁটোয়ারা করে নিয়েছি। কোনও দেশ থেকে কোনও প্রদেশ বিচ্ছিন্ন
হওয়ার আর প্রশ্ন নেই। সমস্ত দেশের প্রতিনিধি দিয়ে আমরা বিশ্ব-রিপাবলিক গড়েছি।
আমাদের কোনও অভাব, কোনও অশান্তি নেই। ধর্ম নিয়েও আমরা আর মারামারি করি না। কোনও
কষ্টকর প্রতিযোগিতায় তোমাদের আর কোনওদিন নামতে হবে না। যে কাজটা করতে সবচেয়ে
ভালবাসো, সেটাই করতে দেওয়া হবে তোমাদের। শুধু একবার জেগে ওঠো তোমরা, জেগে উঠে
দ্যাখো, তোমাদের চারপাশের পৃথিবীটা কত সুন্দর! কী বিশাল! কী মহান! স্বর্গ যদি
কোথাও থেকে থাকে, তো, খোকাখুকুরা, সে এখানেই, এইখানেই, এইখানেই... ।”
আর ভালো লেগেছিল
আশাপুর্ণা দেবীর ‘পাড়ার ছেলে’, এনাক্ষী চট্টোপাধ্যায়ের ‘রাস্তা’, শেখর বসুর ‘দায়িত্ব
পেল দস্যিরা’। মনে রাখার মত গল্প ছিল ক্ষিতীন্দ্রনারায়ণ ভট্টাচার্যের ‘প্রেতাত্মার
উপত্যকা’! উরুগুয়ের পটভূমিকায় লেখা এই বিজ্ঞানভিত্তিক গল্পে খুব সহজভাবে বোঝানো
হয়েছিল স্পঞ্জের দেওয়ালের ধাক্কা লেগে শব্দ কি করে বারবার ফিরে আসে আর মানুষের মনে
রহস্যের সৃষ্টি করে।
ভাল লেগেছিল ‘দ্বীপের রাজা’ নামের কমিক্স যেখানে অনাথ আশ্রমের চার বন্ধু তাদের অত্যাচারী সুপারিন্টেনডেন্টের চোখ এড়িয়ে পালিয়ে গেছিল সমুদ্রের মধ্যের এক দ্বীপে। মনে হয়েছিল, এরকম যদি আমার সঙ্গেও হত!
আর সবার শেষে বলব এই
শারদীয়ায় আমার প্রিয় উপন্যাসের কথা, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়ের ‘ঝিলের ধারে বাড়ি’।
সেই চিরন্তন শীর্ষেন্দু, অনাবিল হাসি, মজা আর তার মধ্যেই আবার গা-ছমছম করা জমজমাট
রহস্য। হ্যাঁ এই উপন্যাসে ভূত নেই কিন্তু আছে অনু আর বিলুর মত ভাই-বোনের জুড়ি আর
নবীনের মত একজন সাধারণ কিন্তু বুদ্ধিমান, প্রত্যুৎপন্নমতি নায়ক। আর অবশ্যই গুপ্তধন
যা শেষ পর্যন্ত পাওয়া গেল ঝিলের নিচের মন্দির থেকে।
জানি না এই লেখাটা আদৌ
কারও ভাল লাগবে কিনা কিন্তু এই লেখা লিখতে গিয়ে গিয়ে ১৩৯৪ সনের শারদীয়া
আনন্দমেলাটা আমার একবার নেড়েচেড়ে দেখা হয়ে গেল। এই লেখা থেকে সেটাই আমার প্রাপ্তি!