"...প্রবাসে দৈবের
বশে
জীবতারা যদি খসে..."
সেই কোন কালে মাইকেল
মধুসূদন লিখে গেছিলেন, তারপর মধুকবির প্রিয় কপোতাক্ষ নদের অনেক জল বয়ে গেছে।
প্রবাসী বাঙ্গালী এখন ফিজি থেকে শুরু করে দামাস্কাস অবধি পৃথিবীর সব দেশেই পাওয়া
যায়। নিউইয়র্কের রাস্তায় সকাল সাতটার সময়, পোখরানের দুপুর ১২টায় ৪৭ ডিগ্রি
সেলসিয়াস উষ্ণতায় বা মেলবোর্নের পার্টিতে মধ্যরাতে, বাঙ্গালী খুঁজে পাওয়া কোন কঠিন
কাজ নয়।
বন্ধুবর কণাদ এবং
পাভেলদা (যার বাড়ির দরজার পাপোষ থেকে শুরু করে চিরুনি অবধি সবেতেই আর্সেনাল ফুটবল
ক্লাবের প্রতীক খুঁজে পাওয়া যায়) একবার উত্তর আমেরিকার উত্তর-পশ্চিম অংশের পোর্টল্যান্ড
শহরের সুপারমার্কেটে মহিলা-দর্শন সহযোগে সবজি বাজার করছিল। সহসা একটি ভারতীয় মহিলা
(যার সঙ্গে তার মাও ছিলেন) দেখে তারা নিজেদের মধ্যে বাংলায় মেয়েটিকে নিয়ে নানাবিধ
আলোচনা করতে করতে শোনে ভারতীয় মাসিমা বাংলায় বলছেন, “বুঝলি মিলি, টমেটোগুলো ভাল নয়!”
তবে এই উক্তিটি কনাদ বা পাভেলদাকে নিয়ে করা কিনা সে আলোচনায় আমরা যাব না!
সে যাই হোক,
বাঙ্গালী আরও উন্নতি করুক, লক্ষ লক্ষ বাঙ্গালী ছেলে-মেয়ে জিআরই দিয়ে
উচ্চশিক্ষার্থে প্রবাসী হোক। নাসা, ন্যাসডাক বা বার্কলেতে ছড়ি ঘোরাক বাঙ্গালীরা।
কিন্তু আমি আজকে যাদের
নিয়ে লিখব তাঁরা হলেন সেই সব বাঙ্গালী যাঁরা ভ্রমণার্থে কিছুদিনের জন্য প্রবাসী
হন। বাঙ্গালী ঘুরতে ভালোবাসে। পাঞ্জাবীরা খেয়ে, তামিলরা সোনা কিনে আর মারোয়াড়িরা
বাড়ী কিনে বা বানিয়ে পয়সা খরচা করে। আর বাঙ্গালী খরচা করে দেশ ভ্রমণে। সাধে কি আর
ব্যানার্জী স্পেসাল আর কুন্ডু স্পেসালের এত রমরমা!
আর কত জায়গায় যে
বাঙ্গালী ঘুরতে যায়! হরিদ্বার থেকে কন্যাকুমারিকা, আন্দামান থেকে অমৃতসর... আজকাল
আবার ৩ দিন-৪ রাতের প্যাকেজ ডিলে বাঙ্গালী ব্যাংকক, ফুকেত আর সিঙ্গাপুরও ঘুরে
আসছে।
তা যাচ্ছেন যান, কেউ
আটকাচ্ছে না কিন্তু সব জায়গায় গিয়ে এত হল্লা করেন কেন? সত্যি বলছি বাইরে ঘুরতে
গেলে, কোন দ্রষ্টব্যস্থান দেখতে গেলেই যেটা নিয়ে আমি সবচেয়ে ভয় ভয় থাকি তা হল, আরো
কিছু বাঙ্গালী পাবলিক নিশ্চয় সেখানেও ঘুরতে এসেছে! তাঁরা গাঁক গাঁক করে চেঁচান,
গান্ডেপিন্ডে গেলে্ন, সারাক্ষণ কলকাতার সঙ্গে তুলনা করেন আর চারদিকের বাকি সবাইকে
বিরক্ত করেন! আর সেই নিয়েই আমার এই লেখা!
২০১০ সালে আমি ১২
দিন ধরে দিল্লি-রাজস্থান ঘুরেছিলাম। তা যেখানেই যাই... সে উদয়পুরের লেক পিছোলাই
হোক বা জয়সলমীরের সোনার কেল্লা... মোট পর্যটকদের একটা খুব পরিষ্কার শ্রেণীবিভাগ
আছে যেটা নিচে দিলাম,
রাজস্থানের মোট পর্যটকের ৫০% বিদেশী, যারা বিশ্বের বিভিন্ন
প্রান্ত যেমন ইজরায়েল, ইতালি বা কানাডা থেকে প্রাচ্যের অভিজ্ঞতা নিতে এবং ভারতীয়
গরু আর সন্ন্যাসীদের দেখতে এসেছেন। ১০% হল ভারতেরই অবাঙ্গালী জনগণ, এরা মাঝেমধ্যে (৫
বছরে ১ বার) ঘুরতে বেরোন। আর বাকি ৪০%ই হল আমাদের প্রিয় পশ্চিমবঙ্গের অধিবাসী।
শুধু কলকাতা নয়, মানকুন্ডু থেকে শুরু করে কাকদ্বীপ অবধি সব জায়গার বাঙ্গালীরাই
ঘুরতে ভালোবাসেন, দলবল নিয়ে বেরিয়ে পরেন আর ঘুরতে গিয়ে জায়গাটার শান্তি নষ্ট করেন।
এই ধরুন রাজস্থানেই,
সব সাহেব-সুবোরা নিঃশব্দে ঘুরে বেড়াচ্ছেন, বিজ্ঞের মত রাজা রাজড়াদের পুরনো চটি,
পিকদানি আর মর্চে পড়া তলোয়ার দেখছেন (কতটা বুঝছেন তা মা গঙ্গাই জানেন!),
অবাঙ্গালীরাও নিজেদের মধ্যে আছেন, চুপচাপই ঘুরছেন, মাঝেমধ্যে এদিকওদিক পানের পিক
ফেলছেন... আর বাঙ্গালীরা!! তাঁরা নিজেদের মধ্যে দল বেঁধে ঘুরছেন, লাইন করে হাঁটার
নামে প্রচন্ড বিশৃঙ্খলা তৈরী করছেন আর অবধারিত ভাবেই অত্যন্ত জোরে জোরে কথা বলে
সবাইকে বিরক্ত করছেন, “অ্যাই বাবলি, এইদিকে আয়; বাবলু তোর জন্য পরোটা রেখেছি, খেয়ে
নে; বাব্বা আগেকার দিনে নবাবগুলো হেভি নবাবী করতো তো!; আরে ঐ ছবিটা দেখ, ইস্ কি
অসভ্য ছিল আগেকার দিনের লোকজন!”
(টীকাঃ দলে একজন
থাকেন যার কাজই হল গলায় ঝলানো এসএলআর দিয়ে বেছে বেছে ঐ সব তথাকথিত অসভ্য ছবির ছবি
তুলে রাখা!)
এবং এসবই তাঁরা করছেন
নির্বিকারভাবে, আশেপাশে বাকিদের যে বিরক্তি হতে পারে, তার কোন হুঁশই নেই তাঁদের।
বরং ভাবটা এমন যেন, বাকিরা তাঁদের বিজ্ঞের মত মতামত শুনে ধন্য হয়ে যাচ্ছে! এই যেমন
গত সপ্তাহেই হায়দ্রাবাদের সালার জং মিউসিয়ামে ঘুরতে ঘুরতে একটি অকালপক্ব বাঙ্গালী আমি
বাঙ্গালী বুঝতে পেরে বলল, “অনেক মিউজিয়াম দেখেছি, কিন্তু এতো ভালো দেখিনি।”
তা এটা শুনে আমি কি
করব! আমি পাতি কাটিয়ে দিলাম, কণাদটা দেখি মজা নেওয়ার জন্য, “হ্যাঁ তা তো বটেই” বলে
মাথা নাড়ছে! যাকগে এর কথায় পরে আবার আসা যাবে!
তা সেই রাজস্থান
ভ্রমণের সব জায়গাতেই এইসব ভ্রমণপিপাসু বাঙ্গালীদের মুখোমুখি হতে হয়েছিল। আরো
বিরক্তিকর হচ্ছে তাঁদের হিন্দি! আরে দাদা, হিন্দি বলতে পারবেন না তো
তামিল-তেলুগুদের মতো ইংরেজী বলার চেষ্টা করুন! তা না যত ভুলভাল হিন্দি বলবেন আর
সারা ভারতের হিন্দিভাষী জনগণ খিল্লি ওড়াবে!
ঐ বারেরই আরেকটা
ঘটনা বলি, স্থান জয়সলমীর, সারাদিন ঘুরে বিকেলের দিকে এসে পৌঁছেছি, তার পর আবার
অনেক ঘোরাঘুরি করে হোটেল করে পাওয়া গেছে! সঙ্গীরা (তাঁরাও বাঙ্গালী,
দিদি-জামাইবাবু আর তাঁদের কন্যা!) জানালেন, তাঁরা খুবই ক্লান্ত, বেরোবেন না। আমি
একটু বেরোলাম, সারাদিন গাড়িতে বসে কোমর ধরে গেছিল, তাছাড়া আসার সময় মিনিট দশেক
হাঁটা দূরত্বে একটা বড় মোড়, দোকান-পাট দেখেছিলাম, সেই অবধি ঘুরে আসবো ঠিক করলাম।
মিনিট পনেরো ঘুরে,
পরের দিনের ঘোরার সঙ্গের হালকা খাবার-টাবার কিনে ফিরছি, দেখি উল্টোদিক থেকে নানা
বয়সী এবং নানা সাইজের গোটা ১০-১২ বাঙ্গালীর একটা দল আসছে। আধ মাইল দুর থেকেই
বুঝলাম যে, তাঁরা বাঙ্গালী! (কি করে আবার? তাঁরা নিজেদের মধ্যে কথা বলছিলেন যে!)
যাই হোক, রাস্তায়
অন্ধকার বলেই হোক বা আমার অবাঙ্গালীসুলভ চেহারার জন্যেই হোক তাঁরা বুঝতে পারেননি
যে আমি বাঙ্গালী, তো আমার কাছাকাছি এসে নিজেদের মধ্যে ফিস্ফিস্ করে বলল, “এ বলতে
পারবে, জিজ্ঞেস করে দেখ...” তারপর তাঁদের মধ্যে এক মধ্যবয়স্ক ব্যক্তি এগিয়ে এসে, সেই
বিখ্যাত শ্যামবাজারী হিন্দি উচ্চারণে বললেন, “ভাইয়া, ইধার বাজার কিধার হ্যায়?”
প্রথমে ভাবলাম
খিল্লি করি, তারপর মনে হল হাজার হোক দ্যাশের লোক, বল্লুম, “সামনে গিয়ে বাঁ দিকে...”
পুরো দলের মুখে হাসি
ফুটল, “ওহ্ বাঙ্গালী! বাঙ্গালী!”
বাঙ্গালীরা ঘুরতে
গেলে, আরও বেশ কিছু চিহ্ন আছে যা দিয়ে সহজেই তাঁদের চেনা যায়। যে কোন ঠান্ডা
জায়গায় তাঁদের সোয়েটার যতই পাতলা হোক মাথায় মাঙ্কি ক্যাপ অবশ্যই থাকে, যে কোন
জায়গাতেই তাঁরা তাঁদের হজম আর অম্বলের সমস্যা নিয়ে আলোচনা করেন। বাইরের যে কোন
মন্দির, রাজবাড়ি বা লেক দেখলেই তাঁরা কলকাতার বিড়লা মন্দির, ভিক্টোরিয়া মেমোরিয়াল
বা গোলপার্ক লেকের সঙ্গে তুলনা করবেন!
তবে সবচেয়ে সমস্যা
হল বাঙ্গালী পর্যটকদের সঙ্গে বাস বা অন্য কোন পাবলিক ট্রান্সপোর্টে ভ্রমণ করা।
বাঙ্গালীরা অন্য আর যেখানেই দলাদলি করুক না কেন ঘুরতে বেরিয়ে বাসে উঠতে হলে তাঁদের
দলগত ঐক্য কয়েক গুণ বেড়ে যায়। তাই এসব ক্ষেত্রে যখনই লাইন দিয়ে ভিড় বাসে উঠতে হয়ে
তাঁরা তাঁদের দলের কাচ্চা-বাচ্চাদের বা বৃদ্ধ-বৃদ্ধাদের এগিয়ে দেন। স্বাভাবিকভাবেই
অন্যরা এঁদের আগে এগিয়ে যেতে তেমন বাধা দেন না। আর তার পরেই দেখা যায়, বাঙ্গালীর
বুদ্ধি! তাঁরা বাসে উঠে একটা সিটে বসেন, সঙ্গে আরো চারটে সিট দখল করে দলের অন্যদের
জন্য জায়গা রাখেন এবং তারস্বরে, “গোপাল, এদিকে, বেচারাম এই যে এখানে ব্যাগ দাও...”
বলে চিৎকার শুরু করেন।
আর এসবের পরে যখন
বাকিরা বিরক্ত হয়ে খিস্তি করেন তখন বাঙ্গালীরা, ‘ওরা তো পাতি পাঁইয়া, ওরা মেড়ো,
ওরা গুজ্জু’ বলে কাটিয়ে দেন নাহলে তাঁদের বিখ্যাত হিন্দিতে ঝগড়া শুরু করেন!
যাই হোক, একটা ভালো
ব্যাপার হল এইসব বাঙ্গালীরা পর্যটকরা এখনও তুলনামূলক ভাবে দক্ষিণ ভারতে অনেক কম
আসেন, হয়ত খাওয়া পোষায় না! তাছাড়া আর একটা কারণ বোধ হয় ভাষা, তাঁদের ঐ বিখ্যাত
হিন্দি দাক্ষিণাত্যে চলবে না এটা মেনে নিতে তাঁদের বোধ হয় খুবই কষ্ট হয়!
তবু মাঝেমধ্যে এঁদের
দেখা মেলে, যেমন আমি দেখলাম হায়দ্রাবাদে! সেই গল্পটাই বলে শেষ করি।
আগেই বলেছি সালার জং
মিউজিয়াম গেছিলাম। তা সেখানে ঢোকার আগেই এনাকে দেখলাম, চিরন্তন বাঙ্গালী চেহারা,
তেল দেওয়া চুল পাট করে আঁচড়ানো, সরু গোঁফ, হলুদ রঙের ফুল শার্ট, পুরো হাতা বোতাম
দিয়ে লাগানো, একটা মোবাইল ফোনে গাঁক গাঁক করে কাউকে বলেছিলেন, “আমরা চলে
এসেছি... ইয়ে... সালার জং... চলে আসুন টেম্পো করে... ষাট টাকা নেবে... হ্যাঁ হ্যাঁ
সিক্সটি... আসুন আমরা আছি...” চারদিকে সবাই জেনে গেল। তারপর যেখানেই যাই লোকটি
তাঁর দলবল নিয়ে পৌঁছে যান। ভালো করে কিছুক্ষণ পর্যবেক্ষণ করে দেখলাম, লোকটি মোটেই
মন দিয়ে দ্রষ্টব্যগুলো দেখছে না, তাঁর প্রধান কাজই হল দলের বাকিরা একসঙ্গে আছে
কিনা সেটা দেখা, আর সবাই একসঙ্গে গ্যালারীতে ঢুকে গেলে তারপরে হয়তো দুটো-একটা ছবি
বা মূর্তি দেখা এবং আমার মত অচেনা বাঙ্গালী দেখলে তাঁদের সঙ্গে ভাব জমানোর চেষ্টা
করা!
সত্যিই তো বিদেশে বাঙ্গালীকে বাঙ্গালী না দেখিলে আর কে
দেখিবে!
আমি তোর সঙ্গে সম্পূর্ণ একমত। আমি বিশেষ বেড়াতে যাই না, কিন্তু বেড়াতে গিয়ে বাঙালি দেখলেই আমি তার থেকে শতহস্ত দূরে থাকি, আর তার মূল কারণ এই গায়ে-পড়া ভাব। কাউকে পছন্দ হোক্ না হোক্, সে বাংলা বলে বলেই তার সঙ্গে গায়ে পড়ে আলাপ করতে হবে, এই ব্যাপারটা আমার অত্যন্ত বিরক্তিকর লাগে।
ReplyDeleteপুনশ্চ -
তুই খুব ভাল বাংলা লিখিস্। আরেকটু ঘনঘন লিখলে পারিস্।
besh bhalo likhechis. tobe oi bhodrolok specifically bolechilen "ami Salar Jung iye te pouche gechi"
ReplyDeleteamar dharona ota kanad kei Tomato bola hoechhilo :|
ReplyDeletear sob bhromonpipashu bangali ra moteo omon noy...tor observation gulo aager generation er bangali der khetre beshirbhag i mile jay bote..kintu ei generation..mane nobyo jubok juboti ra motei oi dole poren na..tara nitantoi onno sreni'r ...english chhara bolen i na...jotro totro photo tolen..facebook e upload o koren songe songei...ebong baki time nijeder moddhei moshgul thaken career nie gyan dite ba nite..bangali dekhle besh durotto bojay rakhen bangla bolbar bhoy te..bangla tao khub kosto kore bojhen era :) eder nieo kichhu lekha asha korchhi
Hna... tumi bolchho bong-der kotha... amar e post ar ektu purono niriho Bangali der niye!!
ReplyDelete