আজকের দিনটা
অন্যরকম। না, গত চারদিনের অক্লান্ত বৃষ্টি আজও থামেনি। আমার মুকুন্দপুরের এই
অ্যাপার্টমেন্টের সাত তোলার ফ্ল্যাটে আজকেও এই বুড়োটাকে বাদ দিয়ে আর কেউ নেই।
আজকেও একটু পরে ছোটন বেল বাজিয়ে আমার খাবারটা দিয়ে যাবে গলির মুখের ‘মা তারা হোটেল’ থেকে। কিন্তু তাও
আজকের দিনটা একটু অন্যরকম।
কিচেন গিয়ে চায়ের
জল বসিয়ে তাক থেকে আমার প্রিয় মকাইবাড়ির চায়ের প্যাকেট আর চিনি বের করলাম। কাল
অনেক রাতে ফিরেছি। কাজটা অনেক আগেই হয়ে গেছিল কিন্তু তারপর সারা সন্ধ্যে
উদ্দেশ্যহীনভাবে ঘুরে বেড়িয়েছি আমার শহরের রাস্তায় রাস্তায়। তখনো ভেবে চলেছি আমার
আমার কাজের যৌক্তিকতা নিয়ে, মনে হয়েছে যে কাজটা ঠিক করিনি, কিন্তু অনেক সময় তো
ঠিক-ভুলের মধ্যের বিভেদগুলো দূরে সরে যায়, তখন সাদা-কালো, ঠিক-ভুল সবই আপেক্ষিক
হয়ে যায়।
আমি এরকম ছিলাম
না, জানেন। এর আগে কখনো কাজ করে ফেলার পর এত ভাবতাম না, বরং পুরোটাই আগে থেকে এত
ভাল করে ভেবে নিতাম যে, কাজটা হত পুরো ১০০ শতাংশ সঠিক। কে জানে, বয়স হয়ে যাচ্ছে
তো, তাছাড়া তখন সঙ্গে ছিল আমার স্যাটেলাইট। তখন ও নেহাতই কিশোর, কিন্তু তাও ওর
সঙ্গে আলোচনা করলে আমারও জিনিসগুলো বেশ পরিষ্কার হয়ে যেত।
নাহ্! বড্ড হঠাৎ
করে শুরু করে দিলাম। আগে একটু পুরনো কথা বলি, তাহলে আপনাদেরও বুঝতে সুবিধা হবে।
তবে একদম শুরুতে যাব না। তাঁর দরকারও
নেই। আর তাছাড়া আপানারা অনেকেই হয়তো সেই গল্পগুলো জানেন।
শুরুটা করি গত
শতাব্দির শেষ দশকে, আমার যখন চল্লিশের কাছাকাছি বয়স। এই সেই নাইন্টিজ, যখন থেকে
পৃথিবীটা আস্তে আস্তে বদলে যেতে লাগল। ভারতে এল উদার অর্থনীতি, সমস্ত
মাল্টিন্যাশানালস, চিপ্স আর কোলা কোম্পানিগুলোর কাছে খুলে গেল পৃথিবীর সবচেয়ে বড়
বাজারের দরজা। সমস্ত পৃথিবীতে বাড়তে লাগলো অন্তর্জাল, ধনতন্ত্রের প্রভাব,
লাগামছাড়া দুর্নীতি আর গা-শিরশিরে উগ্রপন্থা।
সেই সময়, ১৯৯২
সালের এপ্রিল মাসে চলে গেলেন বাংলা সিনেমার সেই বিখ্যাত লম্বা লোকটি। আচ্ছা কখনো
ভেবে দেখেছেন কি? বাঙ্গালীরা এমনিতে ছোটখাটো হলে কি হবে বিখ্যাত কয়েকজন বাঙ্গালী
কিন্তু বেশ লম্বা, যেমন ধরুন রবীন্দ্রনাথ, বিধান রায় কিংবা শরদিন্দু... এবং তিনি।
যাই হোক, তার
কিছুদিন আগে থেকেই কাজ কমে আসছিল, তারপর একদম ছেড়েই দিলাম। ভাবছেন নিশ্চয়ই আমার
কাজটা কি ছিল? কাজটা ছিল রহস্যোদ্ধার। আমি ছিলাম একজন ব্যাক্তিগত গোয়েন্দা। না,
ব্যোমকেশের মত নিজেকে সত্যান্বেষী নয় বরং একজন গোয়েন্দা ভাবতেই ভাল লাগত আমার।
দীর্ঘদিন কাজ করেছি, ভারতের নানা জায়গা ঘুরেছি, এমনকি গেছি বিদেশেও। খ্যাতি, অর্থ
কোনটারই অভাব হয়নি।
তাই হঠাৎ কাজ ছেড়ে
দিলেও অর্থনৈতিক দিক দিয়ে কোন অসুবিধা হয়নি। বরং যে টাকা জমেছিল তা নিয়ে কিছুদিন
ঘুরে বেড়ালাম দুই আমেরিকার অনেকগুলো দেশে। দেশে ফিরে অল্প কিছুদিনের মধ্যেই অপরাধবিজ্ঞান
নিয়ে গবেষণার সুযোগ পেয়ে যাই ফরাসি দেশের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে। গবেষণা, পেপার
লেখা, বিভিন্ন সমাবেশে বক্তৃতা, ভালই ছিলাম। কিন্তু অনেক দিন ধরেই দেশের জন্য মন
কেমন করছিল। শেষে যখন ভারতে ফিরলাম সেটা ২০০৫ সাল। এর মধ্যেই মৃত্যুর খবর পেয়েছি
আমার প্রিয় এক লেখক বন্ধুর।
কলকাতায় কাকার
বাড়িতে থাকতাম, কিন্তু যতদিনে ফিরলাম, ততদিনে আমার খুড়তুতো ভাইটি মার্কিন
যুক্তরাষ্ট্রের একটি নামী বিশ্ববিদ্যালয়ে অর্থনীতি নিয়ে গবেষণা শেষ করে সেখানেই
শিক্ষক হিসেবে যোগদান করেছে। কাকা-কাকিমা ওখানেই চলে গেলেন। যাওয়ার আগে কলকাতার
বাড়িটা বিক্রি করে তার একটা অংশ জোর করেই দিয়ে গেলেন আমাকে। সেই টাকা আর ফ্রান্সে
জমানো টাকা মিলিয়ে কিনে ফেললাম এই ফ্ল্যাটটা। তখন এসব জায়গা জঙ্গল, খুবই ফাঁকা
ছিল, খুব সস্তাতেই পেয়ে গেছিলাম। এখন যত দিন যাচ্ছে আর কোন জমিই খালি পড়ে থাকছে
না।
ওই বয়সে বিয়ে-টিয়ে করে সংসারী জীবনের ইচ্ছে কোনকালেই ছিল না। কাকারা বিদেশে,
আরেকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধু মৃত, তাই একাই বেশ দিন কেটে যাচ্ছিল, ভেবেছিলাম পড়াশুনো করেই
সময় কাটিয়ে দেব, কিন্তু সেটাও হল না। আমার কলকাতা ফেরার খবর পেয়ে আমার সঙ্গে
যোগাযোগ করলেন ভারতের গোয়েন্দা দফতরের এক উচ্চপদস্থ কর্তা। ভদ্রলোক আমার কাজের সঙ্গে আগেই পরিচিত ছিলেন,
তাছাড়া ফ্রান্সে থাকাকালীন আমার কিছু গবেষণার কথাও তিনি জানতেন। তিনি আমাকে
প্রস্তাব দিলেন ভারতের কেন্দ্রীয় গোয়েন্দা দফতরে যোগদান করার।
অনেক চিন্তাভাবনা করলাম। আমি প্রধানত একজন প্রাইভেট ডিটেকটিভ। এইভাবে সরকারি নিয়মকানুন
মেনে কাজ করা ভালো লাগবে তো? নিজের মত করে কাজ করতে পারবো কি? এরকম নানা প্রশ্ন
এসেছিল মনের মধ্যে। কিন্তু তারপর মনে হল যে চ্যালেঞ্জটা নিয়েই দেখি। একটা নতুন
অভিজ্ঞতা তো হবে! এই সব ভেবেই রাজী হয়ে গেলাম, চলে গেলাম দিল্লী।
গল্পের পরের অংশটা একেবারেই ভাল নয়। কিছুদিনের মধ্যেই বুঝতে পারলাম যে আমি
এখানে সময় নষ্ট করছি। হাঁফিয়ে উঠলাম, সঙ্গে এল চরম হতাশা। বুঝতে পারলাম যে,
ব্যাক্তিগত গোয়েন্দা আর পুলিশের উচ্চবিভাগের মধ্যে আকাশ-পাতাল তফাত। হাজার-হাজার
নিয়মের জালে বন্দী লাগছিল নিজেকে। শুধু তাই নয়, ওইসব নিয়মের মধ্যে দিয়ে যখন শেষ
অবধি অপরাধীর কাছহে পৌঁছতাম, দেখতাম তিনি হয় মন্ত্রী, নয় বিশিষ্ট শিল্পপতি নয়তো বা
কোন বিখ্যাত রাজনৈতিক নেতা বা তাদের আত্মীয়, আর তারপরেই শুরু হত আরেক খেলা! কি করে
আড়াল করা হবে তাদের, কি করে লুকিয়ে ফেলতে হবে সমস্ত প্রমাণ, দরকার পরলে সাক্ষীদের
ভয় দেখানো এমনকি মেরে ফেলাও কোন ব্যাপারই নয় তাদের কাছে। তাঁর সঙ্গে আছে আরো অনেক
বাধা। অনেক শর্ত, অনেক গোলমেলে হিসেবনিকেশ। ভোটের হিসেব, সংখ্যালঘুদের খুশি রাখা,
আমরা-ওরা, অনেক লাভ-ক্ষতির অংক আছে এর মধ্যে।
তাও কিছুদিন চেষ্টা করলাম। কিন্তু পারলাম না। শেষ অবধি ফিরে এলাম কলকাতাতেই,
এই বাড়িতে। আমার পরিচিত সেই উচ্চপদস্থ ভদ্রলোককে বুঝিয়ে বললাম আমার অসুবিধার কথা। উনি
বুঝলেম পুরোটাই, সহানুভূতিও জানালেন। শেষ অবধি উনিই একটা ভাল প্রস্তাব দিলেন।
বললেন, “আপনি বরং কলকাতাতেই থাকুন, কন্সাল্ট্যান্ট হিসেবে কাজ কলকাতা পুলিশের
সঙ্গে। সাধারণ ছাপোষা কেসে আপনার দরকার নেই, আমি আপনার সাহায্য নেব চরম বিপদে
পড়লে।“
কথা না বাড়িয়ে রাজী হয়ে গেলাম। সত্যি বলতে ভালোই লাগল প্রস্তাবটা। বেশ নিজের
মত করে পড়াশুনোও করা যাবে আবার কখনো কখনো তেমন জটিল কেস এলে সেটার পেছনে খেটে
মগজাস্ত্রেও বেশ শান দিয়ে নেওয়া যাবে। ভালোই ছিলাম কিন্তু আবার ধীরে ধীরে হতাশা
গ্রাস করতে লাগল। বুঝতে পারলাম যে এরা আমার
সাহায্য চান, কিন্তু শুধুই রহস্যটুকু সমাধান করার জন্য, যখনই অপরাধীকে সনাক্ত
করে ফেলি, তখনই চলে আসে অনেক স্বার্থ, অনেক গোলমেলে হিসেব। কোন ঘটনাই আর জনগণের
সামনে আসে না। এলে আপনারাও বুঝতে পারতেন যে, ভারতের সবচেয়ে বড় অপরাধীরা বাবা
বিশ্বনাথ বা পরেশনাথের গলিতে নয়, থাকে আপনাদের আশেপাশেই।
এরকম একদিন, এই কয়েক মাস আগে, চরম অস্থির অবস্থায় কলকাতার রাস্তায় রাস্তায়
ঘুরে বেড়াচ্ছি, হঠাৎ ডঃ ওয়াটসনের একটা কথা মনে পরে গেল। শার্লক হোমসের বন্ধু ও
লেখক ডঃ জন ওয়াটসন, তাঁর কথা নিশ্চই আপনাদের মনে আছে। জন শার্লককে একটা কথা প্রায়ই বলত। বলত, “শার্লক,
তুমি যদি কোনদিন আপরাধের সঠিক দিক থেকে বেরিয়ে অন্যদিকে চলে যাও, সেইদিন হবে
লন্ডন শহরের পুলিশ বিভাগের জন্য শেষ দিন! তোমার মত মস্তিষ্কের একজন অপরাধীকে
সনাক্ত করা হবে খুব শক্ত কারণ তোমার করা অপরাধ হত ত্রুটিহীন।“
চিন্তাটা মাথার মধ্যে গেঁথে গেল। পারব কি আমি, খুঁজে পাব কি সেই পরিকল্পনা
যেটা হবে, ‘The
perfect crime!’ অনেক চিন্তাভাবনা, পড়াশুনো আর বিনিদ্র রাত্রির পর শেষ অবধি পেলাম সেই প্ল্যান।
নিখুঁত, নিটোল, তুলনাহীন এক পরিকল্পনা। সু্যোগটাও এসে গেল খুব সহজে। জানতে পারলাম
এক প্রদর্শনীর কথা। কলকাতার ভারতীয় যাদুঘরেই হবে সেই প্রদর্শনী, সেখানে থাকবে
দুষ্প্রাপ্য কিছু বই এবং পান্ডুলিপি। পান্ডুলিপিগুলোর মধ্যেই থাকবে টিনটিনের
স্রষ্টা হার্জের আঁকা অপ্রকাশিত কিছু ছবি আর বইয়ের খসড়া, ইউরোপের বিভিন্ন নিলামঘরে
যার মূল্য ছুঁতে পারে কয়েক মিলিয়ন ডলার। কিন্তু আমার তো ডলার চাই না, আমার চাই
শুধু সেই perfect crime-এর পরিতৃপ্তি। আমার চাই একটা
নিখুঁত পরিকল্পনা সফল করার আনন্দ।
কী ভাবছেন? এই বৃষ্টি মাথায় নিয়েও কি আপনি দেখে এসেছেন সেই প্রদর্শনী? আপনার
ছোট্ট ছেলে বা মেয়েটির হাত ধরে? গত এক সপ্তাহ ধরে সব খবরের কাগজে-কাগজেই আলোচনা চলছে
ঐ দূর্লভ প্রদর্শনী নিয়ে, তাই না? তবে আজকের পর হয়তো বন্ধ থাকবে সেটা।
কারণ কাল বিকেলের ঐ প্রচন্ড বৃষ্টির মধ্যে আমি হাতে পেয়ে গেছি হার্জের আঁকা
চারখানা ছবি। হ্যাঁ, আমি কাজে লাগিয়েছি মানুষের বিভিন্ন আদিম প্রবৃত্তিকে। আমাদের
দেশের বিভিন্ন নামী মাফিয়া, নেতা বা ব্যবসায়ীদের মত লোভ দেখিয়ে, ভয় দেখিয়ে, এমনকি
তাদের জীবনের সবচেয়ে গোপনীয় ঘটনার সাহায্যে ব্ল্যাকমেল করে হাত করেছি যাদুঘরের
তিনজন কর্মীকে, যারা কালকে যাদুঘর বন্ধ হওয়ার একটু পরে ছবিগুলো তুলে দিয়ে গেছে
আমার হাতে। না, ওরা জানে না আমার পরিচয়। ওদের কাছে আমার নাম রণবীর সেনগুপ্ত আর যদি
কোনদিন তারা পুলিশের জেরায় স্বীকার করে ফেলে তাদের দোষ, তাহলে তাদের বর্ণনায় যে লোকটির
ছবি আঁকা হবে তাঁর ঘাড় অবধি লম্বা সাদা চুল, লম্বা সামান্য ভাঙ্গা নাক, আর
হাফফ্রেম চশমায় সেটা অনেকটাই হয়ে যাবে হ্যারি পটারের বইয়ের প্রফেসর ডাম্বেলডোরের
মত।
কিন্তু এর পরেই তো গল্পের শুরু। আজ সকালেই সম্ভবত ধরা পড়েছে চুরির কথা। নিশ্চই
হইচই পরে গেছে পুলিশ আর সরকারি ওপর মহলে। আমি জানি আর কিছুক্ষণের মধ্যেই ফোন আসবে
কলকাতার পুলিশ প্রধানের কাছ থেকে। তিনি আমাকে জানাবেন পুরো ঘটনাটা, সাহায্য চাইবেন
আমার কাছে? সারা কলকাতা পুলিশের মানসম্মান জড়িয়ে আছে ঐ ছবিগুলোর সঙ্গে।
কিন্তু আমি কী করব তারপর? আমি কি যাব তদন্ত করতে? প্রশ্ন করব মিউজিয়ামের
কর্মচারীদের? যখন আর কেউ না জানলেও আমি নিজে জানি যে ছবিগুলো লুকিয়ে রাখা আছে এই
বাড়িরই কোন ঘরে।
ঐ যে... আমার সেলফোনটা বাজছে, বাজছে আমার প্রিয় রিংটোন। সোনার কেল্লা সিনেমার
সেই চিরস্মরনীয় বাজনা, ‘ফেলুদা থিম’। ফোনটা তুলে নিলাম টেবিল থেকে, টিপলাম সবুজ
বোতামটা, প্রত্যেকবারের মতই বললাম, “নমস্কার... প্রদোষ মিত্র বলছি...”
No comments:
Post a Comment