Monday, June 20, 2016

দুই দশক...


কুড়িটা বছর পার হয়ে গেছে! আজ থেকে কুড়ি বছর আগে পৃথিবীটা অনেক অন্য রকম ছিল। অনেক নরম, শান্ত, ঠাণ্ডা, মজার একটা জায়গা! আমি তখনো বড় হয়ে যাইনি (এখন তো আর উপায় নেই!) তাই আমার পৃথিবীটাও আমার মতই ছোট্ট ছিল। সেই পৃথিবীর একদিকে বাঁটু্ল উটপাখি পুষছে, টিনটিন আর ক্যাপ্টেন হ্যাডক প্রশান্ত মহাসাগরের দ্বীপে ঘুরে গুপ্তধন না পেয়ে ফিরে আসছে, ফেলুদা পার্ক স্ট্রিটের গোরস্থানের সবুজ ঘাসের ওপর ভাঙা শ্বেত পাথরের টুকরো সাজিয়ে টমাস গডউইনের নাম খুঁজে বের করছে আর কাকাবাবু সুকুমার রায় আবৃত্তি করে শোনাচ্ছে সন্তুকে।
আমার পৃথিবীর অন্য দিকটা জুড়ে ছিল একদল লোক, যাদের খুব ছোট্টবেলা থেকে টিভিতে দেখতাম। টিভির মধ্যে ব্যাট করছে, বল করছে, ক্যাচ ধরছে! আর দেখতাম বিজ্ঞাপনে। পামোলিভ, বুস্ট, পেপসি। তারপর তাদের নিয়ে পড়তে শুরু করলাম। গাভাসকার, কপিল দেব, আজহার, সচিন থেকে শুরু করে সি কে নাইডু, ভিনু মানকড়, ওয়ালশ, অ্যামব্রোজ, লারা, জয়সূর্য!
সেই ওয়ান ডে ক্রিকেটের সুবর্ণ যুগে তখন একের পর এক ক্রিকেট সিরিজ, ত্রিদেশীয়, চতুর্দেশীয় টুর্নামেন্ট হয়েই চলত১৯৯৬তে আবার ঘরের মাঠে বিশ্বকাপতার অভিনব বিজ্ঞাপন, টানটান উত্তেজনা, পাকিস্তানকে হারানোর লাগামছাড়া উচ্ছাসের পরই শ্রীলংকার কাছে করুণ পরাজয়। সব মিলিয়ে সে একটা সময় গেছিল বটে! (যদিও এটা আমার স্মৃতিতে দ্বিতীয় বিশ্বকাপ। বিরানব্বইয়ের অস্ট্রেলিয়ায় বিশ্বকাপ দেখার হাতেখড়ি! ফাইনালে ইমরান খানের জন্য #দিল দিল পাকিস্তানও ছিলাম সেই ন বছর বয়সে!)
বিশ্বকাপ শেষ হতে না হতেই ইন্ডিয়া পটাপট দুটো ত্রিদেশীয় সিরিজ খেলে ফেলল, যদিও একটাও জিতল না। তারপর রওনা দিল ইংল্যান্ডের জন্য, এক গাদা নতুন খেলোয়াড় নিয়ে। রাহুল দ্রাভিড, সুনীল যোশী, ভেঙ্কটেশ প্রসাদ, পরশ মাম্ব্রে, বিক্রম রাঠোড়... এরা কেউ তখনো টেস্ট খেলেনি। ওহ্‌ আর একটা লোক ছিল। ট্যুর শুরুর আগে থেকেই যাকে নিয়ে বাংলা কাগজে বেশ হইচই হচ্ছিল। হাজার হোক, অনেক বছর পর এরকম একটা বড় ট্যুরে একটা বাঙ্গালী ছেলে দলে জায়গা পেয়েছে! ততদিন বাঙ্গালীর আন্তর্জাতিক ক্রিকেট মানেই গোলগাল, চশমা চোখে মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক পঙ্কজ রায়। সঙ্গে বুড়ো বয়সে শুঁটে ব্যানার্জীর ওয়েস্ট ইন্ডিজের বিরুদ্ধে পাঁচ উইকেট নেওয়ার গল্প বা সুব্রত ব্যানার্জীর প্রথম ইনিংসে তিন উইকেট নেওয়ার পর আজহারের দ্বিতীয় ইনিংসে বল না দেওয়ার দীর্ঘশ্বাস! কেউ বলল, ‘কিচ্ছু করতে পারবে না’, আবার কেউ বলল, ‘খেলতে নিলে আগুন লাগিয়ে দেবে!’ কার কথায় ভরসা করা যায় বোঝার বয়স হয়নি তখনও।
লম্বা ট্যুর ছিল। অনেকগুলো কাউন্টির সঙ্গে ম্যাচ, বোধহয় সেই শেষবারইটুকটাক খেলছিল ছোকরা। একটা ওয়ান ডে খেলায় চান্স পেল। সচিন আউট হওয়ার পর ফার্স্ট ডাউন নেমে ৪৬ রান করল। ইন্ডিয়া হারল যথারীতি। সিরিজটাও।
ফার্স্ট টেস্টে টিমে ছিল না। ইন্ডিয়া হেরেছিল। সেকেন্ড টেস্টের আগে টিমে প্রচুর ঝামেলা। মঞ্জরেকারের চোট, সিধুও ঝামেলা করে ইন্ডিয়া ফিরে এসেছিল তত দিনে খবরের কাগজে পড়লাম রাহুল দ্রাভিডের অভিষেক হবে লর্ডস টেস্টে, আরও পরিবর্তন হতে পারে। সে কী কাণ্ড! বাঙ্গালীর ছেলে টেস্ট খেলতে পারে! সে কী প্রাদেশিক উত্তেজনা! বাঙ্গালীকে আর ক্রিকেটে দমিয়ে রাখা যাচ্ছে না! চারদিকে একটা সাজো সাজো রব।
আগেই বলেছি, কুড়ি বছর! আজ থেকে কুড়ি বছর আগে এই দিনে। সৌরভ গাঙ্গুলীর প্রথম টেস্ট! একটা বৃহস্পতিবার। স্কুলে গেছিলাম, ক্লাস সেভেনস্কুল থেকে ফিরে ছটার খাস খবরে শুনলাম সৌরভ খেলছে! উইকেটও নিয়েছে একটা। নটার খাস খবরে শুনলাম, উইকেট একটা নয় দুটো! তার পরের দিন ব্যাট করতে নেমে ২৬ রানে নট আউট। থার্ড ডে শনিবার। স্কুল হাফ ছুটি, ফিরে এসে রেডিও শুনছিলাম, কেবল টিভি তখন নেই। সৌরভ যখন প্রায় সত্তর তখন এক বন্ধুর বাড়িতে হামলা করলাম। আস্তে আস্তে রান বাড়ছে। সৌরভ নব্বই। সবাই উত্তেজিত! বাঙ্গালী খেলবে জানা ছিল কিন্তু এইসব হয়ে যাবে কেউ ভাবতেও পারেনি!
হঠাৎ টিভিতে ক্রিকেট বন্ধ। ইউরো কাপের খেলা। আজ গুগলে চেক করলাম, ইংল্যান্ড বনাম স্পেনের কোয়ার্টার ফাইনাল ছিল। বড় টুর্নামেন্টে ইংল্যান্ডের একমাত্র টাইব্রেকারে জয়! কিন্তু তখন মনে হয়েছিল স্টার স্পোর্টসের চেয়ে হৃদয়হীন কী আর কেউ আছে!
সৌরভের টেস্টে প্রথমবার একশোয় পৌঁছনোর মুহূর্তটা দেখতে পাইনি। কী আসে যায়! সেটা তো একটা সামান্য স্ট্যাটিস্টিক্স! পরের টেস্টেই তো আর একটা হল!
সৌরভ ভারতীয় ক্রিকেটকে কতটা বদলে দিয়েছেআদৌ তার কোন অবদান আছে কিনা ভারতীয় ক্রিকেটে... সেই নিয়ে লোকে তর্ক করে। করুক! কী আসে যায়!
কিন্তু আমার জীবনটাকে সৌরভ কিভাবে পালটে দিয়েছে সেটা নিয়ে তো আর তর্ক করার জায়গা নেই। তার আগে অবধি ক্রিকেট শুধু একটা খেলা ছিল, সেদিন থেকে ক্রিকেট আমার মজ্জায় মজ্জায় ঢুকে পড়ল! সৌরভের খেলা, সৌরভের রান-উইকেট-ক্যাচ, অধিনায়কত্ব, সাফল্য, ব্যর্থতা... সবই আস্তে আস্তে হয়ে উঠল আমার জীবনের একটা অংশ।

আসলে আমার জীবনের দুটো ভাগ! ‘Before Lord’s 1996’ আর ‘After Lord’s 1996’

সেই ভাগটা হয়েছিল আজকের দিনেই, ঠিক কুড়িটা বছর আগে!

Wednesday, June 1, 2016

স্মৃতি

ভাবনা-১

সুনির্মলবাবুর আজকাল নিজেকে বড় একা লাগে। একটা গোটা দোতলা বাড়িটায় আর একটাও মানুষ নেই। একাকীত্ব যেন রোজ গিলে খেতে আসে তাঁকে। কিন্তু সব সময় এরকম ছিল না। সুনির্মলবাবুর স্ত্রী কৃষ্ণা এবং একমাত্র ছেলে অঞ্জন যখন ছিল তখনও পুরো বাড়িটা বেশ জমজমাট থাকত। অঞ্জনের বিয়ের পর আরো একজন লোক বাড়ল, সুনয়না, তাঁর পুত্রবধূ। কিন্তু এরা কেউই এখন নেই। কেন নেই সেটা অনেক ভেবেও সুনির্মলবাবু ঠিক করে বুঝে উঠতে পারেন না! ঘন্টার পর ঘন্টা বসার ঘরে কৃষ্ণার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদের বৈবাহিক জীবনের অনেক খুঁটিনাটি ঘটনার কথা তাঁর মনে পড়লেও এই প্রশ্নের উত্তর তাঁর মাথার মধ্যে নেই!
আসলে মানুষের স্মৃতি ব্যাপারটাই খুব জটিল। আর তার ওপর মস্তিষ্কের এক বিরল রোগের কারণে সুনির্মলবাবুর স্মৃতি এক অদ্ভুত চেহারা নিয়েছেনিজের পঁয়ষট্টি বছরের জীবনের অনেক অকিঞ্চিৎকর কথা তাঁর মনে থাকলেও গত এক বছরের অনেক কথাই তাঁর আর মনে পড়ে নাপাঁচ বছর বয়সে পেয়ারা গাছ থেকে কে তাঁকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল, ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় স্কুলের ফাংশানে কোন আবৃত্তি করে সোনার মেডেল পেয়েছিলেন সেগুলো মনে থাকলেও গতকাল তিনি ঠিক কী খেয়েছেন বা কার সঙ্গে কথা বলেছেন, আদৌ কথা বলেছেন কিনা তার কিছুই তাঁর মনে নেই।
 আজকাল স্মৃতির এই সমস্যা তাঁর দুটো অস্বস্তির মধ্যে একটার কারণ। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর কথা কিন্তু তাঁর বেশ ভালোই মনে আছে। একদম ছবির মত দেখতে পান শ্রাবণ মাসের বৃষ্টিভেজা সেই দিনটা। অনেক লোক হয়েছিল সেদিন। অঞ্জন বারান্দায় অনেকক্ষণ গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারপর উনি গিয়ে পাশে দাঁড়াতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। একদম ছবির মত দেখতে পান এটা। কিন্তু এই অঞ্জন আর সুনয়না কোথায় কী করে চলে গেল তাঁর বিন্দুমাত্র স্মৃতি নেই তাঁর।

দৃশ্য – ১

-      তুমি তাহলে আমার কথায় রাজী হবে না?
-      কী করে হই বল?
-      কিন্তু আমি একদম লজিকাল কথা বলছি বাবা। এত পুরনো একটা বাড়ী, এতটা জায়গা! পাইকপাড়ার মত প্রাইম লোকেশান! খুব ভালো দাম পাওয়া...
-      তোমার বাবাও পুরনো হয়ে গেছে অঞ্জন। তুমি কি তাহলে আমাকেও বেচে দিতে চাও?
-      ননসেন্স! এসব কথার কোন মানে হয় না বাবা! মা মারা যাওয়ার পর তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে!
-      হতে পারে। কিন্তু তাহলেও তোমাকে এই বাড়ী বিক্রির পারমিশান আমি দেবো না!
-      এই তোমার শেষ কথা?
-      হ্যাঁ... আনফরচুনেটলি আমার মৃত্যু অবধি তোমায় অপেক্ষা করতেই হবে।
-      সেটা যাতে তাড়াতাড়ি হয় সেটার ব্যবস্থাও করে ফেলা যায়।
কথাটা বলে গটগট করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল অঞ্জন। সঙ্গে সুনয়নাও। ঘরের বাইরে থেকে তার রিনরিনে গলার আওয়াজ ভেসে এল, “এ বাড়ীতে আর থাকা যায় না। তুমি প্লিজ সল্ট লেকের দিকে একটা ফ্ল্যাট দেখ।”

ভাবনা – ২

সারাটা দিন। একের পর এক স্মৃতি ভেসে আসে। সেই কোন আদ্যিকালের অপ্রয়োজনীয় সব স্মৃতি। কিন্তু একই সঙ্গে কত কত ঘটনার স্মৃতি অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারেননা তিনিএ কী শাস্তি!
এ এক বড় অস্বস্তিকর অবস্থা! এর সঙ্গেই গত বেশ কদিন ধরে আরো একটা জিনিস শুরু হয়েছে। আগে, যখন কৃষ্ণার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন ছবির কাঁচে নিজের ছায়া দেখতে পেতেন সুনির্মলবাবু। এখন আর পান না ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেও পান নাএমনকি দোতলার শোয়ার ঘরের সেই সুপ্রাচীন ড্রেসিং টেবিলের আয়নাতেও আর নিজেকে দেখতে পান না সুনির্মলবাবু। কেন নিজেকে আর দেখতে পান না সেটাও মনে পড়ে না তাঁর। অস্বস্তিটা থেকেই যায়।

দৃশ্য – ২

-      ইয়েস মিস্টার মল্লিক!
-      গুড আফটারনুন স্যার। মার্ডার স্পট থেকে বলছি!
-      কোনটা? গতকালের ওই পাইকপাড়ার কেসটা?
-      ইয়েস স্যার। ওটাই। খুব স্ট্রেঞ্জ কেস স্যার!
-      কেন? একটু ব্রিফ করুন।
-      আপনি তো মোটামুটি জানেন। ভিকটিম রিটায়্যার্ড। ওয়াইফ এক্সপায়ার করেছেন গত বছর। তারপর থেকে ছেলে, ছেলের বউয়ের সঙ্গে থাকতেন। রিসেন্টলি ছেলের সঙ্গে সম্ভবত এই বাড়ী নিয়ে কিছু ঝামেলা হয়েছিল।
-      সেটা কী করে জানলেন?
     -      পাড়ার লোক স্যার! বুঝতেই পারছেন। আর বেশ কয়েকদিন নাকি তর্কাতর্কি বেশ উচ্চকন্ঠেই হয়েছিল, পাড়ার লোক শুনেছে।
     -      ওকে
     -      হ্যাঁ। বেশ কিছুদিন হল, ছেলে-বউকে নাকি আর দেখেনি পাড়ার লোক। উনিও খুব একটা কারো সঙ্গে মেশেন না। তাই কেউ জিজ্ঞেসও করেনি। আর এত বড় বাড়ী স্যার। বাইরে থেকে কিছু বোঝা মুশকিল! নেহাত গতকাল সকালে দুর্গন্ধ পেয়ে পাড়ার লোকে আমাদের খবর দিল, তখন এসে দেখলাম, বসার ঘরের ফ্যান থেকে ঝুলছেন ভদ্রলোক!
     -      কি মনে হচ্ছে? ছেলের হাত থাকতে পারে?
     -      না স্যার। সেটা সম্ভব নয়?
     -      কেন?
     -      কী আর বলব স্যার! পুরো বাড়ী সার্চ করতে গিয়ে ওপরের একটা আঁটকাঠ বন্ধ ঘরে পাশাপাশি দুটো ট্রাঙ্কে ওনার ছেলে আর ছেলের বউয়ের রিমেইন্স পাওয়া গেছে স্যার। টুকরো টুকরো করে কাটা! অন্তত মাস খানেক আগে কিলড্‌।
     -      মাই গুডনেস! কী বলছেন? অস্ত্রটা পাওয়া গেছে?
     -      হ্যাঁ স্যার। একটা রক্তের দাগ লাগা চপার পেয়েছি, টেস্টের জন্য ল্যাবে পাঠিয়ে দিয়েছি।
     -      কোথায় পাওয়া গেল?
     -      আজ্ঞে, বসার ঘরে ওনার স্ত্রীর একটা ছবি আছে, তার পেছনে!
"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”