“কিস্তিমাত!”
কথাটা শুনে দাবার
বোর্ড থেকে মুখটা তুলে একবার প্রতিদ্বন্দ্বীর মুখের দিকে তাকালেন আর্থার। চশমার
আড়ালে তাঁর প্রতিদ্বন্দ্বীর চোখগুলো তখন খুশীতে জ্বলজ্বল করছে। একটা দীর্ঘশ্বাস
ফেলে আবার বোর্ডের দিকেই চোখ ফেরালেন তিনি। কোন রাস্তা আছে কি কিস্তি বাঁচানোর?
বোর্ডের ওপর গুটি
বেশি নেই। অনেকক্ষণ ধরে
খেলা হচ্ছে তাই বেশিরভাগ গুটিই বোর্ডের বাইরে গড়াগড়ি খাচ্ছে। আর্থারের সাদা রাজার
সঙ্গে তিনটে বোড়ে, একটা গজ আর একটা নৌকো আছে। উল্টোদিকে রাজার সঙ্গে গজ, নৌকো তো
আছেই আর আছে একটা ঘোড়া আর সেটা দিয়েই জব্বর কিস্তিটা খেয়েছেন তিনি, রাজাকে সরানোর
কোন রাস্তাই তাঁর কাছে নেই, সরালেও সেটা পড়ে যাবে গজ বা নৌকোর সামনে। অনেকক্ষণ
ভেবেও কোন রাস্তা না পেয়ে বোর্ড ছেড়ে উঠে পড়লেন তিনি। তাঁর প্রতিপক্ষ এতক্ষণ মুচকি
মুচকি হাসছিলেন। এবার তাঁকে উঠতে দেখে বললেন, “কি হল হে ডাক্তার? Dark Knight-এর
চালটায় রণে ভঙ্গ দিলে আজকের মত? আচ্ছা হিসেবটা লিখে রাখি! কত হল বল তো?
২৩৮৭-২৩৪২?”
এই শেষ কথাটায়
কাজ হল! তার আগে অবধি আর্থার কিছু বলেননি, হিসেবটা শুনে তেড়ে উঠে বললেন, “২৩৪২
বললেই হল? কালকেই তো জিতে ২৩৪৫ করলাম! আর তোমারই বা ২৩৮৭ হল কি করে? এক-একবারে ৫
টা করে বাড়িয়ে নিচ্ছ নাকি ব্যানার্জী?”
“আচ্ছা-আচ্ছা, ঐ
তোমার ২৩৮৩-২৩৪৫ ই না হয় হল!” দুষ্টু হেসে ছোট্ট নোটবইটা বন্ধ করলেন ব্যানার্জী,
তবে তাঁর মুখ দেখে কিন্তু মনে হল যে, ঠিক হিসেবটাই তিনি জানতেন, শুধু আর্থারকে
একটু রাগিয়ে দেওয়ার জন্যেই এটা তাঁর একটা প্রচেষ্টা।
সেটাতে কাজও
হয়েছে। আর্থার গজগজ করতে করতে বললেন, “নেহাত বয়সে ছোট, তাই তোমাকে জিততে দি,
নাহলে...”
“বয়সে ছোট কথাটার
মানে কি? আমার বয়সও ৭১, তোমার সমান!”, তাঁকে মাঝখানে থামিয়ে দিয়ে বলে উঠলেন
অন্যজন, মানে যাকে আমরা এখনও ব্যানার্জী বলেই জানি।
হাত তুলে তাঁকে
থামিয়ে দিয়ে আর্থার বললেন, “আঃ! বয়স এক তো কি হয়েছে? আমি তোমার ৪০ বছর আগে
পৃথিবীতে গেছিলাম, তোমার অনেক আগে থেকে পৃথিবী দেখেছি আমি!”
“হ্যাঁ, তাতে কি মাথা কিনে নিয়েছ নাকি ডাক্তার? আমি তোমার
ঠিক ৪০ বছর পর পৃথিবী থেকে পরলোকে এসেছি। তোমার চেয়ে অনেক বেশি আধুনিক দৃষ্টিভঙ্গি
আমার। তুমি তো ১৯৩০-এই কেটে পড়েছিলে পৃথিবী থেকে! আমি ১৯৭০ অবধি ছিলাম, দ্বিতীয়
বিশ্বযুদ্ধ, ভারতের স্বাধীনতা, Cold war... অনেক কিছুই দেখেছি, বুঝলে!” বলে উঠলেন ব্যানার্জী!
************************************************************************************************
বুঝতেই পারছেন যে আমি পরলোকের কথা বলছি। যেখানে মানুষ বিভিন্ন সময়ে এসে
পৌঁছলেও তাঁদের মধ্যে আলাপ জমতে বেশী সময় লাগে না। যেমন ধরুন না এই দুই বৃদ্ধেরই
কথা। জীবিত অবস্থায় দ্বিতীয় জন প্রথম জনের নাম ভালভাবেই জানতেন, কিন্তু দ্বিতীয়
জনের কথা প্রথম জন পরলোকে আসার আগে শুনেছিলেন বলে মনে হয় না। এখনকার ঘনিষ্ঠতা
অবশ্য এনাদের কথা শুনলে আর দাবার রেষারেষি দেখলেই বোঝা যায়। হবে নাই বা কেন?
দুজনের মধ্যে মিলের অভাব নেই। দুজনেই লেখালেখি করে থাকতেন। সামান্য বলতে পারলাম
না, অন্তত যার লেখা নিয়ে ১২টা রচনাসমগ্র হয় তাঁর লেখার পরিমান সামান্য বলি কি করে।
প্রথম জন জাতিতে স্কটিশ, পেশায় ডাক্তার, লেখালেখিতে পারদর্শী। লেখার মধ্যে
ঐতিহাসিক উপন্যাস, অ্যাডভেঞ্চারের গল্প, ভূতের গল্প তো আছেই তবে তাঁর সর্বাধিক
খ্যাতি একটি গোয়েন্দা চরিত্রের রচনার জন্য। চরিত্রটি আমাদের অতি প্রিয় শার্লক
হোমস, সুতরাং ভদ্রলোক যে আর্থার কোনান ডয়াল সেটা বোধ হয় না লিখলেও চলত।
দ্বিতীয় জন বাঙ্গালী সেটা নিশ্চয়ই ওনার নামের শেষাংশ শুনেই বুঝেছেন, ইনি আইন
পাস করলেও লেখার ক্ষেত্রেই এনার খ্যাতিটি। “লেখার মধ্যে ঐতিহাসিক উপন্যাস, অ্যাডভেঞ্চারের গল্প, ভূতের গল্প তো আছেই
তবে তাঁর সর্বাধিক খ্যাতি একটি গোয়েন্দা চরিত্রের রচনার জন্য।” এতক্ষণে বুদ্ধিমান
পাঠক/পাঠিকারা নিশ্চয়ই বুঝেই ফেলেছেন তবু বলি এনার নাম শরদিন্দু বন্দ্যোপাধ্যায়,
ব্যোমকেশের স্রষ্টা।
পরলোকে এদের বন্ধুত্ব
প্রবাদপ্রতিম, রোজই আড্ডা, দাবা খেলা, নিজেদের আর অন্যদের লেখা নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা
চলতেই থাকে। শরদিন্দু কিছুদিন বলিউডে চিত্রনাট্য লিখেছিলেন, সেই সিনেমাগুলোও দেখা
হয়, আর সেগুলো দেখতে গিয়েই কোনান ডয়ালের হিন্দি সিনেমা দেখার বেশ নেশা হয়ে গেছে।
শরদিন্দু অবশ্য আজকালকার হিন্দি সিনেমা দু চোখে দেখতে পারেন না, তাই কোনান ডয়াল
কখোন-সখোন তাঁর কাছ থেকে লুকিয়ে-চুরিয়ে বলিউডি সিনেমা দেখে থাকেন!
মাঝেমধ্যে
হয়তো এঁদের আড্ডায় আগাথা ক্রিস্টি, আলফ্রেড হিচকক বা সত্যজিৎবাবুও যোগদান করেন তবে
তা বেশ অনিয়মিত। সত্যজিতের আসলে বেশিরভাগ সময়টাই কেটে যায় আকিরা কুরসোয়ার সঙ্গে,
এখানে এসেও ভালো সিনেমা দেখায় কোন ক্লান্তি নেই তাঁদের! যাকগে সে অন্য গল্প, অন্য
আরেকদিন হবে!
************************************************************************************************
দুই বৃদ্ধ হাঁটতে
হাঁটতে বারান্দায় এসে বসলেন। এখান থেকে দূরে দিগন্তের দিকে তাকিয়ে ঘন্টার পর ঘন্টা
বসে থাকা যায়। সামনে টেবিলে কফি রাখা ছিল। শরদিন্দু তার থেকে কফি ঢাললেন দুটি
কাপে। একটি এগিয়ে দিলেন কোনান ডয়ালের দিকে। কোনান ডয়াল তখনও বেশ অন্যমনস্ক, হয়তো
এখনও দাবার চালের কথাই ভাবছেন। শরদিন্দুর বাড়িয়ে দেওয়া কফির কাপ নিয়ে তাতে আলতো
একটা চুমুক দিলেন।
“চিনি ঠিক আছে?”
শরদিন্দুর প্রশ্নের উত্তরে আনমনেই মাথা নাড়লেন তিনি। দৃষ্টি তখনও দিগন্তে।
শরদিন্দু পাশের টেবিল
থেকে একটা বই তুলে নিয়ে সেটা কোনান ডয়ালের দিকে এগিয়ে দিয়ে বললেন, “এই বইটা
দেখেছ?”
এতক্ষনে কোনান ডয়াল
তাকালেন শরদিন্দুর দিকে, শরদিন্দুর হাতের বইটার নাম ‘The House of Silk’।
“হুম... এইটা পড়েছি।
বছর খানেক আগেই বেড়িয়েছিল।”
“তা ঠিক, আমি অবশ্য এই
কদিন আগেই পড়লাম। কেমন বুঝলে ডাক্তার?’’
“মন্দ কি? অ্যান্টনি হরউইজ
ছেলেটি ভালই লেখে, বাচ্চাদের জন্য আগেও বেশ কিছু জনপ্রিয় বই লিখেছে। লেখার হাত বেশ
মসৃণ।”
“তা তো হতেই হবে। নাহলে
তোমার এস্টেট ওকে লেখার দ্বায়িত্বই বা দেবে কেন? ভেবে দেখ তোমার মৃত্যুর ৮০ বছর পর
প্রথম কাউকে দেওয়া হল এটা লিখতে!”
“ঠিক বলেছ। এদিক-ওদিকে
বেশ কয়েকজন লিখেছে, তার কয়েকটা পড়েওছি, বেশিরভাগই অপাঠ্য!” মাথা নাড়লেন আর্থার,
“তুমি তো নিজে লেখক ব্যানার্জী, তুমি নিশ্চয়ই জানো যে, নিজের সৃষ্টি নিয়ে এরকম
নয়ছয় করলে কেমন লাগে!”
“সে আর বলতে!” নিজের
মনে একটা দীর্ঘশ্বাস ফেললেন শরদিন্দু।
“তবে এই বইটা আলাদা...”
শরদিন্দুর হাত থেকে বইটা নিয়ে পাতা ওলটাতে ওলটাতে বললেন কোনান ডয়াল, “আমার লেখার style অনেকটাই
ধরে রেখেছে হরউইজ। সেই বিংশ শতাব্দীর প্রথম দিককার লন্ডন, কুয়াশা, ঘোড়ার গাড়ি...
সেই সঙ্গে শার্লক আর ওয়াটসনের সম্পর্ক, শার্লকের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা, ছদ্মবেশ...
সবই এসেছে গল্পটায় ।”
মাথা নাড়লেন শরদিন্দু,
“ঠিক বলেছ, এগুলো আমিও লক্ষ্য করেছি, বিশেষ করে চরিত্রগুলো যেভাবে ধাপে ধাপে গড়ে
তুলেছে সেটা ভালো লাগল, তবে গল্পের প্লটটা একটু যেন বেশি জটিল...”
“একদম!” তাঁকে থামিয়ে
দিয়ে বলে উঠলেন কোনান ডয়াল, “শার্লকের কিছু গল্পের প্লট কিন্তু বেশ জটিল এবং
দীর্ঘ, যেমন ধর ‘The Hound of Baskervilles’। কিন্তু
এই গল্পটার প্লট পুরো অন্যরকম, সেই আমেরিকায় ছবি চুরি দিয়ে শুরু, তারপর আইরিশ
চোরের দল, আফিমের আড্ডা, শার্লককে ফাঁসিয়ে দেওয়া, সত্যি কথা বলতে কি, আমার তো এটা
পড়তে পড়তে অনেক সময় আগাথার লেখার কথা মনে পরে যাচ্ছিল!”
“সেটা অবশ্য আমার তেমন
মনে হয়েনি।”
“না ব্যানার্জী, তুমি
ভেবে দেখ, এই গল্পে ওদের যে adventure বা ধর ঐ climax টা, সেগুলো কিন্তু আমার
গল্পের চেয়ে আগাথার গল্পের সঙ্গেই মিল বেশি। আমি চাইলে হয়তো ওরকম লিখতে পারতাম
কিন্তু অত ঘটনাবহুল করিনি খুব বেশি সময়।”
“তা ঠিক!” মেনে নিলেন
শরদিন্দু। কফির কাপে একটা চুমুক দিয়ে বললেন, “তবে যাই বল, হোমসকে নিয়ে কিন্তু বেশ
অভিনব কিছু কাজ হচ্ছে আজকাল।”
“তা হচ্ছে।” স্বীকার
করে নিলেন আর্থার, “তা ধর, BBC তো ঐ
৬টা এপিসোড দেখাল ‘শার্লক’-এর। শার্লক আর জন একবিংশ শতাব্দীর লন্ডনে, সমস্ত রকম
অত্যাধুনিক গবেষণার সুযোগ শার্লকের হাতের মুঠোয়। জনের সঙ্গে প্রথম আলাপে জনের ফোন
দেখে ওর সমন্ধে সব তথ্য দিয়ে চমকে দেয় শার্লক, আইরিন অ্যাডলারের smartphone এ থাকে রাজবাড়ির কোন অল্পবয়স্ক
সদস্যের গোপন ছবি, বাস্কারভিল হয়ে যায় সেনাবাহিনীর গোপনীয় গবেষণাগার... কিন্তু
তবুও দেখতে ভালো লাগে। কারণ গল্পগুলো যারা লেখে শার্লকের গল্পের মূল চরিত্রটাকে
ধরে রাখতে পেরেছে, হ্যাঁ শার্লক হোমস প্রচন্ড খামখেয়ালি, এমনকি অনেক জায়গাতেই
কর্কশ, অপরাধ ঘটলে খুশী হয় সে, show-off ও কম নেই, কিন্তু
তবু কোথাও যেন আমার সৃষ্টি শার্লকের সঙ্গে এই শার্লকের আত্মার যোগ, আর তাই এটা
দেখতে এত ভালো লাগে।”
শরদিন্দু বললেন, “আমি কিন্তু দেখতে চাই ঐ নকল আত্মহত্যার ঘটনাটা কিভাবে
ব্যাখ্যা করে ওরা। কারণ দেখে কিন্তু খুব সহজ সরল মৃত্যু মনে হয়েছে। সন্দেহের কোন
জায়গাই নেই।”
“ঠিক বলেছ, সেটা আমিও দেখতে চাই, ২০১৩-র শুরুর দিকে নাকি পরের এপিসোডগুলোর
শুটিং শুরু হবে শুনলাম, তবে আমার একটা জিনিস ভালো লেগেছে। শার্লক যে বেঁচে আছে
সেটা কিন্তু ওরা শেষ করার আগে দেখিয়ে দিয়েছে!”
“দেখ, ‘The Final Problem’
গল্পটা হোমসের সবচেয়ে বিখ্যাত গল্পগুলোর মধ্যে একটা, খুব কম লোকই আছে যারা শার্লক
পড়েছে কিন্তু এই ঘটনার কথা জানে না, তাই এই জিনিসটা চেপে রাখলেও লাভ হত না।”
আর্থার হাসলেন, “বাব্বা! আমার এখনও মনে আছে, সেই যেবার আমি শার্লককে মেরে
ফেললাম, তারপর কত যে চিঠি এসেছিল কি বলব! কি করব বল, শার্লক যে আমার সেরা কীর্তি
সেটা আমি বুঝেছিলাম কিন্তু আমার তো অন্য লেখালেখিও ছিল, বল। ঐতিহাসিক উপন্যাসগুলো
নিয়ে কি পরিমাণ পড়াশুনো করতে হয় সেটা আর কেউ না জানুক, তুমি তো জানো ব্যানার্জী।
তাই মেরেই ফেললাম শার্লককে। তখন কি আর জানি যে, আরও ২৫ বছর ধরে লিখতে হবে শার্লকের
গল্প।”
শরদিন্দু হাসলেন। খুব ভালো করেই জানেন তিনি। তবে ব্যোমকেশকে নিয়ে লিখতে গিয়ে
১৯৬৫ সালের ‘তুঙ্গাভদ্রার তীরে’-এর পর আর ঐতিহাসিক উপন্যাস লেখা হয়ে ওঠেনি তাঁর।
অবশ্য ঐ উপন্যাসের জন্যেই রবীন্দ্র পুরষ্কার পেয়েছিলেন তিনি। তাঁর অনেক পাঠকের মতে
ওটাই ওনার শ্রেষ্ঠ উপন্যাস, তাই শেষটা মন্দ হয়নি বোধহয়।
ব্যোমকেশকে নিয়ে অবশ্য শেষ দিন পর্যন্ত লিখে গেছেন। ‘বিশুপাল বধ’টা শেষ করে
আসা হয়নি। একটু মন খারাপ তো থেকেই যায়। গল্পটা মন্দ ভাবেননি তিনি। যাকগে কি আর করা
যাবে!
শরদিন্দু যখন এসব ভাবছিলেন ততক্ষনে আর্থার কফিটা শেষ করলেন, তারপর ফাঁকা কফির
কাপটা টেবিলে নামিয়ে রেখে বললেন, “তবে ঐ সিনেমা দুটো আমার মোটেই পছন্দ হয়েনি!”
“কোন সিনেমা দুটো?”
“আরে ঐ যে গাই রিচি বলে লোকটা বানিয়েছে, রবার্ট ডাউনি বলে ছেলেটা শার্লক
হয়েছে! ওটা শার্লক হোমস না জেমস বন্ড সেটাই আমি মাঝে মধ্যে বুঝতে পারি না!”
“ও... ওইটা? আমি তো ওটার সেকেন্ডটা দেখিওনি এখনও, প্রথমটাই যে কি বিচ্ছিরি
লেগেছিল কি বলব! কিছু মনে কর না ডাক্তার, তবে ঐ সিনেমা দুটো একদম পদের নয়!”
কোনান ডয়াল শরদিন্দুকে থামিয়ে দিয়ে বললেন, “আরে বাবা, মনে করার আছেটা কি? ও
জিনিসটাকে আমি ত্যাজ্য করেছি। ওগুলোকে শার্লকের সিনেমা বলেই আমি মনে করি না। তার
চেয়ে বরং তোমার ব্যোমকেশকে নিয়ে বানানো সিনেমাগুলোর কথা বলা ভালো!”
“ব্যোমকেশ নিয়ে সিনেমা! সেগুলো নিয়ে বেশি কথা না বলাই ভালো।” শরদিন্দু মাথা
নাড়লেন।
“কেন? এখনও অবধি তো তোমার লেখা ব্যোমকেশ নিয়েই কাজ হচ্ছে। শার্লকের মত নতুন
কোন গল্প লেখার সাহস কেউ দেখায়নি।”
“সেটা ঠিক, বাংলাতে সেরকম কাজ কখোনই খুব বেশি হয়নি, ফেলুদা বল, ব্যোমকেশ বল...
কিন্তু আমার গল্প নিয়েও যা হচ্ছে তাতে অনেক সময় মনে হয় আমার কপালে ওকে নিয়ে বানানো
ভালো সিনেমা দেখা নেই!”
“কেন বল তো?”
শরদিন্দু একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, “তা ধর, ব্যোমকেশকে নিয়ে কাজ তো আজ থেকে
হচ্ছে না। সেই চিড়িয়াখানা নিয়ে মাণিক সিনেমা বানিয়েছিল আজ থেকে ৪৫ বছর আগে,
১৯৬৭তে। মাণিকের সিনেমা, তাতে উত্তম ব্যোমকেশ, ভেবেছিলাম দারুণ হবে কিন্তু...”
“হ্যাঁ, ওটা দেখেছিলাম বলে মনে হচ্ছে।”
“হ্যাঁ, দেখেছ... তাই জানবে, মাণিক ওটা কি বানিয়েছিল! চিত্রনাট্য একদম জোরদার
নয়, ব্যোমকেশের পোষা সাপ, ব্যোমকেশ বিবাহিত... পুরো চরিত্রটাই বদলে দিয়েছিল। তারপর
তো আবার চীনে না জাপানী সেজে গিয়ে হাজির হবে গোলাপ কলোনিতে! পুরো ব্যাপারটাই ঘেঁটে
গেছিল একদম!”
“তুমি মাণিককে জিজ্ঞেস করনি কখনো এই সিনেমাটার কথা?”
“কথা বলেছি, জান তো ডাক্তার। মাণিকেরও একদমই পছন্দ নয় সিনেমাটা। আগেও বলেছে
এটা ওর নিজের বানানো সবচেয়ে অপছন্দের সিনেমা। আসলে এই ‘whodunit’ জাতীয় গল্প নিয়ে সিনেমা বানাতে ও
একদম স্বাচ্ছন্দ্য ছিল না। শুনেছি এটা নাকি আসলে ওর কোন সহকারীর বানানোর কথা ছিল,
সে ব্যাটা শেষ মুহূর্তে নার্ভাস হয়ে পড়ায় মাণিক ওটা বানায়। ওর পরিকল্পনা ছিল না
ওটার।”
“এহেহ!” মাথা নাড়লেন কোনান ডয়াল, “গল্পটা নিয়ে কিন্তু ভালো সিনেমা হতে পারত,
এতগুলো অদ্ভুত চরিত্র তোমার বেশী গল্পে নেই!”
“জানি আমি, আর তাই তো মনে হয় যে ব্যোমকেশের কপালটাই খারাপ!”
“হুঁ... তারপর?”
“তারপর আর কি?” শরদিন্দু বললেন, “১৯৭৪ সালে মঞ্জু দে ‘সজারুর কাঁটা’ নিয়ে
সিনেমা বানিয়েছিল, ব্যোমকেশ করেছিল সতিন্দ্রনাথ ভট্টাচার্য বলে একটা ছেলে, কিন্তু
চলেনি ভালো, খুব বেশী লোক দেখেছিল বলেও মনে হয় না!”
“আমিও দেখিনি!” স্বীকার করলেন কোনান ডয়াল!
“এর পর আবার ব্যোমকেশ নিয়ে কাজ হয়ে ১৯৯৩ তে! তবে বাংলায় নয় হিন্দিতে। বাসু
চ্যাটার্জী বলে এক পরিচালক ব্যোমকেশকে নিয়ে টিভিতে সিরিয়াল বানিয়েছিল। অনেকগুলো
এপিসোড, আর একদম প্রথম থেকে আমার গল্পের order মেনে একটার পর একটা বানিয়েছিল। বেশ জনপ্রিয়ও হয়েছিল সেই সময়!”
“ব্যোমকেশের অভিনয় কে করেছিল?” কোনান ডয়ালের প্রশ্ন।
“ব্যোমকেশ হয়েছিল রজিত কাপুর বলে একটি ছেলে, আর অজিত হয়েছিল কে. কে. রায়না!
রজিত ছেলেটি মূলত নাটকে অভিনয় করত। খুব ভালো করেছিল, আজ অবধি শ্রেষ্ঠ ব্যোমকেশ ওই।
তবে কি জান, ঐ ৯৩-৯৪ সালে আমিও যখন দেখেছিলাম ভালোই লেগেছিল, তবে পরে আবার দেখেছি,
বেশ কিছু গন্ডগোল আছে। আসলে কম পয়সায় বানানো তো, সেট সেরকম উন্নত মানের নয়, কাপড়ের
দেওয়াল দেখলেই বোঝা যায়। এমনকি আভিনয়ও অনেকেরই বেশ খারাপ!”
“সে যাই হোক, তবু তুমি যখন বলছ যে রজিত ছেলেটি শ্রেষ্ঠ ব্যোমকেশ তখন দেখা
উচিত। কোথায় পাব?”
“ডিভিডি আছে বাজারে, তবে চাইলে টরেন্ট থেকেও নামিয়ে নিতেই পারো।”
কোনান ডয়াল মাথা নাড়লেন।
শরদিন্দু বলে যাচ্ছিলেন, “এরপরে আর কিছু ছোটখাটো বাংলা সিরিয়াল, সিনেমা এসব
হয়েছে, মাঝে কথা হয়েছিল যে ঐ ঋতুপর্ণ ছেলেটি প্রসেনজিৎ কে ব্যোমকেশ বানিয়ে সিনেমা
বানাবে...”
ফিক করে হেসে ফেলেছিলেন কোনান ডয়াল, সামলে নিলেন।
“...শেষ অবধি সিনেমা বানালো অঞ্জন দত্ত!”
“অঞ্জন দত্ত! সে কে?”
“এটার উত্তর যদি জানা থাকতো! ছোকরা এক কালে সিনেমায় অভিনয় করত, মৃণালের বেশ
কিছু ছবিতে ছিল। তারপর গান লিখতে আর গাইতে শুরু করল। জীবনমুখী, ঐ সুমন, নচিকেতাদের
সঙ্গে। সে ভয়ঙ্কর সব গান... হয় দার্জিলিং নাহলে ব্যর্থ প্রেম... এই দুটোই বিষয়...”
“এই দার্জিলিং আমি জানি! ওখানে ‘ম্যায় হুঁ না’-র শুটিং হয়েছিল!” বলে উঠলেন
কোনান ডয়াল!
শরদিন্দু প্রখরভাবে কোনান ডয়ালের দিকে তাকিয়ে বললেন, “আজকাল এইসব সিনেমা দেখছ
নাকি হে ডাক্তার! বয়স তো কম হল না!!”
কোনান ডয়াল একটু থতমত খেয়ে গিয়ে বললেন, “আহা রাগ করো না ব্যানার্জী। তুমি দেখ,
তোমারও দারুণ লাগবে! খুব মজার সিনেমা! আমি তো পুরোটা দেখিনি তাতেই ৭৩টা ভুল আর
২৭টা টোকা জায়গা খুঁজে পেয়েছিলাম! Amazing!”
শরদিন্দু গজগজ করতে করতে বললেন, “তা বসেছিলে যখন পুরোটা দেখেই উঠতে, তোমার
গঙ্গাপ্রাপ্তি সম্পূর্ণ হত!”
“ আরে পুরো দেখারই তো প্ল্যান ছিল, আসলে তোমাদের ঐ হিরো যখন একটা সাইকেল রিকশা
নিয়ে একটা বোলেরোকে ধাওয়া করল তখন আমি হাসতে হাসতে চেয়ার থেকে পড়ে গেছিলাম!
বিশ্বাস কর! যাকে বলে literally ROTFL!!”
“যাকগে, বাজে কথা ছাড়। তা এই অঞ্জন ছোকরা আজকাল সিনেমাও বানায়, উদ্ভট যত নাম
দিয়ে। সে ঠিক করল যে ব্যোমকেশ নিয়ে সিনেমা বানাবে। আদিম রিপু নিয়ে প্রথম সিনেমাটা
বানাল, নাম দিল ব্যোমকেশ বক্সী!”
“যাহ্! গল্পের নাম দিল না!” অবাক হলেন কোনান ডয়াল!
“শুধু তাই নয়, গল্পের সময়কাল বদলে দিল, চরিত্রগুলোকে বদলে দিল, ব্যোমকেশকে বারে
বসিয়ে মদ খাওয়ালো... এমনকি শেষটাও বদলে দিল!”
“শেষটা বদলে দিল মানে? আদিম রিপু গল্পের শেষটাই তো আসল হে! সেই যে তোমাদের
স্বাধীনতার দিন ব্যোমকেশ গরম লোহার আংটা দিয়ে একটা একটা করে টাকা পুড়িয়ে ছাই করে
দিল! Impact টাই অন্য রকম!”
“তাহলে আর বলছি কি! এক তো ছোকরা গল্পটাকে ১৯৬০ সালে এনে ফেলেছিল, কেন কে জানে!
আর শেষে ব্যোমকেশ নাকি টাকাগুলো নিয়ে গঙ্গায় ফেলে দিয়ে এলো। তার চেয়ে পুরো সিনেমাটাই ধরে গঙ্গায়
ফেলে এলে পারতো।”
শরদিন্দু উঠে একটা জলের বোতল নিয়ে এলেন, “দ্বিতীয়টা আর এক কাঠি সরেস। চিত্রচোর
নিয়ে সিনেমা, গল্পটা মোটামুটি ঠিকই ছিল, কিন্তু চরিত্রগুলোর কোন মাথা মুণ্ডু নেই।
ব্যোমকেশ মাঝখানে বন্দুক বের করে চালিয়ে দিল। দুর... দুর, তার মধ্যে আবার এই
সিনেমার নাম ‘আবার ব্যোমকেশ’, ছোকরা নাকি একটা তিন নম্বর সিনেমাও বানাবে ‘কহেন কবি
কালিদাস’ নিয়ে, সেটার নাম কি দেবে ভেবে আতঙ্কিত হচ্ছি!!”
“বারবার ব্যোমকেশ!” মুচকি হেসে বললেন কোনান ডয়াল! “এটাতে আবার ব্যোমকেশ কে
হল?”
“হয়েছে আবীর বলে একটি ছেলে, অভিনয়টা মন্দ করে না, ওর বয়সী বাকি বাঙ্গালী
অভিনেতাদের চেয়ে ভাল, আর অজিত হয়েছে শাশ্বত...”
“এক মিনিট! শাশ্বত মানে ঐ বব বিশ্বাস আর হাতকাটা কার্তিক?”
“হ্যাঁ ঠিকই ধরেছ! ওহ... সে আর এক কান্ড! আচ্ছা বল দেখি ব্যোমকেশের সহকারী কে?
আমি?”
“না, অজিত বন্দ্যোপাধ্যায়, তোমার alter-ego
বলা যায়।”
“একদম! কিন্তু এই ‘আবার ব্যোমকেশ’ দেখতে গিয়ে জানতে পারলাম যে ব্যোমকেশের
সহকারী নাকি আমি নিজেই! আয়্যসা রাগ হয়েছে কি বলব!”
“মানে? সে আবার হয় নাকি?”
“আর বল কেন? হঠাৎ দেখি একটা চরিত্র এসে শাশ্বতকে বলছে, আপনার লেখা আমার দারুণ
লাগে, ঝিন্দের বন্দী পড়ে খুব ভালো লেগেছিল! আর আবীর মানে সবজান্তা ব্যোমকেশ তাকে
বোঝাচ্ছে যে, ঐ যে ঝিন্দের বন্দী ওটা কিন্তু অ্যান্টনি হোপের ‘Prisoner of Zenda’ থেকে টোকা!”
কোনান ডয়াল নিজেই উত্তেজিত হয়ে বললেন, “এটার মানে কি! এর চেয়ে খারাপ তো আর
কিছু হতে পারে না! ভয়ঙ্কর!!”
“হ্যাঁ” শরদিন্দু হতাশ ভাবে মাথা নাড়লেন, “এই সবই হচ্ছে, বাঙ্গালীরাও দুধের
স্বাদ ঘোলে মেটানোর মত এইসব জিনিস দেখছে। সাধে কি বলেছি যে, ব্যোমকেশের ভাগ্যটাই
খারাপ!”
দুজনেই কিছুক্ষণ চুপ করে বসে রইলেন। শরদিন্দু একটু আনমনা হয়ে পড়েছিলেন। কোনান
ডয়ালই বা কি বলবেন। তাঁরা লেখক, তাঁরা সাহিত্য সৃষ্টি করেন, এরপর তা যখন সিনেমা বা
টিভি তে রূপান্তরিত হয় তখন তাঁদের আর কিছু করার থাকে না। শুধু আশা থাকে যে, হয়তো
তাঁদের লেখা যোগ্য মর্যাদা পাবে, হয়তো পরিচালক তাঁদের লেখার মূল সুরটিকে ধরে রাখতে
পারবেন। এটুকুই হয়তো তাঁদের প্রাপ্য।
· লেখার অধিকাংশ মতামত আমার নিজের, অনেকে এর সঙ্গে একমত নাও হতে পারেন, তবে সেই নিয়ে আলোচনা সব সময়ই স্বাগত।
· কোনান ডয়াল আর শরদিন্দু নিজেদের মধ্যে কোন ভাষায় কথা বলতেন সেটা নিশ্চয়ই কেউ জানতে চাইবেন না, চাইলে বলি পরলোকে সবাই সব ভাষাতেই পারদর্শী, অসুবিধা হয় না!