Thursday, August 15, 2013

স্বাধীনতা দিবস

সকালে ঘুম থেকে উঠেই মনটা ভালো হয়ে গেল। আজকে স্বাধীনতা দিবস। ছুটির দিন। কাল সকালেই ফেসবুকের কভার ফোটোর যায়গায় একটা দারুণ তিরঙ্গা দেওয়া দেশাত্মবোধক ছবি গুগল থেকে খুঁজে লাগিয়েছি। অনেকগুলো ‘লাইক’ও পড়েছে। সঙ্গে প্রোফাইল পিকের যায়গায় আমার প্রিয় বিপ্লবী ভগৎ সিং এর ছবি।
আরো অনেকেই দেখলাম এরকম লাগিয়েছে আর রাত বারোটা বাজার সঙ্গে সঙ্গেই তো চারদিকে সবাই দেশাত্মবোধক স্ট্যাট্যাস দিতে ব্যস্ত হয়ে পড়েছিল। আমিও লিখে দিলাম, ‘Wishing everyone a happy 67th Independence Day! Proud to be an Indian!! Jay Hind!!!!!!!!!!!!!!!!!!!’

তখনই বেশ কয়েকটা ‘লাইক’ পড়ে গেছিল, এখন লগ-ইন করে দেখলাম মোট ১৭টা ‘লাইক’! বাঃ বাঃ!

যাকগে আজকে আর বাড়িতে খাওয়ার ইচ্ছে নেই। ব্যাঙ্গালোরে এমনিতেই রোজ নিজে রান্না করে খেতে হয়, আজকে ঠিক করলাম চা-টা অবধি নিজের হাতে বানাবো না। দাঁত মেজে পাড়ার মোড়ের বেকারিতে গিয়ে চা আর কেক অর্ডার দিলাম। ৮-১০ বছরের ছেলেটা, ভেঙ্কটেশ না নাগার্জুনা কি একটা যেন নাম, আমি তো ‘ছটু’ বলেই ডাকি, এসে চা এর গ্লাস দিয়ে গেল।
নাহ্‌ চা টা সত্যিই ভালো হয়েছিল, বেশ নিজের মনে জম্পেশ করে চা আর কেক খাচ্ছিলাম। খেতে খেতে দেখছিলাম ছটু এদিক ওদিকে ঘুরে ঘুরে চা দিচ্ছে, কুচকুচে কালো গায়ের রঙ, নোংরা সাদা গেঞ্জি, হাফ প্যান্ট, মাথায় কতদিন তেল পড়েনি তার ঠিক নেই। মাঝখানে আবার দৌড়ে গিয়ে পাশের গ্যারাজে চার কাপ চা দিয়ে এল। দেখে বেশ খারাপ লাগলো, শিশু শ্রমিক ব্যাপারটা দেশ থেকে তুলে দেওয়া উচিৎ। চা শেষ হয়ে গেল তো ছটুকে ডেকে কাপটা আর পয়সা দিয়ে বাড়ি চলে এলাম।

বাড়ি ফিরে স্নান-টান করে বেশ সেজে গুজে জিন্স আর পাঞ্জাবী পড়ে বেরোলাম। ফেসবুক ততক্ষণে পুরো গেরুয়া-সাদা-সবুজ ছবিতে ভর্তি হয়ে গেছে!

বাড়ি থেকে সোজা ব্রিগেড রোড চলে এলাম। এখানটা এলেই আমার বেশ কলকাতার নিউ মার্কেট চত্বরের কথা মনে পড়ে যায়। ঐরকম পর পর অনেক দোকান আর প্রচুর মানুষের ভিড়। আর আজকে ১৫ই আগস্ট বলে তো ভিড় আরো বেশি। চারদিকে প্রচুর মামণি রংবেরঙের জামা-কাপড় পরে ঘুরছে। কেউ বয়ফ্রেন্ডের সঙ্গে কেউ বা একা বা নিজের বান্ধবীদের সঙ্গে। অনেকের হাতেই ছোট ছোট প্লাস্টিকের জাতীয় পতাকা, দু-একজন তো দেখলাম বেশ বড় কাপড়ের পতাকা নিয়েও এসেছে!
আমি একাই, সঙ্গে আসার মত কেউই তেমন নেই, মনের আনন্দে ঝাড়ি মারতে লাগলাম। এই রকমই চার সুন্দরীর একটি দলের পেছনে পেছনে একটা রেস্টুরেন্ট ঢুকে খেয়েও নিলাম। মেয়েদের পিছু নিয়েছি শুনে নাক কুঁচকবেন না। শুধু তো পেছন পেছন গেছি আর ওদের ছোট টপ, লো কাট জিন্স আর হট প্যান্টের জন্য একটু ঝাড়ি মেরেছি, আর তো কিছুই করিনি রে বাবা।

খেয়ে দেয়ে বেরিয়ে ভাবছি কি করা যায়, হঠাৎ একটা ভিখিরি বাচ্চা এসে পয়সা চাইতে লাগল। দিলাম তেড়ে ধমক, যতসব ভুলভাল ব্যাপার, পয়সা দিই আর তারপর সেই পয়সা দিয়ে নেশা করে মরুক! এইজন্যেই দেশের কিচ্ছু হচ্ছে না!
কালকে থেকেই সিনেমা দেখার ইচ্ছে ছিল কিন্তু কালকে অনলাইন বুকিং করতে গিয়ে দেখেছি বেশিরভাগ মাল্টিপ্লেক্সেই সব টিকিট শেষ। হঠাৎ খেয়াল হল এখানে একটা আগেকার দিনের সিঙ্গল থিয়েটার সিনেমা হল আছে। সেখানেও গিয়ে দেখি গুচ্ছ ভিড়, ১০০ টাকা, ১৫০ টাকা সব জায়গাতেই হাউসফুল বোর্ড ঝুলছে। মন খারাপ করে ফিরে আসছি হঠাৎ দেখি একটা লোক ভিড়ের মধ্যে এদিকওদিক তাকাচ্ছে আর প্রায় ফিসফিস করে বলছে “শ কে দোশো... শ কে দোশো”
ওহ, ব্ল্যাক করছে বাবু! বললাম, “আচ্ছা সিট মিলেগা?”
“জরুর!” বলে টিকিট বের করে দেখিয়ে দিল, পেছন থেকে চার নম্বর রো-এর টিকিট। কি আর করি, লোকটার কাছ থেকে টিকিট নিয়ে নিলাম দুশো টাকা দিয়ে, একটু দরদামের চেষ্টা করলাম, লোকটা খুব একটা পাত্তা দিল না, অনেক ডিমান্ড! সে যাকগে, ভগবানের দয়ায় মাস গেলে মন্দ তো আসে না ব্যাঙ্কে।

সিনেমা শেষ হওয়ার পর যখন বেরোলাম তখন সন্ধ্যে হয়ে গেছে, ব্রিগেড রোডের দোকানগুলোতে সব আলো জ্বলে উঠছে। উদ্দ্যেশ্যহীন ভাবে এদিক-ওদিক ঘুরছিলাম হঠাৎ একটা গন্ডগোল শুনে দেখি একটা বাইকের ওপর দুটো ছেলেকে পুলিশ ধরেছে। মজা দেখার জন্য কাছাকাছি গিয়ে দাঁড়ালাম। ছেলে দুটো একেবারেই নিরীহ, ভিড়ভাট্টার মধ্যে ভুল করে ‘নো এন্ট্রি’ তে ঢুকে পড়েছে, আর ব্যাস! ধরেছে পুলিশ। আরো বুঝলাম ছেলে দুটো কন্নড় জানে না, হিন্দিতে বোঝাবার চেষ্টা করছে, আর পুলিশটাও সেরকম, হাবভাব করছে যেন হিন্দি জানেই না, যা বলার কন্নড়েই বলতে হবে। নিজে কন্নড়ে প্রচন্ড হম্বিতম্বি করছে ছেলেগুলোকে ভয় দেখানোর জন্য। ওরা যত বোঝাতে যায় পুলিশটা ততই “নো হিন্দি... নো হিন্দি” বলে যাচ্ছে।
আমার ৭ বছর হয়ে গেল এখানে, কন্নড় মোটামুটি কাজ চালানোর মত বলতে আর বুঝতে পারি। প্রথমে ভাবলাম ছেলেগুলোকে হেল্প করি, তারপর ভাবলাম, ‘কি দরকার বাঁড়া পুলিশকে ঘাঁটিয়ে কখন কেস দিয়ে দেবে ব্যাম্বু হয়ে যাবে!’ কেটে পড়লাম ওখান থেকে। ছেলেগুলো তখন পকেট থেকে পার্স বের করেছে আরো ঘোর বাইক নিয়ে!

সারা সন্ধ্যে ওখানেই ঘুরলাম, লোকজনের কি অবস্থা, ভিড়ে-ভিড়াক্কার, গুঁতোগুঁতি করে সবাই ঘুরছে। হঠাৎ দেখলাম রাস্তার ধারে একটা জাতীয় পতাকা পড়ে আছে। বোধ হয় কেউ এনেছিল তারপর ফেলে দিয়ে চলে গেছে। লোকজনও সেরকম, ওটাকেই মাড়িয়ে চলে যাচ্ছে। কাদা-ফাদা লেগে কি অবস্থা ওটার! তুলে নিলে হত, কিন্তু ঐ নোংরা পতাকাটা হাতে নিয়ে কোথায় ঘুরব! কাটিয়ে দিলাম! অনেক লোক আছে, কেউ না কেউ তুলে নেবে। অত ভেবে লাভ নেই!

তারপর একটা পিৎজা দিয়ে ডিনার করে অটো ধরলাম বাড়ি ফেরার জন্য। বাড়ির কাছে এসে কি মনে হল, দুটো স্টপ আগেই অটো থেকে নেমে পড়লাম। সবে দশটা বাজে, হাঁটতে ইচ্ছে করছিল।
ভালোই করেছি দেখলাম, সামনে দিয়ে দুটো হেভি হট মেয়ে হেঁটে যাচ্ছে। একজন পড়েছে টাইট জিন্স আর টপ, অন্যজন পড়েছে একটা ছোট্ট ড্রেস। ভালোই! আমি পেছন পেছন বেশ কিছুটা দূরত্ব রেখে হাঁটছিলাম। হঠাৎ একটু ফাঁকা জায়গায় তিনটে ছেলে একটা বাইকে চড়ে মেয়েগুলোর পাশে গিয়ে ‘বাত্তমিজ দিল’ গাইতে লাগল, নেশা-ফেশা করেছে বোধ হয়। হঠাৎ একটা ছেলে জড়ানো গলায় বলে উঠল, “আজ রাত কা রেট কিতনা হ্যায় জানেমন্‌!” বলে তিনজন মিলে খ্যা-খ্যা করে হাসতে হাসতে চলে গেল বাইক চালিয়ে।
মেয়েদুটো বোধহয় ভাবতেও পারেনি এটা হবে। দুজনে দাঁড়িয়ে পড়ল। একজন পেছন ফিরে তাকালো। আমি অবশ্য টুক করে চোখ সরিয়ে নিয়েছি, কি দরকার বাবা চোখাচোখি হয়ে। যাক, ওরা আবার নিজেরাই হাঁটতে শুরু করেছে। আমি মাথা নিচু করে হনহনিয়ে মেয়েগুলোকে টপকে আগে চলে গেলাম।

বাড়ী ঢুকছি, একটা মেসেজ এল, অফিসের এক সহকর্মী, ‘Dude, whats wrng with ur FB?’

কি হল আবার! ফেসবুক খুললাম, হোমপেজ তো ঠিকই আছে, কি মনে হল আমার প্রোফাইল পেজে গেলাম। আমার গেরুয়া-সাদা-সবুজ কভার পিকটা কই? এটা কিসের ছবি? ইসস্‌ এটা কোন নরককুণ্ডের ছবি! একটা নর্দমা, পাশেই মানুষ আর কুকুরের বিষ্ঠা পড়ে আছে, বমি, আরো কিসব ময়লা, ছবিটা দেখেই গা ঘিনঘিন করে উঠল। আর ভগৎ সিং এর ছবিটা কই, তার বদলে আমারই একটা ছবিকে প্রোফাইল পিক বানালো কে???

2 comments:

  1. আমার কন্সেপ্টটা বেশ ভাল লেগেছে। খুব সুন্দর লেখা।

    ReplyDelete

"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”