এই কদিন আগের কথা।
রাত্তিরে মেট্রোয় বাড়ি ফিরছি। ট্রেনটা বেশ ফাঁকাই ছিল। হঠাৎ দেখি একটা সিটের সামনে
বেশ কিছু লোকের ভিড়। আর সবাই বেশ মন দিয়ে কিছু একটা দেখছে! ছোটবেলায় বাসে-ট্রামে
দেখেছি ইন্ডিয়ার ক্রিকেট ম্যাচের দিন কেউ রেডিও নিয়ে উঠলে তাকে ঘিরে এরকম একটা ভিড়
তৈরী হত। কিন্তু মেট্রোতে কে রেডিও চালাবে? আর খেলাও তো কিছু হচ্ছে না! গুটি গুটি
গিয়ে উঁকি মেরে দেখলাম... আরে না, সিটে বসে একটা লোক তার ফোনে ‘ডেঞ্জার ড্যাশ’
খেলছে!
‘ডেঞ্জার ড্যাশ’
মানে ঐ যে খেলাটা যেখানে একটা লোক সারাক্ষণ দৌড়ে আর লাফিয়ে যাচ্ছে! কখনো পাহাড়ে,
কখনো একটা রেল লাইন ধরে ট্রেনের মাথার ওপর দিয়ে জাস্ট ছুটে চলেছে যেন পেছনে পাগলা
কুকুর তাড়া করেছে! এখানেও ফোনের মধ্যে সেই লোকটা দৌড়চ্ছে আর চারদিকে সবাই খুব মন
দিয়ে ওয়ার্ল্ড কাপ ফাইনালের মত মনোযোগ দিয়ে সেটা দেখছে আর মাঝে মাঝেই “ডানদিক”,
“বাঁদিক”, “লাফান”, “সাবাস” এইসব বলে উৎসাহ দিয়ে যাচ্ছে! ফোনের মালিকও সময়োচিত
ঘ্যাম নিয়ে গম্ভীর হয়ে খেলে যাচ্ছেন, থামছেনই না!

‘ডেঞ্জার ড্যাশের’
আগেও অন্য গেম দেখেছি মেট্রোতে। সেটা হল ‘ক্যান্ডি ক্রাশ’! আজকাল ফেসবুকে কিছু লোকজন
আছেন যাঁরা নিজের কেজি স্কুলের বন্ধু (গত তিরিশ বছর কন্ট্যাক্ট নেই), আগের অফিসের
বস (ছাড়ার আগে এইচ আরের কাছে যার নামে গুচ্ছ চুকলি করে এসেছেন) কিম্বা পাড়ার
দুর্গাপুজোর সম্পাদক (“কী যে বলেন দাদা, পাঁচ হাজার টাকার কম চাঁদা দিলে এই বাজারে
মা দুগ্গাকে খাওয়াবো কী?”) সব্বাইকে যেচে যেচে ফ্রেন্ড রিকোয়েস্ট পাঠিয়ে চলেছেন!
কেন? একটাই কারণ! না ভদ্রতা নয়, অভদ্রতাও নয়... ক্যান্ডি ক্রাশের লাইফ! কী খেল
বানিয়েছ গুরু? যখন তখন লোকজন ফেসবুকে জীবনদান করতে বলে। আগে জানতাম জলই জীবন
কিন্তু এখন কেস পুরো অন্য। ধরুন, কম্পিউটারে একটা ঘ্যামা সিনেমা শেষ করে রাত দুটোর
সময় শুতে যাওয়ার আগে হঠাৎ দেখলেন ফেসবুকে একটা নোটিফিকেশান এসেছে। ফেসবুক খুলে কী
দেখলেন? আপনার জ্যাঠার শ্যালক আপনার কাছ থেকে ‘ক্যান্ডি ক্রাশের’ লাইফ চাইছেন!
এরপর যদি জ্যাঠার শ্যালককে নিজের শ্যালক মনে করে আপনি চাট্টি কথা বলেন তাহলেই সবাই
ছিছিক্কার করবে! কী আর বলব? ঘেন্না ধরে গেল!
যাকগে, সেই মেট্রো
রেলের ‘ক্যান্ডি ক্রাশে’ ফিরে আসি।এটাও কিছুদিন আগের ঘটনা, দেখি এক মাঝবয়সী
ভদ্রলোক, কোনরকমে দাঁড়িয়ে আছেন ভিড়ের গুঁতো খেয়ে, আর সেভাবে দাঁড়িয়েই ‘ক্যান্ডি
ক্রাশ’ খেলে যাচ্ছেন। লাল-নীল-বেগুনী লজেন্স
সব এদিক-ওদিক ওপর নীচ হচ্ছে। আর তাঁর পাশের এক গুঁফো ভদ্রলোক আড় চোখে সেটা দেখে
যাচ্ছেন। হঠাৎ খেলোয়াড় ভদ্রলোক ছড়িয়ে ফেলায় গেমটা শেষ হয়ে গেল। তাতে ভদ্রলোক খেপে
গিয়ে পাশের লোকটার দিকে বেশ কটমট করে চাইলেন। পাশের লোকটা আর কী করে, বেশ
ভ্যাবাচ্যাকা খেয়ে গিয়ে মুখ ঘুরিয়ে নিয়ে নিজের গোঁফ চুলকোতে চুলকোতে আমার দিকে
কটমট করে চাইলেন। আমি আবার আড় চোখে ওনার গেম খেলা দেখা দেখছিলাম কিনা!
এ তো গেল আজকালকার স্মার্ট ফোনের গেমের কথা। এর সঙ্গে আছে চ্যাট বলে বেশ
চ্যাটচ্যাটে একটা ব্যাপার। টেক্সট মেসেজ ব্যাপারটাই লাটে উঠেছে এই চ্যাটের দয়ায়।
আর তাদের নানা রকম নাম... ‘হোয়াটস্যাপ’, ‘হাইক’, ‘চ্যাট অন (প্রথমে ভাবতাম চাটন!)’
আরো আছে! সবগুলো আমার মাথায় ঢোকেও না। তার সঙ্গে ফেসবুক মেসেঞ্জার,
গুগল হ্যাংআউট তো আছেই। পাড়ার মোড়ের নাপিত থেকে শুরু করে বাজারের মুদির দোকানের
মালিক, সবার সঙ্গেই আজকাল চ্যাটেই কথাবার্তা চলছে।
এই তো সেদিন পাড়ার এক বউদি মেসেজ করে এক কেজি মুগ ডাল আর পাঁচশো চিনির অর্ডার
দিয়েছিলেন পাড়ার মোড়ের অন্নপূর্ণা ভাণ্ডারে। দোকানের মালিক কাল্টুদা সেটা পেয়ে
স্মার্টলি একটা সাইকেলের স্মাইলি পাঠিয়ে দিলেন বউদির ফোনে। মানেটা হল দুপুরে ফেরার
সময় উনি সাইকেলে করে মাল পৌঁছে দেবেন। সেই স্মাইলি দেখে বউদির কী মেজাজ। সারা পাড়া
মাথায় করলেন তিনি। পরে খোঁজ নিয়ে জানা গেল, উনি ভেবেছিলেন যে, কাল্টুদা ওনাকে
বিকেলে সাইকেলে ঘুরতে নিয়ে যাওয়ার প্রস্তাব দিচ্ছে! যদিও কাল্টুদা যদি সাইকেলের
বদলে চার চাকার ছবি পাঠাতো তাহলে কী হত সেটা বলা কিন্তু খুবই কঠিন!

বুঝতেই পারছেন আমার রসিকতার ঝুলি আজকের মত শেষ। তাই শেষ করার আগে গুরু তারাপদ
রায়ের লেখা একটা গল্পকেই একটু অন্যভাবে লিখছি।
সেদিন আমার বন্ধু সুনীলের বাড়ি গিয়ে দেখি তার তিন বছর বয়সী পুত্র হালুম
সুনীলের স্মার্টফোনটা নিয়ে ঘাঁটছে। জিজ্ঞেস করলাম, “বাবার ফোন নিয়ে কী করছিস
হালুম?”
জবাব এল, “আমি গাবলুর সঙ্গে হোয়াটস্যাপ করছি!”
বুঝলাম গাবলু কোন পাড়াতুতো বন্ধু। বললাম, “হোয়াটস্যাপ করছিস কী রে? তুই তো
লিখতে শিখিসনি!”
হালুম গম্ভীর হয়ে বলল, “তো কী হয়েছে? গাবলুও হোয়াটস্যাপ শিখেছে। পড়তে এখনো
শেখেনি!”
এই গল্পটা লিখতে গিয়ে বাচ্চাদের আর স্মার্টফোন নিয়ে একটা নতুন গল্প মনে পরে
গেল। সেটাকে ফাউ বলেই ধরে নিন।
আমার আর এক বন্ধুর সদ্যজাত যমজ ছেলের গল্প। আগেকার দিনে ঠাকুমা-দিদিমারা গল্প
বলে, গান গান গেয়ে বাচ্চাদের খাওয়াতেন। এখন সেখানেও স্মার্টফোন! স্মার্টফোনে
ভিডিও দেখিয়ে, গান শুনিয়েই আজকালকার বাচ্চাদের খাওয়ানো, ঘুম পাড়ানো হয়। তা এরা
দুজনও এখন থেকেই ফোনে ভিডিও দেখা শুরু করে দিয়েছে!
এখন সমস্যা হচ্ছে দীপিকা পাড়ুকোনকে নিয়ে। ওনার গানের ভিডিও দেখালে একজন খুশী
হয়ে খিলখিল করে ফোকলা দাঁতে হাসে আর অন্যজন ঠোঁট ফুলিয়ে গলা ছেড়ে কাঁদে। এই দেখে
নাকি ওদের দাদু ওদের নাম রেখেছে ‘রণবীর’ (Ranveer) এবং ‘রণবীর’ (Ranbir)। কেউ জিজ্ঞেস করলে বলছেন নামগুলো নাকি সেই থমসন আর থম্পসন থেকে অনুপ্রাণিত হয়ে
রাখা!
[লেখার সঙ্গের ছবিগুলির সূত্র ইন্টারনেট]
No comments:
Post a Comment