দেখতে দেখতে হুস করে আরো একটা বইমেলা শেষ হয়ে
গেল।
লাখ লাখ লোকের ভিড়ে, গল্প-কথায়, মুক্তমঞ্চের
কবিতা পাঠের আসরে, আনন্দের সামনের লাইনে, বেনফিশের ফিশরোলের গন্ধে, কেসি পালের
সামনের জটলাতে, নামী-অনামী লেখকদের সঙ্গে আলাপচারিতায়, গীটারের মূর্ছনায় আর
নতুন-পুরনো বই নিয়ে কেটে গেল আরো একটা বইমেলা।
হ্যাঁ, আজকালকার ক্রিকেট খেলায় চিয়ার লিডারদের
মত এখানেও বেশ কিছু নামীদামী রংবেরঙের টিভি চ্যানেল স্টল খুলেছিল বটে। সেখানেও ভিড়
কম ছিল না। আর হবে নাই বা কেন? কুইজে পুন্যিপুকুর সিরিয়ালের মেজবউয়ের বড় ভাসুরের
নামটা টুক করে বলে দিয়ে ঐ মেজবউয়ের সঙ্গেই সেলফি তোলার চান্স কি ছাড়া যায়?
(ভাববেন না যে ঐ সিরিয়ালের বিজ্ঞাপন করছি। আসলে
ঐ লেভেলের নামের প্যারোডি করতে গিয়ে বুন্যিকুকুর ছাড়া কিছু মাথায় এল না!)
তার সঙ্গে বিভিন্ন ধর্মীয় স্টল, রাজনৈতিক স্টল
বা স্টেট ব্যাঙ্কের স্টল... সে তো আগেও থাকত। যদিও কেমন যেন
মনে হল ধর্মীয় স্টলগুলোতে ভিড় একটু বেশী এবার। বকধার্মিকতা বেড়েছে আর কি! আর ‘হ্যাংলা হেঁশেল-এর স্টলে বেশ ভীড় ছিল। এমনকি লোকজন খুঁজে খুঁজে ঐ স্টলে
যাচ্ছিল। সেরকম এক জোড়া যুবক-যুবতীকে আমরাও সাহায্য করেছি পথ দেখিয়ে। বুঝতেই পারছি পেটের
ডাক্তারদের পোয়াবারো কেন আজকাল!
আমি নিজে মেলায় গেছিলুম তিনবার। তাও সব
উইকেন্ডে। সোম থেকে শুক্রের মধ্যে কোনদিন ঢুঁ মারলে হয়তো একটু ফাঁকা পেতাম। প্রথম
দিন ম্যাপটা লেগেছিল। তারপর চেনা দোকানগুলো মোটামুটি বুঝে নিয়েছিলাম। রোজ গেলেই
একবার করে ‘সৃষ্টিসুখ’, ‘ভাষাবন্ধনী’ আর ‘গুরুচন্ডালী’টা ঘুরে আসতাম।
সৃষ্টিসুখে বিশাল ভীড় ছিল। সেরকমই
ইন্টারেস্টিং বইয়ের কালেকশান। বিশেষ করে বাঁধাই-প্রচ্ছদ মিলে
এরকম চকচকে ব্যাপার বেশী দেখা যায় না। নেক্সট বার এর চেয়ে বড়
স্টল না হলে সত্যিই বেশ অসুবিধা হবে। সেখানে যতবার গেছি দেখেছি কত কত লোক ‘মীর এই পর্যন্ত’ খোঁজ করে যাচ্ছে। তার মধ্যেই
রোহণের সঙ্গে হালকা আড্ডা, সৌরাংশুদার সঙ্গে টুকটাক গল্প। প্রবীরেন্দ্রদার সঙ্গেও
দেখা হয়ে গেল একদিন। বড় নিজের মনে হয় ওদের এই স্টলটা। বেশ বন্ধুদের একসঙ্গে
ক্যান্টিনে বসে আড্ডার মত।
ভাষাবন্ধনীতে গিয়ে গল্প করেছি বাউদার সঙ্গে। বই
দেখেছি, বই নিয়ে কথা বলেছি, গল্প করেছি। এই লোকটাও ভালো লোক। কত সহজেই আড্ডা
মারছিল আমাদের মত নতুন চেনা বন্ধুদের সঙ্গে!
গুরুচন্ডালীতে গিয়ে আলাপ হয়েছে ইপ্সিতাদির
সঙ্গে। ফেসবুকে যাদের পোস্ট দেখে চিনি তাঁদের অনেককেই দেখেছি ওই স্টলের আশেপাশে।
বইমেলায় গিয়ে এক একদিন দেখা হল তন্ময়, অভীকদা,
সুমন, সৌম্যজিতদা-মধুমিতাদি আর শুদ্ধর সঙ্গে। দল বেঁধে ঘোরা হল কৌশিক, নচিকেতা,
পৃথা, ঈশিতা, সুচেতা, ঋতব্রত, অনিরুদ্ধ, সর্বজিৎ, সায়ন্তনী, সদলবলে চয়নদা আর
আকাশদীপদার সঙ্গে। পৃথার ব্যাগ হারানো এবং তারপর এক সি আই ডি অফিসারের হাত ঘুরে
সেই ব্যাগ ফেরত পাওয়ার মত অলৌকিক ঘটনা ঘটে গেল এবারের বইমেলাতে।
আর সেই পাগলী মহিলাটি তো ছিলেনই। ‘জাগো বাংলা’র
স্টলে গিয়ে সেই পৃথিবী-বিখ্যাত ছড়ার বইটাও এক পিস কিনেছেন তিনি। তাঁর বাকি গল্পগুলো শেষে লিখব। প্রমিস!
কমলিনীর স্টলে দেখেছি সাহিত্যিক শংকরকে। প্রতি
বছরের মতই ওনার নতুন বইতে সই নিয়েছি আবার। শ্রীজাত ঘুরে বেড়িয়েছেন গোটা মেলা জুড়ে।
মিত্র ও ঘোষের স্টলে গিয়ে দেখেছি “বাংলা সাহিত্যের গুণ্ডা” অর্থাৎ ‘গিরিগুহার
গুপ্তধন’ বইয়ের লেখক ষষ্ঠীপদ চট্টোপাধ্যায়কে।
আনন্দর স্টলে পা দিইনি। দয়া করে একে আঁতলামি
ভেবে নাক সিঁটকবেন না। সত্যি বলতে, হাতে অত সময় ছিল না যে লাইনে দাঁড়িয়ে সেটা নষ্ট
করব। তাই আনন্দ এ বছর নাহয় একটু কমই হল।
ভালো লেগেছে শিশু সাহিত্য সংসদের স্টল। প্রতি
বছরের মত এ বছরও ঐ দোকানে গিয়ে সেই ছোটবেলার ছবিতে রামায়ণ-মহাভারত আর ছড়ার বই দেখে
শৈশবকে কয়েক মুহূর্তের জন্য ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করেছি। কোন এক বছর ঐ বইগুলো হয়তো
কিনেই ফেলব আর একবার।
লালমাটির বিভিন্ন কমিকস সমগ্রগুলোও বড্ড লোভনীয়।
কিন্তু দামের দিকে তাকালে পকেটে বড্ড টান পড়ে। তবে শুনে এলাম নারায়ণ দেবনাথ
সমগ্রের পঞ্চম খণ্ডের কাজ চলছে। দেখা যাক কবে বেরোয় সেটা। সপ্তর্ষি প্রকাশনার বেশ
কিছু নতুন বই দেখলাম। এদের অধিকাংশ বই-ই জীবনী বা আত্মজীবনীমূলক। বিশেষ করে বাংলা
সিনেমার বিভিন্ন শিল্পীর লেখা বা তাঁদের নিয়ে লেখা বইয়ের বেশ ভালো সংগ্রহ ছিল
এখানে। অভিযানের বইগুলোও বেশ ভালো লেগেছে, নজর রাখব পরের বইমেলা গুলোতেও।
লিটল ম্যাগের স্টলগুলোতে ঘোরাঘুরি করতে গিয়ে
যেটা সবচেয়ে বেশী চোখে পড়ে সেটা হল লেখক-প্রকাশকদের উৎসাহ। বয়স কম হোক বা বেশী, তাঁদের
উৎসাহে ঘাটতি থাকেনা কোনদিনই। কিছু বই কিনেওছি। আশা করছি ভালো
লাগবে।
খাওয়াদাওয়ার গুচ্ছ স্টল। কী আর বলব। বিশেষ করে
ইন্ডাকশান কুকারের দৌলতে বেশ কিছু লাইভ পাটি-সাপটা কাউন্টার চোখে পড়ল বইমেলাতেই।
আর সেগুলোতে ভীড় কিছু কম নয়।
এইভাবে ঘুরে ঘুরে, বই ঘেঁটে, বই কিনে, আড্ডা
মেরে, ছবি তুলে কেটে গেল আমার এবারের বইমেলা। আবার এক বছরের অপেক্ষা আর তার মধ্যে
দেদার বই পড়া আর মাঝেমধ্যেই অ্যামাজন এবং কলেজ স্ট্রিটের দৌলতে কিছু নতুন বইয়ের
আগমন। ভালো খবর হল এপ্রিল মাসের মধ্যে নতুন একটা দেওয়াল জোড়া বইয়ের আলমারি তৈরী
হয়ে যাবে। কত আর বইয়ের ঘাড়ে বই চাপিয়ে রাখা যায়!
শেষ করার আগে শ্রেয়সীর গল্প, যেটার সহজেই নাম
দেওয়া যায়, “বইমেলা, ছেঁড়া চটি এবং স্বপ্ন”!
প্রথমদিন, আমি সকাল সকাল বইমেলা পৌঁছে গেছি।
শ্রেয়সী বেলগাছিয়া থেকে দীর্ঘক্ষণ ধরে ফোনে উৎসাহ দেখিয়ে যাচ্ছেন... “এই
আসছি!”... “এবার উঠে রেডি হব”... “আধ ঘন্টার মধ্যে বেরোচ্ছি!”... এই করতে করতে শেষ
অবধি ল্যাদের জয় হল। ফোন এল, “আমি আজকে আর যাচ্ছি না। কাল সকাল সকাল চলে আসব।”
দ্বিতীয়দিন, যাথারীতি আমি আগে পৌঁছে গিয়ে ঘুরছি।
আমাদের বন্ধু পৃথাও চলে এল। এরপর শ্রেয়সী আসবে। সাজুগুজু চলছে। তার আপডেট পাচ্ছি।
ফুলটুসি সেজে ট্যাক্সিতে উঠে সেলফি তুলে সেটা আমাদের বন্ধুদের হোয়াটস্যাপ গ্রুপে
পোস্টও হয়ে গেল। ফাইনালি ফোনটা এল, “শুনছো... আমি বইমেলায় এসে গেছি। শিশু সাহিত্য
সংসদের সামনে দাঁড়িয়ে আছি। ঝটপট এস!”
গেলাম। গিয়ে দেখি মুখে একরাশ বিরক্তি! কী
ব্যাপার! জানা গেল, ভদ্রমহিলা কেত মেরে নতুন স্টাইলিশ চটি পরে এসেছেন এবং বইমেলায়
ঢুকেই সেটার একটা অংশ গেছে খুলে। ভালো করে মালটা উলটে পালটে দেখে মনে হল একটা
সেফটিপিন পেলে লাগিয়ে নেওয়া যায়। ওদিকে ব্যাকগ্রাউন্ডে চলছে শ্রেয়সীর বিলাপ, মানে যে
ছোকরা ওকে এটা গছিয়েছিল তার গুষ্টির ষষ্ঠীপুজো!
চণ্ডীপাঠ জানি না বলে দুঃখ নেই বিশেষ, তবে জুতো
সেলাই যে শিখে রাখা উচিত ছিল সেটা তখন মনে হল! আমার কাছে সেফটিপিন নেই, সুতরাং
বকুনি খেলাম। ওনার কাছেও সেফটিপিন নেই! আবার বকুনি খেলাম!
(দ্বিতীয়বার কেন খেলাম এটা যাঁরা বুঝতে পারছেন
না আমি নিশ্চিত তাঁরা বিবাহিত পুরুষ নন। )
যাই হোক, এবার আমরা বেরোলাম সেফটিপিন অভিযানে! এসব
কেসে আমি খুবই প্র্যাক্টিকাল। সুতরাং প্রস্তাব দিলাম যে, কিছু কিছু দোকান বা
পুলিশের কাছে খোঁজ নিয়ে দেখা যাক। কিন্তু শুধু সেফটিপিন চাইতে শ্রেয়সীর লজ্জা
করবে। অতএব সে নিজের প্রতিভা লাগালো। এক ভদ্রমহিলা মেলায় ঘুরে ঘুরে লোকজন পাকড়াও
করে নিজেদের মেডিকাল ক্লিনিকের প্রচার করছিলেন। শ্রেয়সী নিজেই তাঁকে খুঁজে বের
করল। ভদ্রমহিলা চরম উৎসাহে নিজেদের ক্লিনিক নিয়ে বলে চললেন। কোথায় কোথায় শাখা আছে,
কুকুরে কামড়ালে প্রায়োরিটি দেওয়া হবে নাকি মাথা খারাপ হলে, বইমেলায় কোথায় স্টল
দিয়েছেন... শ্রেয়সী সব শুনে বলল, “বাহ্... খুব ভালো। ইয়ে... আপনার কাছে একটা সেফটিপিন
পাওয়া যাবে?”
ভদ্রমহিলা গোমড়া মুখে কাটিয়ে দিয়ে চলে গেলেন।
এরপর শ্রেয়সী গেল ব্যাগের দোকানে। সেখানে বিজ্ঞের মত নেড়েচেড়ে অনেকগুলো ব্যাগ দেখে
পছন্দ করে একটা ব্যাগ কিনে ফেলল একশো পঁচাত্তর টাকা দিয়ে। কিন্তু ব্যাগ কেনার পরেও
সেফটিপিন পাওয়া গেল না উল্টে আমার খুচরো গুলো বেরিয়ে গেল।
এবার কোথায় যাই ভাবতে ভাবতে চলে গেলাম মেলার
পেছন দিকে। সেদিকে রাস্তার ধারে বেশ কিছু দোকানে টি-শার্ট, ওড়না, ছবি ইত্যাদি
পাওয়া যাচ্ছিল। সেখানে সেফটিপিন পাওয়া গেল শেষ পর্যন্ত। তা দিয়ে জুতো লাগানোর
কাজটা এই অধমকেই করতে হল। তারপর জুতো সারাইয়ের আনন্দে সেখানেও একটা টি-শার্ট পছন্দ
করে কিনে ফেললাম।
তাহলে কী দাঁড়াল? শ্রেয়সীর জুতোয় সেফটিপিন
লাগাতে গিয়ে খরচা পড়ল চারশো পঁচাত্তর টাকা!
সাধে কী আর বলে? দেখলে হবে... খরচা আছে!
যাই হোক, সেফটিপিন লাগানো জুতো পড়ে নতুন উদ্যমে
শ্রেয়সী মেলায় এগিয়ে চলল। সৃষ্টিসুখের স্টলের সামনে খুঁজে বের করল তন্ময় অর্থাৎ
বংপেনকে। যাই হোক, আড্ডার মাঝখানে আমি শ্রেয়সীকে মনে করিয়ে দিলাম যে, আমাদের কিছু
বন্ধুর ম্যাগাজিনের জন্য শ্রেয়সী তন্ময়ের কাছে স্বপ্ন নিয়ে লেখা চেয়েছিল। তার পরে
শ্রেয়সী এবং তন্ময়ের মধ্যে কথোপকথন,
-
তোমার লেটেস্ট স্বপ্ন নিয়ে
গল্পটা খুব ভালো হয়েছে।
-
থ্যাঙ্ক ইউ!
-
এবার আমাদের ম্যাগাজিনের
জন্য স্বপ্ন নিয়ে গল্পটা দাও!
-
ওহ্... তুই (তুই এর ওপর
জোর দিয়ে) চেয়েছিলি না স্বপ্ন নিয়ে গল্প!
-
কেন? ভুলে গেছ?
-
আরে সেই জন্যই কদিন ধরে
ভেবে চলছি যে স্বপ্ন নিয়ে একটা লেখা ডেস্কটপে সেভ করে রেখেছি কেন!
-
যাহ্... লেখাটার কী করলে?
-
আরে ওটাই তো ব্লগে পোস্ট
করে দিলাম। এক্ষুনি যেটা বললি তোর ভালো লেগেছে!
No comments:
Post a Comment