Wednesday, June 1, 2016

স্মৃতি

ভাবনা-১

সুনির্মলবাবুর আজকাল নিজেকে বড় একা লাগে। একটা গোটা দোতলা বাড়িটায় আর একটাও মানুষ নেই। একাকীত্ব যেন রোজ গিলে খেতে আসে তাঁকে। কিন্তু সব সময় এরকম ছিল না। সুনির্মলবাবুর স্ত্রী কৃষ্ণা এবং একমাত্র ছেলে অঞ্জন যখন ছিল তখনও পুরো বাড়িটা বেশ জমজমাট থাকত। অঞ্জনের বিয়ের পর আরো একজন লোক বাড়ল, সুনয়না, তাঁর পুত্রবধূ। কিন্তু এরা কেউই এখন নেই। কেন নেই সেটা অনেক ভেবেও সুনির্মলবাবু ঠিক করে বুঝে উঠতে পারেন না! ঘন্টার পর ঘন্টা বসার ঘরে কৃষ্ণার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে তাঁদের বৈবাহিক জীবনের অনেক খুঁটিনাটি ঘটনার কথা তাঁর মনে পড়লেও এই প্রশ্নের উত্তর তাঁর মাথার মধ্যে নেই!
আসলে মানুষের স্মৃতি ব্যাপারটাই খুব জটিল। আর তার ওপর মস্তিষ্কের এক বিরল রোগের কারণে সুনির্মলবাবুর স্মৃতি এক অদ্ভুত চেহারা নিয়েছেনিজের পঁয়ষট্টি বছরের জীবনের অনেক অকিঞ্চিৎকর কথা তাঁর মনে থাকলেও গত এক বছরের অনেক কথাই তাঁর আর মনে পড়ে নাপাঁচ বছর বয়সে পেয়ারা গাছ থেকে কে তাঁকে ধাক্কা মেরে ফেলে দিয়েছিল, ক্লাস থ্রিতে পড়ার সময় স্কুলের ফাংশানে কোন আবৃত্তি করে সোনার মেডেল পেয়েছিলেন সেগুলো মনে থাকলেও গতকাল তিনি ঠিক কী খেয়েছেন বা কার সঙ্গে কথা বলেছেন, আদৌ কথা বলেছেন কিনা তার কিছুই তাঁর মনে নেই।
 আজকাল স্মৃতির এই সমস্যা তাঁর দুটো অস্বস্তির মধ্যে একটার কারণ। তাঁর স্ত্রীর মৃত্যুর কথা কিন্তু তাঁর বেশ ভালোই মনে আছে। একদম ছবির মত দেখতে পান শ্রাবণ মাসের বৃষ্টিভেজা সেই দিনটা। অনেক লোক হয়েছিল সেদিন। অঞ্জন বারান্দায় অনেকক্ষণ গোঁজ হয়ে দাঁড়িয়েছিল। তারপর উনি গিয়ে পাশে দাঁড়াতেই ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠেছিল। একদম ছবির মত দেখতে পান এটা। কিন্তু এই অঞ্জন আর সুনয়না কোথায় কী করে চলে গেল তাঁর বিন্দুমাত্র স্মৃতি নেই তাঁর।

দৃশ্য – ১

-      তুমি তাহলে আমার কথায় রাজী হবে না?
-      কী করে হই বল?
-      কিন্তু আমি একদম লজিকাল কথা বলছি বাবা। এত পুরনো একটা বাড়ী, এতটা জায়গা! পাইকপাড়ার মত প্রাইম লোকেশান! খুব ভালো দাম পাওয়া...
-      তোমার বাবাও পুরনো হয়ে গেছে অঞ্জন। তুমি কি তাহলে আমাকেও বেচে দিতে চাও?
-      ননসেন্স! এসব কথার কোন মানে হয় না বাবা! মা মারা যাওয়ার পর তোমার মাথাটা খারাপ হয়ে গেছে!
-      হতে পারে। কিন্তু তাহলেও তোমাকে এই বাড়ী বিক্রির পারমিশান আমি দেবো না!
-      এই তোমার শেষ কথা?
-      হ্যাঁ... আনফরচুনেটলি আমার মৃত্যু অবধি তোমায় অপেক্ষা করতেই হবে।
-      সেটা যাতে তাড়াতাড়ি হয় সেটার ব্যবস্থাও করে ফেলা যায়।
কথাটা বলে গটগট করে ঘর ছেড়ে বেরিয়ে গেল অঞ্জন। সঙ্গে সুনয়নাও। ঘরের বাইরে থেকে তার রিনরিনে গলার আওয়াজ ভেসে এল, “এ বাড়ীতে আর থাকা যায় না। তুমি প্লিজ সল্ট লেকের দিকে একটা ফ্ল্যাট দেখ।”

ভাবনা – ২

সারাটা দিন। একের পর এক স্মৃতি ভেসে আসে। সেই কোন আদ্যিকালের অপ্রয়োজনীয় সব স্মৃতি। কিন্তু একই সঙ্গে কত কত ঘটনার স্মৃতি অনেক চেষ্টা করেও মনে করতে পারেননা তিনিএ কী শাস্তি!
এ এক বড় অস্বস্তিকর অবস্থা! এর সঙ্গেই গত বেশ কদিন ধরে আরো একটা জিনিস শুরু হয়েছে। আগে, যখন কৃষ্ণার ছবির সামনে দাঁড়িয়ে থাকতেন ছবির কাঁচে নিজের ছায়া দেখতে পেতেন সুনির্মলবাবু। এখন আর পান না ঘন্টার পর ঘন্টা দাঁড়িয়ে থেকেও পান নাএমনকি দোতলার শোয়ার ঘরের সেই সুপ্রাচীন ড্রেসিং টেবিলের আয়নাতেও আর নিজেকে দেখতে পান না সুনির্মলবাবু। কেন নিজেকে আর দেখতে পান না সেটাও মনে পড়ে না তাঁর। অস্বস্তিটা থেকেই যায়।

দৃশ্য – ২

-      ইয়েস মিস্টার মল্লিক!
-      গুড আফটারনুন স্যার। মার্ডার স্পট থেকে বলছি!
-      কোনটা? গতকালের ওই পাইকপাড়ার কেসটা?
-      ইয়েস স্যার। ওটাই। খুব স্ট্রেঞ্জ কেস স্যার!
-      কেন? একটু ব্রিফ করুন।
-      আপনি তো মোটামুটি জানেন। ভিকটিম রিটায়্যার্ড। ওয়াইফ এক্সপায়ার করেছেন গত বছর। তারপর থেকে ছেলে, ছেলের বউয়ের সঙ্গে থাকতেন। রিসেন্টলি ছেলের সঙ্গে সম্ভবত এই বাড়ী নিয়ে কিছু ঝামেলা হয়েছিল।
-      সেটা কী করে জানলেন?
     -      পাড়ার লোক স্যার! বুঝতেই পারছেন। আর বেশ কয়েকদিন নাকি তর্কাতর্কি বেশ উচ্চকন্ঠেই হয়েছিল, পাড়ার লোক শুনেছে।
     -      ওকে
     -      হ্যাঁ। বেশ কিছুদিন হল, ছেলে-বউকে নাকি আর দেখেনি পাড়ার লোক। উনিও খুব একটা কারো সঙ্গে মেশেন না। তাই কেউ জিজ্ঞেসও করেনি। আর এত বড় বাড়ী স্যার। বাইরে থেকে কিছু বোঝা মুশকিল! নেহাত গতকাল সকালে দুর্গন্ধ পেয়ে পাড়ার লোকে আমাদের খবর দিল, তখন এসে দেখলাম, বসার ঘরের ফ্যান থেকে ঝুলছেন ভদ্রলোক!
     -      কি মনে হচ্ছে? ছেলের হাত থাকতে পারে?
     -      না স্যার। সেটা সম্ভব নয়?
     -      কেন?
     -      কী আর বলব স্যার! পুরো বাড়ী সার্চ করতে গিয়ে ওপরের একটা আঁটকাঠ বন্ধ ঘরে পাশাপাশি দুটো ট্রাঙ্কে ওনার ছেলে আর ছেলের বউয়ের রিমেইন্স পাওয়া গেছে স্যার। টুকরো টুকরো করে কাটা! অন্তত মাস খানেক আগে কিলড্‌।
     -      মাই গুডনেস! কী বলছেন? অস্ত্রটা পাওয়া গেছে?
     -      হ্যাঁ স্যার। একটা রক্তের দাগ লাগা চপার পেয়েছি, টেস্টের জন্য ল্যাবে পাঠিয়ে দিয়েছি।
     -      কোথায় পাওয়া গেল?
     -      আজ্ঞে, বসার ঘরে ওনার স্ত্রীর একটা ছবি আছে, তার পেছনে!

6 comments:

  1. লেখাটা যথারীতি খুব ভালো হয়েছে। ইউরো আর কোপা আমেরিকাময় ফুটবল সীজন নিয়ে কিছু লেখা আসছে কি? - সৌগত

    ReplyDelete
  2. নাহ্‌... ক্রিকেট নিয়ে পড়াশুনো চলছে!

    ReplyDelete
  3. Just too good, kintu tan man puro Tanmoy hole ki Bhalo lage? Aajkal sobetei bongpen gondho pai

    ReplyDelete
  4. Replies
    1. ধন্যবাদ! অন্য লেখাগুলোও পড়ুন! মতামত দিন! :-)

      Delete

"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”