আমার এই কাহিনীর
সময়কাল অতি প্রাচীন। কত প্রাচীন সেই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে সঠিকভাবে নাই। এই মানব সভ্যতা তখন সবে হামাগুড়ি দিতেছিল। তবে এসব
ক্ষেত্রে গুরুজনদের সাহায্য গ্রহণ অবশ্যম্ভাবী। সুতরাং শরদিন্দুর হইতে ঋণ লইয়া
বলি,
'সন-তারিখ দিয়া
বলিতে পারিব না। সন-তারিখ তখনও তৈয়ার হয় নাই। তখন আমরা কাঁচা মাংস খাইতাম।'
এই পৃথিবীতে সেই সময়
দেশ বলিয়া কিছুর অস্তিত্ব ছিল না। পর্বতময় অরণ্যসংকুল সেই স্থানে দুটি উপজাতি
পাশাপাশি বসবাস করিত। অরণ্যের ঠিক মধ্যভাগ দিয়া একটি নদী বহিয়া গিয়াছিল। স্থানীয়
ভাষায় সেটির নাম ছিল যশহোর। এই যশহোরের পূর্ব দিকে যে উপজাতিরা থাকিত তাহারা নিজের
মাচস্ এবং পশ্চিমতীরের উপজাতিরা নিজেদের লোটস্ বলিয়া উল্লেখ করিত। নদীর
নিকটবর্তী অরণ্যে পশু এবং নদীতে মৎস্য শিকার করিয়াই তাহারা দিন অতিবাহিত করিত।
পশুপক্ষী শিকার ব্যতীত উহাদের কাজ ছিল পরস্পরকে উত্যক্ত করা। লোটস্ এবং মাচস্
এই দুই উপজাতির মধ্যে দীর্ঘদিনের এক বিবাদ উপস্থিত ছিল। তাহারা একে অপরকে মনুষ্য
পদবাচ্য বলেই মনে করিত না। একে অপরকে দেখিলেই মর্কট, অকালকুষ্মাণ্ড, বরাহনন্দন
ইত্যাদি গালি পাড়িত। শুধু তাহাই নহে, এক অপরের পৃষ্ঠের চর্মাবরণ তুলে দিবার সাবধানবাণী ঘোষণা করিত এবং সময়বিশেষে
করিয়াও দেখাইত। লোটস্ এবং মাচস্দের মধ্যে যুদ্ধ-বিগ্রহ লাগিয়াই থাকিত। তাহাতে দুই পক্ষেরই যথেষ্ট
ক্ষয়ক্ষতি হইলেও কেহই ইহার অবসান ঘটাইতে প্রস্তুত ছিল না। এবং সময়ের সঙ্গে তাল
রাখিয়া তাহাদের যুদ্ধের প্রধান অস্ত্র ছিল প্রস্তর খণ্ড যাহা দূর-দূরান্ত হইতে
ইহারা পরস্পরের উপর নিক্ষেপ করিত। বর্তমানকালের ন্যায় ছুরি, পাইপগান বা পেটো সম্বন্ধে
ইহাদের জ্ঞানের বিকাশ ঘটে নাই।
এই সময় মাচস্
উপজাতির তরুণ নেতা তব্রপোত ঠিক করিল এই পরিস্থিতির অবসান ঘটাইতে হইবে। তন্মধ্যে
ইহারা একে অপরের শিকার হরণ করিতে শুরু করিয়াছেন। এমনকি বেকায়দায় পাইলেই নানাবিধ
অপমানেরও খামতি হইতেছিল না। কিছুদিন পূর্বেই একদল লোটস্ দুটি মাচস্ বালককে একাকী
পাইয়া তাহাদের একে অপরে কর্ণ আকর্ষণ করিয়া তিন ঘটিকা দণ্ডায়মান রাখিয়াছিল। প্রত্যুত্তরে
কল্য কিছু মাচস্ দুই স্নানরত লোটস্কে ধরিয়া ধারালো প্রস্তর দিয়ে মস্তকের
অর্দ্ধেক কেশ কর্তন করিয়া একটি গর্দভের পৃষ্ঠে বসাইয়া তাহাদের নদীর পরপারে পলায়ন
করিতে বাধ্য করিয়াছে। ফলস্বরূপ প্রভাত হইতেই লোটস্ ভূমি হইতে একের পর এক প্রস্তর
খণ্ড উড়িয়া আসিতেছে এবং নদী কূলবর্তী গৃহগুলিতে বিস্তর ক্ষয়ক্ষতির সৃষ্টি করিতেছে।
এহেন পরিস্থিতিতে
তব্রপোত তার পোষ্য সারমেয়টিকে বগলদাবা করিয়া তাহার প্রধান পরামর্শদাতা কষেভি অবুবার
উদ্দেশ্যে গমন করিল। কষেভি একাধারে জাদুকর, বৈজ্ঞানিক, রন্ধন-বিশারদ এবং অতিশয় জ্ঞানী ব্যক্তি। কেহ কেহ ইহাও বলিয়া থাকে যে কষেভি ভবিষ্যৎ দর্শনেরও
ক্ষমতা প্রাপ্ত হইয়াছে যদিও সে বিষয়ে তব্রপোত সম্যক ধারণা ছিল না। সে গিয়া দেখিল, কষেভি
তাহার গৃহের পিছন দিকে এক বৃহৎ গর্ত খনন করিয়া তাহার ভিতর বিবিধ শুষ্ক কাষ্ঠখণ্ড
একত্র করিয়াছে। তব্রপোতকে দেখিয়া সে বলিল,
"এসো হে শাল-বৃক্ষ!
কী সংবাদ?" অন্য মাচস্দের তুলনায় তব্রপোত উচ্চতায় অনেকটাই বেশি ছিল।
"তোমার কী
সংবাদ? এই আয়োজন কীসের?"
"ইহা এক নতুন
জাদু! কৃত্রিম পদ্ধতিতে অগ্নি জ্বালাইয়া এই শাখাপ্রশাখায় আমি তাহা ধরিয়া রাখিয়াছি। সেই আগুনে ছাগ-মাংস, গো-মাংস, বন্য
বরাহ-মাংস, কুক্কুট-মাংস ইত্যাদি সিদ্ধ করিয়া খাইতেছি। শুধু তাহাই নহে, তাহার
সঙ্গে বিভিন্ন উদ্ভিদও সিদ্ধ অবস্থায় খাইয়া দেখিতেছি।"
"উদ্ভিদ
খাইতেছ? বাণপ্রস্থে যাওয়ার সময় কি আগতপ্রায়?" তব্রপোত চক্ষু টিপিয়া জিজ্ঞাসা
করিল।
"মুর্খ! শুধু
উদ্ভহিদ ভক্ষণ যে সুখকর নহে তাহা আমিও জানি। কিন্তু এ সবই আমার বৈজ্ঞানিক গবেষণার
বিষয়। এহেন অগ্নি পৃথিবীর আর কোথাও এখনও আবিষ্কৃত হয় নাই। তাই ইহার ব্যবহার
সম্বন্ধেও লোকের বিশেষ ধারণা নাই। আমি তাহাই বিভিন্ন পরীক্ষা করিয়া দেখিতেছি। শুধু
তাহাই নহে, তণ্ডুল-জাতীয় দানাশস্যকে খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করা যায় কিনা তাহাও আমার
গবেষণার বিষয়। যাহা হউক তোমার এই দগ্ধস্থূলকন্দক পূর্ণ মস্তকে এসব প্রবেশ করিবে
না? কী কারণে আসিয়াছ বল?"
"বলতেছি যে,
লোটস্দের সঙ্গে যুদ্ধ করে তো আর পারিয়া উঠিতেছি না। এই যুদ্ধের তো কোনরূপ শেষ
নাই! একটা কিছু সমাধান বের করিয়া দাও না!"
"যাও তো বাপু,
বিরক্ত করিও না। ইহা তো তোমাদের শিশুদের মত যুদ্ধক্রীড়া। পরস্পরের কেশাকর্ষণ তথবা
কর্ণাকর্ষণ করিয়া মজা দেখিতেছে। বরং বাপু ওই দলের অধিনায়কের সঙ্গে দেখা করিয়া কথা
বলিলেই হয়। বাক্যালাপে সর্ব সমস্যারই সমাধান হয়।"
কষেভির দ্বারা
বিতাড়িত হইলেও তাহার কয়েকটি কথা তব্রপোতের মনে বিশেষ রেখাপাত করিল। সে মনে মনে এক
পরিকল্পনা করিয়া দূতকে তাহার সহিত দেখা করিবার জন্য খবর পাঠাইল।
লোটস্দের কাছে যেতে
হবে শুনিয়াই দূতবাবাজী বাঁকিয়া বাসিয়াছিল। অনেক কষ্টে বিভিন্ন পুরস্কারের লোভ
দেখাইয়া তব্রপোত তাহাকে সম্মত করাইতে সক্ষম হইল। বাক্যালাপ যে প্রয়োজন সে বিষয়ে
তব্রপোত কষেভির সহিত একমত হইয়াছিল। তাহা ব্যাতীত আরো কিছু প্রস্তাব তাহার
মস্তিষ্কে ছিল, যাহা লইয়া চিন্তা ভাবনার জন্য কতিপয় দিবস হাতে রাখিয়া তব্রপোত চিঠি
লিখিল লোটস্ দলপতির প্রতি। লিখিতে গিয়া সে উপলব্ধি করিল যে এত যুদ্ধ সত্ত্বেও
লোটস্দের দলপতির পরিচয় সম্বন্ধে সে অবগত নহে। সাধারণ যুদ্ধ সেনাপতিরাই পরিচালনা
করিয়া থাকেন, সেই কারণে তব্রপোত লোটস্দের
দলপতির সম্মুখে কোনদিন আসে নাই।
কয়েক দিবস পর
কাঁপিতে কাঁপিতে হাতে একখানি শ্বেত বস্ত্রখণ্ড লইয়া দূত মহাশয় লোটস্ শিবিরে গিয়া
তব্রপোতের আমন্ত্রনপত্র প্রদান করলেন। লোটস্রাও দেখা গেল, এই প্রস্তাবে একবাক্যে
রাজী হইয়া গেল। বয়স্ক ব্যাক্তিগণ তাঁদের নেতার সঙ্গে কথা বলিয়া দূতকে জানাইলেন যে,
সাড়ে ছয় সপ্তাহ পরে লোটস্ দলাধিপতি মাচস্ দলাধিপতির সহিত যশহোর নদীর তীরে
সাক্ষাতে সম্মত হইয়াছেন।
দূতের নিকট এই
বার্তা শুনিয়া তব্রপোত তাহার পরিকল্পনাকে বাস্তবে পরিণত করতে উঠিয়া পড়িয়া লাগিলেন।
ঐদিন ছড়াইলে চলিবে না! প্রায়শই তাহাকে কষেভির গৃহের উদ্দেশ্যে যাইতে দেখা গেল।
বুঝা যাইল, ইহারা দুজনে মিলিয়া একটি বিশেষ ফন্দি আঁটিতেছে!
২
দেখিতে দেখিতে শীর্ষ
সম্মেলনের দিন উপস্থিত হইল। সকাল হইতে সাজো সাজো রব। তব্রপোত তাহার শ্রেষ্ঠ ভল্লুক
চর্মের পোশাক পরিধান করিয়া সঙ্গী সারমেয়টিকে লইয়া তাহার উপজাতির অন্যান্য
গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তিদের নিয়ে যশহোরের তীরে উপস্থিত হইল। যদিও কষেভিকে সেখানে দেখা
যাইতেছিল না, কিন্তু সেদিকে দেখিবার সময় কাহারও ছিল না।
অল্পক্ষণের মধ্যেই
নদীর বুকে বেশ কিছু সংখ্যক ভেলক দেখা দিল। তাহাদের মধ্যভাগের সর্বাপেক্ষা উজ্জ্বল,
সুসজ্জিত ভেলকটিতেই যে লোটস্দের অধিনায়ক আছেন তাহাতে সন্দেহের অবকাশ নাই।
ভেলকবৃন্দ নিকটে আসিতেই লোটস্দের অভাগ্যতদের আকার মাচস্দের দৃষ্টিগোচর হইল।
তাহাদিগের সেনাপতিবৃন্দ সৈন্যসমাগমে সম্মুখের ভেলকগুলিতে আসীন ছিলেন, সম্ভবত কোন
আকস্মিক আক্রমণের আশঙ্কায়। এই ভয় মাচস্দেরও ছিল এবং সেইমত সুকৌশলে বিভিন্ন স্থানে
সৈন্য প্রস্তুত হইয়া ছিল। তবে কোন প্রকার গোলযোগ ঘটিল না।
তবে লোটস্দের অধিনায়ককে
দেখিয়া মাচস্বৃন্দ সবিষ্ময়ে মুখব্যাদান করিল। ইহার কারণ আর কিছুই নহে, লোটস্দের
অধিনায়ক এক সুন্দরী তরুণী, যদিও দৈর্ঘ্যে কিঞ্চিৎ খর্ব। রানীসুলভ
গাম্ভীর্যের সহিত সে তীরে অবতরণ করিলে তব্রপোত এগিয়ে গেল তাহাকে অভ্যর্থনার জন্য।
তাহার সারমেয়টি পেছনেই ছিল। লোটস্দের রানী তাহাদের
প্রতি গম্ভীর হইয়া বলিলেন, "একটা গর্দভকে সঙ্গে লইয়া আসিয়াছ?"
তব্রপোত খুবই
বিস্মিত হইয়া বলিল, "ইহা গর্দভ নয় দেবী, ইহা একটি সারমেয়।"
লোটস্দের রানী ঠোঁট
উল্টাইয়া জবাব দিলেন, "তোমাকে নয়, তোমার সারমেয়টিকেই বলিয়াছি!"
(ভবিষ্যতে এই বাক্যালাপটি অনেকেই ব্যবহার করিয়াছেন। এই কারণেই বলা হয় 'History repeats itself')
রাগে চিড়বিড়িয়া
জ্বলিয়া উঠিতে গিয়ে সামলে লইল তব্রপোত। হাসিয়া জিজ্ঞাসা করিল, "আমার সহিত
বাক্যালাপে যাহাতে মহারানীর গ্রীবায় ক্লেশ না হয় তজ্জন্য কি একটি বৃক্ষকাণ্ড অথবা
প্রস্তরখণ্ড আনয়ন করিব?"
এবার মহারানীর
গম্ভীর হইবার পালা। ব্যাজার মুখে বলিলেন, "আমার নাম উপি। তোমাদের এখানে কি
বসিবার ব্যবস্থা নাই?"
"অবশ্যই
আছে।" তব্রপোত উপির সহিত সুসজ্জিত আলোচনাস্থলের দিকে অগ্রসর হইলেন। অবশিষ্ট মাচস্বৃন্দ
লোটস্ অতিথিদের নিয়ে উহারই আশেপাশে বসাইলেন।
উপি বসিয়াই বলিল,
"যাহা বলিবার তাহা কোনরূপ গৌরচন্দ্রিকা না করিয়া পট্ করিয়া বলিয়া ফেল।
তুমি আমার ক্রোধ সম্বন্ধে অবগত নও। চূর্ণ হইতে তাম্বুলপত্র... মানে ইয়ে
তাম্বুলপত্র হইতে চূর্ণ খসিলেই আমার রাগ হয়।"
কোনক্রমে হাসি
চাপিয়া তব্রপোত বলিল, "আমাদের এই দুই উপজাতির মধ্যে কলহের অন্ত নাই। আর সেই
কলহ, হিংসা এবং যুদ্ধের পরিসমাপ্তি ঘটানোর জন্য আমার একটি প্রস্তাব আছে উপি। আশা
রাখিতেছি তুমি আমার সহিত একমত হইবে।"
"কী প্রস্তাব
শুনি।"
"আমরা এই দুই
উপজাতি, লোটস্ এবং মাচস্ যদি যুদ্ধবিগ্রহের পরিবর্তে ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ
করি তাহা হইলে কেমন হয়? ইহাতে দুদলেরই ক্ষয়ক্ষতি কমিবে কিন্তু কে শ্রেষ্ঠ তাহা
ক্রীড়া প্রতিযোগিতার ফলাফল দেখিয়া সহজেই বুঝিতে পারা যাইবে।"
"ক্রীড়া
প্রতিযোগিতা? কি ধরনের ক্রীড়া একটু শুনি।"
"একটি
ভাবিয়াছি। তোমার এবং আমার দলের সমসংখ্যক মনুষ্য ইহাতে অংশগ্রহণ করিতে পারিবে। আমরা
প্রত্যেকেই প্রস্তর-নিক্ষেপে পারদর্শী, কিন্তু এই খেলায় একটিই প্রস্তর থাকিবে। কেহ
তাহাদের হস্ত ব্যবহার করিতে পারিবে না, পদাঘাতে প্রস্তরটিকে ক্রীড়াক্ষেত্রের
একপ্রান্ত হইতে অন্যপ্রান্তে নিক্ষেপ করিতে হইবে। দুই প্রান্তে দুইটি স্থান নির্দিষ্ট হইবে, যাহারা ঐস্থানে অধিক সংখ্যক বার
প্রস্তর প্রেরণ করিতে পারিবে তাহারা বিজয়ী ঘোষিত হইবে।"
উপি শুনিয়া বলিল,
"চমৎকার খেলা। কিন্তু খেলার সময় কে কোন পক্ষের হইয়া খেলিতেছে তাহা কী প্রকারে
নির্ণয় করা যাইবে?"
উপির প্রশ্ন শুনিয়া
তব্রপোত একটু ভাবিয়া বলিল, "তাহারও পদ্ধতি আছে। তোমাদের বনভূমি অতিশয় সুন্দর,
বিভিন্ন পুষ্পের নানাবিধ রঙে তাহা উজ্জ্বল হইয়া থাকে। তোমাদিগের প্রতিযোগীরা ওই
রক্ত এবং পীত বর্ণের পুষ্প দিয়ে গাঁথা মালা পরিয়া উপনীত হউক। এই অঞ্চলের অরণ্য
অপেক্ষাকৃত ঊষর, তাই মাচস্ প্রতিযোগীরা গাছের শ্যামলপত্র ও বল্কল দিয়া প্রস্তুত
মালা পড়িয়া যোগদান করিবে।
উপি বলিল,
"উত্তম প্রস্তাব! আমি নিশ্চিত লোটস্ জাতি এই খেলায় সুনৈপুন্যের পরিচয় দিবে।
কিন্তু আমারও একটি প্রস্তাব আছে।"
"বল।"
"সবাই এই খেলায়
উৎসাহী নাই হইতে পারে। বিশেষত কিঞ্চিৎ স্থূলকায় যারা। তাই তাহাদের জন্য আরো একটি
খেলার প্রস্তাব দিতেছি। উভয়পক্ষের কিছু সৈন্য একপ্রকার কাষ্ঠদণ্ড হস্তে লইয়া ঘুরে
বেড়ায়। এই খেলায়, একটি দল অন্য দলের দিকে প্রস্তর নিক্ষেপ করিবে। বিপক্ষ দল ঐ দণ্ড কর্তৃক প্রহারপূর্বক প্রস্তরগুলিকে দূরে নিক্ষেপ করিবে। যাহারা অধিক দূরত্বে
প্রেরণ করিবে তাহারাই বিজয়ী হইবে।" উপি হাসিয়া বলিল, "কেমন?"
"অর্থাৎ যাহারা
সর্বাপেক্ষা অধিক প্রহার করিবে তাহারাই সর্বাপেক্ষা কুশলী বলিয়া চিহ্নিত
হইবে?"
"তাহা কেন? কেহ
যদি বিপক্ষের নিক্ষিপ্ত প্রস্তরখণ্ডের সম্মুখে প্রাচীরের ন্যায় নিজেকে প্রতিষ্ঠিত
করিতে পারে তাহাও কম কৃতিত্বের নহে।"
"সাধু!"
তব্রপোতের পছন্দই হইয়াছিল। প্রস্তাব এবং প্রস্তাবকারিণী, উভয়কেই। মাচস্ এবং লোটস্দের অন্যান্যরাও সম্মত
হইয়াছিলেন। বন্ধুত্বপূর্ণ পরিবেশে দুই উপজাতির মধ্যে বাক্যালাপ হইতেছিল।
সহসা এক অপূর্ব
সুবাসে তাহাদের মন চঞ্চল হইয়া উঠিল। সবাই দেখিল, কষেভি এবং তার কিছু সঙ্গী বেশ
কিছু পাত্র লইয়া আসিতেছে। পাত্রগুলি থেকে ধূম নির্গত হইতেছে, সুগন্ধও তদ্রুপ। সর্বাপেক্ষা বৃহৎ পাত্রটি কষেভি তব্রপোত এবং উপির সামনে গিয়া রাখিল। উপি অবাক
হইয়া জিজ্ঞাসা করিল, "ইহা কী?"
তব্রপোত বলিল,
"ইনি আমার সুহৃদ, বিখ্যাত বৈজ্ঞানিক কষেভি অবুবা। এই বস্তুটি উহারই এক
অসাধারণ আবিষ্কার। মশলামিশ্রিত তণ্ডুলের মধ্যে সুপক্ক কুক্কুটমাংস, ডিম্ব ও কন্দ
দিয়া প্রস্তুত এইরূপ খাদ্য তুমি যে পূর্বে কখনো খাওনি তাহা আমি পণ রাখিয়া বলিতে
পারি। ভয় নাই, ইহাতে বিষ নাই, আমি তোমার সঙ্গে এক পাত্রেই আহার করিব।"
অতঃপর সেই স্থানে
উপস্থিত সমস্ত নারী-পুরুষ, মাচস্-লোটস্ একত্রে সেই অনন্য খাদ্য সেবনে উদ্যত হইল।
এমনকি বৃহত্তর মাংসখণ্ড কার ভাগ্যে জুটিবে সে বিষয়ে তব্রপোত এবং উপির মধ্যে ঈষৎ
বিদ্বেষ দেখা দিয়াছিল, যদিও শেষ অবধি দুজনেই নিজ নিজ অংশটি অন্যের জন্য রাখিয়া
দিয়েছিল। তাহা নিছক ভদ্রতা কিনা সেই প্রশ্নের উত্তর আমার কাছে নাই।
আহার সম্পন্ন হয়তে
হইতে দেখা গেল লোটস্ এবং মাচস্দের মধ্যে বন্ধুত্বের সূচনা হইয়াছে। পরবর্তী কবে
খেলিবার জন্য সবাই একত্র হইবে তাহা নির্ধারণ করিয়া এবং মাচস্গনকে নিজ অঞ্চলে
আমন্ত্রণ জানাইয়া লোটস্রা বিদায় লইল। উপি যাইবার সময় হাসিমুখে বলিল, "বড়ই ভালো
লাগিল। এই খাদ্য অসাধারণ। মধ্যে মধ্যে আসিয়া ইহা খাইতে চাহি।"
"যথা আজ্ঞা
মহারানী।", বলিল কষেভি।
লোটস্রা চলিয়া
যাওয়ার পর তব্রপোত তাহাকে পাকড়াও করিল, "কী ব্যাপার? লোটস্দের দলে ভিড়িবে
নাকি? উহাকে মহারানী সম্বোধন করিলে যে!"
"তার কারণ খুবই
সহজ। তুমি এই রাজ্যের রাজা আর আমি ভবিষ্যৎদ্রষ্টা!" মুচকি হাসিয়া প্রস্থান
করিতে লাগিল কষেভি।
তব্রপোত চিৎকার
করিয়া বলিল, "পলাণ্ডু-পক্কবটিকা না মারিয়া এই দেবভোগ্য খাদ্যের নাম বলিয়া যাও?"
উত্তর আসিল, "আপাতত
কোন নাম ঠিক করি নাই, তবে ইহা অবগত আছি যে, ভবিষ্যতে ইহা বিরিয়ানি নামে খ্যাত
হইবে!"
****************
কালের সঙ্গে সঙ্গে
কত কী না ইতিহাসই মহাকালের গহ্বরে চলে যায়! হয়তো কষেভির মৃত্যুর পর এই ঐশ্বরিক
খাদ্যের কথাও সবাই বিস্মৃত হইয়াছিল। কিন্তু ইতিহাস সদা পরিবর্তনশীল।
পূর্বেই লিখিয়াছি,
"History Repeats itself"। কয়েক সহস্র বৎসর পরে এই দেবভোগ্য খাদ্য এই বিশ্বে প্রত্যাবর্তন করে, তবে পারস্য দেশে। ক্রমশঃ
ভারতবর্ষ তথা সমগ্র বিশ্বে ইহা খ্যাতি লাভ করে!
ভাষাখানা চমৎকার হয়েছে, তপোব্রত।
ReplyDeleteধন্যবাদ কুন্তলা!
ReplyDeleteGhyama
ReplyDelete:D
ReplyDelete