Sunday, May 21, 2017

ইন্দোনেশিয়া ডায়েরি - ১

আমি মালয়শিয়ায় আসার পর থেকেই দলবলের সঙ্গে মালয়শিয়া এবং তার আশেপাশের জায়গাগুলো ঘোরার প্ল্যান বানানো চলছিল। তর্ক-বিতর্কের বহু বিষয় ছিল। যেমন কবে যাওয়া হবে, কোথায় যাওয়া হবে, কী কী দেখা হবে ইত্যাদি। প্রায় মাসখানেক বহু হোয়াটস্যাপ চ্যাট, কনফারেন্স কল এবং ইন্টারনেট সার্চের পর ফাইনালি একটা প্ল্যান দাঁড় করানো গেল।
কিন্তু প্ল্যানের আগে কারা কারা এই ঘোরার প্ল্যানের পার্ট ছিল সেটা লিখে ফেলি।
আমি আর দেবাদ্রি তো ছিলামই মালয়শিয়া থেকে।
কলকাতা থেকে আসছিল আমার অর্ধাঙ্গিনি শ্রেয়াসী, যাকে নিয়ে আমার ব্লগেও আগেও লেখা হয়েছে। সঙ্গে ছিল পাঠভবনের পাঁঠা ওরফে ঈশিতা ওরফে ভাইটু যাকে দার্জিলিং ঘুরতে গিয়ে আমাদের সঙ্গী বিকাশ বলত 'বাইটু'!
দিল্লী থেকে আসছিল দলের সবচেয়ে হাল্কা-ফুল্কা সদস্য দেবনাথ ওরফে ড্যুড!
হায়দ্রাবাদ থেকে আসছিল কঙ্কনা। যার বয়স আঠেরোর বেশী বাড়ে না এবং যে সুস্থভাবে ফিরে যাওয়ায় ওর অফিস আহ্লাদিত হয়ে ওকে এমন একটা পুরষ্কার দিয়েছে যে ঘোরার পুরো খরচাই নাকি উঠে গেছে!
ঘোরার প্ল্যানে কেএল ছাড়াও ছিল সুরাবায়া এবং বালি। পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রথমে যাওয়া হবে সুরাবায়া। সুরাবায়া ইস্ট জাভার অন্তর্গত এবং ইন্দোনেশিয়ার ম্যাপে বালির সামান্য ওপরে অবস্থিত। সেখানে যাওয়ার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল মাউন্ট ব্রোমো আগ্নেয়গিরি এবং মাদিকারিপুরা জলপ্রপাত দর্শন। সেখানে থেকে পরের গন্তব্য বালি, সেখানে স্কুবা ডাইভিং করা হবে এবং বালির বিভিন্ন অসাধারণ সুন্দর  ঐতিহাসিক মন্দিরগুলো দেখে কেএল ফেরা হবে।
ফ্লাইট এবং হোটেল বুকিং পুরোটাই অনলাইন করা হয়েছে এয়ার এশিয়া এবং বুকিং ডট কমের সাইট থেকে। এছাড়া শ্রেয়াসী 'ডিসকভার ইন্দোনেশিয়া' বলে একটি গ্রুপের সঙ্গে যোগাযোগ করে একদিনের ব্রোমো-মাদিকারিপুরা ঘোরার প্ল্যান-গাড়ী ফাইনাল করে ফেলেছিল। আর দেবা ঠিক করে ফেলেছিল স্কুবার গ্রুপ। সেও অনলাইন!
দেবাদ্রির ফ্ল্যাটের বারান্দা থেকে শ্রেয়সীর তোলা ছবি
যাই হোক, এপ্রিল মাসের ২৭ তারিখ কলকাতা-দিল্লী-হায়দ্রাবাদ থেকে দলবল চলে এল কুয়ালালামপুরে। পরের দিন সন্ধ্যেবেলার ফ্লাইট সুরাবায়ার উদ্দেশ্যে আর তারপরেই শুরু অ্যাডভেঞ্চার!
ভুল! অ্যাডভেঞ্চার শুরু হল প্লেনে ওঠার আগেই! ব্যাপারটা হল, আমি আমার অফিসে বলে ২৮ তারিখের একটা হাফ-ডে যোগার করেছিলাম, শুক্রবার ছিল তাই খুব বেশী চাপ হয়নি। কিন্তু দেবার বিকেল পাঁচটার সময় একটা স্ট্যাটাস আপডেট কল ছিল যেটা অনেক চেষ্টা করেও ও কাটাতে পারেনি। এদিকে প্লেনের সময় সাতটা পঁয়ত্রিশ, এবং ইন্টারন্যাশানাল ফ্লাইট তাই তার এক ঘন্টা আগে চেক-ইন বন্ধ হয়ে যাবে! সুতরাং ব্যাপারটা দাড়িয়েছিল যে, ছটা নাগাদ অফিস থেকে বেরিয়ে কোনভাবে ওকে ছটা পঁয়ত্রিশের মধ্যে এয়ারপোর্ট এসে পৌঁছতে হবে! আর ওর অফিস থেকে এয়ারপোর্ট যাওয়ার সবচেয়ে তাড়াতাড়ি উপায় হল কেএল সেন্ট্রাল এসে এয়ারপোর্ট শাটল্‌ ট্রেন নেওয়া যেটা করলেও ৪৫ মিনিট লেগেই যাবে। তার মধ্যে আবার দুপুরে এক প্রস্থ ঝোড়ো বৃষ্টি হয়ে গেল। প্রচণ্ড টেনশান মাথায় নিয়ে আমি, শ্রেয়াসী, ভাইটু আর কঙ্কনা এবং অধিকাংশ ব্যাগ নিয়ে চারটে নাগাদ এয়ারপোর্টের দিকে যাত্রা শুরু করলাম। ড্যুড গেল দেবার অফিস, ওর মিটিং হয়ে গেলে ওকে নিয়ে একসঙ্গে চলে আসবে।
রাস্তার জ্যাম কাটিয়ে মোটামুটি সাড়ে পাঁচটা নাগাদ এয়ারপোর্টে ঢুকে গেলাম। কিন্তু সেখানে আমাদের জানিয়ে দেওয়া হল যে, শুধু যে কজন এসেছে তাদের পাসপোর্ট দেখে সেই বোর্ডিং পাসগুলো দেওয়া হবে। বাকিরা যখন এসে পৌঁছবে তখন বোর্ডিং পাস পাবে। কী আর করা, আমরা আমাদের বোর্ডিং পাস নিয়ে, ইমিগ্রেশান, সিকিউরিটি চেক করে গেটের সামনে পৌঁছলাম, তখন প্রায় ছটা বাজে। দেবারা তখনো কেএল সেন্ট্রালের পথে। আমরা চারজন গম্ভীর মুখে ঘুরে বেড়াচ্ছি। এর মধ্যে এক জায়গায় সিকিউরিটি চেকিং হওয়ার পর একটা গোদা ব্যাগ ফেলে এসেছিলাম, সেটা আবার দৌড়ে গিয়ে নিয়ে এলাম। কিন্তু দেবাদের পৌঁছনোর টেনশানে ওটার চাপ মাথায় রেজিস্টারই হল না। ছটা দশ নাগাদ শুনলাম দেবারা ট্রেনে উঠেছে। যে ট্রেন এয়ারপোর্ট পৌঁছতে ৩৩ মিনিট সময় নেবে। আমাদের গোটা আষ্টেক ব্যাগের দায়িত্ব কঙ্কনাকে দিয়ে তখন আমি, শ্রেয়সী আর ভাইটু এদিকওদিক র‍্যান্ডম অ্যাটেন্ডেন্টকে ধরে ম্যানেজ করার চেষ্টা করছি। সাড়ে ছটা বাজল, দেবারা আপডেট দিচ্ছে যে আর একটু পরেই এয়ারপোর্ট। ছটা তেতাল্লিশ, দেবা আর ড্যুড এয়ারপোর্টে নেমে চেক-ইন লবির দিকে ছুটছে। এর মধ্যে এক দাত-ক্যালানে সিকিউরিটি অ্যাটেন্ডেন্ট আমাদের বুঝিয়েছে, "সি, ইওর ফ্রেন্ডস আর লেট, রাইট? সো ইটস দেয়ার ফল্ট, রাইট?" আর দশবার করে খালি বলে, "আর দে ইন এয়ারপোর্ট?" লাস্টে আমি "একে দিয়ে হবে না, কাটা!" বলে মেয়েগুলোকে অন্যদিকে নিয়ে গেলাম।
ছটা পঞ্চাশ... দেবারা আর ফোন ধরছে না, আমরাও ওদের ছুটোছুটির মধ্যে আর ফোন করছি না।
এর মধ্যে শ্রেয়সী এবং ভাইটু এয়ার এশিয়ার একটি ছেলেকে দাঁড় করিয়ে সমস্যার কথা বলল, সে শুনে 'দেখছি' বলে কেটে পড়ল। আমি তখন মনে মনে ভাবছি যে, ওদের পরের ফ্লাইটে আসতে বলে আমরা এগিয়ে পড়ব কিনা!
পাঁচ মিনিট পর আবার এয়ার এশিয়ার ছেলেটি এসে আমাদের ডেকে নিয়ে গেল। আমরা তিনজন গেলাম একজিট গেটের কাছে। সেখানে একটা কম্পুটারের ব্ল্যাক স্ক্রিনে কয়েকটা নাম দেখিয়ে বলল, "এখানে তোমার বন্ধুদের নাম আছে?"
আমরা দেখে বললাম, না। ছোকরা ম্যাটার অফ ফ্যাক্টলি বলল, "ওহ্‌ তাহলে তোমাদের বন্ধুদের চেক ইন হয়ে গেছে!"
সেই শুনে আমাদের আর দেখে কে! শ্রেয়সী ওই একজিট গেটের সামনে যে জয়োল্লাস ও নাচটা শুরু করল সেটা সাধারণতঃ বিরাট কোহলি টেস্ট সিরিজে স্টিভ স্মিথকে আউট করার পর করে থাকে! লোকজন বেশ ঘাবড়ে গেছিল, আমি 'সরি-টরি' বলে ম্যানেজ করলাম। কঙ্কনাকে গিয়ে সুখবর দিতে দিতে দেখি লম্বা প্যাসেজের শেষপ্রান্ত থেকে বিশ্বজয়ীর হাসি দিতে দিতে দুই মক্কেল আসছে!!

জানা গেল, 'জানে তু ইয়া জানে না' স্টাইলে অনেক দৌড়দৌড়ি করে এবং ঝামেলার পর তারা তাদের বোর্ডিং পাস পেয়েছে। যাই হোক, সব ভালো যার শেষ ভালো! আমাদের ভ্রমনের যদিও সবে শুরু!

... চলবে

3 comments:

"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”