Monday, September 10, 2018

লন্ডনে লণ্ডভণ্ড - ২

~~শ্রেয়সীর লন্ডন প্রবেশ~~

প্রথম পোস্টটা পড়ে অনেকেই খরচার কথা বলেছেন। কথা দিলাম, পুরো লেখার শেষে খরচের হিসেবটা ডিটেলে দিয়ে দেব। লেখার মধ্যে টুকটাক উল্লেখ তো থাকবেই। মোটামুটি খরচ হয়েছে মাথাপিছু এক লাখ ষাট-পঁয়ষট্টি মত। কেনাকাটা ছাড়া।
যাই হোক, আবার কলকাতা থেকে মুম্বাইয়ের বিমানে ফিরে যাই। সেখানে তখন খাবার নিয়ে একটা বিতর্কের সৃষ্টি হব হব করছে! সেটা লেখার আগে একটা জিনিস বলা উচিত। আমরা দুজনেই মানে এই আমি আর পিউ কেউই খুব একটা চালাকচতুর নই। তাই ঘুরতে গিয়ে অনেক জিনিসই আমাদের চমকপ্রদ লেগেছে বা না বুঝে ছড়িয়েছি যেগুলো অন্যদের অতটাও অদ্ভুত নাও লাগতে পারে।
যাই হোক, কলকাতা থেকে মুম্বাইয়ের বিমানে ব্রেকফাস্ট এল। ভেজ না ননভেজ সেটারও যথাযথ উত্তর  দেওয়া হল। তা আমার প্লেট নিয়ে ঐ রাংতা খুলে দেখলাম যে ননভেজ বস্তুটি হল ডিমের ভুজ্জি। তা ভালো! যা পাওয়া যায়। কিন্তু পিউ জিনিসটা দেখেই এয়ারহোস্টেস দিদিমণিকে ডেকে বলল, “এটা তো ভেজ!” কারণ ওর বাটিতে যে জিনিসটা আছে সেটা দেখতে হলুদ হ্লুদ, অনেকটা আমাদের পেঁপের ঝোলের মত! দিদিমণি হেসে বললেন, “না না, ওটাই নন ভেজ!” তখন বস্তুটিকে নেড়ে ঘেঁটে দেখে বোঝা গেল যে ওই বস্তুটিও ডিমের ভুজ্জি, কোন অজ্ঞাত কারণে ওটাকে হলুদ, মশলা দিয়ে রান্না করা হয়েছে। আরো একটু পরে বুঝলাম যে, পুরোটাই ওভাবে রান্না করা হয়েছে, এবং আমার প্লেটে যে অংশটা এসেছে সেখানে মশলা ভালো করে ঢোকেনি বলে ডিম-ডিম ভাবটা রয়ে গেছে আর তাই দেখে বুঝতে পেরে গেছি।
যাই হোক, মুম্বাইয়ে ঠিক সময়ই পৌঁছে গেছিলাম। তারপর এদিক ওদিক অনেকটা হেঁটে, এক তলা দোতলা করে দরকারী কাজকর্ম মিটিয়ে আমরা লাউঞ্জে পৌছলাম। লাগেজ একদম কলকাতাতেই জমা পড়ে গেছিল, তাই সেসব নিয়ে চাপ ছিল না। আমরা এয়ারপোর্টে একটু পাও ভাজি ইত্যাদি খেয়ে টুক করে লন্ডনের প্লেনে উঠে পড়লাম। এমনিতে সব ঠিকই ছিল। যদিও শুরুতেই প্লেনে উঠিয়ে
প্রিমিয়াম ইকনমি বা বিজনেস ক্লাসের মধ্যে দিয়ে হাঁটিয়ে সিটে পাঠানোটা একটু দুঃখজনক! যেন দেখাচ্ছে, দ্যাখ শালা, সস্তার টিকিট কেটে কী মিস করলি! (ফ্লাইট টিকিট বুক করেছি মেকমাইট্রিপ থেকে, জেটের ফ্লাইট, ৯২,০০০ মত, তাতে আমার ক্রেডিট কার্ডের একটা অফারের সৌজন্যে ৭,৫০০ টাকা ক্যাশব্যাক পেয়েছিলাম)
অন্য যেকোন লম্বা প্লেনজার্নির এটাও বেশ বোরিং ছিল। ঐ টুকটাক খাওয়া দাওয়া, সিনেমা দেখা আর অনেক ঘুমিয়ে যখন লন্ডন পৌঁছলাম তখন ওখানে বিকেল, বাইরে ঝকঝকে রোদ।
এয়ারপোর্টে নেমে ইমিগ্রেশানে অনেক সময় লেগেছে। সে প্রায় চার-পাঁচশো লোকের লাইন। সেও টুকটুক করে পার হয়ে ইমিগ্রেশান কাউন্টারের কাকুর সঙ্গে একটু খেজুর করে পাসপোর্টে স্ট্যাম্প পাওয়া গেল। যথারীতি ছড়িয়ে যে বেল্টে লাগেজ আসছিল সেটায় না গিয়ে পাশের বেল্টে খুঁজছিলাম। এয়ারপোর্টের এক কর্মচারী ভুল ধরিয়ে দেওয়ায় নিজেদের লাল রুকস্যাক আর নীল স্যুটকেসও পাওয়া গেল। এর পরের কাজ ছিল অয়স্টার কার্ড আর সিম নেওয়া।
এয়ারপোর্টেই একাধিক কাউন্টারে অয়স্টার কার্ড পাওয়া যাচ্ছিল। যে দিদিমণি কার্ড বিক্রি করছিলেন তিনি কার্ডের ব্যবহার বুঝিয়ে ‘সিটিম্যাপার’ নামক একটি অ্যাপ নামানোর উপদেশ দিলেন। কিন্তু তিনি জানতেন না যে গুগল এবং ইউটিউবের কল্যানে ওই অ্যাপের প্রয়োজনীয়তা আমার জানা এবং সেটা কলকাতায় থাকতেই আমার ফোনে নামানো হয়ে গেছে!
সিটিম্যাপার খুবই কাজের জিনিস এবং লন্ডনে পাবলিক ট্রান্সপোর্ট নিয়ে ঘুরতে গেলে সিটিম্যাপার না নিয়ে ঘোরা অসম্ভব না হলেও বোকামি তো বটেই। মোটামুটি লন্ডন এবং গ্রেটার লন্ডনের যেকোন দুটো জায়গার মধ্যে যাওয়ার সমস্ত সাম্ভাব্য উপায় এই অ্যাপ দেখিয়ে দেয়। হেঁটে গেলে কতক্ষণ লাগবে (এবং কত ক্যালোরি ঝরবে), উবেরে গেলে কতক্ষণ এবং কত ভাড়া, বাসে, ট্রেনে বা আন্ডারগ্রাউন্ডে (এমনকি ফেরীও) গেলে কত বিভিন্নভাবে যাওয়া যাবে এবং তাতে ভাড়া এবং সময় কত লাগবে তা এই অ্যাপ বলে দেয়। এবং অবশ্যই পরবর্তি বাস বা ট্রেনের সময়ও দেখিয়ে দেয়। পুরো দু সপ্তাহ আমাদের নিজেদের মত ঘোরার পেছনে সিটিম্যাপারের অবদান ভোলার নয়!
সিম নেওয়া হল লাইকার। এদের ১৫ পাউন্ডের প্যাকে এক মাসের জন্য, লোকাল কল, ৫ জিবি ডেটা আর ভারতসহ ৪৩টা দেশে ইন্টারন্যাশানাল কলিং ফ্রি। তবে একটু মনে রাখবেন যে, এই প্যাক ভরাতে হলে সবসময় মোবাইল ডেটা অফ করে ভরতে হয়, তারপর একটা বিশেষ নম্বর ডায়াল করে প্যাক অ্যাক্টিভেট করতে হয়। ডেটা অফ না করা থাকলে পাউন্ড ভরার সঙ্গে সঙ্গেই ডেটার জন্য পয়সা কাটতে শুরু করে এবং ওই বিশেষ প্যাকটা চালু হয় না। এটা না জানায় আমার ১৫ পাউন্ড গচ্চা গেছিল। শ্রেয়সীর সমস্যা ছিল অন্য। ওর প্যাক চালু হওয়ার পরেও ইন্টারনেট চলছিল না। সেটা পরেরদিন বিকেলে একটি দোকানে ৫ পাউন্ডের বিনিময়ে ঠিক করাতে হয়। 
যাই হোক, হিথরো থেকে যখন ট্রেনে উঠলাম তখন আটটা বেজে গেছে। আমাদের গন্তব্য ভিক্টোরিয়া স্টেশান। মাঝে একবার চেঞ্জও করতে হল। লন্ডনের আকাশে তখন বিষণ্ণ বিকেল, সন্ধ্যে নামছে… মানে ওই সাড়ে আটটা বাজে! ভিক্টোরিয়ায় নেমে রাতের জন্য স্যান্ডউইচ কিনে আমরা হাঁটা লাগালাম আমাদের পরবর্তী চারদিনের ঠিকানা পাবলাভ হোস্টেলের উদ্দেশ্য। পথ দেখালো সিটিম্যাপার। মোটামুটি মিনিট পনেরো হেঁটে আমাদের গন্তব্যে পৌঁছলাম। তার আগে চোখে পড়েছে ভিক্টোরিয়া কোচ স্টেশান। এখান থেকে আমাদের টনটনের বাস ধরার কথা। মাঝে একটা থানাও দেখেছিলাম। শ্রেয়াসী ইন্টারনেট চলছে না বলে ঘ্যানঘ্যান করায় ওকে পুলিশে দেওয়ার ভয়ও দেখিয়েছিলাম।
হোস্টেলে ঢুকে নিজেদের পাসপোর্ট দেখিয়ে নাম-টাম মিলিয়ে ঘরে ঢোকার কম্বিনেশান পাওয়া গেল। পাবলাভে মোট ছটা ডর্ম আছে এবং তাদের প্রত্যেকে কম্বিনেশান লক আলাদা আলাদা। তখনো অবধি লন্ডনে একেবারেই ঠাণ্ডা লাগেনি, বরং হাল্কা গরমভাব। নিজেদের ঘরে ঢুকে চমকে গেলাম!
ঘর পুরো ভ্যাপ্সা গরম এবং তার সঙ্গে গোটা পনেরো লোকের একসঙ্গে থাকার দরুন একটু গুমোটভাব। ব্যাগ-ফ্যাগ গুছিয়ে বসেও গরমের জন্য অস্বস্তিই হচ্ছিল। তাই একবার নিচে যাওয়া হল এয়ার কন্ডিশানের ব্যবস্থা আছে কিনা জানতে। রিশেপ্সানের ছেলেটি পাতি হাত উলটে জানালো, এসি বা ফ্যানের কোন ব্যবস্থা এই হোস্টেলে নেই!
সুতরাং আবার ঐ ঘরেই প্রত্যাবর্তন। ভাগ্যক্রমে, যে খাটের নীচের এবং মাঝের বাংক পাওয়া গেছিল সেটা জানলার পাশেই, তাই জানলার পর্দা সরিয়ে একটু হাওয়া আসার ব্যবস্থা করা হল। তারপর ফ্রেস হয়ে ওই স্যান্ডউইচ খেয়ে শুয়ে পড়লাম। ক্লান্তি ছিল, একটু পর থেকে গরমও বিশেষ লাগেনি। ঘুমলাম ভালোই। পরদিন সকালেই বেরনোর কথা। লর্ডস ট্যুরের টিকিট আছে এগারোটার সময়।

3 comments:

"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”