বছর দুয়েক আগে এই ব্লগেই লিখেছিলাম আনন্দবাজারপত্রিকার উপকারিতার কথা। সেই পথেই এগিয়ে গিয়ে এবার বাংলা মেগা সিরিয়ালগুলো আমাদের জীবনে
কত কাজে লাগে সেই নিয়েই দু-চার কথা।
১. বাংলা সিরিয়ালের দৌলতেই যে আজকালকার
ছেলেপুলেরা একটু-আধটু আত্মীয়স্বজনের নাম জানতে শিখেছে সেটা মানতেই হবে। বিশেষ করে আজকের
এই নিউক্লিয়াস ফ্যামিলির যুগে ফুলপিসি বা ন-কাকিমার মত চরিত্রগুলো বাংলা সিরিয়াল
না থাকলে খুঁজেই পাওয়া যেত না। মনে রাখবেন বাংলা সিরিয়ালের পরিবার মানেই সেটা আবশ্যিকভাবেই
একটা একান্নবর্তী পরিবার যেখানে পিসি, মাসি বা জামাইয়ের মাসতুতো ভাইয়ের শালার মত
যেকোন আত্মীয়ই যখন তখন এসে হাজির হোন!
যদিও নিজের মায়ের প্রথম বরের দ্বিতীয় বউ, যে আবার মায়েরই বৈমাত্রেয় বোন, তাকে
মাসী বা কাকিমা কী বলে ডাকা উচিত? এই প্রশ্নটা বাঘা বাঘা লোককে ঘাবড়ে দেওয়ার পক্ষে
যথেষ্ট।
২. বিদ্যাসাগর আমাদের সুবোধ বালক গোপালের কথা বলে গেছিলেন। আর তার চেয়েও সুবোধ
বালিকাদের দেখা পাওয়া যায় আজকের বাংলা সিরিয়ালগুলোতে। এখানে অবিশ্যি সব চরিত্রই হয়
কালো নয় সাদা। নাহলে দর্শকদের বুঝতে অসুবিধা হতে পারে কিনা। তাই ধূসর কোন চরিত্রের
জায়গাই নেই এখানে। এদের মধ্যে আবার সবচেয়ে সুবোধমতি হলেন সিরিয়ালের নায়িকারা।
বিছানা গোছানো থেকে বাসন মাজা অবধি বাড়ির সব কাজই এঁদের ঘাড়ে সমর্পিত থাকে।
এমনকি দরকারে বাড়ির ছোট মেয়ের বদমাইশ প্রাক্তন প্রেমিককে গুলি করে মারার কাজটাও
এঁদের কাছে চা বানানোর মতই সহজ!
এনারা খারাপ কাজ করেন না, খারাপ কাজ দেখেন না, খারাপ কিছু বলেন না, খারাপ কথা
শোনেন না, এমনকি ভুল করে কাউকে নিয়ে খারাপ কথা ভেবে ফেললে বা খারাপ স্বপ্ন দেখলে
বাড়ির পাশের মন্দিরের গুরুদেব বা গোমাতার চরণামৃত খেয়ে প্রায়শ্চিত্ত করতে যান। গল্পের
খলনায়িকা যদি নায়িকাকে বিষ খাইয়ে মারতে গিয়ে, বা বারে গান গাওয়াতে (অবশ্যই
রবীন্দ্রসঙ্গীত) গিয়ে ধরা পড়ে জেলে যান তাহলে পুলিশকে যুক্তির জালে হার মানিয়ে
তাঁকে জেল থেকে বের করে আনাও গল্পের নায়িকার দায়িত্বের মধ্যেই পরে!
৩. প্রায় সব বাংলা সিরিয়ালেই একটি বা দুটি বিশেষ চরিত্র থাকেন। কেউ হয়তো হুইল
চেয়ার নিয়ে ঘোরেন, কেউ সারাক্ষণ আধো আধো করে কথা বলেন, কেউ আবার কিছুই করেন না
শুধু এক জায়গায় চেয়ারে বসে দোলেন (টেমপ্লেটঃ সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় – শাখাপ্রশাখা)।
কিন্তু এঁরা প্রত্যেকেই মুখ খুললে প্লেটো কিম্বা সক্রেটিস, ছবি আঁকলে পিকাসো
কিম্বা ফিদা হুসেন আর গান গাইলেই শ্রাবনী সেন! আমার তো সন্দেহ হয় শ্রাবনী সেনের
গাওয়া দু-তিনটি গান বোধহয় এই সিরিয়ালের প্রযোজকদের কাছে রাখা আছে। সেগুলোকেই বিভিন্ন
সিরিয়ালে বিভিন্ন সময়ে ঘুরিয়ে ফিরিয়ে ব্যবহার করা হয়।
৪. গত বিশ্বকাপের সময় একটা জোকস্ ফেসবুকের দেওয়ালে দেওয়ালে ঘুরছিল। ভারতীয়
দলের খেলোয়াড় স্টুয়ার্ট বিনি দলে জায়গা না পেয়ে দিনের পর দিন বোর হয়ে একদিন তাঁর
স্ত্রী ময়ান্তী ল্যাঙ্গারকে বললেন, “চল না কোথাও ঘুরে আসি।” ময়ান্তী, স্টার
স্পোর্টসের উপস্থাপক, গম্ভীরভাবে (গৌতম গম্ভীর নয়) বললেন, “তোমার কাজ না থাকলেও
আমার আছে!”
কিন্তু স্টুয়ার্ট বিনির চেয়েও করুণ অবস্থা বাংলা সিরিয়ালগুলোর পুরুষ
অভিনেতাদের। এঁরা থাকেন, মাঝেমধ্যে বাক্যালাপেরও সুযোগ পান কিন্তু সেগুলো কেউ তেমন
পাত্তা দেয় না। নায়িকার স্বামীই হোন বা খলনায়িকার স্বামী, এই ব্যাপারে সব পুরুষই
সমান সমান।
এঁরা রোজ একসঙ্গে খাবার খান, সেখানে নানারকম কূটকাচালী (কে কাকে কখন কার দিকে
কী ভাবে তাকিয়ে কী খাবার দিয়ে কী বলল!) দেখার পর কোন এক রহস্যজনক অফিসে চলে যান।
মাঝেমধ্যে পরিচালকের ইচ্ছে না হলে অফিসে না গিয়ে বাড়িতে ঘুরে বেরান (ছুটি কী করে
ম্যানেজ হয় সেটা জিজ্ঞেস করা মানা!), বাড়িতে কোন অনুষ্ঠান চললে খুব ব্যস্ত হয়ে কোন
কাজ না করে এদিক ওদিক যাওয়া আসা করেন, সেরকম বিশেষ ঘটনা ঘটলে ক্যামেরা তিনবার করে
তাঁদের দেখায়। কিন্তু সব মিলিয়ে এরা সারাক্ষণই ভ্যাবা গঙ্গারামের মত আচরণ করেন
যেটাকে স্বাভাবিকভাবেই বাড়ির মেয়েরা এবং টিভির মহিলা দর্শকরা গুরুত্ব না দিয়ে
কাটিয়ে দেন।
৫. বাংলা সিরিয়ালগুলো তাদের দর্শকদের প্রতি খুবই শ্রদ্ধাশীল। দর্শকদের
সুবিধা-অসুবিধার দিকে তাদের বিশেষ নজর থাকে। এই ব্যাপারে অর্ণব (গ্রেট বং) আগেই
লিখে গেছে তবু একবার লিখি। ধরুন আপনি একটি বাংলা সিরিয়াল খুব মন দিয়ে দেখেন।
কিন্তু বাচ্চাদের গরমের ছুটিতে দশদিনের জন্য সিকিম বা উত্তরাঞ্চল গেলেন যেখানে
সিরিয়াল দেখার সুযোগ পেলেন না। তাহলে ফিরে এসে গল্প যদি পাঁই পাঁই করে এগিয়ে যায়
তাহলে তো আপনি অথৈ জলে পড়বেন।
সেই কারণেই এখানে গল্প শামুকের চেয়েও ধীরগতিতে এগিয়ে চলে। এমনকি আপনার ভাগ্য
ভালো থাকতে এসে দেখতে পারেন গল্প এক লাইনও এগোয়নি। কারণ গত দশ দিনে ধরে হয় বড়ির
আদরের মেয়ে তাঁর গানের অনুষ্ঠানের জন্য বাড়ির সবাইকে নিয়ে রেওয়াজ করে গেছেন (সব
নারী কন্ঠই শ্রাবনী সেন, পুরুষ কন্ঠ... ৪ নম্বর পয়েন্ট দেখুন!) অথবা বাড়ির বড়
ছেলের ছোট মেয়ের ননদের বেস্ট ফ্রেন্ডের বিয়ের তত্ব সাজানোর জন্য দশটি এপিসোড খরচ
হয়ে গেছে!
৬. বাংলা সিরিয়ালের আর একটা উপকারিতা দিয়ে শেষ করি। ‘গরুর রচনা’ প্রবাদটা মাঝে
মধ্যেই ব্যবহৃত হয়। সেই যে ছোট্ট ছেলেটি শুধু গরুর রচনা মুখস্ত করেছিল বলে
পরীক্ষার যেকোন রচনাতেই শেষ অবধি গরুর বিবরণ লিখে ফেলত।
এখানেও সেই একই অবস্থা। সিরিয়ালের শুরুটা থ্রিলারধর্মী হোক বা ছোট্ট বাচ্চাদের
নিয়ে শেষ অবধি সবই গিয়ে দাঁড়ায় শাশুড়ী-বউমা-জা-ননদের ল্যাং মারামারির গল্পে। এমনকি
সেই ল্যাং মারার পদ্ধতিগুলো পর্যন্ত মোটামুটি একই... রান্নায় নুন মিশিয়ে দেওয়া,
প্রাক্তন প্রেমিক-প্রেমিকাকে ডেকে এনে ঝামেলা করানো বা গয়না চুরির বদনাম দেওয়া...
মানে যতটা কিম্ভুত কিছু হতে পারে আর কি! এর সুবিধাও কম নয়... ১ নম্বর এপিসোড থেকে
না দেখলেও চলে, ১০০ এপিসোড বা ৫০০ এপিসোড, যখন ইচ্ছে দেখা শুরু করুন, গল্প বুঝতে
পাঁচ মিনিটও সময় লাগবে না!
ta ta dhinta bangla serial amar darun lage, keno, bolbo keno?
ReplyDeleteএমনভাবে হতচ্ছেদ্দা করিস না! এগুলো আছে বলেই না লেখার সুযোগ পাচ্ছিস :D
ReplyDeleteএকটা মোক্ষম পয়েন্ট মিস করে গেছিস রে ভাই। বাংলা মেগা সিরিয়াল গুলোয় নিয়মিত দেখা যায় - একটা স্বামীর দুটো বউ বা দুটো স্বামীর একটা বউ।
ReplyDeleteঅর্থাৎ মেগা সিরিয়াল নিয়মিত দেখলে দিপিকা পাড়ুকনের "It's My Choice" ভিডিওটার গুরুত্ত্ব উপলব্ধি করা যায়।
Arnab, Bangla serial amar o darun lage!! Darun stress buster!!
ReplyDeleteসায়ন্তন, ছি...ছি, হতচ্ছেদ্দা কই? আমি তো উপকারিতাগুলো লিখলাম! :)
ReplyDeleteতমোনাশ, সেটা তো বাংলা সিরিয়ালের চিরকালীন থিম! প্রথম পয়েন্টেই দ্যাখ উল্লেখ আছে!
ReplyDelete