Saturday, January 31, 2015

উত্তর বাংলার আনাচে কানাচে - ৬

(আগে যা ঘটেছে)

গরুমারা
কাকুর বাড়ির সাঁওতালি নাচ, যাত্রাপ্রসাদের গন্ডার

গরুমারার গল্প বলার আগে বলতে হবে গরুমারা পৌঁছনোর গল্প। ততদিনে বিট্টু মানে আমাদের ড্রাইভারের ওপর আমাদের বিরক্তি চরম সীমায় পৌঁছে গেছে। ব্যাটা অর্দ্ধেক জায়গায় যায় না। যেখানে যায়, সেখানে রাস্তা চেনে না। রাস্তার লোককে জিজ্ঞেস করে করে রাস্তা চিনে গাড়ী চালায়। গত দুদিন ধরে লোলেগাঁওতে বসে বসে শুধু ছুটি কাটিয়েছেএমনকি আগের দিন সন্ধ্যেবেলা লোকটাকে দেখেছিলাম ওখানকার স্থানীয় লোকেদের সঙ্গে একটা ছোট্ট রেস্তোঁরায় সামনে বোতল-গেলাস নিয়ে বসে থাকতে।
তাই গরুমারা যাওয়ার সময় যখন ও বলল যে, লাভা হয়ে লোলেগাঁও যাওয়ার রাস্তায় অনেক ঘুরতে হয়। তাই সেটার বদলে ও একটা নতুন রাস্তা জেনেছে, যেটার প্রথম ছ-সাত কিলোমিটার রাস্তা খারাপ কিন্তু তারপর পিচের রাস্তা এবং সময় কম লাগবে তাই ও সেটা দিয়ে যাবে তখন আমরা খুব একটা ভরসা করিনি।
যাত্রা শুরু করার পনেরো মিনিটের মধ্যে আমাদের সন্দেহ আরও বাড়ল যখন আমরা একটা জঙ্গলের মধ্যে গিয়ে পড়লাম। রাস্তা খারাপ বলেছিল, কিন্তু আসলে বলা উচিত ছিল যে রাস্তা বলে কিছু নেই। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাথরের ওপর দিয়ে লাফাতে লাফাতে গাড়ি চলল। দুদিকে মাঝারি ঘন জঙ্গল, মোবাইল নেটওয়ার্কের নামগন্ধ নেই। এইভাবে চলেই যাচ্ছি, ঘন্টা খানেক হয়ে গেল, রাস্তার কোন উন্নতি নেই। বিট্টুর মতলবটাও কিছু বোঝা যাচ্ছে না। মাঝে মাঝে মাথা নাড়ছে। সে সত্যিই রাস্তা চেনে না নাকি কোন নাটক করছে তা বোঝারও কোন উপায় নেই।
মাঝখানে তিনটে কাঠুরেকে দেখে সে গাড়ী থামিয়ে রাস্তা জিজ্ঞেস করছিল, শ্রেয়াসী দেখি আমার হাত আঁকড়ে ধরে বসে আছে। ফিসফিস করে আবার বলল, “গাড়ী লক করে রাখো!”
যাই হোক, খারাপ কিছুই হয়নি, ঐ লোকগুলোর দেখানো পথেই এগিয়ে গিয়ে শেষ অবধি ভালো রাস্তা পাওয়া গেল, তারপরেও আরও ঘন্টা খানেক ভালো-খারাপ রাস্তা মিলিয়ে চলার পর শেষ অবধি লাটাগুড়ির কাছে গিয়ে শহরের রাস্তায় পড়লাম।
শেষ কয়েকদিন লাভা-লোলেগাঁওয়ের মত ছোট্ট জায়গায় কাটানোর পর ঐ লাটাগুড়ির শহরতলি দেখেও কী ভালোই না লাগলো। দোকান-পাট, বাজারের মধ্যে দিয়ে আমাদের গাড়ী চলল চালসার দিকে। আমাদের রিসর্টের নাম ছিল কা-কুর-বাড়ি। যদিও সেটা কার কাকার বাড়ী সে নিয়ে আমাদের কোন ধারণা নেই।

আমরা যখন রিসর্টে ঢুকলাম তখন বারোটা বেজে গেছে। অনেক চেষ্টা করেও সেদিন বিকেলের অরণ্যভ্রমনের ব্যবস্থা করা গেল না। কিন্তু পরের দিন ভোর চারটের জন্য জিপের ব্যবস্থা করে রাখলাম। ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টেরই জিপ, সেটা নিয়েই জঙ্গলের মধ্যে ওয়াচ টাওয়ারে চলে যাওয়া যাবে।
এরপর সারাদিন রিসর্টেই ল্যাধ খেয়ে কাটালাম। কিছুই বিশেষ করার ছিল না, এমনকি কা-কুর-বাড়ির কাছের মূর্তি নদীর জলও শীতকালে শুকিয়ে যাওয়ায় সেটা দেখতেও যাওয়া হয়নি।
সন্ধ্যেবেলা রিসর্টের ম্যানেজারের উদ্যোগে আরও একটি বাঙালী পরিবারের সঙ্গে বসে সাঁওতালি নাচ দেখার সুযোগ হল। রিসর্টের মধ্যেই মাঠের মাঝখানে আগুন জ্বালিয়ে সেই আগুনকে ঘিরে পনেরো জন সাঁওতালি মেয়ের নাচ। সঙ্গে তাদের আদিম সঙ্গীত। এই জিনিস সামনে থেকে দেখার মজাই আলাদা। শেষের দিকে আমাদের তথাকথিত শহুরে মহিলারাও নাচে যোগদান করলেন। পুরুষদের যোগ দেওয়ারও প্রস্তাব ছিল কিন্তু আমি নাচার বদলে ঐ নাচকে ক্যামেরাবন্দী করায় মন দিলাম।

৩১শে ডিসেম্বরের সকাল শুরু হল ভোর সাড়ে তিনটের সময়। তখন কী জানি যে পরের কুড়ি-একুশ ঘন্টায় কত কী হতে চলেছে। যাক গে, শুরু থেকেই শুরু করি।
চারটে বাজার একটু পরেই আমাদের জিপ এসে আমাদের নিয়ে চলল গরুমারা জাতীয় উদ্যানের টিকিটঘরের উদ্দেশ্যে। বাইরে তখন প্রচণ্ড ঠান্ডা, হাড়ে হাড়ে কাঁপুনি ধরে গেছিল আমাদের। পাঁচটার আগে কাউন্টারে পৌঁছেও দেখলাম আমার সামনে নজন ততক্ষণে লাইনে দাঁড়িয়ে পরেছেন। টিকিটঘর যদিও খোলার কথা ছটায়।
ঠিক ছটায় টিকিটঘর খুলল। তার আগে টুরিস্টদের বদলে স্থানীয় লোকেদের লাইনে জায়গা রাখা নিয়ে সামান্য ঝামেলা হয়ে গেল ছোট করে। টিকিট নিয়ে, গাইড ঠিক করে তাকে তুলে নিয়ে আমাদের জিপ ছুটল যাত্রাপ্রসাদ ওয়াচ টাওয়ারের দিকে। লোকে বলে ঐ যাত্রাপ্রসাদ ও রাইনো অবসার্ভেশান পয়েন্ট থেকেই গন্ডার দেখার সুযোগ সবচেয়ে বেশী।

সাড়ে ছটা নাগাদ জঙ্গলে ঢুকতে পেলাম। আমাদের জিপই সেদিনকার প্রথম জিপ। দূরে দেখতে পাচ্ছি কাঞ্চনজঙ্ঘা। জঙ্গলের মধ্যে যাত্রাপ্রসাদ যাওয়ার পথে একটা বাইসন আমাদের সামনে দিয়ে ছুটে রাস্তা পের হয়ে গেল। আর দেখলাম বার্কিং ডিয়ার।
নদীর ধারে একটা সল্ট লিকের ঠিক সামনে ওয়াচ টাওয়ার যাত্রাপ্রসাদ। সেখান দাঁড়িয়ে সামনের দৃশ্য দেখে মনে ভরে গেল। সামনেই মূর্তি নদী, তারপর অনেকটা খোলা জায়গা, তার পেছনে ঘন জঙ্গল। জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে কুয়াশার ঘন আস্তরণ। সবার পেছনে আবছা হয়ে আছে বিভিন্ন পাহাড়চূড়া, যদিও কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাচ্ছিল না ওখান থেকে। এসবের মধ্যে দিয়ে আমাদের চোখের সামনে দিনের সূচনা হল। আকাশের ছাই ছাই আবছা রং পরিবর্তিত হল সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গে।


আমাদের পর আরও বেশ কিছু টুরিস্ট গ্রুপ সেখানে এসে জায়গা নিল, প্রত্যেক গ্রুপের সঙ্গেই একজন করে গাইড নেওয়া আবশ্যক। বাচ্চারা থাকায় কিচিরমিচির বাড়ল একটু। সেখানে প্রথম দেখতে পেলাম একটা ময়ূর। যদিও কানপুরে থাকার দরুন এবং রাজস্থান ঘুরে আসার পর ময়ূর দেখে আর নতুন লাগে না। ময়ূরের সঙ্গে সঙ্গেই অন্যান্য পাখী দেখতে পেলাম, মাছরাঙা দেখলাম, ধনেশ পাখীও দেখলাম, যদিও এদের ছবি তুলেছি পরে।
কিছুক্ষণ পর গাইডরা দেখালো বহু দূরে একটা হরিণ নদী পার হচ্ছে। সে প্রায় আবছা এতটাই দূর। আরও কিছুক্ষণ পর গাইডদের মধ্যে আবার চাঞ্চল্য দেখা দিল। জিজ্ঞেস করায় আঙুল তুলে দেখাল দূরে বন দফতরের হাতি বেরিয়েছে, সম্ভবত গন্ডার খোঁজার জন্য, যাতে গন্ডাররা তাদের বাসস্থান থেকে বেরিয়ে এসে আমাদের দর্শন দেয়। তাদের কথামতই একটু পরে হাতির তাড়া খেয়ে একটা গন্ডার বেরিয়ে এল। যদিও সেও অনেকটাই দূরে। দূরবিন বা ক্যামেরার ভিউ ফাইন্ডারে জুম না করে দেখলে সেই গন্ডার পরিষ্কার দেখা সম্ভব নয়।















পঁয়তাল্লিশ মিনিট যাত্রাপ্রসাদে কাটিয়ে আমাদের গাইডের কথামত আমরা চলে এলাম রাইনো পয়েন্টে। এটার সামনে দিয়েও মূর্তি নদীর একটা শাখা বয়ে চলেছে। এখানে পাখীর সংখ্যা আরো বেশী... নদীর বুকে বক জাতীয় নানা রকমের পাখী ঘুরে বেড়াচ্ছিল। আসছিল, আবার একটু বসে উড়ে চলে যাচ্ছিল। ওখানেই এক ধনেশ দম্পতির ছবি তুলতে পেরেছিলাম।




একটু পরে, দূরে গন্ডার দেখা গেল। প্রথমে একটা একা, তারপর একটা বড় গন্ডারের সঙ্গে একটা বাচ্চাও। সেগুলো মোটামুটি পরিষ্কারই দেখা গেল। তারপর গাইডরা জানালেন যে, দূরে নাকি একটা বাইসনের পাল বেরিয়েছে, “কিন্তু আপনাদের চোখে সেটা ধরা পড়বে না।”
অনেক কষ্ট করে জঙ্গলের দিকে একটানা তাকিয়ে থাকার পর দূরবিন আর ক্যামেরার জুম দিয়ে জঙ্গলের ধারে সত্যিই একপাল বাইসন দেখতে পাওয়া গেল। কিন্তু ছবিগুলো দেখলেই বুঝতে পারবেন যে বাইসনগুলো সত্যিই কতটা দূরে ছিল।
সাড়ে ছটা থেকে আটটা অবধি সময় ছিল। তারপর আমরা গুটি গুটি ফেরার পথ ধরলাম। সেখানেই দেখলাম, ফরেস্ট ডিপার্টমেন্টের বাংলো, রাইনো পয়েন্টের ঠিক পাশেই। জঙ্গলে থাকার পক্ষে এরকম আদর্শ জায়গা আর হয় না। পরের বার গরুমারা এলে এখানেই থাকার চেষ্টা করব এইসব ভাবতে ভাবতেই বেরিয়ে এলাম গরুমারা ন্যাশানাল পার্ক থেকে। আমাদের জিপ ছুটল কা-কুর-বাড়ি রিসর্টের দিকে।

সুনীল লিখেছিলেন, ‘কেউ কথা রাখেনি’... আমিও কথা রাখতে পারলাম না। এই সপ্তাহে অফিসের চাপে সময় করে এইটুকুই লিখতে পেরেছি। রবিবার আবার ব্যাঙ্গালোর যাচ্ছি দিন চারেকের জন্য। সুতরাং শেষ পর্ব লিখতে পারব সেখান থেকে ফেরার পরেই।

সুতরাং এই লেখার আরো এক পর্ব বাকি। জলদাপাড়ার টুরিস্ট লজের গল্প বাকি আছে এখনো। জে কে রাওলিং সাত পর্বে হ্যারি পটারের গল্প লিখেছিলেন আর আমি নাহয় সাত পর্বে উত্তরবঙ্গ ভ্রমণের গল্প লিখছি, মন্দ কী!

                                                                                                                         (চলবে)

No comments:

Post a Comment

"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”