দার্জিলিং-২
দার্জিলিং জমজমাট
রক গার্ডেনের পর আমাদের গন্তব্য ছিল পদ্মজা নাইডু
হিমালয়ান জুওলজিকাল পার্ক এবং হিমালয়ান মাউন্টেরিয়াং ইনস্টিটিউট। একই ক্যাম্পাসের
মধ্যে পাশাপাশি এই চিড়িয়াখানা, মিউজিয়াম এবং সেই সঙ্গে পর্বতারোহণ শেখার স্কুল।
চিড়িয়াখানাটা সত্যিই ভাল, বিভিন্ন পাহাড়ি ছাগল, হরিণ, ইয়াক, ভাল্লুক, বিভিন্ন
ধরনের লেপার্ড, বাঘ এবং অবশ্যই বিরল প্রজাতির লাল পান্ডা এবং নানা ধরনের পাখী এই
চিড়িয়াখানার বাসিন্দা। তাদের এবং তাদের সঙ্গে আমাদেরও প্রচুর ছবি তোলা হল।
এভারেস্ট মিউজিয়ামটাও বেশ ভাল, যত্নের ছাপ সর্বত্র।
তেনজিং নোরগে ও অন্যান্য পর্বতারোহীদের ব্যবহৃত পোশাক, সরঞ্জাম, গাঁইতি, তাঁবু এসব
দেখার মধ্যে সত্যিই একটা অন্য রকম ব্যাপার আছে। তার সঙ্গে আছে হিমালয়ের বিভিন্ন
মডেল ছাড়াও পাহাড়ের বুকে পাওয়া বিভিন্ন পাখী, সাপ ও অন্যান্য মৃত জন্তুদের স্টাফড
দেহ।
তবে শুধু জন্তু জানোয়ার নয় ওখানে গিয়েই আমাদের সঙ্গে
আলাপ হয়েছিল আমাদের ট্যুরের সবচেয়ে চিত্তাকর্ষক মানুষটির সঙ্গে। তাঁর নাম রূপেন।
পাহাড়ি লোকটি ছিলেন চিড়িয়াখানা এবং মিউজিয়ামে আমাদের গাইড। বেশ জ্ঞানী এবং মিশুকে
লোক এবং তার সঙ্গে সঙ্গেই ফটো তলায় তাঁর খুব উৎসাহ। মাঝে মাঝে তিনি আমার ক্যামেরা
চেয়ে নিয়ে আমার এবং পিউয়ের বেশ কিছু ন্যাচারাল ছবি এবং পশুপাখীদের ছবি তুলে
ফেলেছিলেন। এরপর মাউন্টেরিয়াং ইনস্টিটিউটের কাছে এসে তিনি একটু বেশীই উৎসাহিত হয়ে
পড়েন। দেওয়ালে করা পর্বতারোহণের একটি মুরালের সামনে তিনি আমার আর পিউয়ের নীচের
ছবিটি তোলেন এবং তারপর মন্তব্য করেন, “এই দেখুন, তেনজিং নোরগে ছন্দা গায়েনকে
পাহাড়ে উঠতে হেল্প করছেন!”
এর কিছুটা পর হঠাৎ একটা গাছের সামনে এসে ভদ্রলোক দাবী
করলেন যে, আমাকে ঐ গাছটায় উঠতে হবে এবং তিনি সেটার ছবি তুলবেন। অনেক বুঝিয়েও যখন
তাঁকে নিরস্ত করা গেল না তখন বাধ্য হয়েই দুরু দুরু বক্ষে আমাকে সেই শ্যাওলাধরা
গাছে উঠতে হল এবং সেই প্রচণ্ড নার্ভাসনেসকে ঢেকে দেওয়ার জন্য মুখে একটা বীরের হাসি
ঝুলিয়ে রাখতে হল আর ভদ্রলোক পটাপট কয়েকটা ছবি তুলে ফেললেন।
মিউজিয়াম দেখে আমরা যখন আবার চিড়িয়াখানা ফিরে এলাম
ততক্ষণে আমি আমার ক্যামেরার ওপর থেকে আমার সমস্ত দাবী প্রত্যাহার করে নিয়েছি। সেটা
রূপেনের কাছেই আছে এবং সেই দিয়ে তিনি লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে, লেপার্ডের খাঁচায় প্রায় ঢুকে
পড়ে আমাকে ছবি তুলে এনে দিচ্ছেন।
তার সঙ্গে সঙ্গে তাঁর রানিং কমেন্ট্রি চলছে অবশ্য,
যেমন বাঘের খাঁচায় দ্বিপ্রাহরিক নিদ্রারত বাঘটিকে দেখিয়ে তিনি বললেন, “ইসকা নাম
হ্যায় সৌরভ গাঙ্গুলী, বেঙ্গল টাইগার!”
ভদ্রলোক বোধহয় ‘গুণ্ডা’ দেখেননি নাহলে জানতেন যে
পৃথিবীতে বেঙ্গল টাইগার বলতে মিঠুনদাকেও ডাকা হয়!
ভাল্লুকের সামনে দাঁড়িয়ে তাকে ব্যাকগ্রাউন্ডে নিয়ে
ছবিও হল রূপেনের খেয়ালে। তবে রূপেন সবচেয়ে উত্তেজিত হয়ে পড়েছিল লাল পান্ডার ছবি
তুলতে গিয়ে। লাল পান্ডা বিরল প্রাজাতির অত্যন্ত অলস একটি প্রানী। আমরা যেটিকে
দেখেছিলাম সেটি একটি গাছের ডালে বসে ছিল। আমরা যখন তার সামনে গিয়ে
পৌঁছলাম তখন সে মুখ তুলে আমাদের দেখছিল কিন্তু তারপর বোধহয় সে বোর হয়ে গিয়ে
গুটিসুটি মেরে ঘুমিয়েই পড়ল। মাঝে আমাদের দেখে একবার মাথা তুলেছিল কিন্তু ওইটুকুই। তাও পরে হোটেলে ফিরে
দেখলাম রূপেন ঐ লাল পান্ডাটির পনেরো খানা ছবি তুলেছে যার অন্তত বারোটা ছবির
ক্ষেত্রে তাদের নিজেদের মধ্যে কোন পার্থক্যই নেই!
কিন্তু এসব সত্ত্বেও বলতেই হবে যে রূপেন দেখিয়েছিল
খুব ভালো করে, আর আপনারা ওখানে গেলে ওকে গাইড নিলে খুব একটা ঠকবেন না।
চিড়িয়াখানা থেকে আমরা গেলাম একটা চা-বাগানে যেটার নাম
আমার মনে নেই। তবে সেখানে থেকেও কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি তুললাম, তার সঙ্গে লেবং
রেসকোর্সেরও ছবি তোলা হল। চা বাগানের লাগোয়া দোকানে চা খাওয়া হল সঙ্গে ঐ বাগানের
চা-পাতা কেনাও হল। ভালোই!
সেখান থেকে আমরা গেলাম শহরের আর-এক চত্বরে জাপানী
মন্দির আর পিস্ প্যাগোডা দেখতে। রাস্তায় আমাদের গাড়ীর ড্রাইভার বিকাশ সেন্ট পলস্
স্কুল দেখিয়ে দিল যেখানে ‘ম্যায় হুঁ না’ সিনেমার শুটিং হয়েছিল! শান্তি স্তুপ দেখে
ভালই লাগলো যদিও ঐ ধরণের স্তুপ আমি আগে রাজগীরেও দেখেছি। তবে স্তুপের দেওয়ালের
কিছু কিছু কাজ সত্যিই বেশ ভালো এবং যথারীতি ঐ স্তুপের ওপরে উঠলেও দূরে কাঞ্চনজঙ্ঘা
দেখতে পাওয়া যায়।
শান্তি স্তুপ ছিল সেদিনকার মত শেষ ঘোরার জায়গা। তারপর
বিকাশ আমাদের দার্জিলিং চৌরাস্তায় ঠিক কেভেনটার্সের সামনে নামিয়ে দিয়ে, “কাল আবার
দেখা হবে বলে” কেটে পড়ল। বিকাশকে আমাদের বেশ পছন্দ হয়ে গেছিল তাই পরের দিন ওর
গাড়ীতেই মিরিক যাওয়া হবে বলে ঠিক করে ফেলেছিলাম।
সারাদিন ঘুরে খিদে তো পেয়েইছিল তাছাড়াও আমাদের দুজনের
জন্যেই কেভেনটার্স ছিল অবশ্য দ্রাষ্টব্য। একদিকে আমি ভাবছি ওখানে ফেলুদা সেই কোন ছোট্টবেলায় তোপসেকে নিয়ে গেছিল আর
অন্যদিকে পিউ ভাবছে ওখানেই রণবীর কাপুর থুড়ি বরফি শ্রুতিকে প্রেমপত্র দিয়েছিল। পিউ
এটাও আশা করেছিল যে ওর জন্যও কেউ ক্লক টাওয়ারে চড়ে হাত-পা নাড়বে তবে আমি অবশ্যই সে
রিস্ক নিইনি। অত পুরনো ক্লক টাওয়ার, ধসে গেলে দেখবে কে!
কেভেন্টার্সে গিয়ে আমার ক্যামেরা হারাল। মানে হঠাৎ
দেখলাম আমার সঙ্গের ব্যাগে আমার ক্যামেরা নেই। খাওয়া মাথায় উঠল! ব্যাগের সব জিনিস
বের করে বার দুয়েক ঘেঁটেও যখন পাওয়া গেল না তখন বিকাশকে ফোন করা হল, তার গাড়ীতে
পড়ে আছে কিনা জানার জন্য। সেও ‘দেখে দু মিনিট পর ফোন করছি’ বলে ফোনটা দিল কেটে। সে
এক অসহ্য দু মিনিট! যাই হোক দ্বিতীয়বার তাকে ফোন করে জানা গেল যে ক্যামেরা তার
গাড়ীতেই আছে এবং পাঁচ মিনিটের মধ্যে সে নিজে কেভেনটার্সের দোতলায় এসে ক্যামেরা
দিয়ে গেল।
ক্যামেরা পেয়ে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই প্রচণ্ড খিদে পেয়ে
গেল আমাদের। সকালের সেই ব্রেকফাস্টের পর থেকে কিছু না খেয়েই ঘুরছি। সুতরাং দু
প্লেট চিকেন স্যান্ডুইচার সঙ্গে দু প্লেট অমলেট এবং বেকন অর্ডার হয়ে গেল প্রথমেই।
সঙ্গে কফি। তারপর আরো দু প্লেট হ্যাম স্যান্ডউইচ খাওয়ার পর আমাদের আত্মা সন্তুষ্ট
হল। খাওয়ার আসার ফাঁকে মনের সুখে কাঞ্চনজঙ্ঘার ছবি তুললাম। পিউ একগাদা সেলফি তুলল,
পাশের টেবিলের একটা বাচ্চা মেয়ের সঙ্গে গল্প করল আর ওখানকার কর্মচারীদের মধ্যে
কাকে কাকে বরফি সিনেমায় দেখিয়েছে সেই নিয়ে গবেষণা করল।
আধ ঘন্টা পরে যখন আমরা কেভেন্টার্স থেকে মৌরি চিবোতে
চিবোতে বেরোলাম তখন আমাদের পেট ভর্তি, মন প্রসন্ন! অতঃপর শুরু হল দার্জিলিং-এর শেষ
বিকেলের মিঠে রোদে আমাদের উদ্দেশ্যহীন পদচারণা।
এই দোকান, সেই দোকান... কোনটা কিউরিও শপ তো কোনটা
কেকের দোকান, আর গরম কাপড়ের দোকান তো আছেই। ঘোরাই আসল, তার সঙ্গে যদি কোন জ্যাকেট
পছন্দ হয় এবং পছন্দমত সস্তা দামে পাওয়া যায় তাহলে কেনেকাটাও হবে। জ্যাকেট যদিও হল
না কিন্তু বেশ কয়েকটা কিউরিও শপ ঘুরে শেষ অবধি ‘নেপাল কিউরিও শপ’ (হুঁ হুঁ বাওয়া!
ফেলুদা ওখানেই গেছিল) থেকে আমি আমার জন্য একটা ইয়াকের হার দিয়ে বানানো তিব্বতী
ধাঁচের গনেশ, বন্ধু মৃন্ময়ের জন্য জপযন্ত্র (যার ভেতরে মন্ত্র লেখা কাগজ আছে কিনা
দেখে নিয়েছিলাম), বাবার জন্য ছোট্ট ভোজালীর মত দেখতে পেপার নাইফ... এইসব কিনে
ফেললাম। জিনিসপত্র কিনতে কিনতে এবং আরো অনেক রকমের ইন্টারেস্টিং জিনিস দেখতে দেখতে
আমরা পৌঁছে গেলাম ম্যালে।
দার্জিলিং-এর ম্যাল আমার খুব পছন্দ হয়েছে। সুন্দর
ছড়ানো একটা জায়গা। একদিকে ক্রিসমাস উপলক্ষে বানানো একটা স্টেজের ওপর বাচ্চারা
ছোটাছুটি করছে, অন্যদিকে পরপর পুরনো পুরনো চায়ের দোকান। জায়গায় জায়গায় বেঞ্চ পাতা
আছে যেখানে বসে আড্ডা মারা যায়। আবার চাইলে কোন চায়ের দোকানে ঢুকে পৃথিবীবিখ্যাত
কোন চায়ের কাপে চুমুক মারাও যায়। ফেলুদা মকাইবাড়ির চা ফ্রি-তে পেত। আমরা না হয় পাই
না কিন্তু তাই বলে খাব না তা কি হতে পারে! সুতরাং আমরা দুজনে গোল্ডেনটিপসে ঢুকে
পড়ে দু কাপ মকাইবাড়ির চা অর্ডার দিয়ে দিলাম। একটু পরেই দুটো বেশ বড় কাপে প্রায়
কমলা রঙের সেই মহার্ঘ্য পানীয় এল। আমরা দুজনে খেলাম এবং দুঃখের বিষয় তেমন কিছুই
আলাদা করে বুঝলাম না! বেরসিক আর কাকে বলে!
সূর্য অস্ত যাওয়ার পর থেকেই ঠাণ্ডাটা বেশ তাড়াতাড়িই
বাড়ছিল। সেই শীত উপেক্ষা করেই ঘুরছিলাম তবে সাড়ে ছটা নাগাদ রণে ভঙ্গ দিলাম।
চৌরাস্তায় এসে একটা গাড়ি নিয়ে নিলাম আমাদের হোটেলে পৌঁছনোর জন্য। আমাদের হোটেল
মানে পাহাড়ী সোলের ঘরোয়া ব্যবহার এবং কাঞ্চনজঙ্ঘার অসাধারণ ভিউয়ের সঙ্গে সঙ্গে
প্রধান যে সমস্যাটি আছে সেটা হল হোটেলটা ম্যাল থেকে প্রায় পাঁচ-ছ কিলোমিটার দূরে।
তাই রীতিমত ২০০ টাকা ভাড়া দিয়ে হোটেলে ফিরতে হল। হোটেলে ফিরে সোজা লেপের তলায়। তার
আগে ডিনারের অর্ডার দিয়ে দিলাম, দু বাটি চিকেন থুকপা, আমার এবং পিউয়ের জন্য। ঐ
কনকনে ঠান্ডার মধ্যে এর থেকে ভালো খাবার আর হয় না।
শুয়েও পড়লাম তাড়াতাড়ি। কাল পঁচিশে ডিসেম্বর, বড়দিন।
দার্জিলিং দেখা শেষ তাই আমাদের কালকের প্ল্যান মিরিক যাওয়া আর সঙ্গে সামান্য বিদেশ
ভ্রমণ, যদিও বিনা পাসপোর্টে!
(চলবে)
Tenzing Norgey-r mural er nicher photo ta dekhe mone hocche Bangla film er gaaner drishyer screen shot. Lal Panda-r photo dekhe besh bhalo laglo. Darjeeling er rastay kono Batikbabu kingba Phillip Tamag er sange dekha hoyechilo naki? Porer part porar janye agroho aaro bere gelo.
ReplyDeleteBatikbabuke dekhte pai kina kheyal rekhechhilam... kintu nojore poreni!
ReplyDeleteAnjan Dutta k kothao pao ni? Lekhata kintu jomai chaliye jao
ReplyDeleteAnjan babu nischoi Park St. e Borodin katachchhilen!
ReplyDeleteDuronto!
ReplyDelete