Saturday, January 24, 2015

উত্তর বাংলার আনাচে কানাচে - ৫

(আগে যা ঘটেছে)


লাভা-লোলেগাঁও
নট আ গুড ‘চয়েস’

কালিম্পঙে আমাদের এক রাত্তিরই থাকার কথা। পরদিন সকালে উঠেই ব্যাগ-ট্যাগ গুছনোর ব্যাপার ছিল। তাছাড়া আমি রোজ সকালে বেরোবার আগে সারাদিনের প্ল্যান করে নিতাম বা কোথায় কখন কি কাগজ-পত্র লাগবে সেগুলো দেখে নিতাম। সেদিন সকালে উঠে লাভার হোটেলের বুকিঙের কাগজ দেখতে গিয়ে ঘাবড়ে গেলাম। আমরা হলিডেহোমইন্ডিয়া বলে একটা ওয়েবসাইট থেকে লাভার হোটেল চয়েসে বুকিং করেছিলাম। ওরা পোস্টেই বুকিং স্লিপ পাঠিয়ে দিয়েছিল। তখন কীভাবে জানি না নজর এড়িয়ে গেছে, এখন দেখলাম আমাদের হোটেল বুকিং ঠিক এক মাস আগের। মানে ২৭শে ডিসেম্বরের বদলে ২৭শে নভেম্বর। কেলেঙ্কারী ব্যাপার! এদের দিয়েই লোলেগাঁওর বুকিংও করানো হয়েছিল। সুতরাং সবার আগে সেটার তারিখ চেক করলাম। কিন্তু মজার ব্যাপার যে সেটার বুকিং ঠিক তারিখেই হয়েছে। ভুল শুধু হয়েছে লাভার কেসটায়।
কী আর করি। স্লিপে যেসব নম্বর দেওয়া ছিল, তার কয়েকটায় ফোন করলাম, বেশীরভাগ সুইচ অফ, নাহলে বেজে যাচ্ছে। অতঃপর গুগল থেকে খুঁজে পেতে একটা নম্বরে ফোন করায় ফোন লাগল। ভদ্রলোক ঐ হোটেলের কলকাতা অফিসে বসেন। ওনাকে বুঝিয়ে বললাম প্রবলেমটা। উনি ব্যাপারটা বুঝলেন, তারপর বললেন যে, ঘর পাওয়া যাবে। চাপ হওয়া উচিত নয়। তবে দশটার পর ফোন করলে উনি সেটা কনফার্ম করবেন।
টেনশান কমিয়ে আবার প্যাকিং-এ মন দিলাম। এর মধ্যে পিউ উঠল, তাকে এইসব জানানো হল। সেও খুব একটা চাপ না নিয়ে ব্রেকফাস্টে মন দিল।
সব গুছিয়ে নিয়ে দশটা নাগাদ বেরনো হল। এর মধ্যে আমাদের নতুন ড্রাইভার বিট্টু তার অল্টো নিয়ে হাজির হয়ে গেছিল। কালিম্পং থেকে ঘন্টা তিনেক জার্নি করে এসে পৌঁছলাম লাভা। এর মধ্যে হোটেলে ফোন করে আমাদের থাকার ব্যবস্থা নিয়ে নিশ্চিত হওয়া গেছে। হোটেল চয়েসে ঘর ফাঁকা আছে যেখানে থাকা যাবে।
লাভা একটা খুবই ছোট্ট জায়গা। তার মধ্যে রাস্তার দুদিকে একের পর এক হোটেল। সেগুলোর মধ্যেই এক গলির মধ্যে আমাদের হোটেল চয়েস খুঁজে বের করলাম। প্রথম দর্শনেই মনটা বেশ দমে গেল। ছোট্ট হোটেল, সামনে একটা লাউঞ্জ মত জায়গা, এক পাশে রান্নাঘর। লাউঞ্জের পাশেই আমাদের ঘরটাও খুবই ছোট, বিছানার চাদরটাও খুব পরিষ্কার নয়, রুম-হিটার নেই। একেবারেই সাধারণ ব্যবস্থা আর তার সঙ্গে কনকনে ঠান্ডা! কালিম্পঙের চেয়ে লাভায় অনেকটাই ঠাণ্ডা বেশী ছিল। ঘরে গিয়েই লেপের তলায় ঢুকতে হল।
যাই হোক একটু ধাতস্থ হয়ে আমি আর পিউ দুপুরের খাওয়া খুঁজতে বেরোলাম। গলি থেকে বেরিয়ে কয়েক পা হেঁটেই দেখি, একটা বাঙ্গালী হোটেল এবং খাবার জায়গা যেখানে অনেক লোক একসঙ্গে খাওয়া দাওয়া করছে। সেখান কিছুক্ষণ অপেক্ষা করতেই বসার জায়গা পাওয়া গেল। খাওয়া হল ভাত, ঘি, ডাল, পাঁপড়, বাঁধাকপি আর ডিমের ডালনা। শেষ কদিনের থুকপা আর স্যান্ডউইচের পর ডাল-ভাত দারুণই লেগেছিল। কিন্তু রাত্তিরে ঠান্ডার মধ্যে আবার ওখানে আস্তে ইচ্ছে করবে কিনা সেই ভেবে রাতের খাবার অর্ডার করলাম না। আসলে লাভা এতটাই ছোট জায়গা যে সব হোটেলই রাতের জন্য বিকেলের মধ্যে অর্ডার নিয়ে সেই মত মাথাগোনা খাবারের ব্যবস্থা করে।

লাঞ্চ করে সামান্য মিনিট পনেরো ঘোরাঘুরি করতেই লাভার প্রধান রাস্তাটা আমাদের দেখা হয়ে গেল। তখন বুঝলাম যে জায়গাটা কত ছোট। হোটেলগুলোও বেশীরভাগই যে খুব ভালো লাগলো তা নয়, মনে হল আমাদের হোটেলটার মতই হবে। আর কিছু ছোটখাট দোকান, ঘর সাজানোর জিনিস, মুর্তি, খেলনা, পুতুল, শাল... এইসব সামগ্রী নিয়ে বসে আছে। সঙ্গে অতি অবশ্যই ল্যেজ, কোল্ড ড্রিঙ্কস, বিস্কুটের মত দরকারী জিনিসগুলোও আছে।
আমাদের গাইডবই অনুযায়ী লাভায় প্রধান দুটো দেখার জায়গা নেওড়া ভ্যালি ন্যাশানাল পার্ক আর ছ্যাঙ্গে ফলস্‌। সেদিনকার মত কাটিয়ে দিয়ে আমরা হোটেলের ঘরে লেপ মুড়ি দিয়ে সেট ম্যাক্সে ‘মোহব্বতে’ দেখতে বসলাম। প্ল্যান করলাম পর দিন সকালে লোলেগাঁও যাওয়ার আগে এ দুটো দেখে নেওয়া যাবে।
সারা বিকেল-সন্ধ্যে আধা ঘুম-আধা আড্ডা মেরে কাটল। সঙ্গে মাঝে মাঝে কফি, ম্যাগি এইসব উপাচার তো ছিলই। মাঝখানে একবার হোটেলের মালিক মিঃ রোবেনের সঙ্গে কিছুক্ষণ আড্ডা মারলাম। জানতে পারলাম যে, হোটেলের পেছনে পাহাড়ের ঢালে ওদের বাড়ী। ও  আর ওর বউ মিলে হোটেলটা চালায়, এছাড়া সাইট সিইং-এর গাড়ীর ব্যবসাও আছে। আরো জানতে পারলাম যে, নেওড়া ভ্যালি বা ছ্যাঙ্গে ফলস্‌ যাওয়ার রাস্তা এতটাই দুর্গম যে আমাদের ছোট অল্টো গাড়ী কোনমতেই যাবে না। তার জন্য আলাদা বড়, ভারী গাড়ী ভাড়া করতে হবে।
শুনে প্রথমে মনে হয়েছিল যে, হয়তো নিজের গাড়ী গচানোর জন্য এইসব বলছে, তাই অতটা পাত্তা দিইনি। পরের কথায় একটু পরে আসছি।
রাত্তিরে মুর্গির মাংস-ভাত অর্ডার দেওয়া ছিল। খাওয়া-দাওয়া হয়ে যাওয়ার পর রোবেন এসে জিজ্ঞেস করল, “অর কুছ চাহিয়ে সাব?” কিছু লাগবে না বলায়, “তো হাম আতা হ্যাঁয় সাব” বলে সে চলে গেল। তখন কিছু সন্দেহ হয়নি। কিন্তু মিনিট দশেক পর মনে হল, বাইরে থেকে একেবারেই কোন আওয়াজ আসছে না। দরজাটা খুলতেই দেখি বাইরেটা ঘুটঘুটে অন্ধকার। লাউঞ্জের সব আলো নেভানো, জনপ্রাণী নেই। প্রথমে দেখে দুজনে ঘাবড়েই গেছিলাম। মনে হল হিন্দি-ইংরেজি ভূতের সিনেমার মতই কোন ভূতুড়ে হোটেলে এসে পৌঁছেছি। মোবাইলের টর্চের আলোয় হাতড়ে হাতড়ে সুইচ বোর্ডটা পাওয়া গেল। লাউঞ্জের আলোটা জ্বলে উঠতেই পরিবেশটা একটু উন্নত হল। কিন্তু চারদিকে তাকিয়ে যা দেখলাম সেটা মোটেই আশাব্যঞ্জক নয়। লাউঞ্জে কেউ নেই, ঐ ফ্লোরের অন্য ঘরটায় লোক নেই, সেটা আমি জানতাম। আরো দুটো দরজা, একটা খুলে দেখলাম ওটা একটা বাথরুম, অন্যটা পেছনদিকে একটা বারান্দা। বুঝতে পারলাম যে দোতলায় যাওয়ার সিঁড়িটাও বাইরে দিয়ে। হোটেলের কাঁচের দরজাটা টেনে দেওয়া, বাইরে থেকে সহজেই খুলে ফেলা যায়। সামনের ধাতব শাটারটা তিন-চতুর্থাংশ নামানো।
এসবের মধ্যে আরো খেয়াল হল সারাদিনে রোবেনের ফোন নম্বরটাও নেওয়া হয়নি। কী আর করি, ঐ বারান্দায় গিয়ে “রোবেন, রোবেন” বলে হাঁক পাড়তে লাগলাম। একটা আবছা “আয়া”ও শুনতে পেলাম বলে মনে হল। আবার লাউঞ্জে ফিরে হোটেলের রেজিস্টারটা ঘাঁটব ভাবছি এমন সময়ে হন্তদন্ত হয়ে রোবেন এসে হাজির। আমার প্রশ্নের উত্তরে সে জানালো যে, এটাই তার হোটেলের সিস্টেম। তারা সকলেই রাত্তিরে নিজেদের বাড়ী চলে যায়। লাউঞ্জটা ফাঁকাই থাকে। চিন্তার কিছু নেই, ওপরে দোতলায় অন্য গেস্টরা আছে। এইসব বলে-টলে নিজের ফোন নম্বরটা দিয়ে রোবেন কেটে পড়ল। আমরা আর কী করি। ঘরে ঢুকে দরজার ছিটকিনিটা শক্ত করে লাগিয়ে দিয়ে দরজার গায়ে আমাদের ভারী সুটকেস, ব্যাগ, চেয়ার ঠেকিয়ে রেখে দিলাম। পিউ দাবী জানিয়েছিল যে আলো জ্বেলে ঘুমনোর জন্য, কিন্তু ঘরের নাইট ল্যাম্পটার আলোর রং লাল! তাতে ভয় যত না কমল তার চেয়ে বেশী ভূতুড়ে পরিবেশের সৃষ্টি হল। সুতরাং শেষ অবধি টিভিটা চালিয়ে রেখে ঘুমোতে যাওয়া সব্যস্ত হল। ঠান্ডাটা ততক্ষণে অস্বাভাবিক রকমের বেড়ে গেছে।
সকালে যখন ঘুম থেকে উঠলাম আগের রাতের বিভীষিকা(!) তখন আর নেই। বাইরে উজ্জ্বল আকাশ। ঘরের বাইরে থেকে রোবেন আর হোটেলের বাকি লোকেদের গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছে, ঠান্ডা যদিও কমেনি।
রেডি হয়ে, কফি খেয়ে বেশী দেরি না করেই বেরিয়ে পড়া গেল। বিট্টু মানে আমাদের ড্রাইভারকে যখন নেওড়া ভ্যালি আর ছ্যাঙ্গে যাওয়ার কথা বললাম, তখন সে আমতা আমতা করে যা বলল তা হল, তার গাড়ী ওইসব জায়গায় যাবে না। গেলেও রাস্তাতেই আটকে যাবে। ঐসব জায়গার জন্য বড় গাড়ীর প্রয়োজন, ঠিক যা রোবেন বলেছিল। সে আরো যা বলল, তাকে বলা হয়েছে যে, তার গাড়ী নিয়ে আমাদের শুধু কালিম্পং থেকে লাভা, লাভা থেকে লোলেগাঁও... এই জায়গা থেকে আরেক জায়গায় নিয়ে যেতে হবে। এইসব সাইট সিইং সে করাবে না। তার চেয়েও বড় কথা এই ছোট অল্টো গাড়ী অধিকাংশ জায়গায় যাবেই না।
যার কাছ থেকে গাড়ী নিয়েছি তার এটা বোধহয় জানানো উচিত ছিল। তাকে ফোন করেও বিশেষ লাভ হয়নি। নানা রকম বাহানা করে সে কাটিয়ে দিল। সুতরাং এই ফাঁকে এখানে একটা উপদেশ দিয়ে রাখি, উত্তর বাংলায় ঘুরতে গেলে দুজনই যান বা দশজনই যান সবসময় বোলেরো-সুমো বা ঐ জাতীয় বড় গাড়ী ভাড়া করবেন। দরকার হবে না ভেবে বা পয়সা বাঁচানোর চক্করে ছোট গাড়ী ভাড়া করলে সেই গাড়ী অর্দ্ধেক জায়গাতেই যাবে না! আপনার ঘোরার বারোটা বেজে যাবে!
এইসব ঝামেলায় মুড একেবারেই খিঁচরে গেল। আর অন্য গাড়ী নিতেও ইচ্ছে করছিল না। নেওড়া ভ্যালি ন্যাশানাল পার্কের শুরুতে কিছুটা জায়গা নিয়ে গোটা পার্কের একটা ছোট রেপ্লিকা আছে। সেটা আমরা দেখে নিলাম। বিভিন্ন গাছপালা আর পাখীর মডেল ছাড়াও একটা স্টাফড্‌ ভাল্লুকও ছিল। পুরোটা দেখতে দশ মিনিটও লাগলো না। পিউ যদিও তার মধ্যেও ভয় পাওয়ার চেষ্টা করেছিল!
তারপর সেখান থেকে সোজা লোলেগাঁও। একই রকমের পাহাড়ি রাস্তা ধরে এগিয়ে যাওয়া। যদিও রাস্তার হাল বেশ খারাপ। ঘন্টা দুয়েক পর লোলেগাঁও পৌঁছে দেখলাম সেটা লাভার চেয়েও ছোট একটা জায়গা। তবে এখানকার হোটেলটা বাইরে থেকে দেখে বেশ ভালোই লাগল। আর হোটেলের ঠিক সামনে থেকে দেখা যাচ্ছে আমাদের পুরনো বন্ধু কাঞ্চনজঙ্ঘা। যদিও হোটেল কাফালের মালকিন জানালো যে আমাদের ঘর এখনো রেডি নেই। সুতরাং রিশেপসানের এক পাশে আমাদের ব্যাগ-পত্তর রেখে দুপুরের খাবারের অর্ডার দিয়ে বেরিয়ে পড়লাম ‘হ্যাঙ্গিং ব্রিজ’ দেখতে।


কাঞ্চনজঙ্ঘা ছাড়া জঙ্গলের মধ্যে ঐ কাঠের ব্রিজটাই লোলেগাঁওয়ের প্রধান দ্রষ্টব্য। জঙ্গলের মধ্যে ভালোই লাগল সেই ব্রিজ। তবে আরো অন্যান্য টুরিস্ট এবং বাচ্চাদের ক্যাঁই-ম্যাই এর জন্য জঙ্গলের শান্তি অনেকটাই বিঘ্নিত হয়েছিল। সেখানেই রাস্তার ধারে একটা নীচু গাছের ডালে চড়ে ছবি তোলা হল। পিউয়ের সেই ‘শাখামৃগ’ নামের ছবিটা ফেসবুকে এত বিখ্যাত হয়ে গেছিল যে দেখলাম আমার ব্রাজিলিয়ান সহকর্মী পর্যন্ত এসে সেটা লাইক করে গেছে!
হোটেলে ফিরে ঘর দেখে মন ভরে গেল। বেশ পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন ঘর। কাঠের দেওয়াল, দুদিকে বড় বড় জানলা, সেই ঘরের আবার একটা নামও আছে, ‘কস্তুরি’। কিন্তু তার চেয়েও বড় কথা, ঘরের বারান্দা থেকে বটেই এমনকি জানলার পর্দা সরালে বিছানায় শুয়ে শুয়েই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখতে পাওয়া যায়।
জিজ্ঞাসাবাদ করে জানলাম যে, এই লোলেগাঁওতে দেখার মত আরো দুটো জায়গা হল একটা সানসেট পয়েন্ট আর একটা সানরাইজ পয়েন্ট। বিশেষ করে সেই সানরাইজ পয়েন্টের সূর্যোদয় নাকি টাইগার হিলের সূর্যোদয়ের মতই সুন্দর! এবার আপনারাই বলুন একবার ঠান্ডায় জমে বরফ হতে হতে সানরাইজ দেখার পর আবার কেউ সেই জিনিস দেখার জন্য ভোর চারটের সময় ওঠে! সুতরাং সানরাইজ আর সানসেট, দুটোই কাটিয়ে দিয়ে আমরা পরের দিনের রিষপ যাওয়ার প্ল্যান বানালাম। বলাই বাহুল্য সেই রাস্তাতেও আমাদের বিট্টুর গাড়ী চলবে না। তাই লোলেগাঁও বাসস্ট্যান্ড থেকে পরের দিনের জন্য বোলেরো গাড়ী ভাড়া করে ফেলা হল। তারপর বাকি দিনটা নির্ভেজাল বিশ্রাম, আড্ডা, কফি-পাকোড়া খাওয়া, টিভি দেখা আর ঘুম!
পরদিন সকালে নিজেরা সূর্যোদয় দেখতে না গেলেও হোটেল সুদ্ধু লোকের উৎসাহের চোটে ভোর চারটের সময় ঘুম ভেঙ্গে গেল। কী করব? চারদিকে যা হইচই হচ্ছিল সে কহতব্য নয়, আর ঐ কাঠের পাতলা দেওয়াল ভেদ করে সেইসব আওয়াজ আমাদের ঘুমেরও সাড়ে বারোটা বাজিয়ে দিল। যাই হোক, সবাই বেরিয়ে যাওয়ার পর চারদিক শান্ত হলে আমরা আবার একটু ঘুমিয়ে নিলাম। তারপর হঠাৎ ছটা নাগাদ ঘুম ভাঙ্গল। কী মনে হল, জানলার পর্দা সরিয়ে দেখলাম, কাঞ্চনজঙ্ঘার গায়ে লাল রং ছড়িয়ে গেছে। পুরো গোলাপী রং ধরেছে  চূড়ায়। সে এক অসাধারণ অনুভূতি। জানি না, যারা সানরাইজ পয়েন্টে গেছিল তারা বিশেষ কী দেখেছে কিন্তু আমার ঘরে বসে সেদিন যে অভিজ্ঞতা হল তার তুলনাও সহজে মেলা ভার।

দশটা বাজার আগেই আমরা দুজন রিষপের জন্য বেরিয়ে পড়লাম। লোলেগাঁও থেকে রিষপের রাস্তা সত্যিই খুব খারাপ। জায়গায় জায়গায় রাস্তা বলে কিছুই নেই। কোথাও বড় বড় গর্ত, কোথাও হয়তো শুধু পাথর। জায়গায় জায়গায় খাড়াইটাও বেশ চোখে পড়ার মত। ঐ রাস্তা দিয়ে ঘন্টা দুয়েক যাওয়ার পর আমাদের ড্রাইভার (নাম ভুলে গেছি) গাড়ী থামিয়ে বলল, “এবার ঘুরে আসুন।”
গাড়ী থেকে নেমে দেখি রাস্তার ধারে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে পাহাড়ের গায়ে ঢালু পথ উঠে গেছে। একটা গাছের ডালে আটকানো বোর্ডে লেখা ‘টিফিন ডেরা’। ঠিক জানতাম না ওখানে কী আছে। ড্রাইভার ছেলেটিকে জিজ্ঞেস করায় যা বলল তাতে মনে হল যে, ওপরে মাইল খানেক গেলেই একটা ভিউ পয়েন্ট আছে। ভাবলাম, ওপরে গেলে নিশ্চয়ই কাঞ্চনজঙ্ঘা দেখা যাবে। যাই হোক, দুজনে মিলে জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাঁটা শুরু করলাম। জঙ্গল খুব একটা ঘন না হলেও খাড়াই। সেই খাড়াই পথ দিয়ে মিনিট পনের হাঁটার পরেও জঙ্গল ছাড়া যখন কিছুই দেখতে পেলাম না তখন সন্দেহ হল যা ভেবে হাঁটছি সেটা ঠিক নাও হতে পারে। আরো পাঁচ মিনিট হাঁটার পরও যখন জঙ্গল আরো গভীর হতে লাগল, তখন আমরা ফিরে যাওয়াই উচিত বলে মনে করলাম।
গাড়ীর কাছে গিয়ে আমাদের ড্রাইভারকে জিজ্ঞেস করলাম, “ভিউ পয়েন্ট কাঁহা হ্যাঁয়?”
তাতে সে খুব অবাক হয়ে রাস্তার উল্টোদিকে একটা ফাঁকা জায়গা দেখিয়ে বলল, “ইঁহা!”

ভগবান জানতে পারে কিন্তু আমি আজও জানি না ও আগেরবার ঠিক কী বুঝেছিল!
এবারের দেখানো জায়গাটায় গিয়ে দেখতে পেলাম উজ্জ্বল নীল আকাশের বুকে ঝলমল করছে কাঞ্চনজঙ্ঘা। এটা ভিউ পয়েন্টই বটে, কোন ভুল নেই। সেখানে বেশ কিছুক্ষণ সময়ে কাটিয়ে এবং নানাবিধ চিত্রকর্মের পর আমরা লোলেগাঁও ফেরার পথ ধরলাম। অনেক বুঝিয়েও আমাদের ড্রাইভারকে রাজী করানো গেলনা রিষপ পর্যন্ত যাওয়ার জন্য। যতই বলি চলো, সে মাথা নেড়ে বলে, “ও ছোটা বস্তি হ্যাঁয়, দেখনে লায়েক কুছ নেহি হ্যাঁয়!”
আমাদের লাভা-লোলেগাঁওয়ের গল্প মোটামুটি এখানেই শেষ। সত্যি বলতে কী বোরই হয়েছিলাম ঐ কদিন। হয়তো এই লেখাতেও সেটা বেরিয়ে এসেছে। পড়তে গিয়ে আপনিও বোর হয়েছেন হয়তো।

পরের পর্বে আসছে গরুমারা-জলদাপাড়ার গপ্প। আর সেটাই এই লেখার শেষ পর্ব। দয়া করে আর কদিন ধৈর্য ধরুন।
(চলবে)

2 comments:

  1. Na bore holam na karon etao akta experience.lolegaon jaoar ichhe thaklo.

    ReplyDelete
  2. Hna gele Lolegaon te thakai better... Lava te thakar moto kichhui nei!

    ReplyDelete

"It’s always very easy to give up. All you have to say is ‘I quit’ and that’s all there is to it. The hard part is to carry on”